জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—চেকোশ্লোভাকিয়া/যেমন কর্ম তেমন ফল /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোক গল্প—চেকোশ্লোভাকিয়া

যেমন কর্ম তেমন ফল

চিন্ময় দাশ
 
নদীর গা থেকে শুরু হয়েছে বনটা। সেই বনের একটেরে থাকে একটা বনমোরগ, আর একটা মুরগি। ভারি বন্ধুত্ব দুজনের। একেবারে ভাই-বোনের মত মিল তাদের। যখনই যেদিকে যায়, একসাথেই যায় তারা।
মোরগটার যেমন মাথা গরম, তেমনি বোকার বেহদ্দ সেটা। আগু-পিছু না ভেবেই, এটা-ওটা করে বসা তার চিরদিনের অভ্যাস। প্রায়শই কিছু না কিছু ভুল করে বসে সে। এদিকে, মুরগিটা বেশ বিবেচক। হুটহাট কিছু করে বসে না কখনো। আর, তার সাধ্যে যতটা কুলোয়, মোরগকে লক্ষ্য-নজর করে বেচারি।
ভুল-ভাল কিছু করতে গেলেই, সাবধান করে মুরগি—ওহো, এটা তোমার একেবারেই করা উচিত নয়।
কিন্তু কে শোনে, কার কথা। ছোট্ট মুরগিটার কথা শুনতে তার বয়েই গেছে। শুনলে তো ভালোই হোত। বেঁচে যেতো অনেক হয়রানির হাত থেকে। আর কিছু না হোক, বেঁচে তো থাকতো আজ! 
কিন্তু ঐ যে বললাম, চিরকাল মাথা গরম, আর বোকার বেহদ্দ। পুঁচকে একটা মুরগির কথা শুনতে বয়েই গেছে মোরগের। কোনদিন কানেই তোলে না সে তার পরামর্শ।
একবার কী হয়েছে, বলি। তখন বসন্তকাল। গুজবেরি ফলে আছে চার দিকে। তবে পাক ধরেনি তখনও ফলে। সবই কাঁচা, ঘন সবুজ রঙ তখনও ফলগুলোর। মোরগটা একদিন ঝটপট করে বাগানে ঢুকে পড়ল। টপাটপ একটার পর একটা বেরি খেয়ে যেতে লাগল। মুরগির চোখে পড়তেই, হইহই করে উঠল—আরে, আরে! করছোটা কী তুমি? জানো না, কাঁচা বেরি খেতে নাই। পেটে ব্যথা উঠবে এক্ষুনি। 
কিন্তু কে শোনে কার কথা? খেয়েই যেতে লাগল, নিষেধ কানে না তুলে। থামল কখন? না, যখন সত্যি সত্যি পেটে ব্যথা শুরু হোল। 
আর ব্যথা বলে ব্যথা। মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে পেটের ভিতর। যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগল মোরগ। আর চেঁচাতে লাগল—বাঁচাও গো। পেটের ব্যথায় মরে গেলাম একেবারে।
এমন চিৎকার আর উথাল-পাথাল ছটফটানি দেখে, কি আর রাগ করে বা চুপ করে থাকা যায়? মুরগি ছুটল খরগোশের বাড়ি। খরগোশ হোল বনের বদ্যি। খবর শুনেই, কোবরেজ মশাই এলেন হন্তদন্ত হয়ে। কী সব পাতা বেটে খাওয়ানো হোল। আর শেকড় বেটে মাখিয়ে দেওয়া হোল মোরগের পেটে। তখন রেহাই হোল যন্ত্রনার হাত থেকে।
তোমরা কি ভেবেছ, এতে শিক্ষা হয়েছে হতভাগার? একেবারেই না। সে রয়ে গেছে যেমনটিকে ঠিক তেমনটিই। যেমন অবাধ্য, তেমনই গোঁয়ার গোবিন্দ!
আবার একদিন। মাথায় হঠাতই কী ভূত চাপল, মাঠের মধ্যে দৌড়তে শুরু করে দিল। একবার এমাথা তো একবার ওমাথা। এদিকে ভরা দূপুর সেসময়। সূয্যিঠাকুর একেবারে মাথার ঠিক ওপরটাতে। কড়া রোদে মাথার চাঁদি ফেটে যাবার জোগাড়। কিন্তু মোরগের সেদিকে ভ্রূক্ষেপই নাই। পাগলের মতো দৌড়ে চলেছে তো চলেছে। 
থামল কখন, না যখন একেবারে দম আটকে আসার জোগাড় হোল। দৌড় থামিয়েই, এক ছুটে নেমে গেল নদীতে। চোঁ-চোঁ করে জল খেতে লেগে গেল।
মুরগি দেখতে পেয়ে, চিৎকার করে উঠল—আরে, করছোটা কী তুমি? এই ঘাম শরীরে জল খায় না কি কেউ? মারা পড়বে যে।
কিন্তু সাবধান করলে, কী হবে? কারও কথা শুনবার পাত্রই নয় মোরগ। খেয়েই যেতে লাগল, যতক্ষণ পেটে ধরে। 
ফল যা হবার, তাই হোল। বেদম ঠাণ্ডা লেগে গেল মোরগটাকে। বুকে কফ। দম নিতেও পারছে না যেন। ভারি কাহিল অবস্থা। আবার কোবরেজ মশাই এসে নানা রকম দাওয়াই দিলেন। বিছানায় পড়ে থাকতে হোল মোরগকে। 
পড়ে থাকা মানে, পড়ে থাকা! সেই গরমকাল থেকে বিছানায় পড়ে আছে। উঠতে পারল একেবারে শীতকাল শুরু হবার পর। আর তাতেই হোল বিপদ।
ক’মাস ধরে ঘর বন্দী হয়ে আছে মোরগ। মন উচাটন বাইরে বেরুবার জন্য। যেই না শরীর একটু সেরেছে, দিক-বেদিক ভাবনা নাই, বেরিয়ে পড়ল। 
তখন শীত পড়তে শুরু করেছে। বাড়ির বাইরেই নদী। বরফ জমতে শুরু করেছে নদীর জলে। দুধের মত ধবধবে সাদা রঙ বরফের। ঘন সবুজ বন নদীর দু’পাড় জুড়ে। সেই সবুজের ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়েছে টলটলে নীল জলের নদী। বরফ তো নয়, সেই জলের ওপর যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কেউ।
অপূর্ব দৃশ্য। চোখ পড়লেই মন ভরে যায়। মোরগকে তখন কে আটকায়? মুরগিকে বলল—আমি নদীতে যাচ্ছি। একটু স্লাইডিং করে আসি। 
শুনে তো বেদম ঘাবড়ে গেল মুরগিটা। আঁতকে উঠে, বলল— আরে, বলছোটা কী তুমি। বরফ জমেনি এখনও ভালো করে। বরফ একটু শক্ত হতে দাও। তারপর না হয় যেও।
মোরগ তো চিরকালের অবাধ্য। এতবার ভুগেও শিক্ষা হয়নি তার। তাছাড়া, পুঁচকে একটা মুরগির বাধা সে কেন শুনতে যাবে? মোরগ বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। নদীতে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বলল—মিছামিছি ভয় পাচ্ছো। কিচ্ছু হবে না আমার। 
মুরগির চোখ দুটো গোল গোল। আজ আবার না কিছু একটা বিপদ ঘটিয়ে বসে। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল তার। 
মোরগ ততক্ষণে নদীতে নেমে পড়েছে। বরফের ওপর এক পায়ের ঠেলা দিয়ে দিয়ে, হড়কে হড়কে অনেক দূর চলে যাওয়া যায়। ভারি মজা হয় তাতে। সেই মজার টানেই নেমে এসেছে মোরগ।
ওপর থেকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মুরগিটা। ভয় পাওয়া ছাড়া, করারই বা কী আছে তার? বেশ ফুর্তিতে তিন-চার বার এইভাবে যাওয়া আসা করল মোরগ। তার পরেই ঘটে গেল বিপত্তিটা। 
এক জায়গায় বরফ নরম ছিল। মোরগ চলেছে হড়কাতে হড়কাতে। বরফ গেল মুড়মুড় করে ভেঙে। টুক করে জলে পড়ে গেল বেচারা। শীতের কনকনে ঠাণ্ডা জল। বরফও সেখানে নরম। উঠে আসবে, সে সুযোগও পেল না বেচারা মোরগটা। জীবন্ত অবস্থাতেই সলিল সমাধি হয়ে গেল তার। 
মুরগির চোখের সামনেই ঘটে গেল ঘটনাটা। সে কেবল একবারই চিৎকার করে উঠতে পেরেছিল—হায়, হায়, এ তুমি কী করলে? 
বলা হয়, সেদিন থেকেই মুরগিরা আর গলা ছেড়ে ডাকতে পারে না। আসলে না কি, অনেক দুঃখ পেয়ে, গলা ছেড়ে ডাকতে ভুলে গিয়েছিল সেই মুরগিটা। তার পর থেকে কোন মুরগিই আর জোর গলায় ডাকেনি কোনদিন।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments