জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—কানাডা (উত্তর আমেরিকা)/উনুন সমস্যার উনিশ পরামর্শ /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস


দূর দেশের লোকগল্প—কানাডা (উত্তর আমেরিকা)
উনুন সমস্যার উনিশ পরামর্শ

চিন্ময় দাশ
 
গোণা-গুণতি কুড়িটা বাড়ি নিয়ে একটা গ্রাম। সকলেরই ছেলে-পুলে, বাবা-মা নিয়ে সংসার। কেবল একটা বাড়িই একটু আলাদা। একলা এক বুড়ি থাকে সে বাড়িতে।
তিন কুলে কেউ নাই বুড়ির। তবে, ছাই রঙের একটা মুশকো বেড়াল থাকে বুড়ির ঘরে। আর গোয়ালে গোটাকয় গরু। এই যা! এই নিয়েই সংসার বুড়ির।
সেদিন শনিবার। সবাই জানে, শনিবার মানেই ‘বেকিং ডে’। কাজের দিন। পরদিন, রবিবার গীর্জায় যেতে হয়। তার আগের দিনে কাজের যেন শেষ নাই। সবচেয়ে বড় কাজ হোল, কেক আর পাঁউরুটি বানাবার দিন। ময়দারে, চিনিরে, মাখনরে—কত কিছুই না জোগাড় করতে হয়। একা মানুষ, সব কাজ করে উঠতে সময় লেগে যায় অনেক। 
সেজন্য ভোর ভোর উঠে পড়েছে বুড়ি। এক বোঝা কাঠ এনে, রাখল উনুনের কাছে। তখনই একটু খটকা লাগল  বুড়ির। উনুনের পাল্লাটা এমন হাট করে খোলা কেন? কী করে খুললো?  
সরু একটা ডাল ঢুকিয়ে দেখতে গেল, ভেতরে পাতাপুতি বা ডালপালা কিছু রয়ে গেছে কি না। কিন্তু ডালটা তেমন ভেতরে যাচ্ছে না। আটকে যাচ্ছে কোন কিছুতে। নিশ্চয় কিছু একটা রয়ে গেছে ভেতরে।
বুড়ি উনুনের উপর ঝুঁকে দেখতে গেল, ভেতরে কী রয়ে গেছে। তাতে ভেতরে যা দেখল, বুড়ির তো চক্ষু চড়কগাছ! তাড়াহুড়ো করে বন্ধই করে দিয়েছে উনুনের পাল্লাটা।
দিয়েই, পড়মরি করে এক দৌড়। ঘর ছেড়ে উঠোনে। উঠোন ছেড়ে রাস্তায়। এবার গ্রামের দিকে দৌড়তে লেগেছে হাঁফাতে হাঁফাতে। 
প্রথম দেখা পেল প্রতিবেশি ফেলিক্সের। সব্জি বাগানে জল দেবে বলে, কূয়ো থকে বালতি ভরে জল তুলছিল সে।
--ফেলিক্স, ফেলিক্স। তাড়াতাড়ি এসো একবার। আমার উনুনে একটা ভোঁদড় ঢুকে বসে আছে। বুড়ির যেন তর সয় না। 
ফেলিক্স বলল—ঠিক বলছো তো? দ্যাখো গিয়ে, ভোঁদড় নয়, তোমার বেড়ালটাই হয়তো।    
বুড়ি বলল—নাগো। ঠিকই দেখেছি আমাই। তাছাড়া, আমার বেড়লের গায়ে কি সাদা ডোরা আছে না কি? 
--ঠিক আছে, তুমি বাড়ি যাও। ফেলিক্স বলল—আর দুটো বালতি জল তুলেই আমি যাচ্ছি। 
বুড়ি খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছে। গ্রামের দিকে আরও খানিক এগিয়ে গেল। কেননা, দুজনের চেয়ে, তিন মাথার বুদ্ধি কিছুটা হলেও বেশি ভালো হবে। এই ভেবে, এবার পৌঁছল লুইসের বাড়ির সামনে। বুড়ি চেঁচিয়ে বলল—লুইস, লুইস! তাড়াতাড়ি এসো একবার। আমার উনুনে একটা ভোঁদড় ঢুকে বসে আছে।
--ভোঁদড়? তোমার উনুনের ভেতর? লুইস হেসে বলল—দূর, তাই আবার হয় না কি? ভালো করে দ্যাখো গিয়ে। ভুল করে নিজেরই পুরাণো ফারের কোটটাই ফেলে রাখোনি তো ওখানে?
--আচ্ছা মানুষ তো তুমি! পুরাণো হয়েছে বলে, নিজের কোটটাই ফেলে দেব? তেমন লোক না কি আমি?
--তা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। ঠিক আছে, তুমি বাড়ি যাও। মুরগি বাচ্চাগুলোকে খাবারটা দিয়েই আসছি আমি।
কাউকে একটা সাথে না নিয়ে ঘরে ফিরতে বুড়ির মন চাইল না। সামুয়েলের খেতবাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হোল এবার। 
--সামুয়েল, সামুয়েল! এক্ষুণি এসো একবার আমার সাথে। একটা ভোঁদড় আমার উনুনে ঢুকে বসে আছে। 
--ঠিক দেখেছ তো? পাল্লা খুলে, হয়তো নিজের ছায়াটাকেই দেখেছ তুমি। বলা তো যায় না। বুড়ো বয়স। চোখের ভুল তো হতেই পারে। 
--কী যে বলো না, তার নাই ঠিক। ছায়ার আবার ফুলো-ফুলো লেজ থাকে না কি? না কি, ছায়া কখনো দাঁত দেখিয়ে গরগর করে ওঠে? আমার তো মনে হয় না।
--ওহ বাবা! তাই না কি? ঠিক আছে, তুমি এগোও। এক্ষুনি আসছি আমি। বাকি আগাছা কটা সাফ  করে নিয়েই যাচ্ছি।
কাউকে একজন সাথে না নিয়ে বুড়ি ফিরবে না। সে এবার এক এক করে গ্রামের অন্য বাড়িগুলোর দিকে চলতে লাগল। 
এইভাবে সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে, নিজের ঘরে ফিরে এলো এক সময়। সেখানে তখন ফেলিক্স আর লুইস এসে দাঁড়িয়ে আছে। এর পর এক এক করে স্যামুয়েল এলো। গ্রামের অন্যরাও জুটতে লাগল এসে। 
শনিবার, হাজারো ঝামেলার কাজের দিন। এদিকে বুড়ি একেবারে একলা মানুষ। আস্ত একটা ভোঁদড় তার উনুনে ঢুকে বসে আছে। কম ঝামেলার বিষয় না কি?
স্যামুয়েলের বউ মাদাম রস উনুনের পাল্লা খুলে ভেতরটা দেখল। পাল্লা লাগিয়ে দিয়ে বলল—একেবারেই ঠিক দেখেছে। একটা ভোঁদড়ই বসে আছে ভেতরে। কোন ভুল নাই এতে। 
সে কথা শুনে, খেঁকিয়ে উঠল বুড়ি—সেটা তো আমিও ভালোই জানি। আসল কথা হোল, এখন কী করা যাবে? 
--একটু সবুর করো। ফেলিক্স বলল-- বাড়ি থেকে বন্দুকটা নিয়ে আসি। ওতেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে বাছাধনের।
বুড়ি আঁতকে উঠে, চেঁচাতে লাগল—খবরদার না। অমন কাজটিও কোর না। গন্ধের ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? 
মাদাম রয় বলল—ঠিকই বলেছে। একটি মাস এই উনুনের আর ধার ঘেঁষতেও পারা যাবে না। পেটের ভাত উঠে আসবে গন্ধের চোটে। 
সকলেই মেনে নিল কথাটা। সত্যিই তো, বেদম গন্ধ ভোঁদড়ের গায়ে। 
--তাছাড়া, গুলি লাগলে চামড়াটাও নষ্ট হয়ে যাবে। সামুয়েল মন্তব্য করল। 
মা বাবার সাথে সামুয়েলের মেয়ে এলিসও এসেছে। সে বলল—আচ্ছা, একটা কুকুরকে নিয়ে এলে কেমন হয়? কুকুরের চেঁচামেচি শুনলে, নিশ্চয় ভয় পেয়ে বেরিয়ে পালাবে ওটা। 
বুড়ি বলল—ধরা যাক, কুকুরের ডাকে ভয়ই পেল। কিন্তু তখন কী করতে পারে ভোঁদড়টা, সেটা একটু আগাম ভেবে দেখা দরকার। নইলে, নতুন কোনও সমস্যায় না পড়ে যাই। 
ভীড়ের ভেতর থেকে একজন আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠল—না, না। সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেতে পারে। 
অন্য একজন বলল—আমি একটা কথা বলি। এক টুকরো মাংস আনা হোক। সেটাকে বড়শির মতো করে গেঁথে, ঝুলিয়ে দেওয়া হোক ভোঁদড়ের সামনে। মাংসের গন্ধ নাকে গেলে, নিশ্চয় সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে তখন। 
বুড়ি সাত তাড়াতাড়ি বলে উঠল—না, না। আমার ঘরে মাংস নাই। থাকলেও, ভোঁদড়ের জন্য মাংস নষ্ট করতাম না আমি।  
এ পরামর্শটাও বাতিল হয়ে গেল। মাংস অনেকের ঘরেই আছে। কিন্তু বুড়ি নিজেই মাংস খরচ করতে রাজি নয়, তাই অন্য কেউ সে রাস্তায় এগোতে চাইল না। 
--হায় আমার পোড়া কপাল। বুড়ি কপাল চাপড়াতে লাগল। 
গ্রামের প্রায় সকলেই এসে জড়ো হয়েছে। কেটেও গেছে অনেকটা সময়। এদিকে, এক্টুকরো কেক বা রুটি তো দূরের কথা। এক পেয়েলা করে চা দেওয়ার ভাবনাও নাই বুড়ির মাথায়।
হঠাৎই ফেলিক্স আর তার বউয়ের মনে পড়ে গেল—গাই দোয়া হয়নি এখনো। আগাছা সাফ করা শেষ হয়নি লুইসের। এভাবে সকলেরই কিছু না কিছু একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। বাড়ি যেতে হবে তাদের।
তখনই বুড়ির চোখে পড়ল, জুলস মার্টেল এসে ঢুকল উঠোনে। বুড়ি ভালোই জানে, ছেলেটা একেবারেই হাবাগোবা। তেমন বুদ্ধি-সুদ্ধি নাই মাথায়। তবুও, ডুবে মরবার সময় খড়কুট পেলেও, আঁকড়ে ধরবার অবস্থা এখন বুড়ির। বুড়ি বলল—হ্যাঁ, বাপু, জুলস। একটা ভোঁদড় এসে আমার উনুনে ঢুকে বসে আছে। ওটাকে বার করবার কোন ব্যবস্থা করতে পারবে তুমি? তবে বাপু, ভয়টয় পাইয়ে দিও না যেন।
শুনে, মাথাটা একটু কেবল নাড়ল ছেলেটা। মুখে কোন কথা নাই। উনুনের কাছে এগিয়ে গেল। ঢাকনা খুলে ঝুঁকে দেখল ভিতরে। 
তারপর? তার পর সকলেরই কানে গেল, কী যেন বিড়বিড় করছে ছেলেটা। কাকে বলছে, কী বলছে—মাথায় ঢুকল না কারুরই। 
একটু বাদেই পিছিয়ে এলো ছেলেটা। তখনই একেবারে ভোজবাজি! উনুনের মুখে বেরিয়ে এসেছে ভোঁদড়টা। এদিক ওদিক উঁকি দিচ্ছে সেখান থেকে। চমকে গিয়ে, দু-এক পা পিছিয়ে গেল সবাই। 
ভোঁদড়ের শরীরটা একটু নড়ে উঠল এক সময়। উনুনের বাইরে বেরিয়ে এলো। ঘর থেকেও বের হয়ে গেল। কোন তাড়াহুড়ো নাই। সামান্যও ভয়ে পেয়েছে—এমনটাও মনে হোল না। 
ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন। উঠোন থেকে রাস্তা। তারপর লেজ উঁচিয়ে, নিজের ডেরার দিকে চলে গেল হেলতে দুলতে। 
বুড়ির তো হতভম্ব অবস্থা। অন্য কারও মুখেও কথা সরছে না যেন। কী করে ভোজবাজির মত ব্যাপারটা ঘটে গেল, মাথায় ঢুকছে না কারুরই।
প্রথম রা কাড়ল স্যামুয়েল। জুলসকে জিজ্ঞেস করল—ব্যাপারটা ঠিক কী হোল, বলো তো। কী করে ওটাকে বাইরে বের করলে তুমি?
অন্য একজন বলল—ওকে অমন বিড়বিড় করে কী বলছিলে তুমি? 
—কী আর বলব? আড়মোড়া ভাঙার মত, হাত দুটো সামনে পিছনে ঘোরাতে ঘোরাতে জুলস বলল—কী আর বলব ওকে। বললাম—ওরে হতভাগা! বুদ্ধিশুদ্ধি আছে কিছু তোর মাথায়? আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে, গোটা গায়ে তো পাঁউরুটির গন্ধ হয়ে যাবে তোর। আর তা যদি হয়ে যায়, তখন কী দশা হবে তোর? পাড়ার কোন ভোঁদড়ই তো ধারেকাছে আসবে না তোর। বউ ঘরে ঢুকতে দেবে তোকে? সেটা খেয়াল আছে? 
স্যামুয়েল মাথা নাড়তে লাগল—সত্যিই তো, কেউ ভাবতেই পারিনি আমরা। কিছু একটা করে বসলাম। কিন্তু তাতে অন্যেরা আমাকে কী চোখে দেখবে, কী ভাববে আমার সম্পর্কে, ভেবেই দেখি না কেউ। কিন্তু ছোট্ট একটা জীব, সেও গ্রাহ্য করেছে বিষয়টা। 
এলিশ বলল—আমার মনে, নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সকলেরই সচেতন থাকা দরকার। সে মানুষই হোক বা ছোট্ট কোন একটা জীব।
সকলেই মাথা নাড়তে লাগল সহমত জানিয়ে।    
 যে যার বাড় চলল নিজের নিজের কাজ সারার জন্য। এবার বুড়িও বসবে ময়দা মাখতে। 
বুড়ি জুলসকে বলল—কাল রবিবার। চার্চ থেকে বেরিয়ে, সোজা আমার বাড়ি আসবে তুমি। কাল তোমার নেমন্তন্ন আমার এখানে। এসো কিন্তু বাবা।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments