জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৪৬/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৪৬

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


 রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বর্তমান সহ- সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী প্রভানন্দজী লিখছেন --“...১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীশ্রীঠাকুরের তিথিপূজার পরেই অখণ্ডানন্দজী নীলাম্বর মুখার্জির বাড়িতে অবস্থিত মঠ থেকে রামকৃষ্ণানন্দজীকে লিখেছিলেন, ‘ভাই। আমাদের famine work তোমারই পরিশ্রমে সুসম্পন্ন হইয়াছে।’ এর পিছনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন। রামকৃষ্ণানন্দজী গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দকে দুর্ভিক্ষের রাজ্য পরিত্যাগ করে মঠে ফিরতে উপদেশ দিয়েছিলেন। স্বামীজীর নির্দেশে স্বামী অখণ্ডানন্দ সেবাকাজ আরম্ভ করেছিলেন ১৫ মে। তার পূর্বেই স্বামীজীর আদেশানুসারে তুরীয়ানন্দজী ৯ মে তারিখে মান্দ্রাজে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে নির্দেশ দেন সঙ্ঘের পত্রিকা ‘ব্রহ্মবাদিন’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’ দুর্ভিক্ষপীড়িতদের ও প্রস্তাবিত সেবাকাজের বিবরণ প্রকাশ করবার জন্য। এদিকে স্বামী অখণ্ডানন্দজীকে নির্দেশ দেওয়া হয় ত্রাণকাজের বিবরণ মান্দ্রাজে পাঠাবার জন্য। তদনুযায়ী ‘ব্রহ্মবাদিন’ পত্রিকা ৫ জুন অখণ্ডানন্দজীর পত্রাংশ উদ্ধৃত করে লিখল, ‘It is impossible to count the number of men and women that are already dead, as well as those that on their death bed for want of food.’ তাঁর দ্বিতীয় পত্রাংশ উদ্ধৃত করে লিখল, ‘When I imagine the agonies of that starving men, I almost shrink to go to their side, for I will not be able to do anything to them save seeing their extreme pain.’ ধনীদের বিরুদ্ধে ধিক্কার দিয়ে অখণ্ডানন্দজী এই চিঠিতেই লিখেছিলেন, ‘...যেসব হৃদয়হীন জীবগুলি এই সংকট সময়েও নিশ্চিন্ত বিলাসের মধ্যে শুয়ে হাস্যপরিহাস করে সময় কাটাচ্ছে তারা ঈশ্বরের বৈধ সন্তান নয়, শয়তানের বাচ্চা।’ তাঁর তৃতীয় পত্র থেকে ‘ব্রহ্মবাদিনের’ পাঠকগণ জানতে পারলেন ত্রাণকাজ আরম্ভ হয়েছে। ‘ব্রহ্মবাদিন’ ১৯ জুন ( ১৮৯৭ ) সংখ্যার ত্রাণকাজের বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হল। ৩ জুলাই, ১৭ জুলাই ও ২৮ অগস্ট সংখ্যায় আরও তথ্যাদি প্রচারিত হল। প্রায় প্রতি সংখ্যাতে রামকৃষ্ণানন্দ অর্থ-সাহায্যের জন্য আবেদন জানালেন। মান্দ্রাজ প্রেসিডেন্সির বেলারির একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার আর গোপাল আইয়ার তিনবারে ১৫০০ টাকা পাঠালেন। আমেরিকার ডেট্রয়েট শহর থেকে জনৈক দাতা পাঠালেন ৫ পাউণ্ড ২ শিলিং। কলকাতা, বারাণসী ও মান্দ্রাজ থেকে ‘Swami Vivekananda Famine Fund’-এ অর্থ অল্পস্বল্প আসতে থাকল। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ এই সংগৃহীত অর্থ পাঠিয়ে দেন আলমবাজার মঠে।” ( স্বামী অখণ্ডানন্দ মননে, মৃণাল গুপ্ত সম্পাদিত, ত্যাগ সেবা ও প্রেমের এক মহাজীবন স্বামী অখণ্ডানন্দ -- স্বামী প্রভানন্দ, পৃ: ৫৯-৬০ ) 
 এই প্রসঙ্গটি শুরুতে উল্লিখিত হলেও যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এর বর্ণনা করেছেন প্রভানন্দজী তা অবগত করানোর প্রয়োজন ছিল।
 শশী মহারাজ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বহু স্থানে ভ্রমণ করেন এবং প্রধানত তাঁরই প্রভাবে ভানিয়ামবাড়ি, ব্যাঙ্গালোর, ত্রিবান্দ্রাম, পুডুকোটাহ্, ধর্মপুরী এবং আরও অন্যান্য স্থানে কেন্দ্র স্থাপিত হয়। তাঁর দেওয়া বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা একত্রিত করে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘দ্য ইউনিভার্স অ্যাণ্ড ম্যান।’ এটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বেদান্তের গভীর দর্শনের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনের কিছু কিছু দিক নিয়ে আলোচনা রয়েছে ‘শ্রীকৃষ্ণ দ্য প্যাস্টেল’ এবং ‘শ্রীকৃষ্ণ দ্য কিং মেকার’ পুস্তক দু'টিতে। যেগুলি শশী মহারাজ লিখিত। আবার ‘দ্য সোল অব ম্যান’ পুস্তকটি উচ্চ দার্শনিকতা সমৃদ্ধ। রামানুজের জীবনী রচনার বাসনায় তিনি রামানুজের স্মৃতিপূত বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন, এই বিষয়ে আলোচনা করেন বহু বৈষ্ণব পণ্ডিতদের সঙ্গে। এইভাবে সংগৃহীত উপাদানের ভিত্তিতে রচিত হয় ‘দ্য লাইফ অব শ্রীরামানুজ’ ( বাংলায় ‘রামানুজ চরিত’ )।
 শ্রীশ্রীমা ও ঠাকুরের মানসপুত্র, তাঁর একান্তপ্রিয় গুরুভ্রাতা স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে ( রাজা মহারাজ বা মহারাজ ) দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন শশী মহারাজ। এই বিষয়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দশম সঙ্ঘগুরু স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী জানাচ্ছেন -- “একদিন তিনি মহারাজকে নিয়ে যান মাদুরাইতে মীনাক্ষী মন্দিরে। ওখানে কাউকেই গর্ভমন্দিরের ভিতর যেতে দেওয়া হতো না। কিন্তু শশী মহারাজের বাসনা হলো মহারাজকে নিয়ে সেখানে যাবেন। তিনি অদ্ভুত এক কৌশল অবলম্বন করলেন। মহারাজ ও শশী মহারাজ দুজনেই চেহারায় ভারিক্কি ও বলিষ্ঠ ছিলেন। শশী মহারাজ তারস্বরে বললেন, ‘আলওয়ার! আলওয়ার!’ এবং মহারাজকে ধরে নিয়ে গিয়ে দেবীমূর্তির সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মহারাজ সঙ্গে সঙ্গে সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নিস্পন্দ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। শশী মহারাজ লক্ষ্য রাখছিলেন যাতে মহারাজ পড়ে না যান। উপস্থিত পুরোহিতদের কারুর কিছু বলার বা তাঁদের জাত নিয়ে প্রশ্ন করার সাহসও ছিল না। ঐ অবস্থায় রাজা মহারাজ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।” (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের স্মৃতিমালা, পত্র ও রচনাসংগ্রহ, স্বামী বিমলাত্মানন্দ ও স্বামী চেতনানন্দ সম্পাদিত ও সংকলিত, উদ্বোধন কার্যালয় )
 শ্রীশ্রীমা'কে রামেশ্বর তীর্থে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শশী মহারাজ। মা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে রামেশ্বর গিয়েছিলেন। সেখানে মা'কে দিয়ে ১০৮ টি স্বর্ণ বিল্বপত্র নিবেদনপূর্বক মহেশ্বর শিবের পূজা করান। রামেশ্বর শিবলিঙ্গ নরম বালুপাথর দিয়ে গড়া। তাই শিবলিঙ্গটি একটি ধাতুর আচ্ছাদনে ঢেকে জল ঢালা হয়। শ্রীশ্রীমা যখন পূজা করছিলেন সেইসময় ঢাকনাটি সরিয়ে দেওয়া হয়, শিবলিঙ্গটি দেখতে পান মা। সেটি দেখে তিনি মন্তব্য করেনঃ “যেমনটি রেখে গেছিলাম তেমনটিই আছে।” একথা শুনতে পেয়ে এক ভক্তমহিলা জিজ্ঞাসা করেন -‘মা, আপনি কি বললেন?’ মা অবশ্য এর কোনও উত্তর দেন নি।  দাক্ষিণাত্য থেকে মায়ের প্রত্যাবর্তনের পর শশী মহারাজ বলেছিলেন দক্ষিণ ভারতে তাঁর কাজ শেষ হল। এর কয়েকমাস পরেই তিনি রোগাক্রান্ত হন। বায়ু পরিবর্তনের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাঙ্গালোরে। কিন্তু সেখানে তাঁর স্বাস্থ্যের কোনও উন্নতি হল না। কলকাতায় এলে চিকিৎসকরা জানান যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত তিনি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে রোগ, নিরাময়ের কোনও লক্ষণই দেখা দেয় না। মানবহৈতষণার উদ্দেশ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবপ্রচারে অসম্ভব কষ্ট সহ্য করেছিলেন দক্ষিণভারতে। উপযুক্ত খাওয়াদাওয়ার অভাব ছিল। কিন্তু স্বামীজীর নির্দেশ পালনে বিন্দুমাত্র যাতে ত্রুটি না হয় সেই উদ্দেশ্যে প্রাণপাত করেন। শরীরের ভিতর এমন করেই বাসা বেঁধেছিল দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষ্মা। তাঁর এই আত্মত্যাগ দধীচি মুনি বা ক্রুশবিদ্ধ যিশুর সঙ্গে তুলনীয়। সমস্ত যন্ত্রণার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি দক্ষিণভারতকে ঠাকুরের ভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন। মাত্র উনপঞ্চাশ বছর বয়সে মহাসমাধিতে লীন হন। স্বামী সারদানন্দজী বলেছিলেন --“দক্ষিণভারতে গিয়ে ভক্তদের কাছে খোঁজ কর, জানতে পারবে স্বামীজীর তিরোধানে তাঁরা কিরূপ মর্মাহত হয়েছিলেন এবং শশী মহারাজের স্নেহ স্মরণ করে তাঁরা কিভাবে অশ্রু বিসর্জন করেন। আজ খুব সহজেই বলতে পারি  -- চারিদিকে তাকিয়ে দেখ তাহলেই বুঝতে পারবে শশী মহারাজ দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র কি করে গেছেন।”

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments