জ্বলদর্চি

কলাবউ স্নান /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪০

কলাবউ স্নান

ভাস্করব্রত পতি

অতি প্রাচীনকাল থেকে যে বৃক্ষপূজার প্রচলন শুরু হয়েছে তারই অন্যতম রূপ দুর্গাপূজায় 'নবপত্রিকার পূজা'। ষষ্ঠীতে শুরু হয় দেবীর বোধন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে রাবণকে হত্যা করার জন্য রামচন্দ্র দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সেসময় ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ণ। ফলে দেবতারা তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। ব্রহ্মা সেসময় রামচন্দ্রকে সহায়তা দানের জন্য দেবী দুর্গাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসেন মর্ত্যে। দেবী তখন একটি পাতার ফাঁকে ছোট্ট কন্যা রূপে ঘুমিয়ে ছিলেন। ব্রহ্মা দেবীকে স্তব স্তুতি করে জাগরিত করেন। সেই দিনটি ছিল ষষ্ঠী। আর সেদিনই তাই দেবীর বোধন হয়। বিল্ববৃক্ষ তলে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় হয় বোধন ক্রিয়া। বোধনের পর হয় অধিবাস। আর অধিবাসের প্রাথমিক পূজা হয় এই বিল্ববৃক্ষতলে। শরৎকালে এই দুর্গাপূজাকে বলা হয় তাই 'অকালবোধন'। দেবীকে জাগ্রত করে রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণবধের যজ্ঞ করেছিলেন।

প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বৃক্ষ পূজার অনুসারী দ্যোতক হিসেবেই দেবীর বোধন বিল্বতলে হয়। হিন্দু সংস্কৃতিতে বৃক্ষ পূজার রীতি বহুলভাবেই প্রচলিত। দক্ষিণবঙ্গের গ্রামগুলিতে তুলসীমন্দিরে তুলসি গাছে জলদান করা হয় নিয়মিত। অশ্বত্থ, বট, পাকুড় গাছে জল ঢালা হয়। নতুন পুকুর কাটানো হলে পুকুরের মধ্যভাগে বেল গাছ পুঁতে পুকুর প্রতিষ্ঠা করার রীতি রয়েছে। পৌষ সংক্রান্তির দিন ‘খেত বাড়ানো' উপচারে এক গুচ্ছ শিষযুক্ত ধান গাছের পূজার্চনা করা হয়। নলসংক্রান্তিতে ব্যবহৃত হয় নলগাছ সহ আরও বহু প্রকার গাছ। তেমনি দুর্গাপূজায় বিল্বতলে দেবীর বোধন সহ পূজা করা হয় ‘নবপত্রিকা'-র। এই নবপত্রিকা আসলে নয়টি গাছের মিশ্রিত রূপ।
রঘুনন্দন তাঁর 'দুর্গোৎসব তত্ত্ব'তে এই 'নবপত্রিকা' সম্পর্কে লিখেছেন— “কদলী দাড়িমী ধান্যঃ হরিদ্রা, মানকংকচুঃ / বিল্বাশোকৌ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকাঃ।” অর্থাৎ, এই নবপত্রিকাতে রয়েছে কদলী (কলা), হরিদ্রা (হলুদ), মান, দাড়িম্ব (ডালিম), কচু, অশোক, বিল্ব (বেল), ধান্য (ধান) এবং জয়ন্তী গাছের পাতা, কাণ্ড, ফল ইত্যাদি। সাথে থাকে শ্বেত অপরাজিতা লতার বন্ধন। এই নয়টি বৃক্ষের সম্মিলিত অবস্থানই আমাদের আলোচিত 'নবপত্রিকা'। কৃত্তিবাসী রামায়নে পাই – “বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।”

এই নবপত্রিকার আরাধনা আসলে শস্যদেবীর আরাধনা। পণ্ডিতদের মতে শষ্যদেবী দুর্গার অন্য নামই তো 'শাকম্ভরী'। এই নয়টি গাছের সমষ্টি 'নবপত্রিকা' আসলে মা দুর্গারই প্রতিনিধি বা অন্য রূপ। এই নয়টি চারার (বৃক্ষ) প্রত্যেকটির অধিষ্ঠাত্রী এক একজন দেবী। তাঁরা হলেন ~ কদলী—ব্রহ্মাণী, হরিদ্রা — দুর্গা, কচু -- কালিকা, দাড়িম্ব— রক্তদন্তিকা, বিল্ব – শিবা, ধান — লক্ষ্মী, জয়ন্তী — কাৰ্ত্তিকী, মান —চামুণ্ডা এবং অশোক — শোকরহিতা।

অনেকের মতে 'নবপত্রিকা' আসলে ‘কুলবৃক্ষ'। দেবীর নানা শক্তির প্রতীক। যোগিনীরা সবসময় নাকি কুলবৃক্ষতে বসবাস করেন। তাই দেবী এখানে নবপত্রিকাবাসিনী। পৃথিবীর সকল ওষধি জাতীয় উদ্ভিদের মাধ্যমে জগৎ সংসারের জীবকূলকে উদ্ধার করেন তিনি। পণ্ডিত রামপ্রসাদ চন্দ বলেছেন— "An important aspect of Durga Worship called navapatrika of the worship of the nine plants (lit-leaves) also clearly shows that the gooddess was conceived as the personification of the vegetation spirit."

দেবী দুর্গা হলেন ত্রিভূবনেশ্বরী। এই ত্রিভূবনের সর্বত্র তাঁর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। প্রাণীজগৎ এবং উদ্ভিদজগৎও বাদ যায়নি। দেবীর পূজায় আনয়ন করা হয় 'নবপত্রিকা' বা 'কলাবউ'। এই 'নবপত্রিকা' বা 'কলাবউ' হ'ল সমগ্র উদ্ভিদ জগৎ এবং বসুন্ধরার মূর্ত প্রতীক। স্বয়ং দেবী দুর্গার প্রতিনিধি হিসেবে পূজা পায়। ওষধি, শাক, কন্দ, বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ সহযোগে তৈরি হয় 'নবপত্রিকা'। কেটে নেওয়া বেল গাছের ডাল এবং নবপত্রিকা সহ পূজাস্থানে প্রবেশ করতে হয়। তখন শ্বেত অপরাজিতা লতিকা এবং হলুদ রঙের বন্ধনী দিয়ে বেঁধে পীঠাসনে স্থাপন করতে হয়। 

এই যে 'নবপত্রিকা'— যাঁকে আমরা বলে থাকি 'কলাবউ' তা আসলে সমৃদ্ধির প্রতীক। একটি ছোট কলাচারাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা পরা বউয়ের মত করা হয়। দাঁড় করিয়ে রাখা হয় গণেশের পাশে। দেবীমূর্তির সাথেই পূজিতা হন কলাবউ। আমরা এঁকে 'গণেশের বউ' বলে ভুল করি। লোকছড়ায় পাই ---
"গনেশ দাদা পেটটি নাদা
গায়ে মেখেছো সিঁদুর।
কলাগাছকে বিয়ে করেছ
বাহন তোমার ইঁদুর!!"

তন্ত্রমতে 'লক্ষ্মী' ও 'সরস্বতী' গনেশের বউ। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ গনেশের দুই স্ত্রীর নাম 'তুষ্টি' ও 'পুষ্টি' বলে জানিয়েছেন। আবার 'শিবপুরাণ' অনুসারে ব্রম্ভার দুই কন্যা 'সিদ্ধি' ও 'বুদ্ধি' নাকি গনেশের স্ত্রী। সিদ্ধির গর্ভে 'ক্ষেম' এবং বুদ্ধির গর্ভে 'লাভ' এর জন্ম হয়। এছাড়াও 'সন্তোষী' হলেন গনেশের কন্যা। তবে 'মৎস্যপুরাণ' অনুসারে পাই গনেশের স্ত্রীরা হলেন 'ঋদ্ধি' এবং 'বুদ্ধি'। তবে স্বামী নির্ম্মলানন্দ "গনেশের চরিত্রবৈভব" সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, "প্রথম জীবনে গণেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—তিনি দার পরিগ্রহ করবেন না, চিরকুমার থেকে সমগ্র জীবন যাপন করবেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যাতেই নিরত হন। কিন্তু তাঁর এ তপস্যায় বাধ সাধেন ধর্ম্মধ্বজের কন্যা তুলসী। সুন্দরী রাজবালা গণেশকেই ভালোবেসে ফেলেন একান্তভাবে। তাঁকে চান বিবাহ করতে। কিন্তু ধৈর্য্যশীল ও আত্মসংযমনিষ্ঠ গণেশ যুবা হলেও যুবতীর প্রণয়গুঞ্জনে তথা তাঁর আত্মদানের প্রতিজ্ঞায় বিচলিত নহেন বিন্দুমাত্রও। তিনি দৃঢ়তা সহকারে ভুলসীকে প্রত্যাখ্যান করেন। গোপন প্রণয়ের সমাজনিন্দিত দুর্ব্বলতা তাঁকে আদৌ স্পর্শ করতে পারে না। প্রণয়ের আবেদন ব্যর্থ হলে একটা না একটা অঘটন ঘটেই থাকে। কাম প্রতিহত হলেই আসে ক্রোধ। ক্রোধের পরিণাম বিপর্য্যয় অথবা বিনাশ। তুলসী যখন দেখেন নিজের যৌবন ও রূপের মদিরায় তপোনিষ্ঠ গণেশকে আকৃষ্ট করা গেল না, তখনই তাঁর নৈরাশ্যময় জীবনে উপচিত হয় দারুণ ক্ষোভ ও ক্রোধ। প্রগলভযৌবনা প্রতিহিংসার বশে বাঞ্ছিত প্রণয়ীকে অভিশাপ দিয়েই বসেন। গণেশের প্রতিজ্ঞা ছিল, তিনি বিবাহ করবেন না, কিন্তু তুলসীর অভিসম্পাৎ–“তুমি বিবাহ করতে বাধ্য হবে”। গণেশও ক্ষমা করতে পারেন না এ অন্যায় ব্যবহার। তিনি তুলসীকে প্রত্যভিসম্পাৎ করেন - 'তুমি যেরূপ কামাতুরা, তাতে তুমি দেবভোগ্যা না হয়ে অসুরভোগ্যা হবে'। উভয়ের অভিশাপই সত্য হয়েছিল। পরবর্তী কালে গণেশ পুষ্টি নাম্নী এক দেববালার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে এ পুষ্টিরই অপর নাম মহাষষ্ঠী। আর তুলসীর বিবাহ হয়েছিল শঙ্খচূড় নামক এক অসুরের সঙ্গে। এ বিবাদের পর থেকে গণেশের পূজায় তুলসী পত্র আর লাগে না"। অতয়েব কলাবউ কখনোই গনেশের স্ত্রী নয়। বরং গনেশের মা বলেই চিহ্নিত।

এই 'কলাবউ' বা 'নবপত্রিকা' হল দেবী দুর্গার অন্য একটি রূপ। আসলে বাঙালির নিজস্ব কল্পনায় 'কলাবউ' গনেশের বউ হলেও এটি আসলে সমগ্র উদ্ভিদ জগৎ এবং পৃথিবীর বিমূর্ত প্রতীক। উদ্ভিদজগতের সঙ্গে প্রাণীকুল যে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে -- তা প্রতিভাত এখানে। প্রকৃত অর্থে দেবী দুর্গার পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত ৩৩ কোটি দেবতা, গাছপালা, পশুপাখি, সরিসৃপ, অসুর সহ সকল জীবকূল। নবপত্রিকার স্নানের পর জলসহ ঘট পূজামণ্ডপে এনে নানা আচারাদি পালনের মাধ্যমে দেবীকে আহ্বান করে ঘটগুলি স্থাপন করা হয় দেবীর সামনে। আর নবপত্রিকাকে স্থাপন করা হয় গণেশের পাশে। কলাবউ বা নবপত্রিকার স্নান করানো হয় নদীতে, বড় পুষ্করিণীতে বা দিঘীতে। শোভাযাত্রা সহকারে সপ্তমীর সকালে 'কলাবউ স্নান' বা 'নবপত্রিকার স্নান' বাঙালির চিরাচরিত লৌকিক উৎসব।
এই 'নবপত্রিকা স্নান' নিয়ে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "উষ্ণ জলে কদলিতরু চণ্ডনায়িকে। শিশিরের জলে হরিদ্রেহররূপাসি শঙ্করস্য সদাপ্রিয়া। তরাগের জলে ওঁ কচ্চি (কচু) সদা সিদ্ধিপ্রদায়িনী। পুষ্পোদকে ওঁ জয়ন্তী। সর্বেষৈধিজলে ওঁ শ্রীফল (বেল)। সমুদ্রজলে ওঁ দাড়িম্ব। সুগন্ধি জলে ওঁ অশোকে শোকহারিনি। রত্নোদকে ওঁ মান মান্যেষু। তিল তৈলযুক্তজলে ওঁ লক্ষ্মীস্বত্বং। সবশেষে মহাস্নান। মা এইবার স্নান করবেন। চন্দন, পিটুলি, পঞ্চ শস্য চূর্ণ তৈল হরিদ্রা। ওঁ নানারূপধরে দেবি দিব্যবস্ত্রাবগুণ্ঠিতে। সমস্ত নদীর জলে স্নান। পঞ্চামৃত, পঞ্চকষায়, পঞ্চ শস্যোদক, রজতজল, স্বর্ণজল, মধু, ঘৃত, দুগ্ধ, নারিকেল উদক, ইক্ষুরস, দধি, তিলোদক, বিষ্ণুতৈল, অগুরু, চন্দন, শিশির, বৃষ্টির জল। আটটি কলসে আলাদা আলাদা করে রাখা গঙ্গার জল, বৃষ্টির জল, সরস্বতী নদীর জল, সমুদ্র জল, পদ্মরেণযুক্ত জল, নির্ঝরের জল, সর্বতীর্থ বারি, চন্দনবাসিত জল। ও মা! তোমার ভক্ত আমি, বুঝি পাগল হয়ে গেছি পৃথিবীর মাকে আমি পৃথিবী মাখাই নদী, সমুদ্র, মনি, রত্ন, খনিজ, সম্পদ যা কিছু আছে সব দিয়ে লেপন করেও মনে হচ্ছে কিছুই বুঝি হলনা। ওঁ বসবশ্চাভিষিঞ্চস্তু কলসেনাষ্টমেন তু। অষ্টমঙ্গল সংযুক্তে দুর্গে দেবি নমোহস্তুতে। আটটি জলে আটটি স্নান মন্ত্রের আটটি সুর মালবী, ললিত, বিভাস ভৈরবী, আভোগ, বসন্ত। অসুরের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছ এবার শান্তি, ওঁ শান্তি!"

তবে মোট ৩৩ রকম জলে মায়ের স্নানের বিধি রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নারকেল জল, মুক্তাজল, তিলযুক্ত জল, ঈষদুষ্ণজল, রজতজল, স্বর্ণজল, শীতল জল, মহাঔষধী জল, চন্দনজল, মিস্টিজল, সহস্রধারার জল, পুষ্করিণীর জল, শিশিরের জল, সর্বৌষধীজল, কুশযুক্তজল, শুদ্ধজল, গঙ্গাজল, পুষ্পজল, অগরুজল ইত্যাদি। তারপরে অষ্টকলসির জলে মাকে স্নান করানো হয়। সেকথা উল্লেখ করেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আর কাঁসর ঘন্টা, উলুধ্বনি, ঢাকের বাদ্য এবং বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবী মায়ের স্নানপর্বের সমাপনী ঘটে। আর নবপত্রিকার প্রবেশের আগে দেবী চামুণ্ডার পূজা করা হয়। তারপর শুরু হয়ে যায় দেবী আরাধনার নানা উপচার।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments