জ্বলদর্চি

বৌদ্ধ দর্শন:এক /বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বৌদ্ধ দর্শন:এক

বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

নমো তস্ স ভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্ স (পালি)

ভগবান বুদ্ধের নির্দেশিত আর্য-অষ্টাঙ্গ-মার্গ নির্ব্বাণ লাভের
একমাত্র উপায় । জন্ম,জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু প্রভৃতি জগতের 
যাবতীয় দুঃখ নিরোধ করার এটিই একমাত্র প্রকৃষ্ট পন্থা।
কে এই বুদ্ধ ? কি তাঁর পরিচয় ? শুনুন তাঁর নিজেরই মুখে ।

।।বুদ্ধের আত্ম-পরিচয় দান।।

ত্রিতাপ ভুলে, বসে তরু-মূলে ভগবান তথাগত,
এক ব্রাহ্মণ,পেয়ে দর্শন হলেন সমীপাগত ।
ব্রাহ্মণ কন,"ও গো গুণীজন কি তোমার পরিচয়?
জন গণ নেতা,তুমি কি দেবতা?বলো প্রভু দয়াময়।"

তথাগত কন,"শোনো ব্রাহ্মণ,আমি তো দেবতা নই,
জীব কল্যানে বিশ্ব ভূবনে সদা তৎপর রই ।"
ব্রাহ্মন ফের প্রশ্ন করেন,"গন্ধর্ব কি তুমি?"
"না না আমি নই স্বর্গ -গায়ক বিশ্ব আমার ভূমি।"

"তবে কেগো তুমি,বলো দেখি শুনি অবশ্য তুমি যক্ষ।"
"না না ব্রাহ্মণ, শোনো দিয়ে মন আমি আর্তের পক্ষ।"
"তবে দয়াময়,তুমি নিশ্চয় মানব অতি সাধারণ?"
"শোনো ওগো দ্বিজ,আমি না মনুজ জানে তা সর্বজন।

বলি ব্রাহ্মণ, আমার এখন সব পরিচয়ই লুপ্ত,
এই পৃথিবীর ,সব মায়াবীর পাশ হতে আমি মুক্ত,
আমি তো এখন অবয়ব হীন নিত্য এবং শুদ্ধ,
সকলে আমাকে এ কারণে ডাকে মোক্ষ-প্রাপ্ত বুদ্ধ।"

রাজকুমার সিদ্ধার্থ লোকেদের জন্ম, জরা, ব্যাধি ও
মৃত্যু  কষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে সকল সম্পদ তৃণবৎ
পরিত্যাগ করে মহাভিননিষ্ক্রমনের পথে বেরিয়ে পড়েন।
অদম্য অধ্যবসায় সহকারে  সুকঠোর তপস্যা করে
তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন । কিন্তু শুধু মাত্র আত্মোন্নতিই
তাঁর লক্ষ্য ছিলো না । তিনি চেয়ে ছিলেন তাঁর মার্গ-ধর্ম
প্রচার করতে যাতে পৃথিবীর সকল আপামর জনসাধারণ 
শান্তিপূর্ণ এই অভিনব পথে নির্ব্বাণ লাভ করতে পারে ।
তাঁর প্রদর্শিত পথে একদিন ভারতের বহু দিকে বহুবিধ
উন্নতি হয়ে ছিলো । সমগ্র ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিলো এক
মহা পুণ্য ভূমি । তাঁর এই ধর্ম-মত আজ পৃথিবীর একতৃতীয়াংশ লোক অনুসরণ করেন । তাঁরা বিপুল পুণ্য সঞ্চয় করেন । এই ধর্ম সম্পর্কে জানতে হলে নব অষ্টাঙ্গিক 
মার্গ কে জানতে হবে । এই সব তথ্য এবং তত্ব লিপি বদ্ধ
আছে ( ১) বিনয় (২) সূত্র এবং (৩) অভিধর্ম এই ত্রিপিটক
নামক গ্রন্থে । এই গ্রন্থটি মাগধি ভাষায় লিখিত ।
'পিটক' শব্দের অর্থ হলো মাগধি ভাষায় লিখিত বুদ্ধবচন।
'বিনয় পিটক' হলো 'আণাদেসনা' বা আজ্ঞাদেশনা :সূত্র পিটক'
হলো 'বোহার দেসনা' বা ব্যবহার দেশনা এবং 'অভিধর্মপিটক' হলো 'পরমত্থদেসনা' বা পরমার্থ দেশনা ।
ভগবান বুদ্ধ(১) বিনয় পিটকে বহুবিধ আজ্ঞা বা উপদেশ দিয়েছেন । (২)সূত্র পিটকে ব্যবহার-সত্য বিষয়ে নানান
উপদেশ দিয়েছেন এবং (৩) অভিধর্ম পিটকে পরমার্থ
সত্যের উপদেশ দিয়েছেন । বিনয় পিটক হলো আদি কল্যাণ
সূত্র পিটক হলো মধ্য কল্যাণ এবং অভিধর্ম পিটক হলো 
অন্ত কল্যাণ । ভগবান বুদ্ধ সকলকে বলছেন," প্রাণী হত্যা, চুরি ইত্যাদি দুশচারিত কাজ কখনও করো না" । বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে সমগ্র বিশ্বে যে সব প্রাণী বাস করে পর্যায় ভুক্ত করলে তাদের নিম্নরূপে ভাগ করা যায় : 
১) ব্রহ্মা অর্থাৎ উচ্চতর আধ্যাত্মিক জীব
২) দেব অর্থাৎ নিম্নতর আধ্যাত্মিক।জীব
৩) মানব অর্থাৎ ইহ লোকের মরণশীল প্রাণী
৪) জীব জন্তু অর্থাৎ পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ সরীসৃপ ইত্যদি
৫) প্রেত অর্থাৎ অশরীরী আত্মা
৬) অসুরক অর্থাৎ পতিত দুঃখময় আধ্যাত্মিক জীব
৭) নৈরয়িক অর্থাৎ অস্তিত্বের নিম্নতম স্তরের অধিবাসী
     নারকীয় জীব ।
এই সমস্ত জীবই জন্মগ্রহণ করে এবং নির্দিষ্ট সময় অবসানে
মৃত্যুমুখে  পতিত হয় । কিন্তু মৃত্যু তাদের জীবনের চরম
অবসান ঘটাতে পারে না । ব্রহ্মা বা উচ্চতর আধ্যাত্মিক জীব গণ দেব (অর্থাৎ নিম্ন তর আধ্যাত্মিক প্রাণী) কিংবা মানব রূপেও পুনর্জন্ম নিতে পারে । আবার দেব বা মানব গণ 
পশু ,প্রেত ,অসুরক বা নারকীয় ইত্যাদি নিম্ন স্তরেও জন্ম নিতে পারে । মৃত্যুতেই সব শেষ হয় না জীব মাত্রকেই পুনর্জন্ম 
নিতে হয় । ব্রহ্মা হতে আরম্ভ করে নৈরয়িক পর্যন্ত সকল
জীবকেই বার বার জন্ম গ্রহণ করে বার্ধক্য, রোগ এবং মৃত্যুর অধীন হতে হয় এটাই মহা দুঃখের কারণ । যদি কদাচিৎ 
কোনও বুদ্ধের জ্ঞানের আলো প্রবেশ করে শুধু তখনই সে
'ধম্ম' শ্রবণের সুযোগ পায় । এই 'ধম্ম'ই সব দুঃখের অবসান
ঘটাতে পারে । কেবল তখনই জীব ধর্মানুসারে জীবন
চর্চা করে বার্ধক্য রোগ ও মৃত্যুর দুঃখ হতে মুক্তি পেতে
পারে । যাঁদের হৃদয়ে অপরিমিত করুণা তাঁরাই প্রাণী জগৎকে
মুক্তির সন্ধান দিতে পারেন । কিন্তু শুধু সংকল্প গ্রহণ করলেই
বুদ্ধত্ব অর্জন করা যায় না । দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি যদি কেউ ভাবেন 
মানুষকে ব্যাধির কষ্ট হতে মুক্তি দেবেন এবং ডাক্তার হয়ে
তিনি মানুষের সেবা করবেন তবেই কি তিনি তা পারবেন?
তাঁকে তো প্রথমে ডাক্তার হতে হবে । আর ডাক্তার হওয়ার জন্য তাঁকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে । শিক্ষাব্রতী হয়ে
প্রচুর পাঠাভ্যাস করতে হবে ।
যাঁরা বুদ্ধত্ব অর্জন করতে চান তাঁদেরকে দশটি প্রধান দায়িত্ব 
পালন করতে হবে । পালি ভাষায় এই দশটি কর্তব্যকে বলা
হয় 'দস পারমী' ।
১) সর্বস্ব সমর্পণ    এর নাম 'দান পারমী'
২) অসৎ বর্জন।     এর নাম 'সীল পারমী' (শীল)
৩) জাগতিক জীবন পরিহার  এর নাম 'নেক্ খম পারমী' 
৪) লোক হিত কর জ্ঞানার্জন 'পঞঞা পারমী' (প্রজ্ঞা)
৫) শক্তি নিয়োগ ' বীরিয় পারমী' (বীর্য)
৬) ধৈর্য ধারণ ও ক্ষমাশীল হওয়া 'খন্তী পারমী'  (ক্ষান্তি)
৭) সত্য ভাষণ  'সচ্চ পারমী' (সত্য)
৮) সংকল্প পালন   'অধিট্ ঠান পারমী' (অধিষ্ঠান)
৯) সর্ব জীবে দয়া  'মেত্তা পারমী'  (মৈত্রী)
১০) তিতিক্ষা অবলম্বন - 'উপেক্ খা পারমী' (উপেক্ষা)

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments