জ্বলদর্চি

বৌদ্ধ দর্শন -- দুই /বিশ্বরূপ ব্যানার্জী

বৌদ্ধ দর্শন -- দুই

বিশ্বরূপ ব্যানার্জী 

' বুদ্ধ জ্ঞানমনন্তং হি আকাশ বিপুল সমং
ক্ষপয়েত কল্প ভাষন্তং ন চ বুদ্ধ জ্ঞান ক্ষয় '  (ললিত বিজয়)

ভগবান বুদ্ধ অনন্ত জ্ঞানের আধার । যদি কেউ কল্প কাল
ধরেও তাঁর জ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা করে তবে 
কল্প ( ৪৩২ কোটি বছর ) শেষ হয়ে যাবে কিন্তু বুদ্ধের
জ্ঞান বর্ণনা সমাপ্ত হবে না । এই অমিত জ্ঞানশালী
মহাপুরুষের ধর্ম ব্যাখ্যা করা বা তার মার্গ ধর্মকে
প্রাঞ্জল করে উপস্থাপিত করা খুব একটা সহজ কাজ নয় ।
তবু প্রয়াস করা তো যেতেই পারে ।
পুরাকাল হতেই এই ভারত ভূমিতে একটি ধারণা বহুল প্রচলিত ছিলো । সেই ধারণাটি হলো কঠোর তপস্যা বলে
দেবতাদেরও সমকক্ষ হওয়া যায় । তবে এ তপস্যা ছিলো
খুবই কঠোর । এতে তপস্বীকে  নিজের শরীরে অনেক অনেক
শারীরিক কষ্ট নিতে হতো । কেউ কেউ এর কষ্ট সহ্য না
করতে পেরে মারাও যেতেন । প্ৰচলিত এই শারীরিক ক্লেশ 
নেওয়ার ধারণার বশবর্তী হয়ে সিদ্ধার্থও প্রথমে তপস্যা শুরু করে ছিলেন । তিনটি উদাহরণ এখানে দিই শারীরিক ক্লেশ গুলি ঠিক কি রকম ছিলো সেটা বোঝানোর জন্য :
(১) প্রখর গ্রীষ্মে খোলা প্রান্তরে আগুন জ্বেলে তার মাঝ খানে
বসে সাধককে সাধনা করতে হতো । মাথার ওপর লোহিত সূর্য
আগুন ছড়িয়ে দিতো সাধকের দেহে ।
(২)পদ্মাসনে বসে দুই হাতের তালু বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে ধরে থাকা ।  দীর্ঘ কাল পরে দেখা যেতো নখ হাতের তালুকে
ফুটো করে অন্য দিকে বেরিয়ে গিয়েছে ।
(৩)বছরের পর পর ঊর্ধ্ব-বাহু হয়ে বসে থাকা ।
এছাড়াও আরও অনেক রোমহর্ষক  সাধন পদ্ধতিতে
সাধনা করতে হতো । সিদ্ধার্থ তাঁর অনুগত পাঁচজন শিষ্য
কে নিয়ে উরুবেলা গ্রামে এলেন আর সেখানে নৈরঞ্জনা
নদী তীরে ছয় বছর ধরে কঠোর তপস্যা করলেন । রাজপুত্র
অথচ সন্যাসী সাধকের কথা লোক মুখে চারি দিকে ছড়িয়ে পড়লো । অনেকে দেখতে এলেন এই সন্যাসী রাজপুত্রকে ।
সুকঠোর এই তপস্যায় সিদ্ধার্থ ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ছিলেন ।
ক্রমে তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস বব্ধ হওয়ার উপক্রম হলো । তবুও তিনি
এই কঠোর তপস্যা হতে বিরত হলেন না । আহার কমিয়ে 
দিয়ে একটি মাত্র তন্ডুল খাওয়া শুরু করলেন । তাঁর দেহ
ক্রমেই অস্থিচর্ম সার হয়ে পড়লো । এই অবস্থায় একদিন তিনি
হঠাৎ মুর্ছিত হয়ে পড়লেন । তাঁর পাঁচ জন শিষ্য ভাবলেন তাঁর
মৃত্যু ঘটেছে । এই সময়ই এক বোধহীন (?)রাখাল তাঁকে
এক বাটি দুধ এনে মাতৃ স্নেহে তাঁকে খাইয়ে দিলো । তিনি
একটু সুস্থ হলেন । তিনি এও বুঝলেন এইরূপ কঠোর
তপস্যায় তিনি মৃত্যু লাভ করতে পারবেন কিন্তূ তিনি যা 
খুঁজছেন তা পাবেন না । তিনি তাই আবার নিয়মিত আহার
করতে শুরু করলেন । কঠোর  তপশ্চরণ বন্ধ করে দিলেন ।
এই দেখে তাঁর শিষ্যরা তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেলো । এই তপস্যা বর্জনকারী গুরুর আর কি মূল্য থাকতে পারে ?
যে সময় তাঁর শরীর খুবই দূর্বল । নান সন্দেহে দ্বিধায়
দোলায়মান চিত্ত , যে সময় উদার ভালোবাসা ও যত্নের
সবিশেষ প্রয়োজন সে সময়েই তাঁর পাশে তিনি
কাউকেই কি পাবেন না ? কি হবে এবার তবে ? বিধির ই
করুণায় এই সময়েই একজন মাতার স্নেহ নিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন সুগভীর মমতা নিয়ে । কে তিনি ? তিনি পার্শ্ববর্তী  এক গ্রামের এক সন্তান হীনা রমণী । তাঁর নাম
সুজাতা । এই সাধ্বী রমণী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর একটি শিশু সন্তান হলে বন দেবতার পূজা দেবেন । তরুণ এই উপবাস ক্লিষ্ট সন্ত্রাসীকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন । ভাবলেন তাঁর
প্রার্থনা মঞ্জুর করতেই স্বয়ং বন দেবতা স্বর্গ হতে নেমে এসেছেন । সিদ্ধার্থ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, "বৎসে তুমি
আমার জন্য কি উপহার এনেছো" ?
সুজাতা উত্তর দিলেন," হে ভগবান আপনার জন্য  আমার গোয়ালে প্রতিপালিত ছয়টি শ্রেষ্ঠ গরুর দুধ দোহন করে 
তা দিয়ে আমি সুন্দর সুস্বাদু পরমান্ন আপনার জন্য প্রস্তুত করেছি । এতে উৎকৃষ্ট সুগন্ধী  তন্ডুল ও উত্তম সুগন্ধী মশলা 
দেওয়া আছে । আপনি কৃপা করে আহার করুন । আমার একটি ব্রত আছে বন দেবতা আমার দেওয়া এই সুস্বাদু
পরমান্ন যদি গ্রহণ করেন তাহলে  দেবতা আমাকে অবশ্যই 
পুত্র বর দেবেন" । সিদ্ধার্থ সেই পরমান্ন আহার করলেন 
আর সুজাতাকে বললেন, " ভগিনী তুমি যেমন তোমার ব্রত
পালন করে সুখি হয়েছো আমিও যেন আমার ব্রত পালন 
করে আমার আকাঙ্খা সার্থক করতে পারি "।
শরীরে বল পেয়ে তিনি আবার বৃক্ষতলে সমাধিতে বসলেন ।
সে দিনই  দিব্য জ্ঞান লাভ করে তিনি প্রবুদ্ধ হলেন ।
সেই দিন  হতে ঐ বৃক্ষের নাম হলো 'বোধি বৃক্ষ'
বোধিসত্ত্ব যখন নৈরঞ্জনা তীরে বোধি বৃক্ষ তলে সত্য কি তা জানবার জন্য সমাধিস্থ হয়ে ছিলেন তার আগে তিনি শপথ করে ছিলেন :
'আমার এ দেহ যদি শুকনো কাঠ ও হয় ,
চর্ম, অস্থি, লয়  হয় প্রলয় জলে,
বিরোধী মারেরা এসে দেখলেও ভয় ,
ভয় হীন হবো  'বোধি'  এ ধরণী তলে ' ।

সত্যি মারে রা এসে তাঁকে অনেক প্রলোভন ও অনেক ভয়
দেখিয়ে  ছিলো তবুও তিনি ছিলেন অটল ও নির্ভীক ।
তথাগত ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ , পরম শান্তি পদ নির্বাণ
গমনের ও চরম মুক্তি লাভের যে সহজ ও সরল পথ
অবিস্কার করেছেন তা আর্য়- অষ্টাঙ্গিক-মার্গ নামে 
অভিহিত । সে গুলি হলো :
(১) সম্মা দিট্ঠি -------- সম্যক দৃষ্টি।
(২) সম্মা সঙ্কপ্ পো ---সম্যক সঙ্কল্প।
(৩) সম্মা বাচা ---------- সম্যক বাক্য।
(৪) সম্মা কম্মান্তো -----সম্যক কর্মান্ত।
(৫) সম্মা আজীবো----সম্যক আজীব।
(৬) সম্মা বায়ামো -------সম্যক ব্যায়াম।
(৭) সম্মা সতি-----------সম্যক স্মৃতি।
(৮) সম্মা সমাধি -----------সম্যক সমাধি ।

(১) সম্যক দৃষ্টি :  এটি তিন প্রকার
                          (ক)কর্ম বিষয়ক সতর্ক সজাগ দৃষ্টি ।
                          (খ) চারি সত্য বিষয়ে উত্তম ও
                                সতর্ক  দৃষ্টি ।
                          (গ) দশ বস্তু বিষয়ক সতর্ক উত্তম দৃষ্টি

(২)সম্যক সঙ্কল্প :  যথার্থ ও ন্যায় সঙ্গত উদ্দেশ্য।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments