জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১০৪

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ১০৪


সম্পাদকীয়,
দুর্গা তো নৌকোয় চেপে ছেলেমেয়ে নিয়ে কৈলাসে রওনা দিল। এদিকে লক্ষ্মী বায়না ধরল সে আরো ক'টাদিন  মামারবাড়ি থাকবে। ক'দিন বাদে লক্ষ্মী পুজোও মিটে গেল কিন্তু লক্ষ্মীতো বসে বসে ছোটোবেলার গল্পগুলো শুনতে শুনতে ভুলেই গেল কৈলাসে ফেরার কথা। ঐ যে শাশ্বতি আন্টির তোলা  প্রচ্ছদের ছবিটাতো সেটারই। লক্ষ্মী খুব ভালবাসে ছড়া শুনতে আমি যশোধরা আন্টির ছড়াটা পড়ে শোনাতেই হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল। আমি তখন রূপা পিসি, বানীয়া দিদির কবিতা শোনালাম। শরতের কবিতা শুনে মনে হয় শারদীয়া পুজোর কথা মনে পড়েছিল লক্ষ্মীর। মনটা মা আর ভাই বোনেদের জন্য খারাপ হতে পারে ভেবে আমি মৌসুমী আন্টির সাত ভাই চম্পার কবিতাটা শোনালাম। সে কি খুশি, ভাবতে পারবে না। বলে কিনা আরো রূপকথার গল্প বলো। আমি তখন দীপক জেঠুর অনুবাদ গল্পটা বললাম। গল্পের ঈগলটার কথা শুনে পেঁচা, দিদি দিদি, করে কাঁদতে শুরু করল। আমি কি করি এবার? শ্যামলী আন্টির লেখা চং এর গল্পটা বললাম। দেখলাম, চং এর গল্প শুনে পেঁচার পেঁচা মুখে হাসির ঝিলিক। লক্ষ্মী আবার বলে কিনা চং কেতো চিনি আমি। পেঁচা এবার গাল ফুলিয়ে বলল, আরো গল্প বলো। আমি গৌর জেঠুর লেখা ডাবলুর গল্প বললাম। সেই শুনে পেঁচা উড়ে গেল মরা পিঁপড়েটা দেখতে। আমি তো, পেঁচা পেঁচা, করে কত ডাকলাম শুনলোই না। লক্ষ্মীর মন উতলা হবে ভেবে তাড়াতাড়ি ওকে রঙ তৈরির গল্প শোনাতে লাগলাম। ওমা, কি হল যেন? অদিতি আন্টির রঙ তৈরির গল্প শুনে লক্ষ্মী প্যাস্টেল দিয়ে একটা সাদা কাগজে পেঁচা এঁকে পাশে রেখে দিল। আর জয়দীপের আঁকা কৃষ্ণের ছবিটা দেখতে লাগল। দেখে কি বলল যেন, এই উৎসবের জন্য কতদিন কৃষ্ণ সিরিয়ালটা দেখা হয়নি। লক্ষ্মীর মন ভাল করতে ব্রততী আন্টির গল্প শোনালাম। রোহনের ঘুড়ি ওড়ানোর কথায় খুব মজা পেল আর তপশ্রী আন্টির উপন্যাসের নিউটন প্রোটনের বুদ্ধির কথা শুনে বলে কিনা ওদের বলো আমার পেঁচাকেও খুঁজে দিতে। বোঝোঠেলা। আমি কি আর করি ঋদ্ধিতের আঁকা ছবিটা লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে নিজেই গেলাম পেঁচাকে খুঁজতে।  খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখি। পায়েল আন্টির গল্পের দুনুর পাশে বসে পেঁচা কাঁদছে ঘাসেদের জন্য। ওদের পাশে বসে শ্রীপর্ণা ঘাস ফুলের ছবি আঁকছে। ওদের বুঝিয়ে টুঝিয়ে লষ্মীর কাছে নিয়ে এলাম। এসে সকলকে বাড়ি পাঠানোর মতলবে অমিত অঙ্কেলের স্কুল খোলার গল্প বললাম। স্কুলের কথায় সবাই তো ব্যস্ত হয়ে গেল। লক্ষ্মী শশব্যস্ত হয়ে বলল, আর না আমিও চলি, নাহলে মা চিন্তা করবে। লক্ষ্মী চলে যাবার পদচিহ্ন শ্রীপর্ণার বন্ধু সঙ্গীতা ক্রেয়ন দিয়ে এঁকে আমাকে দিল। আমি জানি তোমরা ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর আগমণী পায়ের ছাপ এঁকেছো। তাই যাবার সময়ের পায়ের ছাপ রেখে দিলাম ছোটোবেলার দপ্তরে, আবার এসো মা🙏 
মৌসুমী ঘোষ


আর . আই. পি .

গৌর বৈরাগী

কে ডাবলু?
ওই যে সেই নটোরিয়াস ছেলেটা। তার কথাই হচ্ছে। ছেলেটা কোনদিন খালি হাতে থাকে না। কোনদিন গুলতি, কোনদিন স্টিক, কোনদিন থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তার জন্য বাড়িতে কারো প্রবেশাধিকার নেই। এইতো কয়েকদিন আগে "হুই -হাই" ,"ঢিসুম-ঢিসুম"- ছাড়াও কি সব  "জামি - জুকি" কিংবা "টুসকি-জুকি'"র মতো শব্দ গলা দিয়ে বার করে আনছিল ছেলেটা। ওই শব্দ করতে করতে মুঠো বাগিয়ে তেড়েও যাচ্ছিল। কার দিকে ? না দাদুর দিকে, মিনি পিসির দিকে, দিদুর দিকে। দিদু বিরক্ত হয়ে বলে, তোর জ্বালায় আমরা কি সবাই বাড়ি ছাড়া হব। বলে কিন্তু বাড়ি ছাড়ে না। এদিকে বাড়িছাড়া হল চুনু আর হিমাংশু বাবু। চুনু হল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কুকুর ছানাটা। এখন বেশ গায়ে-গতরে আরও দেখনসই হয়েছে সেটা। কিন্তু তাহলে কি হবে, ডাবলুর ভয়ে সে এখন কাঁটা আর  বাড়ি ছাড়া। হিমাংশু বাবুও লেজ ঝুলিয়ে আর ছাদে এসে বসছে না। হুফ হাফ করে লাফও দিচ্ছে না।
কতবার বলা হয়েছে, আরে বাবা ওটা হল ডাবলু। ওটা হলো ডাবলুর মিছিমিছি ঘুষি। আর ওই যে একটা আপার কাট মারল ওটাও হলো মিছিমিছি। ওই আপার কাট, লোয়ার কাট কিংবা থ্রোট কাট সবই হল মিছিমিছি। কিন্তু কেউ সেটা বিশ্বাসই করে না। তার ফলে হলো কি ছেলেটার সামনে আজকাল আর কেউ আসছে না। অমন আদরের চুনু তো ছাড়, ঘরের দেওয়ালের টিকটিকি, তারও দেখা মেলে না আজকাল। আগে ডাবলুর হাতে বন্দুক দেখলেই দৌড় দিত চুনু। এখন শুধু ডাবলু কে দেখলেই সে চো চো করে দৌড়োয়।
ডাবলু বলে, ওরে শোন চুনু। আজ আমার হাতে থ্রি নট থ্রি নেই। গাদা বন্দুক টাও নেই। চুনু
দূর থেকে বলে, বন্দুক না থাক, তুমিতো আছো ডাবলু দা।
দেখেটেকে দাদুবাবা বলল, খুব বদ অভ্যাস তৈরি হয়েছে ছেলেটার।
মা বলল ,ওকে ক্যারাটে তে ভর্তি করাই ভুল হয়েছিল।
হ্যাঁ ক্যারাটেতে ভর্তি হয়েছিল ডাবলু। বেশ কটা দিন ক্যারাটে গি চাপিয়ে মাঠে গেল। ক্যারাটের ইউনিফর্মের নাম হল ক্যারাটে গি। কোমরে বেল্ট বেঁধে হাত পা ছুঁড়লো। আর মুখে বলতে লাগলো টুসকি-জুকি, কি -জামি - জুকি, উরা-কেন্ -নুকিতে।
মাস দুয়েক যেতে না যেতে ক্যারাটে ছাড়লো সে। কিন্তু ক্যারাটে তাকে ছাড়লো না। সারাদিন রাত পাঞ্চ  আর হাত পা ছোড়াছুড়ির সঙ্গে মুখে ফুটতে লাগল জাপানি বুলি।
মা বলল, ওই ক্যারাটেই হল যত নষ্টের গোড়া।
বাবা বলল, ক্যারাটের ঘাড়ে দোষ চাপানো কাজের কথা নয়।
তাহলে দোষী কে? ওই অতটুকু ছেলেটার ভেতর গুন্ডামি ভরে দিচ্ছে কে?
দাদুবাবা বলল, কে আবার, ওই তোমাদের মোবাইল ।
কথাটা যে খুব ভুল তা কিন্তু নয় । হাতে মোবাইল থাকলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে যায় ছেলেটা। মোবাইলে গেম খেলে, একটা শেষ হলে আর একটা ডাউনলোড করে। খেলা আর শেষ হয়না।
দাদুবাবা বলে, একেবারে ঠিক কথা। পড়াশুনোর পাট তুলে দিয়ে শুধু গেম আর গেম। আর ওই গেমের ভেতর শুধু খুন খারাবি, রক্তারক্তি কান্ড। শত্রুকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। আবার কখনো পাহাড় থেকে ফেলে দিচ্ছে। শুধু রক্ত --
পিসি বলল ওটাকে কি গেম বলে নাকি! গুলি গোলা তার সঙ্গে আগুন। মোবাইলের গেমের সঙ্গে ক্যারাটের পাঞ্চ মিলে একটা যাচ্ছেতাই কান্ড হচ্ছে বাড়িতে এখন।
তো ঘটনা হল এইরকম। লোকে চেষ্টা করে নাম ছড়াতে। বাবা-মা চেষ্টা করে ছেলের নাম ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে। ডাবলুর মাও চায় হয়তো একটু বেশিই চায়। কেউ যদি বলল, আপনাদের ডাবলু টা কি ভাল। গর্বে মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তেমন ভাগ্য করে কি এসেছে নাকি ডাবলু মা। নামের বদলে ছেলেটার বদনাম ছড়িয়ে পড়লো দিকে দিকে। ডাবলু কারো বাড়িতে গেলেই সেখানে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আগে থেকে খবর থাকলে ডাবলু যাওয়ার আগেই তার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে মোবাইল, টিভির রিমোট, নতুন কেনা মেকানিক্যাল বক্স, ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক ট্রেন, রং পেন্সিলের বাক্স ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখা গেল ডাবলু যখন ওই বাড়িতে গেল তখন সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বাড়িতে এসেছিল পলাশকাকু। আজকাল বাড়িতে কেউ এলেই তাদের সব আলোচনা ঘুরেফিরে ডাবলুকে নিয়ে হয়। তো পলাশ কাকুকে পেয়ে মা প্রথমেই বলল, ওকে নিয়ে কি করা যায় পলাশ ঠাকুরপো?
পলাশ কাকু হেসে বলল, আরেকটু বড় হোক না ,তারপর সব নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। আরেকটু দেখো।
মা মুখ ঝামড়ে বলল, সেই চার বছর বয়স থেকে শুনছি কথাটা, বড় হলে ঠিক হবে। সেই 'চার' 'পাচ 'হল, পাঁচ ছয় হল, ছয় সাত হল। এই করতে করতে এখন 'নয়' চলছে ঠাকুরপো। এদিকে ঠিক হবার বদলে বেঠিক হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আর যে পারা যাচ্ছে না।
কথাটা একটুও ভুল নয় জানেন, আসলে দোষটা ডাবলুর নয়---
তাহলে কার দোষ? প্রশ্ন করে ভুরু কুঁচকে মা তাকিয়েছে। এমনভাবে তাকানো যেন মনে হচ্ছে, যার ,দোষ হাতের সামনে তাকে পেলে মা দেখে নেবে। তাই রাগী গলায় দ্বিতীয়বার বলল, তাহলে কার দোষ বলো ঠাকুরপো?
পলাশ কাকু হাসলো। তুমি যা ভাবছো বৌদি তা কিন্তু নয়। দোষী একজন আছে বটে তবে তাকে তুমি ধরতে পারবে না। সে আছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
কে সে?
পলাশ কাকু হেসে বলল, সে হল মোবাইল। আর ওই মোবাইল কাকু, যেটা ছোটদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে তা হল কিলার ইনস্ট্যি্্টিট।
মা ভেবে দেখল কথাটা বুঝি ঠিকই। যত নষ্টের গোড়া ওই যন্তরটা। পড়াশোনা সব লাঠে তুলে দিচ্ছে ওটা।
অথচ এমনটা ছিল না। এতদিন দুচোখের বিষ ছিল। দাদু মা-বাবা সকলের কাছেই ওটা ছিল শত্তুর। কিন্তু কোভিড নাইন্টিন এসে সব তালগোল পাকিয়ে দিল। স্কুল ছুটি, কবে খুলবে তার কোন ঠিক নেই। তখনই স্কুল থেকে ঠিক করা হল , ক্লাস হবে এবং সেটা হবে অনলাইনে।
ব্যস ছেলেদের আর পায় কে। সকাল আটটার সময় ক্লাস শুরু হচ্ছে, তখন বাধ্য হয়ে ছেলেদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে মায়েরা। সেই ক্লাস শেষ হচ্ছে বেলা বারোটায়। তারপর চান খাওয়া বলতে যেটুকু সময়। তারপরেও আবার মোবাইল।
দুপুরে এখন এটা কি দরকার তোর?
আহা! হোমক টা করতে হবে না? অর্চিষ্মানকে  একবার কল করতে হবে । মিস ম্যারিয়টের ক্লাসে কতটুকু লেসন হল সেটা ওর কাছে জানতে হবে।
এরকম হলে মোবাইল তুলে দিতেই হবে। আর হাতে একবার মোবাইল পড়লে তখন ওই যন্তরটাই চালাবে ডাবলু কে। ডাবলুর ইচ্ছা না থাকলেও গেমে চলে যাবে। আরেকটু পরেই স্ক্রিনের উপর ফুটে উঠবে গেম। সেখানে ধুম ধারাক্কা মারপিট, খুনোখুনি রক্তারক্তি কান্ড। ঢিশুম  ঢিসুম---ক্লাক ক্লাক---বুগিস  বুগিস।
এ সময় মা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে তুই কি ভালো হবি না বাবু!
ডাবলু বলল, প্লিজ মা আর তিন মিনিট। এই গেমটা শেষ হোক, তারপর।
মা রাগী গলায় বলল, আজ একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বো। আর তিন মিনিট সময়ও দেব না তোকে। বল, শিগগির বল।
ডাবলু মায়ের রাগী থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলবো মা?
আমাকে "মা" বলে ডাকবে না। আমি তোমার মা নই।
ডাবলু বলল তাহলে তোমাকে "কী" বলে ডাকবো?
আমি জানিনা।
আচ্ছা মাসি বলা যাবে কি?
আমি জানিনা।
আচ্ছা যদি কিবলিশ বলে ডাকি।
সেটা আবার কী?
সেটা হলো কিবলিশ।
হ্যাঁ ছেলেটা এইরকম। ওকে বাগ মানানো যাচ্ছে না, রাগ মানানোও যাচ্ছে না। আবার যে ওর উপর রাগ করে থাকবে, সেটাও হচ্ছে না।। এই যেমন এখন বলল, ও মা বলনা তোমাকে মায়ের বদলে "কিবলিশ" বলে ডাকবো কিনা?
এটা হাসির কথা। হাসাহাসিরও কথা। কিন্তু এখন হেসে ফেললে ওকে আস্কারা দেওয়া হয়ে যাবে।  তাই কথা বন্ধ করল মা। সারারাত কথা বন্ধ রইল। সকাল নটা অব্দি নো কথা। সেই কারণেই কিনা কে জানে, দেখা গেল ছেলেটা ভারী শান্ত হয়ে গেছে।
খাটে বসে আছে, সামনে ড্রয়িং খাতা আর রং পেন্সিল। বড় চুপচাপ আজ। ব্যাপারটা কি! মা ঘরে ঢুকছে কিন্তু তাকাচ্ছে না। না তাকিয়েও বুঝতে পারছে ,রং পেন্সিল দিয়ে বড় ড্রয়িং পেপারে ছবি আঁকছে ছেলেটা। আঁকুক, মা কথা বলবে না?
দ্বিতীয়বার ঘরে ঢুকেও তাকালো না, কিন্তু বুঝলো সাদা কাগজের ওপর রঙিন ফুল আঁকছে ছেলেটা। একটা-- দুটো-- তিনটে--
আড় চোখে যতটুকু দেখা যায়--দেখতে দেখতে সরে এলো মা।
তৃতীয়বার ঘরে ঢুকে মা আড়চোখে দেখল, কালো বর্ডারের ধারে ধারে আরো ফুল আঁকা হয়ে গেছে। এবার সবুজ পাতা আঁকা হচ্ছে। সাদা পাতা এবার সবুজে ভরে যাচ্ছে। তবে ড্রইং পাতাটার মাঝখানটুকু শূন্য ধূ ধূ। ওই মাঝখানে কি আঁকবে ছেলেটা? ফুল আর লতা পাতার মাঝখানে কাকে বসাবে ডাবলু? জানতে ভারী আগ্রহ হল মায়ের।
মা আর আগ্রহটুকু চেপে রাখতে পারল না।  বলল, মাঝখানের ওই ফাঁকা জায়গাটায় কী আঁকবি?
ডাবলু ঠোঁটে আঙুল তুলে বলল, চুপ ! তারপর কথা না বলে কাগজের মাঝখানে কালো রঙের একটা বর্ডার দিয়ে জায়গাটা ঘিরে দিল।
তারপর?   তারপর?
তারপর ড্রইং খাতার একপাশে পড়ে থাকা মৃত একটা ডেয়োপিপড়ের দেহটা তুলে নিয়ে পাতা টার মাঝখানে আনল সে।
মা বলল, এটা কি হচ্ছে রে?
আবার ঠোঁটে আঙুল তুলে চাপা গলায় ডাবলু বলল, এই পিঁপড়েটাকে আমি ভুল করে মেরে ফেলেছি মা। কথা শেষ করে ছবিটার ঠিক মাঝখানের শূন্যস্থানে মৃত পিঁপড়েটাকে আস্তে করে রেখে দিল ডাবলু। তারপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করার আগে বড় বড় করে তিনটে  অক্ষর লিখল সে। অক্ষর তিনটে হল---R I P.
আর  R I P মানে যে রেস্ট ইন পিস এটা মা জানে।
আশ্চর্য হয়ে মা দেখল। তাদের ছেলেটা শুধু বড় হয়নি, কখন যেন ভালও হয়ে গেছে।


ছড়া
যশোধরা রায়চৌধুরী 

সারাগায়ে কাদা মাখামাখি 
ফুটবল খেলে এলি নাকি?
সারাগায়ে ধুলো বালি মাটি
কুস্তি করেছ বুঝি খাঁটি?
সারাগায়ে আঁশ পাতা ঘাস
ঝাঁট দিয়ে এলে বুঝি মাঠ?
সারা মাথা তুলো আর ফেঁসো
বালিশ যুদ্ধে বুঝি মাথা ঢুঁশিয়েছো?

সারা চোখে  আকাশ মাখানো
পাখা মেলে উড়ছো এখনো?
সারা মুখ দুষ্টুমিভরা
চুরি করে খেলি রসবড়া?
সারা ঠোঁটে  হাসি হাসি হাসি 
বন্ধু মিলেছে বুঝি, তারই এত খুশি


চঙের কাণ্ড
শ্যামলী আচার্য 

আরাম করেই বসেছে দেখা যাচ্ছে। তিস্তু আর গোল্লু গেট ঠেলে বেরোতে গিয়েই ওকে দেখতে পেল। একটা বড়সড় নারকেল পাতা পড়ে আছে, তার ওপর জাঁকিয়ে বসেছে চং। পোষা নয়, ওদের পেয়ারের বেড়াল। তার গায়ের ওপর একফালি রোদ্দুর এলিয়ে পড়েছে। বেশ আয়েশ করে রোদ পোয়াচ্ছে। মর্নিং ওয়াকে বেরোনো রাস্তার লোকজনকে অলস চোখে মাপছে। গোল্লুর হাতে নতুন মোবাইল, পরীক্ষার পরে বাবা কিনে দিয়েছেন। গোল্লু মোবাইলের ক্যামেরা বাগিয়ে ফস ফস করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। 
“এক্ষুনি ইন্সটাতে ছবিগুলো সাঁটাবি, তাই না?”
গোল্লু একবার ঢোঁক গিলল।  
চং সাধারণত কথা বলে না। বেড়ালেরা কথা বলবেই বা কেন? তারা মিয়াঁও, ম্যাঁও, গোঁ, গররর, ফ্যাঁশ, ঘেঁয়া জাতীয় শব্দ দিয়েই মনের ভাব প্রকাশ করে। কিন্তু চং এসব শব্দ যেভাবে উচ্চারণ করে, তাতে তার স্বরক্ষেপণে তিস্তু আর গোল্লুর বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না, সে ঠিক কী বলতে চায়। 
চঙের কথা তোমাদের আগেও বলেছি। সে এই পাড়াতেই থাকে। তার থাকা-খাওয়ার নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। সকালে গোল্লুদের পাশের বাড়ির জন্টির মা ওকে দুধ-পাঁউরুটি দেন, বেলার দিকে পিছনের বাড়ির বাবাই মাছের তেল, কাঁটা, আঁশ খেতে ডাকে, দুপুরে লাঞ্চ টাইমে তিস্তু আর গোল্লু মাছের ঝোল-ভাত মেখে জোর করে তাকে ঠুসে খাওয়ায়। ঠুসে খাওয়ানোর কারণ হল, ওই সময় চং একা আসে না, তার দুটি হুলো বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। তাদের তিস্তু আর গোল্লুর একদম পছন্দ নয়। ফলে ওরা দুই বন্ধুকে সরিয়ে আগে চংকে পেট ভরে খাইয়ে নেয়।  
চং যে এপাড়ার একটি অতি বিচ্ছু বেড়াল, সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না। কিন্তু চংকে বিচ্ছু, বদমাইশ তো দূরস্থান, সামান্য দুষ্টু বললেও তিস্তু আর গোল্লু হাঁ হাঁ করে তেড়ে এসে তার চুল ছিঁড়ে মাথায় টাক বানিয়ে তাতে পারমানেন্ট মার্কার পেন দিয়ে হাবিজাবি লিখে ছেড়ে দেবে। উফ! চং-এর নামে গোল্লু বা তিস্তুকে একবার কেউ কিছু বলে দেখুক। গোল্লুর মা অবিশ্যি বলেন, তিস্তু আর গোল্লু চঙের কাছ থেকেই যাবতীয় বদমায়েশি শিখছে।    
কিছুদিন হল চং একটু বেশি খবরদারি করছে। সেটা দুষ্টুমি নয়, গার্জিয়ানি। এই আজই যেমন।  
গোল্লু চেঁচিয়ে বলে, “অ্যাই, তুই কি করে জানলি রে আমি ইন্সটাতে তোর ছবি দেব?”
চং ফ্যাঁচ করে হাসল। ফিচেল হাসি। “হে হে, শোন, জানলা দিয়ে তোর সব কীর্তিকলাপই আমি দেখতে পাই। বাবা-মা যেই বেরিয়ে গেল, ফস করে বইখাতা সরিয়ে অমনি মোবাইলের মধ্যে গিয়ে গোঁত্তা খেলি। হয় গান শুনছিস, নয় সিনেমা দেখছিস, বেরোক তোর পরীক্ষার রেজাল্ট, তখন টের পাবি।”  
গোল্লু হাঁ। কী অকৃতজ্ঞ বেড়াল রে বাবা! তিস্তু সামলাতে এল। 
“গোল্লু, ছাড় তো ওর কথা। কেবল পাকামো। অ্যাই চং, তুই এক্কেবারে গেটের সামনেই গুছিয়ে বসেছিস যে! গেট খুলে লোকে যাবে আসবে কেমন করে?”
“কেন? টুক করে লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে যাবে! কিংবা পাঁচিলের ওপর দিয়েই হেঁটে যাবে... তোদের যত বোকা বোকা প্রশ্ন।”  
কী আশ্চর্য! একটু পরে খবরের কাগজ দিতে ভোম্বলদা আসবে, দুধওলা আসবে, রন্টুকাকু ইস্তিরির জামাকাপড় নিতে আসবে, সুশীলদা দিদানের পুজোর ফুল দিতে আসবে, ঋতুমাসি রান্না করতে আসবে, গোপালমামা বাজার নিয়ে আসবে, কাজলমাসি বাসন মাজতে আসবে, শ্রীকান্তদা বাগানের পরিচর্যা করতে আসবে--  এরা সবাই পাঁচিল টপকে ঢুকবে? বাবা-মা অফিসে যাবে পাঁচিল টপকে? দৃশ্যটা ভেবেই কুলকুল করে হাসি উপচে আসতে লাগল তিস্তুর গলা বেয়ে। কেউ রোগা, কেউ মোটা, কেউ বেঁটে, কেউ বুড়ো... তারা সব টপ করে লাফিয়ে উঠল বাড়ির পাঁচিলে, আর ধুপ করে নামল বাড়ির ভেতরের কম্পাউন্ডে। হি হি হি হি।  
তিস্তু আর হাসি চাপতে পারল না। 
চং কটমট করে তাকাল। “তুই বড্ড হাসকুটে রে। কথা নেই বার্তা নেই, খ্যা খ্যা করে হাসছিস। আমাকে দেখে কি তোর কমিক রিলিফ মনে হচ্ছে?” 
“না না। তুই হলি চং। আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধ বেড়াল মাসিমা।”  
চং রেগে কাঁই। “অ্যাই অ্যাই, বলি হচ্ছেটা কি? বৃদ্ধ, মাসিমা... এসব কি বলছিস রে? এক্ষুনি আঁচড়ে তোর কানের ছাল ছাড়িয়ে নেব বলে দিলাম।” 
“এই রে!” গোল্লু ভয়ই পেয়ে যায়। “থাক থাক, ক্ষমা কর ভাই। কিন্তু তার আগে তুই বল, এত জায়গা থাকতে তুইই বা এইখানে গুছিয়ে বসেছিস কেন?”
চং ফোঁস করে উঠল। “পেছনে দেখ।”  
তিস্তু আর গোল্লু দেখল। চং বসে আছে গেটের সামনে। ওর পেছনে বাড়ির গ্রিলের গেট। আর কোথায় কী?
চং ঘাড়ও ঘোরাল না। ওইভাবে বসে থেকেই বলল, “তোরা যে পরীক্ষায় গোল্লা পাস, তার কারণ হল তোদের এই আনমনা ভাব। পেছনে যে বাড়ির একটা এতবড় পাঁচিল আছে, সেটা দেখতে পেলি না?”
গোল্লু  তেড়ে যাবার মতো করে বলল, “অ্যাই বার বার নম্বর নিয়ে খোঁটা দিবি না, বলে দিলাম। পাঁচিল আছে তো হয়েছেটা কী? তুই পাঁচিলে বসিসনি, বসেছিস গেটের সামনে। আর আমরা তার কারণ জানতে চাইছি। বলবি কী না!”   
“প্রতিবাদ চলছে। আমার অবস্থান। পাঁচিলের লেখাটা দেখ।”     
পাঁচিলের দেওয়ালে পোস্টার। লেখা আছে, রাজ্যের বেকারদের চাকরির দাবিতে অবস্থান। বাকিটা পড়া যাচ্ছে না...। 
“মানেটা কী? তুই বেকারদের চাকরির দাবিতে... হে হে হে হে... হি হি হি হি...” গোল্লু আর তিস্তু হেসে গড়িয়ে পড়ল। 
চং আড়মোড়া ভাঙল। হাই তুলল একটা। “তোদের কনশাসনেস জিরো। কিস্যু বুঝিস না, কেবল হ্যা হ্যা করে হাসিস। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে বেকারদের কাজের দাবিতে একটা অবস্থান করছি... আর তোরা এত অশিক্ষিত... তোদের মনেই হয় না, পড়াশুনো শেষ হলেও তোরা সেই বেকার, পড়াশুনো করতে করতেও বেকার...” 
চং হয়ত আরও কিছু বলত। রঙ্গনফুলের ঝোপের দিক থেকে একটা মোটা গলার ‘ম্যাঁও’ শোনা গেল। আর শোনামাত্র চং চনমন করে উঠল একদম। 
“তোরা মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছিস? যা ভাই। আমিও একটু দৌড়ে গা ঘামিয়ে আসি। বুঝিস না, প্রতিবাদ, বিপ্লব, অবস্থান, ধর্মঘট--- সবকিছুর জন্য আগে শরীর ফিট রাখতে হয়। তোরাও বরং হেঁটে আয়। একসঙ্গেই বসব বরং। পাড়ার লোকজন, প্রতিবেশীরাও ব্যাপারটা বুঝবে। ভালোই হবে, বল?” বলতে বলতেই চং উঠে দাঁড়ায়, আর এক লাফ মেরে উঠে পড়ে পাঁচিলের ওপর। পাঁচিলে থেকে ঝাঁপ দিয়ে রঙ্গনফুলের ঝোপের পাশে, আর তারপরেই হাওয়া।
তিস্তু আর গোল্লু ভ্যাবাচ্যাকা। হাঁ করে তাকায়। বন্ধু এসে খেলতে ডাকামাত্র সব প্রতিবাদ অবস্থান লাটে তুলে দিল? আর এতক্ষণ কত জ্ঞানগর্ভ কথা বলছিল! 
চং বড্ড বিচ্ছু। তিস্তু গোল্লুর চোখে চোখে কথা হয়। 
এবার থেকে চংকে কেউ দুষ্টু বললে ওরা আর প্রতিবাদ করবে না।


নিবন্ধ

রং তৈরির রঙিন গল্প
অদিতি ঘোষ দস্তিদার 

বিল্টু পড়ে ক্লাস থ্রিতে। থাকে বালিগঞ্জে। গত সপ্তায় বিল্টুর মামা এসেছেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। অতিমারির জন্যে মাঝে দুই তিন বছর আসতে পারেননি নিজের বেড়ে ওঠার শহরে, আত্মীয়স্বজন ভাইবোন বন্ধুবান্ধবদের কাছে। বিল্টুর মামার বাড়ি হাওড়ায়। কাল রাতে মামা আর মামি এসেছেন বিল্টুদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে। বিল্টু তো ভারী খুশি। তোমাদের মতো বিল্টুও খুব ছবি আঁকতে আর রং করতে ভালোবাসে – আর সে কথা মামা-মামি জানেন বলে মস্ত এক বাক্স মোম রং ওই যে গো তোমরা যাকে ক্রেয়ন বলো, তাই এনে দিয়েছেন।  
কাল রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিল্টুর খুব ইচ্ছে হয়েছিল যে একবার খোলে সেই রঙের বাক্স, কিন্তু রাত হয়ে গেছে আর পরদিন সকালে স্কুল – তাই বাধ্য হয়ে ঘুমোতে চলে গেছিল। ভেবেই রেখেছিল স্কুল থেকে ফিরেই বসে পড়বে আঁকতে আর রং করতে। 
বিকেল এখন। বিল্টু দাদু-ঠামুর ঘরের মেঝেতে বসেছে পেনসিল, রবার, আঁকার খাতা সব নিয়ে। বিছানায় বসে চা আর মুড়ি চানাচুরের খেতে খেতে গল্প জুড়েছেন বড়োরা। বিল্টুর দাদু খুব ভালো ছবি আঁকেন, তাছাড়াও নানান বিষয়ে ওনার আগ্রহ। বিল্টু দাদুর কাছে গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে। 
বিল্টুর মা বললেন, “বাবা আপনি প্রথম ওই রঙের বাক্স খুলে নাতির খাতায় কিছু একটা এঁকে দিন, তারপর বিল্টু আঁকবে।"
দাদু বললেন, "না, দাদুভাই তুমিই খোলো!"
বিল্টু তো মহা খুশি। প্লাস্টিকের কভার ছিঁড়ে বাক্স বের করে ঢাকনা খুলে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। সবার মন সেই দিকে। ওমা! হঠাৎ বিল্টুর এক বছরের বোন খেয়া দ্রুত হামা দিয়ে এসে চোখের নিমেষে একটা রং তুলে নিয়েই মুখে!
সবাই তো চমকে উঠেছে। বিল্টুর বাবা প্রায় বিদ্যুৎগতিতে ধেয়ে গিয়ে খেয়ার মুখ থেকে রং বের করে দিয়েছেন। বিল্টুর মায়ের মুখ একটু কাঁদো কাঁদো। দৌড়ে গিয়ে জল এনে ধুইয়ে দিলেন খেয়ার মুখে আর কচি দাঁতে লেগে থাকা রং। রং কেড়ে নেওয়ায় খেয়া জুড়েছে চিল চিৎকার! 
বিল্টুর দাদু বললেন, "আরে, কিচ্ছু হবে না, এ রং নন টক্সিক! বাচ্চাদের জন্যেই তৈরি করা। এ ক্রেওলা (Crayola) কোম্পানি কি আজকের? কত বছরের ব্যবসা ওদের! কত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবে এই সব ক্রেয়ন বাজারে এসেছে আর একশোরও বেশি বছর ধরে সুনাম ধরে রেখেছে।" 
বিল্টুর মামি হেসে বললেন, "আপনার ঝুলিতে নিশ্চয়ই এই ক্রেওলার গল্প আছে, তাই না মেসো?"
বিল্টু লাফিয়ে উঠল। 
"হ্যাঁ, দাদু বলো না গল্প এই রঙের!"
ইতিমধ্যে আর একপ্রস্ত চা এসে গেছে। খেয়া এখন শান্ত হয়ে মায়ের কোলে বসে দুধ খাচ্ছে।  
দাদু শুরু করলেন, “আচ্ছা, তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়ে কি ঝুল কাকে বলে জানো? দেখেছো রান্নাঘরে কখনো!"
বিল্টুর মামা বললেন, "হ্যাঁ মেসো, আমাদের ছোটোবেলা তো গ্রামেই কেটেছে, মাটির উনুন, কয়লার উনুন সব ছিল। ইয়া লম্বা লম্বা ঝুল দেখেছি!"
বাকি বড়দেরও ঝুল সম্বন্ধে কিছু না কিছু জ্ঞান আছে জানা গেল। বেচারা বিল্টুর মুখ শুকনো। সে তো কিছুই বুঝছে না। সবাই যখন কে কোথায় কী ঝুল দেখেছেন এই নিয়ে গল্পে মশগুল তখন ঠামু চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই আবার ফিরে এলেন হাতে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ আর একটা স্টিলের প্লেট নিয়ে। 
ঘরে ঢুকেই দাদু আর বাকিদের উদ্দেশ্যে একটু বকার সুরে ঠামু বললেন, “তোমরা তো তোমাদের ঝুল কালি নিয়ে নানান গল্প ফেঁদে যাচ্ছ বাপু, একবারও ভাবছো না, এই বাচ্চাটা যে গ্যাসের উনুন ছাড়া কিচ্ছু দেখেনি, হ্যারিকেন, কুপি কী তা জানে না, সে কেমন করে বুঝবে কাকে বলে ঝুল আর কাকে বলে কালি!”
“এই দ্যাখ সোনা!” বলে ঠামু প্রদীপের শিখার ওপরে উল্টে রাখলেন প্লেটটা। আস্তে আস্তে প্লেটটা কালো হয়ে গেল। ঠামু দেখালেন বিল্টুকে, “এই দ্যাখ, এই হচ্ছে কালি, অনেক কালি জমে জমে ঝুল বা shoot হয়, আর তোমাকেও বলিহারি বাপু, হচ্ছিল রঙের কথা তুমি চলে গেলে ঝুলকালিতে!” 
দাদু হেসে উঠলেন হা হা করে, "আরে গিন্নি, রেগে যাচ্ছ কেন! সব কিছুরই কারণ আছে! এই রং তৈরি তো প্রথম শুরু হয়েছিল ঝুল আর কাঠকয়লা থেকেই! কাঠ পোড়ালে যে শক্ত ছাই হয় তাই হল কাঠকয়লা বা চারকোল, বুঝলে দাদুভাই?” 
বিল্টুর মুখ হাঁ।  
ঠামুর মুখেও এখন হাসি, “ও এইবার বুঝেছি, এই দ্যাখ সোনা, এই কালি ঘিতে মাখিয়ে আগে ঘরে ঘরে কাজল তৈরি হত। তোর বোনের কপালে যে টিপটা, ও এই কালি দিয়েই!” 
“ঠিক! অনেকটা সেরকমই!” বলে চললেন দাদু! “এই ঝুল আর চারকোলের সঙ্গেই প্রকৃতি থেকে পাওয়া রং মিশিয়ে মধ্যযুগের শেষে ইউরোপে প্রথম তৈরি হয়েছিল ছোট ছোট মোমবাতির আকারের রং। গড়নটা অমন ছিল যাতে হাতে ধরে রং করতে সুবিধে হয়। এই যেমন তোদের ঠামু কাজল বানাতে মেশায় ঘি, তেমনি রঙে মেশান হত তেল। কিন্তু সেই রং খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি।"
"তাহলে এই ক্রেয়ন বানালো কারা?"
"আসছি সে কথায়। সময়টা আঠারোশ সালের মাঝামাঝি। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক রাজ্যের পিকসকিলে( Peekskill) জোসেফ বিনি নামে এক ভদ্রলোকের ছিল রঙের ব্যবসা। লাল আর কালো এই দুটো রংই বেশি বানানো হত তাঁর কোম্পানিতে। আমরা আমেরিকা বলতে শুধু ভাবি নিউইয়র্ক শহর আর ওয়াশিংটন ডিসি, কিন্তু আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল এলাকা জুড়ে কিন্তু গ্রাম, জানিস দাদুভাই!”
“হ্যাঁ রে বিল্টু, মাইলের পর মাইল ভুট্টা, আলু, টমেটোর ক্ষেত। আর মাঝে মাঝে লাল টুকটুকে বার্ন হাউস।” মামা ব্যাখ্যা করলেন। 
“বার্ন কী গো মামা?”
"বার্ন মানে গোলা, মামারবাড়ি গিয়ে ধানের গোলা দেখিসনি?" বিল্টুর মা বললেন। 
"হ্যাঁ, বার্ন মানে গোলা, কিন্তু আমেরিকার বার্ন কিন্তু আমাদের গোলার মত নয়, মস্ত মস্ত কাঠের বাড়ি। ভেতরে শস্য তো জমা করা থাকেই, আর থাকে চাষ বাসের জন্য দরকারি নানা রকম যন্ত্রপাতি, ট্র্যাক্টর এই সব। এই দ্যাখ বার্নের ছবি. আমার নিজের তোলা।" ফোন খুলে সবাইকে ছবি দেখালেন মামা।
"আচ্ছা, আবার গল্প শুরু হোক! সরি মেসোমশাই, আপনার কথা কাটলাম।"
"আরে না না! তুমি তো আমার সুবিধাই করে দিলে গল্প বলতে, বার্নের কথা বলে আর ছবি দেখিয়ে। তোমরা ছবি তো দেখলে, তবে জানো তো ঠিক ছবির মতোই আমেরিকায় যত বার্ন আছে সবার রং লাল, আর জানলা দরজাগুলো কালো, এখন হয়ত অন্য রঙের হয়, কিন্তু সে যুগে সব কালোই হত। লাল রঙে ব্যবহার হত রেড অক্সাইড বলে একটা যৌগ আর আর কালো রঙের জন্যে মূলত চারকোল। কিন্তু এই বিনি ভদ্রলোক রংএর ব্যাপারে বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। তাই তাঁর রং করা অন্যান্য জিনিস মানে ধরো গাড়ির টায়ার এই সবের কথা বেশ লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল।
"আঠেরোশো সালের শেষের দিকে জোসেফের রঙের কোম্পানির ভার নিলেন জোসেফের ছেলে আর ভাগ্নে। এডউইন বিনি আর হ্যারল্ড স্মিথ। এই দুই মামাতো পিসতুতো ভাই নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা শুরু করলেন রং নিয়ে, নতুনভাবে বানালেন জুতোর কালি, প্রিন্টিং এর কালি। লোকের মনে ধরল সেগুলো। এইবার শুরু হল স্কুলের বাচ্চাদের জন্যে স্লেট পেন্সিল বানানো। বিল্টুবাবু তোমার হাতে খড়ি হয়েছিল স্লেটে, লিখেছিলে যে পেন্সিল দিয়ে তেমনি..."
"আমি স্লেট কাকে বলে জানি দাদু!"  
সবাই হেসে উঠলেন। 
দাদু আবার শুরু করলেন, "স্লেট পেন্সিল তৈরির সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল ডাস্ট-ফ্রি চকের ভাবনাচিন্তা। চকের গুঁড়োয় কেমন হাত জামা কাপড় সাদা হয়ে যায়, দেখেছো তো! অনেকের আবার এলার্জি হয়, এই সব থেকে বাঁচা যাবে ডাস্ট ফ্রি চক তৈরি করতে পারলে, তাই না? 
"আবার একদিকে এই চক বা স্লেট পেন্সিলের পাশাপাশি এই দুই ভাই বের করে ফেললেন আর একরকমের মোম রং বা ওয়াক্স ক্রেয়ন- তেলের বদলে রঙের সঙ্গে মেলালেন মোম!"
"মোম! কিন্তু তুমি যা নিয়ে কাজ করো তার গায়ে তো লেখা অয়েল প্যাস্টেল!" কৌতূহলী বিল্টু।
"হ্যাঁ, তেল আর মোম দুইই চলে। প্যাস্টেল আর ক্রেয়ন মোটামুটি জাতভাই হলেও ব্যবহারে ফারাক আছে। আর ক্রেয়ন মোটামুটিভাবে ছোটোরাই ব্যবহার করে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম- মোম রংগুলো আসলে দরকার ছিল বাক্স, ট্রাঙ্ক, পিপে এই সবের গায়ে দাগ দেবার জন্যে।"
"পিপে কী তা আমি জানি দাদু! তুমি সেই যে গল্প বলেছিলে আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের, মর্জিনা কী রকম বুদ্ধি করে পিপের মধ্যে গরম জল ঢেলেছিল!"
"আরে, বিল্টুবাবু তুমি তো অনেক কিছু জান!" মুদ্ধ মামা!
"হ্যাঁ দাদুভাই, সেই পিপেই। কিন্তু এই মোম রং বাচ্চাদের পক্ষে খুব ক্ষতিকর মানে টক্সিক ছিল। সাবধানে রাখতে হত বড়দের, যেন নাগাল ছোটোরা না পায়।"
"হ্যাঁ, তাই তো! বোনু যেমন হঠাৎ করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল - বোঝার আগেই।"
খেয়া দুধ খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে। 
মা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, "সত্যি আমরা ভেবে দেখি না, কিন্তু একটা জিনিস তৈরি পেছনে কত ভাবনা থাকে, ভাগ্যিস ননটক্সিক বানিয়ে ছিলেন তাঁরা!"
"একদমই তাই। ১৯০০ সালের একদম গোড়ার দিকে, দুই ভাই বের করলেন এমন ক্রেয়ন, যা বাচ্চারা যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারে। নাম হল এই ক্রেয়োলা।..নাম দিলেন এডউইনের স্ত্রী অ্যালিস বিনি!দুটো ফ্রেঞ্চ শব্দ গেঁথে তৈরি করলেন নামটা। ‘craie’ মানে চক, আর ola যা এসেছে oleaginous থেকে – তার মানে তেলে ভেজা কোনো জিনিস।”
“বাঃ, দারুণ তো! সেই তখন থাকে আজও একই নাম রয়েছে!” মামা বিস্মিত!
“হ্যাঁ, সেই ১৯০৩ সাল থেকে!” দাদু উত্তর দিয়েই বিল্টুকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার রঙের বাক্সে কটা রং আছে দাদুভাই” 
"১২০টা!" 
“প্রথম তৈরি হয়েছিল আটটা রং, লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি, বাদামি আর কালো। দাম ছিল এক নিকেল, মার্কিনি ৫ পয়সা।”
বিল্টুর চোখ গোলগোল! 
মামি এবার ব্যাগ থেকে বের করলেন আরো দুটো বাক্স। 
"এই নে বিল্টু, আরো দুরকম এনেছিলাম, আমার ব্যাগে রয়ে গেছিল - খেয়াল ছিল না! মেটালিক আর গ্লো ইন দ্য ডার্ক ক্রেয়ন!"
"মানে রং করলে অন্ধকারে জ্বলবে! আরিব্বাস! ছবি এঁকে বন্ধুদের ভয় দেখাব! কিন্তু মেটালিক কী গো!"
"মেটাল মানে হল ধাতু, যা চকচক করে। রং করলে ওই মেটালের এফেক্ট আসবে। এখন তো রোজই আরো নানা ধরণের রং বের করছে ক্রেয়লা, নিত্য নতুন আকর্ষণ!"

গল্প করতে করতে কখন ঘড়ির কাঁটা রাত নটার দিকে পৌঁছে গেছে খেয়াল নেই কারোর, চমক ভাঙল অ্যালার্মের আওয়াজে। খাবার আগে দাদুর ওষুধ খেতে হয় - ভুল যাতে না হয় তাই মা ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছেন।
"ইসস, অনেক রাত  হয়ে গেল, চলো চলো খাবার গরম করতে হবে। খেতে খেতে হবে আবার অনেক গল্প হবে।"
ঠামু তাগাদা দিলেন।  
খাবার টেবিলে এসে দাদু বিল্টুর হাতে দিলেন একটা ছবি, চটপট স্কেচ করেছেন ক্রেয়নে। বিল্টু ছবি আঁকছে টেবিলে বসে আর মেঝেতে বসে খেয়া ক্রেয়ন চুষছে!
বাবা হেসে বলে উঠলেন, "এ তো ক্রেয়লার অ্যাড হয়ে গেল বাবা! ননটক্সিক ক্রেয়ন!"
মা বিল্টুকে বললেন, "যতই নন টক্সিক হোক না কেন, তোর রঙের বাক্সের নাগাল যেন বোনু না পায়। যত্ন করে গুছিয়ে রাখবি যাতে অনেকদিন ব্যবহার করা যায়। ভুলে যাস না এই ক্রেয়ন রঙের কোম্পানি ঐতিহাসিক, একশো বছরের বেশি পুরোনো!"



ছন্দেতে মাপা সাত ভাই চাঁপা 
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস 


সাত সাগরের ফেনা চেঁছে চেঁছে উঠেছে গল্প গাথারা,
     বাংলা ভাষার লোক সম্পদ,
     ঠাকুর মায়ের নিখাদ পরশ,
     ঘুম পাড়ানিয়া ছেলে ভুলানিয়া,
     আনে সুখ ঘুম, শান্ত হরষ,
চিরসম্পদ বাংলার ধন যেন জামদানি নকশী কাঁথারা। 

সাতটি রানির ঘর কন্যায় সে কোন দেশের একটি রাজন 
     ছিলেন বুঝি রাজার হালে,
     সন্তানসুখ নেই কপালে!
     ছয় বড় স্ত্রী খুব দেমাকি,
     আর যেই জন থাকলো বাকি
রাজার প্রিয়, শান্ত স্বভাব, রানির মধ্যে সেই ছোট জন। 

অনেক বছর কাটছে ধীরে মনের মধ্যে দুঃখ রাজার,
     এই যে এত ধন দৌলত,
     মাঠেতে ফসল, বন পর্বত,
     কে করে ভোগ? কোল যে ফাঁকা!
     কাদের জন্য এই গদি রাখা?
এমন সময় একটি খবর জ্বাললো আশার আলো হাজার। 

ছোট রানি মা হবে, তাই রাজ্যে বসে আনন্দ হাট,
     রত্ন মানিক খাবার দাবার,
     দরজা খোলা আসা যাবার,
     প্রজারা পায় বখরা খুশির,
     বড় রানিদের বুকে বেঁধে তীর,
ছয় হিংসুটে ছোটকে জব্দ করার জন্য বাঁধে  আটঘাট। 

রাজার কোমরে ছোটোর কোমরে সোনার শিকল বাধা,
     রাজা বলে, 'শিশু হলে দিও টান,
     হাজির হবোই আঁতুড়ে সটান'।
     বড়রা আগেই আঁতুড়ে হাজির,
     শিকল নাড়ালে রাজা অস্থির
হয়ে এসে শোনে নেই তো খবর, তবে কেন টান? ধাঁধা। 

সতর্ক করে যান বড়দের, অকারণে সাড়া পেলে
     সাজা বরাদ্দ, কাটবেন গলা,
     ছয় বড় জন করে ছলা কলা,
     সাত ছেলে এক মেয়ে পরপর,
     রাজার কানেতে দেয় না খবর,
চুপি চুপি সেই শিশুদের ওরা পাঁশশালে পুঁতে ফেলে। 

ছোট রানি শোনে মানুষ নয় তো, হয়েছে ইঁদুর বিছা,
     মূর্ছিত ছোট রানি পড়ে থাকে,
     রাজা ফিরে আসে শিকলের ডাকে,
     পুরুত ঠাকুর বরকন্দাজ
     নিয়ে ছুটে ফিরে আসে ফেলে রাজকাজ,
দেখে, সন্তান মানুষ তো নয়, যত আশা সব মিছা। 

সেই মুহূর্তে রাজপুরী থেকে ছোট হলো বিতাড়িত,
     বড়দের মুখে প্রশস্ত হাসি,
     রাজার মহলে বিষাদের বাঁশি,
     ছোট খায় ঘুঁটে কুড়িয়ে দু'বেলা,
     কত দুখ তার, শত অবহেলা,
আর ছয় জন নাচে গায়, খায় আনন্দে দুধ ঘৃত। 

খাঁ খাঁ করে রাজপ্রাসাদ, প্রজারা কষ্টে কাটায় দিন,
     রাজ্য ও রাজা দুই সুখহীন,
     "রাজ্যলক্ষ্মী হলে গৃহহীন
     এমনই হয় তো সর্বকালে",
     ভাবছেন রাজা হাত রেখে গালে,
এমন সময় রাজমালি আসে, কণ্ঠ যে তার ক্ষীণ। 

"ফুল নেই গাছে গোটা এলাকায়, এমন কান্ডখানা,
      রাজপুরোহিত খুব‌ই বিব্রত,
      রাজমন্দিরের রোজকার মতো
      পুজো হবে কিসে? ভেবে হয়রান,
      আমি পথে পথে করি সন্ধান
শুধু আটখানা গাছে আছে ফুল, যেন আট হীরে দানা। 

রাজবাড়ীর ওই পাঁশগাদা দিয়ে নেই আসা-যাওয়া আর,
      সাতটি চম্পা, একটি পারুল
      গাছ সুবিশাল, এক একটি ফুল
      ফুটে আছে, তারা কি যে অপরূপ!
     গন্ধে বাতাস হয়ে আছে চুপ,
কিন্তু সে ফুল ছিড়তে গেলেই তারা করে চিৎকার।" 

সে কথা শুনেই চলেন রাজন আটটি গাছের নিচে,
      পারুল ফুলটি বলে ওঠে কথা,
     "জাগো, জাগো, সাত চম্পক ভ্রাতা,
     রাজা নেবে ফুল",  বলে চাঁপা সব, 
     "বড় রানিমার খুব যে গরব!
পুজোর ফুল যে তিনিই পাবেন দাঁড়ালে রাজার পিছে।" 

বড় রানী এলো, তাই দেখে ফুল উঠল শতেক দূরে,
      ডাক পড়ে আর‌ও পাঁচ রাজ্ঞীর,
     দেখতে তামাশা জমে গেল ভিড়,
     পারুল চাঁপারা উঠল উচ্চে,
     কে জানি কি ছাই তাদের ইচ্ছে!
দুশ্চিন্তায় রাজার হৃদয় খাচ্ছে যে কুরে কুরে। 

চাঁপারা তখন করল হুকুম, "ফুল পেতে চাও যদি,
     নিয়ে এসো ঘুঁটেকুড়ানি দাসীকে,
    কোথায় সে থাকে? আছে সে কি টিকে?"
   এদিক ওদিক ছোটে পেয়াদায়,
   খুঁজে পেল তাকে গোবর গাদায়,
চৌদোলা গিয়ে নিয়ে এলো তাকে পেরিয়ে জমিন-নদী। 

ছেঁড়া শাড়ি, গালে গোবরের ছাপ, দাসী পৌঁছায় যেই
     পারুল চাঁপারা নামে নিচে ঝুপ,
     "মা, মা" ডাকে, কোলে পরে টুপ টুপ,
     ফুল নয়, তারা সাত রাজপুত,
     রাজনন্দিনী, রূপ অদ্ভুত,
কি অবাক খেল! পারে না হঠাৎ কেউ আর বুঝতেই। 

এবারে রাজার চোখে আসে জল, "কি ভুল করেছি হায়",  
     ফুটফুটে মেয়ে ছেলেগুলি তার,
     পায়নি তো কোল দুঃখিনী মা'র,
     বড় রানিদের হিংসের বিষে
     জীবনটা তাঁরও যাচ্ছিল পিষে,
রাজাদেশে ছয় বজ্জাত রানি কঠিন দন্ড পায়। 

জয় ডঙ্কায় ভরে চার দিক, জ্বলে ওঠে আলো-বাতি,
     রাজপুরী জুড়ে খুশির বন্যা,
     ছোট রানী, আট পুত্র কন্যা
     ফিরে পেল ঘর ভাগ্যের জোরে,
     আজও ঘরে ঘরে এ কাহিনী ঘোরে,
ঠাকুমা দিদার শব্দবুননে মাতে নাতনি ও নাতি।



দুনুর বন্ধু
পায়েল চট্টোপাধ্যায়


-"এই দুনু! লাগছে আমার। আরে বাঁশটা সরা"। 
কে বললি রে? আচমকা এমন মখমলি গলায় চমকে উঠে দুনু লাফিয়ে পড়ল পাশের উঁচু রাস্তাটার উপর। দুনুদের বাড়ির পাশে সবুজ চাদরের মত একটা ঘাসসমেত মাঠ রয়েছে। এই মাঠেই খেলে সবকটা। একটু পরেই এসে জড়ো হবে সকলে। দুনু, লাড্ডু, টিপাই, পিসুন। আজ ফুটবলের দিন।

দুটো সরু বাঁশের লগা পুঁতে রাখতে এসেছিল দুনু। গোলপোস্ট তৈরি হবে।‌ দুধু একটা ছোট কাস্তে নিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। ভাগ্যিস বাবা বাড়ি ছিল না! নইলে এসব কাস্তে-টাস্তে হাতে দেখলেই পিঠে রদ্দা! মা দেখেছে তবে। কিছু বলেনি দুনুকে। মিথ্যে কথা না বললে, কারোর ক্ষতি না করলে মা একেবারে বকে না। মা ঠিক ঘাস মেলা মাঠের মত। জড়িয়ে ধরে সবসময়। মাকে তাই বলে এসেছে দুনু। 

''আমি এই সরু লগা দুটো পুঁতেই চলে আসব।'

-''তাড়াতাড়ি চলে এসো, আবার তো এসে খেলতে যাবে। বাবা এসে তোমায় না দেখতে পেলে খুব রেগে যাবে।"

মায়ের কথায় বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়ে দুনু। মা ওরকম বলে। বাবা এসে খোঁজ করলে মা বলবে "এসে যাবে এখনই, মুড়ি আনতে পাঠিয়েছি, আর সমীরদের দোকান থেকে একটা অপরাজিতা গাছের চারাও আনতে বলেছি।"

কথাটা বলেই দরজায় পরীদের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে মা। দুনু দূর থেকে দৌড়ে আসবে। ঘাম-কাদা মেখে জড়িয়ে ধরবে মাকে। এদিকে বাবা একেবারে শান্ত হয়ে বসে রয়েছে। গাছের কথা শুনলেই বাবার মুখে আলো ফোটে। দুনু বাড়ি ফিরলেই মা ওকে গাছ আর মুড়ির ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। মা হয়তো সকালেই গাছের চারাটা এনে রেখেছে। টবসমেত চারাগাছ দেখাবে বাবাকে। দুনু সন্ধ্যার পর নিশ্চিন্ত হয়ে বাবার কাছে পড়তে বসবে।

আজ তবে সবটাই অন্যরকম। খানিকক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে, এই বলেই বেরিয়েছিল ও। এতক্ষণে মা নিশ্চয়ই দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবা বাড়ি এসে বকাবকি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু যাই হয়ে যাক, এমন অদ্ভুত ঘটনার পর এখনই যাওয়া যায় নাকি? দূর দূরান্তে কেউ নেই! এমনকী নিস্তব্ধ রাস্তাটায় পচার সাইকেলের ট্রিংট্রিংও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তাহলে কে এমন মিহি সুরে কথা বলল! সে আবার দুনুর নাম জানে! 
এর মধ্যে আচমকা রাস্তায় পড়ে গিয়ে পায়ে লেগেছে দুনুর। মাঠের যে জায়গাটা থেকে কথাগুলো শুনেছিল দুনু আবার ফিরে এলো সেখানে। এমন একটা আগ্রহের বিষয়! ছেড়ে যাওয়া যায় নাকি! 

-" এই দুনু! আমরা ডেকেছি রে তোকে! আমরা! তোকে আমরা অনেকদিন ধরেই চিনি। তাই তোর নাম জানি।"
কেউ কোথাও নেই। অথচ দিব্যি শব্দ ভেসে আসছে। ঠিক ভেসে আসছে না, কেউ যেন কথা বলছে। সরু, মিহি স্বর। ঝাঁ-ঝাঁ করা রোদ চারিদিকে। দুপুর আর বিকেলের মাঝের রোদমাখা জনহীন প্রান্তরে দুনুর সমস্যা কে মেটাবে?

যেদিকটায় বাঁশগুলো এনে গোলপোস্ট পুঁততে শুরু করেছিল দুনু, কথাগুলো বোধহয় সেই দিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। ওদিকের ঘাসগুলো কী মাথা দোলাচ্ছে? দুনু ঘাসগুলোয় কান পাতে। মিহি সুরে কান্না শোনা যাচ্ছে। যা বাব্বা, এমন আবার হয় নাকি!
-'' এই দুনু, আমরাই কথা বলছি। শোন, তোদের এই খেলার মাঠ আর থাকবে না, অনেকে মিলে এখানে বড় বড় বাড়ি তৈরি করবে, সেই সব বাড়িতে অনেক মানুষ থাকবে। তোদের আর খেলার জায়গা থাকবে না। আমরাও আর থাকব না! কিছু কর তুই দুনু।"

কথাগুলো ধীরে ধীরে বলছে কেউ। কিন্তু স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই সময়টায় সাইকেলের ট্রিং ট্রি ং আওয়াজ আজ টিপাইয়ের বোনের কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না ‌। এমন নিস্তব্ধ জায়গায় দুনু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে । তার মানে ঘাসেরা কথা বলছে! এমন আবার হয় নাকি? 
দুনুর তবে আনন্দ হচ্ছে। এমন আশ্চর্য বিষয়ে খুশি না হয়ে কোন উপায় নেই! 
তবে এই আনন্দ বেশিক্ষণের নয়! ওরা যে বিপদের কথা শোনাচ্ছে। সব ঘাস নষ্ট করে দেবে ওরা! 
মাঠের এই জায়গাটায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে বাঁশ পোঁতে দুনু। তাই দিয়ে গোলপোস্ট তৈরি হয়। ওরা খেলে। আচ্ছা তখনো কি ঘাসেদের কষ্ট হয়? কোনদিন তো ভেবে দেখা হয়নি। দুনু ঘাসেদের এই কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

-" নারে তোদের নরম পায়ে একটুও ব্যাথা লাগে না আমাদের। বরং তোরা খেললে আমাদের আনন্দ হয়।"

দুনু খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়। যাক বাবা, ওদের জন্য এই ঘাসেদের কষ্ট হয় না। একটা হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাস কথা বলে।

-''শোন আমরা সব পরিবার নিয়ে থাকি এখানে। তোকে কিছু একটা করতেই হবে। বাঁচাতেই হবে আমাদের। আর নিজেদের খেলাটাকেও বাঁচাতে হবে।"

একটা ছোট্ট কচি ঘাস কথা বলে এবার।
-"আমাদের বিপদে একমাত্র তোমার কথাই মনে পড়ল। তোমার অন্য বন্ধুরাও খুব ভালো। কিন্তু আমার মনে হয় তুমিই আমাদের বাঁচাতে পারবে।"

ছোট ঘাসটার কথায় দুনু বেশ অবাক হয়। দুনুর এই বন্ধুরা ওকে বিশ্বাস করছে। দায়িত্ব নিতে বলছে। কিন্তু দুনু একা একা কী করবে? তবে এই খেলার মাঠটা ওদের খোলা আকাশ। প্রতিবছর পূজোর পর সকলে মিলে এখানে চড়ুইভাতি করে। শীতকালে কত পাখি আসে। এই সবকিছুর বদলে সারাদিন যদি ধুলোবালি ওড়ে! দুনুদের ওপরের ঘর হওয়ার সময় দেখেছে, নতুন বাড়ি তৈরি মানেই সারাদিন আওয়াজ, ধুলো, নোংরা। আর এরা তো বলছে শুধু একটা বাড়ি নয়, অনেক বাড়ি তৈরি হবে। দুনুর কান্না পায়। হঠাৎ কেঁদে ফেলে। কুচি ঘাসটা আবার কথা বলে।
-''কাঁদলে হবে না দুনু। তুই কিছু একটা ব্যবস্থা কর। বাড়ি যা তাড়াতাড়ি।"
বেশ তাড়াহুড়ো করেই বাড়িতে চলে আসে দুনু। ওদের সকলের খেলার সময় হতে একটু বাকি আছে। একটু পরেই টিপাই, লাড্ডু ডাকতে আসবে। কিন্তু মাঠে ফিরে এলেই আবার ঘাসেরা জিজ্ঞেস করবে। 

বাড়িতে মা নেই বোধহয়। বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। দুনু বাবার পাশে বসে। কিন্তু কাকে বলবে ও এসব কথা? আর কে বিশ্বাস করবে? বাবাকে কি বলে দেখবে?

-''কিরে কিছু বলবি?"
বাবা যেন মনের কথা পড়ে ফেলছে।

বাবা দুনুর মাথায় হাত রাখে। দুনুর মনে হয় বাবার হাতগুলো ঘাসের মতই নরম। বাবা মিষ্টি করে তাকিয়ে আছে দুনুর দিকে।  ঘাসেদের মত জড়িয়ে ধরে। দুনু বাবাকে জড়িয়ে ধরে সবটা উগরে দেয়। বাবার মুখটা কেমন যেন মেঘমাখানো আকাশের মত হয়। তবে খানিক বাদেই আলোর মত দেখায় বাবাকে।

বাবা চন্দ্রনাথ কাকুকে ফোন করে। বাবার বন্ধু চন্দ্রনাথকাকু। এ পাড়ায় সকলেই কাকুকে একডাকে চেনে। কাকুও সকলকে ভালোবাসে। এই অঞ্চলের যে কোন সমস্যা কাকু মিটিয়ে দেয়। সেই তো সেবার পিসুনদের বাড়ির কাছে ওপারের ছেলেগুলো অকারণ হই-হল্লা করছিল। পিসুনের দাদুর খুব শরীর খারাপ তখন। মাইকের আওয়াজে দাদুর খুব কষ্ট হচ্ছিল। চন্দ্রনাথকাকুই সকলকে বুঝিয়ে-সুুঝিয়ে বিদায় দিয়েছিল।

 দুনুর বন্ধুদের সমস্যাও কাকু নিশ্চয়ই মেটাতে পারবে। এখন দুনুর টেনশন হচ্ছে। বাবা এখনো ফোনে কথা বলছে। বাবাকে ম্যাজিশিয়ানের মতো দেখতে লাগছে দুনুর।

-"চন্দ্রনাথ কাকু তোদের সকলকে একসঙ্গে যেতে বলেছে ওদের বাড়ি।"

-"তুমি কি ওই ঘাসেদের কথা বলার ব্যাপারটা কাকুকে জানিয়ে দিলে?"
দুনু কাঁচুমাচু মুখে প্রশ্ন করে। বাবা দুনুর মাথায় হাত রাখে।
-'' বাবা তোর থেকেও বেশি তোকে বোঝে।"
দুনুর মুখে হাসি ফোটে। 

দুনু, লাড্ডু, টিপাই, পিসুন সকলেই একসঙ্গে যাচ্ছে চন্দ্রনাথ কাকুদের বাড়ি। দুনু সকলের আগে।

-'' এই দুনু, তোর বাবা মাঠে বসে কী করছে? ঘাসেদের সঙ্গে কথা বলছে নাকি?"

লাড্ডুর প্রশ্নে সকলে হো হো করে হেসে ওঠে। শুধু দুনু অবাক হয়ে তাকায়। মাঠের যে অংশটায় দুনু ঘাসেদের সঙ্গে কথা বলছিল, সেখানে হাঁটু মুড়ে বসে বাবা বিড়বিড় করছে। ঘাসেদের কাছে কান পাতছে। ওদের গায়ে হাত বোলাচ্ছে। দুনু চমকে যায়। তবু বাকিদের কাছে প্রকাশ করে না সবটা। বরং সকলকে ধমক দেয়।

-''দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবি নাকি তোরা? চন্দ্রনাথকাকু কোথাও বেরিয়ে গেলে তখন অসুবিধায় পড়ব আমরা। আমাদের খেলার মাঠ বাঁচানোর দায়িত্ব তো আমাদের।"
দুনু গটগট করে এগিয়ে যায়। 
লাড্ডু, টিপাই, পিসুন কথা না বাড়িয়ে দুনুকে সঙ্গ দেয়।



ধারাবাহিক উপন্যাস

শয়তানের উঁকি
তপশ্রী পাল

মিস্টার পাকড়াশী চিন্তিত মুখে বললেন “সেটাই কথা! কী লাভ? আচ্ছা, তোমরা কি এই স্টাডি মেটিরিয়াল পেয়ে গেছো?”
“হ্যাঁ”
“কবে পেয়েছো?”
“ঐ যেদিন আমাদের লাস্ট ক্লাস হলো আর ম্যাম বললেন বিশাখা মিসিং হয়েছে – সেইদিন বিকেলে মাঠ থেকে ফিরে দেখি প্যাকেটটা রাখা আছে!”
“ঐশিকা তুমি কবে পেলে?”
“ঐদিনই পেয়েছি!”
“কিসে এসেছিলো প্যাকেটটা?”
এবার প্রোটন বললো “মা বলেছিলেন কুরিয়ার এসে কী একটা প্যাকেট দিয়ে গেছে”
“তার মানে কুরিয়ারে এসেছিলো প্যাকেট! আচ্ছা বিশাখার প্যাকেট পেয়েছিলেন আপনারা?”
“না তো!”
“এইখানেই গোলমাল! খুব সম্ভব কুরিয়ারের ছেলেটিকে ট্যাপ করা হয়, যখন সে আপনাদের বাড়ির সামনে আসে এবং তার কাছ থেকে প্যাকেটটি, এই বাড়ির লোক পরিচয় দিয়ে কে বা কারা হয়তো নিয়ে নেয়।“
এবার বিশাখার বাবা বললেন “ধুর! স্টাডি মেটিরিয়াল নিয়ে বদমাইশরা কী করবে? আমার মেয়েকে পাচ্ছি না সাত দিন হতে চললো আর আপনারা কী সব অদ্ভুত কথা বলছেন! তাড়াতাড়ি যেখান থেকে হোক ওকে উদ্ধার করুন! নইলে মেয়েটাকে আর জ্যান্ত ফেরত পাবো না!”
মিস্টার পাকড়াশী বললেন “স্টাডি মেটিরিয়াল নয়! এখানে উদ্দেশ্য অন্য! কাজের মেয়েটিকে দু ঘন্টার জন্য বিদায় করা হলো। এবার বিশাখা কোনমতেই দরজা খোলার কথা না। কিন্তু সে দরজা খুলেছিলো। এমন কিছু একটা বলা হয় যাতে সে দরজা খোলে! সম্ভবতঃ কেউ কুরিয়ার সেজে দরজায় এসে বলে যে স্কুলের স্টাডি মেটিরিয়াল এসেছে! বাধ্য হয়ে বিশাখা দরজা খুলে সেটা নিতে যায় এবং তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়!”
প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন বিশাখার বাবা “কিন্তু কেন? কারা করলো পুলিশ তো কিছুই বলতে পারছে না! টাকা পয়সাও তো কেউ চায়নি! কে নিয়ে গেলো মেয়েটাকে!”   

মিস্টার পাকড়াশী বিশাখার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনি কী করেন?”
“আমার ব্যবসা আছে বাথরুম ফিটিং এর। বড় বাজারে। আমাদের অনেককালের পারিবারিক ব্যবসা।“
“মনে হচ্ছে এটা পয়সার জন্য কিডন্যাপিং নয়, সাত দিনেও কেউ যখন ফোন করলো না। আচ্ছা, আপনার কি কোন শত্রু আছে? এমন কেউ যার আপনার প্রতি প্রচন্ড রাগ কোন কারণে!”
“ব্যবসার ফিল্ডে তো কেউ তেমন নেই।“
“আত্মীয়স্বজন কেউ –“
এবার বেশ ইতস্ততঃ করে বিশাখার বাবা বললেন “আমি এই ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে বলতে পারছি না। আপনি এদের একটু বাইরে বসতে বলুন।“ প্রোটন, নিউট্রন আর ঐশিকাকে নিয়ে বিশাখার মা ভিতরে গেলেন। বললেন “আমার মনের অবস্থা বুঝতেই পারছো! নইলে এই পুজোর দিনে তোমাদের এতোক্ষণে কতো কী খাওয়াতাম! যাই হোক একটু সরবত খাও।“ প্রোটনরা আগের ঘরের লাগোয়া আরেকটি ছোট ঘরে বসেছিলো। বিশাখার মা সরবত আনতে যেতেই প্রোটন দরজায় কান পাতলো। 
বিশাখার বাবা বলছেন “আমার ছোটভাই ছোটবেলায় বখে যায়। ওর পড়াশোনা হয়নি। অনেকদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। শুনেছি নানারকম চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। দু একবার জেলও হয়। এই গতবছর লকডাউনের সময় কোথা থেকে এসে হাজির হয়। বলে বাড়ির ভাগ চাই।“
“তারপর?”
“আমি দিতে অস্বীকার করি, কারণ বাবা এ বাড়ি আমাকে দিয়ে যান। ওকে এখানে থাকতে দেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব ছিলো! তাও ও জোর করে গুন্ডা নিয়ে এসে ওধারের কয়েকটা ঘর দখল করে থাকতে শুরু করে। পুলিশকে জানিয়ে কোন লাভ হয়নি। পুলিশ কোন সাহায্য করেনি। আমরা কোনরকমে চোখ কান বুঁজে চালাচ্ছিলাম। কিন্তু ক্রমে ওর ঘরে নানা আজেবাজে লোকজন আসতে শুরু করে। মাঝরাতে কিসের ট্রাক এসে থামতো – মালপত্র উঠতো। তারপর একদিন পুলিশ রেড হয়। ওর ঘর থেকে প্রচুর কোকেন পাওয়া যায়! পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু কী করে জামিন পেয়ে যায় ও! তখন আমি আর কোন উপায় না দেখে ওর নামে মামলা করি যে ও আমার বাড়িতে জবরদখল করেছে। মামলায় আমি জিতে যাই, কারণ ওর কাছে সম্পত্তির কোন কাগজপত্র ছিলো না। কোর্টের পারমিশন নিয়ে ওকে এখান থেকে তাড়ানো হয়।“

“তাহলে তো শত্রু আপনার ঘরেই! কিন্তু সে বিশাখাকে নিয়ে কী করেছে সেটাই এখন দেখার। যাই হোক, আমরা আজ উঠি। আজকালের মধ্যেই খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি।“
       
“জানি না স্যার, আমরা খুব চিন্তায় আছি! আমার মেয়েটাকে বাঁচান!”

বিশাখাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা মোড় ঘুরতেই খুব বড়ো একটা নাম করা পুজোর প্যান্ডেল! খুব ঢাক বাজছে! এমনিতে এতো দূর আসা হয় না। তাই প্রোটন বললো “চল না দাদা, ঠাকুরটা দেখে আসি!” মিস্টার পাকড়াশী বললেন “দু মিনিটে ঘুরে আসবে কিন্তু! আমি দাঁড়াতে পারবো না!”

প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখছিলো প্রোটন, নিউট্রন আর ঐশিকা! এই সেই সোনার ঠাকুর! অনেক নাম শুনেছে ওরা! প্রত্যেকবারই এই প্যান্ডেলে ভীড়ের ঢল নামে। হঠাত প্রোটনের পিছনে একটা লোক বলে উঠলো “স-স-সরো দে-দে-দেখি! এ-এ-এ-ক্কানে দাঁড়াবার নিয়ম নে-নে-নে-হে-ই” হঠাত প্রোটনের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো! বিশাখাদের কাজের লোক বলেছিলো না পুলিশকে যে ওকে যারা রাস্তায় ধরেছিলো তার মধ্যে একজন খুব তোতলাচ্ছিলো! নিউট্রনকে কানে কানে বলে প্রোটন। নিউট্রন বলে “আরে তোতলা লোক তো কতই আছে!” বলতে বলতেই দেখে, লোকটা ওদের দিকে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ধীরে ধীরে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে – প্রায় দৌড়োতে শুরু করেছে! মূহূর্তের মধ্যেই প্রোটন আর নিউট্রন ঐশিকাকে বললো পাকড়াশী স্যারকে সব বলতে আর ছুটতে শুরু করলো লোকটার পিছনে! 

অলি গলি দিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে লোকটা হঠাত একটা বাঁশের ব্যারিকেডের সামনে এসে পড়লো! এই পুজোর জন্য চারিদিকে ব্যারিকেড! এবার আর যাওয়ার জায়গা নেই! লোকটা ব্যারিকেডের ওপর উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়লো! আর নিউট্রন গিয়ে খপাত করে লোকটার ঘাড় ধরলো! বললো 
“পালাচ্ছেন কোথায়? কেন পালাচ্ছেন?”
“না-না-না-মানে-“
“চলুন আমাদের সঙ্গে”
লোকটাকে নিয়ে গাড়ির সামনে ফিরে এলো ওরা দুজন! পাকড়াশী আঙ্কল গাড়িতে তুলে নিলেন লোকটাকে! বললেন “তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে ড্রাইভার। আমি দেখছি একে!”
সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে গেলো ওরা। প্রোটনের মা তো ওদের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন! বললেন “তোরা কি মারামারি করে এলি? আর কোত্থাও বেরোতে হবে না! খেয়েদেয়ে একদম ঘুম!”
চারটের সময় ঘুমিয়ে সাতটা নাগাদ ঘুম ভাঙলো ওদের। সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রন মিস্টার পাকড়াশীকে ফোন করলো। বললো “কিছু বললো লোকটা?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব বার করে ছেড়েছি পেট থেকে! বিশাখার কাকাই ওদের দলটাকে লাগায় বিশাখাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য! ফোন আগেই হ্যাক করা ছিলো। অনলাইন ক্লাসেও অন্য কোন ব্যক্তি ঢুকেছিলো। ওরা ও সম্বন্ধে কিছু জানে না। ওদের বিদ্যেয় কুলোবেও না। ওদের বলা হয়, ঐদিন কাজের মেয়েটিকে সরিয়ে দিতে হবে। তারপর বিকেলে কুরিয়ার এলে, তার কাছ থেকে স্টাডি মেটিরিয়ালের প্যাকেটটা নিয়ে নিতে হবে। তারপর বিশাখা কুরিয়ার ভেবে দরজা খুলে দিলে ওকে তুলে নিতে হবে। ওরা বিশাখাকে তুলে ওর কাকার কথামতো এয়ারপোর্টের ধারে একটা ধাবায় ছেড়ে দেয়। তারপর ওর কী হলো ওরা সেটা একেবারেই জানে না। অনেক মেরে ধরেও এর থেকে বেশী কিছু ওর থেকে বার করতে পারিনি! মনে হয় সত্যিই জানে না।“
“তাহলে এবার?” 
“তাই তো – দেখি ঐ মোবাইলের আই এম ই আই নম্বরটা বার করা যায় নাকি। তোমরা বেশী চিন্তা কোরো না। কিছু পেলেই জানাচ্ছি।“
(ক্রমশ)


শরৎ এলো 
রূপা চক্রবর্ত্তী 

 নীল আকাশে কে ভাসালো 
 সাদা মেঘের ভেলা ---
 বর্ষা রানীর সারা হোলো 
 লুকোচুরি খেলা |
 
 টাপুর টুপুর বৃষ্টি মানেই 
 ছন্দে নেচে ওঠা ---
 তারই তালে জেনো সবাই 
 পদ্ম জলে ফোটা |

 ভ্রমর ছোটে গুনগুনিয়ে 
 মেখে শরৎ আলো ---
 আসছে পুজো দুর্গামায়ের 
 ঘুচাতে সব কালো |

 নতুন নতুন জামা জুতো 
 কেনার পালা শুরু ---
 এমন সময় পড়ার কথায় 
 হয় যে বাঁকা ভুরু |


ম্যাজিক মাঞ্জা
ব্রততী সেন দাস

বন্ধ জানলায় ঠক ঠক শব্দ!
দুপুরবেলা চরাচর নিঝুম,কালীপুজোর পর থেকেই শীত আসি আসি করে।তাই ঘরের জানলা বন্ধ করে রোহন ছুটির হোম ওয়ার্ক করতে বসেছে।অন্যঘরে মা আর বোন বাবলি ঘুমোচ্ছে।বাবা ডিউটিতে গেছেন।জানলাটা ফাঁক করে দেখে মালো পাড়ার উদয় জানলায় টোকা দিচ্ছে।রোহনকে দেখে ফিস ফিস করে বলল-কবে এলি?
রোহনও খুব নীচুস্বরে বলল-ছুটি পড়তেই এসেছি।তুই কোথায় ছিলি?
-মামাবাড়ি…আজ সকালেই ফিরেছি।
-আমি তো ভাবলাম তুই না বলে কোথায় চলে গেলি?
-আরে,কথা দিয়েছি যখন তখন ঠিক কথা রাখব
-হুম…বিকেলে মাঠে দেখা হবে।
-না না,মাঠে নয় ,তেঁতুলতলায় আয়।
-মাঠে নয় কেন,আজ খেলবি না?
-না রে,শরীরটা ভাল নয়।

রোহন কলকাতায় থাকে মা আর বোনের সঙ্গে,মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করে ,ছুটিতে ছুটিতে বাবার কাছে আসে।ওর বাবা দিব্যন্দু রায় বেঙ্গল পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার,বর্তমানে কোচবিহারে জেলার দিনহাটায় পোস্টেড। রোহনরা প্রতি ছুটিতে এসে এসে এই জায়গাটা ভালবেসে ফেলেছে।কলকাতায় ওরা থাকে  বদ্ধ ফ্ল্যাটে আর পড়ে সাহেবী স্কুলে।রীতিনীতি আর কেতায় মাপা ওর জীবন।আর এখানে সব কিছু খোলামেলা। মস্ত বড় বাংলো ,পাঁচিলের বাইরে উন্মুক্ত সবুজ প্রকৃতি।রোহন ভিষণ মিশুকে,প্রতিদিন বিকেলে ওর মা ওকে খেলার অনুমতি দিয়েছেন।মাঠে খেলতে গিয়ে অনেক ছেলের সাথেই ওর বন্ধুত্ব হয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বেশী বন্ধুত্ব উদয়ের সঙ্গে।কারণ উদয় খুব ভাল স্পোর্টসম্যান আর ডানপিটে।শহরের বন্ধুদের মত ভীতু ভীতু নয়।ও ওর মায়ের সঙ্গে থাকে,বাবা মারা গেছে।ওর মা হাসপাতালের গ্রুপ ডি কর্মী।
উদয় সারাদিন মাঠে-ঘাটে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।পড়াশোনায় মোটেই মন নেই,হাডুডু-দাঁড়িয়াবান্ধা-গোল্লাছুট-ফুটবল খেলায় খুব চোস্ত।তবে সবচেয়ে দক্ষ ঘুড়ি ওড়ানোতে।রোহন ওর ওই ঘুড়ি ওড়ানো দেখে মুগ্ধ কেননা কলকাতায় ও নানা খেলায় পারদর্শিতা অর্জন করলেও কোনদিন ঘুড়ি ওড়ায়নি।হাতে সুতো ধরা আর সুদূর আকাশে পেটকাটি ,শতরঞ্চি,বগগা, চাদিয়াল ঘুড়িগুলো  সোঁ সোঁ করে উড়ছে  তো উড়ছে, উঁচু থেকে আরো উঁচুতে উঠে একটা ছোট্ট বিন্দুতে পরিণত হয়েছে ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়।কী দক্ষতার সঙ্গে উদয় তাকে ডানে- বাঁয়ে ওড়ায় , হ্যাঁচকা টানে ঘুড়ির রাজ্যে অন্য ঘুড়িকে ভোকাট্টা করে জিতে ফিরে আসে।রোহন উদয়কে জিজ্ঞেস করে-কী ভাবে তুই এত ঘুড়ি ভোকাট্টা করিস রে ?উদয় বলে -আমার লাটাইয়ের সুতোয় ম্যাজিক মাঞ্জা আছে।
-ম্যাজিক মাঞ্জা?
-হ্যাঁ, আমার মামা এই যাদু লাটাই তৈরি করে দেয়।
-আমায় দিবি রে?
-নিশ্চয়ই দেব,তার আগে ঘুড়ি ওড়ানো তো শেখ।তুই হলি গে কলকেতার নবাববাহাদুর ,হি হি হি!
উদয় ওকে এই নামেই খেপায়।

সেবার রোহনের সারা ছুটিতেই ঘুড়ি ওড়ানোর দক্ষতা অর্জন করতেই চলে গেল।শিদলডাঙার বিশাল মাঠ ,সেখানে টাউনের সব ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াতে আসে।বড় ছেলেরা পয়সা বাজি ধরে খেলে। অমন চারদিক খোলা উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘুড়ি ওড়ানোয় এক অপরিসীম উল্লাস , মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের সাথে বন্ধুত্বের রোমাঞ্চই আলাদা !উদয় ওই মাঠে ঘুড়ি কাটার চ্যাম্পিয়ন।ওকে কেউ হারাতে পারে না।ও বলে-পারবে কী করে,ওদের তো আমার মত সুতা নাই।এই স্পেশাল সুতা আমার মামা দিসে।
রোহনের ঘুড়ি ওড়ানো তো শেখা হল কিন্তু ঘুড়ি ভোকাট্টা করতে হলে ভাল মাঞ্জা দরকার।রোহন বলে-আমাকে তোর মামার জাদু লাটাই এনে দে।
-ঠিক আছে, পুজোর সময় এলে তোকে মামা বাড়িতে নিয়ে যাবো,যাবি?
-যাব।আমি ভাল করে ঘুড়ি ওড়াতে শিখে ইন্টারন্যাশনাল কাইট ফেস্টিভ্যালে যাব,ঘুড়ি উড়িয়ে প্রাইজ জিতে নিয়ে আসব!
-কিন্তু কাউকে বলবি না,যদি বেশি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে যাদু লাটাইয়ের গুণ নষ্ট হয়ে যাবে।উদয় বলে মামার এই লাটায়ের কথা দেশ বিদেশের অনেকেই জানে প্রতিবার ঘুড়ি ওড়ানোর ওস্তাদরা গুজরাট,তেলেঙ্গনা,রাজস্থান এমন কি চীন জাপান থেকে এসে মামার থেকে যাদু লাটাই কিনে নিয়ে যায়।
ছুটি শেষ হতে রোহন আবার কলকাতায় ফিরে গেল ।তবে ওখানে গিয়ে শুধু অপেক্ষা করতে লাগল কবে উদয়ের মামাবাড়ি গিয়ে যাদু লাটাই সংগ্রহ করবে।পুজোর ছুটি শুরু হতে দিনহাটায় বাবার কাছে  এলো।কিন্তু উদয়ের কোন হদিশ নেই।কেউ বলতে পারল না ও কোথায় গেছে ।খুব হতাশ হয়ে পড়ল রোহন,তাহলে কি যাদু লাটাই পাবে না? 
ফিরে যাওয়ার আর এক সপ্তাহ বাকি তখন হঠাৎ একদিন উদয় কোথা থেকে এসে উদয় হলো।
বিকেলে তেঁতুলতলায় রোহন আর উদয়ের দেখা করে প্ল্যান করল পরদিন দুপুর নাগাদ ওরা উদয়ের মামাবাড়ি কেসুগ্রাম যাবে।বেশি দূর নয়, হেঁটেও যাওয়া যায় আবার ভ্যান রিক্সাও যাওয়া যায়।উদয় বলল- আমি সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাব তাহলেই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।

দুপুরে মা-বোন বিশ্রাম নিচ্ছে এই ফাঁকে দুজনে রওনা হলো।সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল,এক্টু পরেই ঝরো হাওয়া শুরু হল।যত এগোচ্ছে তত যেন মানুষের বসতি কমে ক্রমে ক্রমে জায়গাটা নির্জন হয়ে যাচ্ছে।একটা জঙ্গুলে জায়গা, দুপাশে বড় বড় গাছ,মাঝখান দিয়ে  সুঁড়িপথ।একেবারেই নিরিবিলি।ঝরো হাওয়ায় গাছগুলো খুব দুলছে,এখুনি বৃষ্টি শুরু হল বলে।রোহন সাইকেলের সামনের রডে বসা,উদয় ওকে এমন ভাবে চালিয়ে আনল যেন ওর শরীরে কোন ওজনই নেই।পালকের মত হালকা।দুপাশে উঁচু গাছ , ঘন বুনোট আগাছা লতার জঙ্গল আর নির্জনতায় কেমন গা ছমছম করতে লাগতে লাগল রোহনের।জিজ্ঞেস করল-আর কত দূর?
-এসে গেছি,ওই যে!
সামনে তাকিয়ে দেখে কাঠের একটা পুরনো দোতলা বাড়ি,অর্ধেক ভাঙা,লতাপাতায় জড়ানো,ভগ্নস্তুপের মত পড়ে আছে।বাড়িটার সামনের দিকটা পুরোটা জংলি লতায়  ঢেকে গেছে।ভেতরে ঢোকার রাস্তাটা পেছনের দিকে।ইতিমধ্যে আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল গুরুগুরু শব্দে আর আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।উদয়  সাইকেল থামিয়ে নিল, দুজনে তাড়াতাড়ি গিয়ে বারান্দায় আশ্রয় নিল।
-এ তো একটা ভাঙা বাড়ি,এখানে তোর মামা থাকে?
-হ্যাঁ,এই বাড়িটা বহু পুরনো ।দাদু মারা গেলে আর সারানো হয়নি।আয়…বলে উদয় সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে লাগল।বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে কাঠের সিঁড়ির  ক্যাঁচকোঁচ শব্দ এক ভয়ংকর সিম্ফনি তৈরি করল।
দোতলায় উঠে পাশাপাশি দুটো ঘর,কাঠের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা বিশ্রি চিমসে গন্ধে রোহনের নাক জ্বলে গেল।ঘরের ভেতরটা অন্ধকার ,অন্ধকার ঠেলে মস্ত দুটো ছুঁচো ঘর থেকে কেমন দিকবিদিকশূন্য হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে রোহন দেখল ঘরের মধ্যে কেউ নেই,শুধু একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা কাঠের আলমারি,যার পাল্লাগুলো ঘষা আর অস্বচ্ছ কাঁচের।ভেতরে কী আছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক রকম বড় ছোট কৌটো রয়েছে।রোহন ভাবতে লাগল এগুলো হয়ত  মাঞ্জার সরঞ্জাম- তুঁত, কাঁচের গুড়ো,শিরীষের আঠা,সাবু ইত্যাদিতে ভর্তি।কিন্তু মামাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না!উদয় বলে উঠল-রোহন তুই দাঁড়া,আমি মামারে খুঁজে আনি।বৃষ্টি কমে যেতে উদয় কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।দিনের আলো কেমন নিভু নিভু,বৃষ্টি হওয়াতে আরো যেন ঝুপসি অন্ধকার চারদিকে।রোহনের মনে হতে লাগল এই ঘরে সে ছাড়া আরো কেউ আছে।ঠিক যেন ওর গা ঘেঁষে বসে আছে।এদি ওদিক চেয়ে ফিরে অবশ্য কাউকে দেখতে পাচ্ছে না রোহন কিন্তু কারো অস্তিত্বের আভাস টের পেয়েছে।ঠিক তখুনি উদয় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল-আমার মামা কি এসেছে?
-না তো,আর তোর মামাকে কি আমি চিনি?
-তবে দেরি নেই।এক্ষুণি এসে যাবে।চল…
-কোথায়?
-গুদামে।
-সেটা কোথায়?
-চল না দেখাচ্ছি।
 একটা পায়ে চলা পথ দিয়ে বাড়ির পেছনে  একটা গুদাম ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল,এটা সিমেন্টের তৈরি,টিনের চাল।
-এই হল মামার গুদাম ঘর,এখানে মাঞ্জাসুতোর জাদু লাটাই লাট করে রাখা থাকে।যার দরকার লাগে সে এখান থেকে কিইনা নিয়া যায়।এইখানে অপেক্ষা করি,মামা আসবে।
-আরো অপেক্ষা করতে হবে? এরপর ফিরব কখন?দেরি হলে মা চিন্তা করবে তো!
-আরে দাঁড়া না,অত চিন্তা কিসের?অন্ধকার না হলে মামা আসে না?
 কথাটা শুনে রোহনের গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল।
-কেন?
-আরে, মামা যেখানে কাজ করে সেখানে সন্ধে হলে ছুটি হয়।
-ওহ!
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ, সাঁঝবেলায় পাখির দল  টি টি করতে করতে বাসায় ফিরছে। ঝোপেঝাড়ে  পোকা আর ব্যাঙের কন্সার্ট শোনা যেতে লাগল। সন্ধে ঘনিয়ে আসার মুখেই উদয় বলল -ওই তো মামা!রোহন দেখল একটা শীর্ণকায় বেঁটে মত মানুষ ধীরে ধীরে গুদামের পেছনের জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে এলো।পরনে মলিন একটা প্যান্ট,ছেঁড়া সোয়েটার আর মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। কাছে আসতে উদয় ওদের ভাষায় কী যেন বলল,মামা মুখ ঘুরিয়ে রোহনের দিকে তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।টুপির নীচ থেকে একটা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে লোকটা কিন্তু আশ্চর্য হল সে চোখের পাতা পড়ে না।আর কাছে আসতেই একটা চিমসানো গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল,  ঠিক এই গন্ধটা ও কাঠের ঘরটিতে পেয়েছিল।
উদয় বলল-মামা এই আমার বন্ধু রোহন,ও তোমার মাঞ্জাসুতার লাটাই নিতে চায়।
একটা  ফ্যাসফ্যাসে ও মৃদু গলায় বলল-চল,গুদামঘরের দরজা খুলতে হবে।
গুদামঘরের দরজার সামনে গিয়ে মামা প্যান্টের পকেট থেকে একটা মরচে ধরা চাবি বার করে দরজার মস্ত একটা মরচে ধরা তালাকে খুলে দিল।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে এক ঝাঁক চামচিকা মাথার ওপর ঘুরপাক খেতে লাগল।রোহন সাবধানে পা ফেলে গুদামের  মধ্যে ঢুকল।কোথায় কী! রোহন ফিসফিস করে উদয়কে জিজ্ঞেস করল-লাটাই কোথায়?এ তো ফাঁকা গুদাম। 
উত্তরে উদয়ের মামা বলল-কেন তোরা কি দেখতে পাস না,সারি সারি লাটাই মজুত করে রাখা বাক্সে।আর ওই দেখ ওদিকে বসে ওই লোকগুলো কাচ গুঁড়া করত্যাসে,সাবু জ্বাল দিত্যাসে,রং গুলত্যাসে।আর এই দেখ আমার হাতে ম্যাজিক মাঞ্জার আসল গুঁড়া।এই দিয়াই ম্যাজিক লাটাই তৈরি হয়।যত ঘুড়ি সব হয় ভোকাট্টা!যতবড়ই ঘুড়ি উড়ানেয়ালা হোক,আমার এই মাঞ্জার সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারে না…হু হু বাবা!
কই? কাউকে তো দেখাই যাচ্ছে না।ওই কাঠের বাড়িটার মতই এ গুদামও একেবারে ফাঁকা তবে একটা কোলাহল কিন্তু শোনা যাচ্ছে।একদল মানুষের কন্ঠস্বর  হাঁকডাক ,কথা,চেঁচামেচি পরিষ্কার কানে আসছে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।যেন কোন কর্মযজ্ঞ চলছে-হৈ হৈ কান্ড।কিন্তু কোথাও কাউকে কেন দেখতে পাচ্ছে না রোহন?খুব ভয় পেয়ে গেল ,চিৎকার করে বলে উঠল -উদয়, এ তুই কোথায় নিয়ে এলি?
উদয় বলল-কেন রে তুই দেখতে পারতিসিস না,কত লোক কাম করতাসে?ওই তো বাক্স বাক্স লাটাই।দেশ বিদেশ থেকে লোক আসে এই লাটাইয়ের জন্য।এই নে,তোরে আমি একটা লাটাই দিই।এইটা দিয়া কলকাতায় গিয়া জোর ঘুড়ি উড়াবি।
মামা বলল-দেখ,কত লোক আসত্যাসে,বাক্স বাক্স লাটাই কিনা নিয়া যাইত্যাসে।সব বড় দুকানে বিক্রি করব।যত বেচব ,তত লাভ।
রোহন চিৎকার করে বলে উঠল-না না ,আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না,আমার লাটাই চাই না।আমি বাড়ি যাব,আমার মাথা ঘুরছে…
মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে ও শুনতে পেল উদয় বলছে-এই নে লাটাই…এই নে লাটাই…হা হা হা…তুই ভয় পাচ্ছিস…ভীতু রাম…হা হা হা !  !তারপর দেখল উদয় আর ওর মামা ধোঁয়ার কুন্ডুলির মত সামনে থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে!
 
ক্ষীণস্বরে মানুষের কথা শুনে রোহন অতিকষ্টে চোখ মেলল।চোখ খুলতেই দেখল মা আর বাবার মুখ ,দুজনেই ঝুঁকে আছেন ওর দিকে।মার চোখে জল, উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন-বাবি , কেমন লাগছে শরীর?
রোহন মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল-আমি কোথায়?
বাবা বললেন-তুমি বাড়িতে।
বাবার অফিসের কলিগ দীপঙ্কর মিত্র ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার জলদগম্ভীর স্বরে বললেন-তোমাকে কেসুগ্রামে একটা পরিত্যক্ত গুদামের মধ্যে অচেতন অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেছে।তাও দু দিন পরে।তুমি ওখানে কী করে গেলে? রোহন একটু সুস্থ বোধ করে উঠে বসে সমস্ত কাহিনিটা বলে।উদয়ের কথা,ওর যাদু মাঞ্জার কথা,মামার কথা সব।দীপঙ্কর মিত্র সঙ্গে সঙ্গে খবর নেওয়ার জন্য লোক পাঠালেন। জানা গেল মালো পাড়ার উদয় গত বর্ষায় ডেঙ্গিজ্বরে ভুগে হাসপাতালে মারা গেছে।ওর মা শোকে পাগল হয়ে হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে লাটাগুড়িতে চলে গেছে।তাহলে রোহন ওখানে গেল কীভাবে আর এইটা কে দিল? বালিশের পাশে লাটাইটায় হাত বুলিয়ে রোহন ভাবতে লাগল সে কথা!

দয়া করে আমাকে মেরো না 
দীপক কুমার মাইতি

রাজার হুকুমে একদল কাঠুরে চলেছে বনে। মহারানি ইচ্ছে হয়েছে নতুন চন্দন কাঠের পালঙ্কে শোবেন। সবচেয়ে ভালো চন্দন কাঠের পালঙ্ক বানাতে হবে। ঘরে থাকলে যেন তার সুবাসে ঘর  ম ম করে। কাঠুরে দলের নেতা বৃদ্ধ নারিলিঙ্গম। সে সরেস চন্দন কাঠ চেনার অস্তাদ লোক। অনেক ঘোরাঘুরির পর একটি মোটা ও পুরান চন্দন গাছ নারলিঙ্গমের পছন্দ হয়। সকলে গাছের চারিদিকে গোল হয়ে বসে বনদেবী ও প্রকৃতির পুজো করে। গাছ কাটার জন্য তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। পুজো শেষে প্রথানুযায়ী নারিলিঙ্গম গাছে প্রথম কোপ দিতে কুঠার হাতে গাছের দিকে এগিয়ে যায়। নারিলিঙ্গম ঈশ্বরের নাম নিয়ে প্রথম কোপ দিতে যেই কুঠার তুলেছে, গাছের ভিতর থেকে কেউ কাতর কন্ঠে বলে ওঠে, “ দয়া করে আমাকে মেরো না। দয়া করে আমাকে মেরো না।” নারিলিঙ্গম অবাক হয়ে পিছিয়ে আসে। ভাবে গাছ কি এভাবে মিনতি করছে!
এই চন্দনগাছের উঁচু ডালে একটি কোটরে একটি ঈগল পাখি থাকত। আকাশে উড়তে উড়তে শিকারের খোঁজ করত। সেদিন উড়তে উড়তে বনের শেষে একটি নদীর উপর চক্কর কাটছিল। তার নজরে আসে কিছু একটা নদীর তীরে পড়ে আছে। নদীর কাছাকাছি এসে সে অবাক হয়। দেখে লাল কাপড়ের উপর একটি মানব শিশু শুয়ে হাত পা ছুঁড়ে খেলা করছে। চারিদিক লক্ষ করে ঈগল দেখে চারিদিকে কোন মানুষের চিহ্ণ নেই। বুঝতে পারে কেউ শিশুকে নদী তীরে ফেলে গেছে। ঈগলের মায়া হয়। ভাবে শিশুটিকে ছেড়ে চলে গেলে বন্য হিংস্র জন্তু খেয়ে নেবে। মুহূর্তে চিন্তা করে ঈগল তার ঠোঁট ও পা দিয়ে সাবধানে শিশুটিকে তুলে নিয়ে তার কোটরে নিয়ে আসে।
শুরু হয় মানুষ-মেয়ে ও ঈগল-মা-এর ভালোবাসার সংসার। দিনের বেলায় মেয়ে কোটরে থাকে। মা যায় খাওয়ারের সন্ধানে। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ঈগল-মা-র একটু দেরি হলে মেয়ে উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঈগল-মা এলেই জড়িয়ে ধরে। দুজন দুজনকে আদর করে। সেদিনও ঈগল মা খাওয়ারের খোঁজে বেরিয়েছে। সেই সময় কাঠুরেরা হাজির। কাঠুরেরা বুঝতে পারে গাছ নয়, গাছের উপর থেকে কোন বাচ্চা কথা বলছে। নারিলিঙ্গমের হুকুমে একজন কাঠুরে গাছে উঠে। সব দেখে সে অবাক হয়। গাছ থেকে নেমে নারিলিঙ্গমকে সব জানায়। নারিলিঙ্গম বলে, “ অনেকদিন হল মহারাজার কোন সন্তান হয়নি। তাই মহারাজা ও  মহারা্নি অসুখী। আমরা চন্দন কাঠের সঙ্গে মেয়েটিকে নিয়ে গেলে, মহারাজ খুশি হবেন। তোমরা মেয়েটিকে যত্ন করে নামিয়ে নিয়ে এস।”
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। কাঠুরেরা গাছটিকে কেটে ফেলে। কাঠ ও লালকাপড়ে মেয়েটিকে সযত্নে মুড়ে হাজির হয় রাজবাড়িতে। তখন সেখানে মহারানিও ছিলেন। ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে দেখে মহারানি মহাখুশি। মেয়েকে পেয়ে তার মাতৃত্বের অপূর্ণ স্বাদ পূর্ণ হবে। মহারাজাও খুশি হন। কাঠুরেদের প্রচুর ধনরত্ন দান করেন। রাজবাড়িতে আনন্দের হাট বসে যায়। কিন্তু মেয়েটি এত আদর ও আনন্দেও মন মরা হয়ে ঘুরতে থাকে। বারবার ঈগল-মা-এর কথা ভাবতে থাকে। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।
এদিকে ঈগল বাসায় ফিরে গাছ ও মেয়েকে দেখতে না পেয়ে তার হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। পাগলের মতন চারিদিকে খুঁজতে থাকে। এক চুড়ুই পাখি তাকে সব জানায়। রাজবাড়িতে মেয়ে আছে জানতে পেরে ঈগল পাগলের মত রাজবাড়ির দিকে উড়তে উড়তে পৌঁছে যায়। রাজবাড়ির উপর চক্কর দিতে দিতে তীব্র শব্দে মেয়েকে ডাকতে থাকে। ঈগল-মা-এর ডাক শুনে ছোট্ট মেয়ে রাজবাড়ির ছাদে একছুটে চলে আসে। মেয়েকে দেখে আনন্দিত ঈগল তার দিকে নেমে আসতে থাকে। রাজপ্রহরী দেখে ভাবে ঈগল বুঝি রাজকুমারীকে ছোঁ মারতে আসছে। তাই রাজকুমারীকে বাঁচাতে ঈগলের দিকে তীর ছুঁড়ে মারে। তীরবৃদ্ধ ঈগল ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে মেয়েটির সামনে পড়ে যায়। মেয়েটি কান্নায় মা ঈগলের উপর আছড়ে পড়ে। শেষবারের মত মেয়ের গায়ে ডানা বুলিয়ে ঈগল মারা যায়। মহারাজ ও মহারানি সেই সময় সেখানে হাজির হন। মানব-মেয়ে ও ঈগল-মা-র ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হন। মহারানি মেয়েকে শান্তনা দেন। এই ভালোবাসার চিহ্ণ হিসাবে রাজবাড়ির সামনে বিশাল এক ঈগলের মূর্তি তৈরি করে দেন। রাজকুমারী রোজ সকালে ঈগল-মার মূর্তিতে ফুল দিয়ে পুজো করে দিনের কাজ শুরু করে। 
( গল্পটি একটি কেরালার প্রচলিত )


নীল শরৎ
বানীয়া সাহা


বর্ষা যখন ব্যাগ গুছিয়ে পৌঁছল ওর নিজের বাড়ি
আকাশ এখন শুধুই আমার শরৎ হেসে করলো জারি।

চলল শরৎ বুক ফুলিয়ে আকাশে আজ রাজত্ব তার
বাজবে কাঁসর জমবে আসর নেই তো কোনো চিন্তা যে আর।

খুশির রোদে ঠিক শুকোবে দুঃখ দিনের জলের ধারা
ঢাকের সুরে ব্যস্ত জীবন চাইবে হতে বাঁধন ছাড়া।

কাশের বনে ওই শোনা যায় দস্যি মেয়ের পায়ের নুপুর
ঝরছে কত শিউলিও আজ বৃষ্টি হয়ে টাপুর টুপুর।

কুমারটুলি শরৎকে আজ মাখছে গায়ে রঙতুলিতে
শারদীয়ার ছোঁয়া লাগে একঘেয়েমি দিনগুলিতে।

নীল আকাশের সাদা মেঘে শরৎও সুখ খুঁজে পেলো
আসবে মা এই ঘরে আবার সময় যে তার হয়ে এলো!


আবার দেখা হবে 

অমিত মজুমদার 

১ 
সেকেণ্ড পিরিয়ড শেষ হতেই ফাইনাল সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললো সমীরণ। আজ মিড ডে মিলে সয়াবিনের ঝোল আর ভাত সেটা সবাই প্রেয়ার মিটিংয়ের আগেই জেনে গেছে। ফার্স্ট বেঞ্চে বসে সমীরণ পাশে বসে থাকা রাহুলকে বললো, “আজ মিড ডে মিল জমবে না। সেই সয়াবিন। একদম পাতলা ঝোল। ও খাওয়া যায় না।” 
        “কে বললো খাওয়া যায় না ? আমরা তো খাই। তুই বেশীরভাগ দিন খাস না।” 
        “তাহলে তুই সয়াবিন খা। হাড্ডিছাড়া মাংস তো। আমি ওসব খাবো না।” 
        “না খেয়ে থাকবি ? নাকি টাকা এনেছিস ?” 
        “না খেয়ে থাকবো কেনো ? গেটের বাইরে নিতাইকাকার ঘুঘনি খাবো। আজ টাকা দিয়েছে মা।” 
        “ও আচ্ছা এই ব্যাপার!” 
        “হ্যাঁ রে এই ব্যাপার। নিতাইকাকা ঘুঘনিটা খারাপ করে না। তবে আমাদের পাড়ার শিবেনকাকার দোকানের ঘুঘনি আরও ভালো। একদিন খেলে বুঝতে পারবি।” 
        “কোথায় দোকান ?” 
        “আমাদের বাড়ির কাছেই। চায়ের দোকান। কিন্তু সকালের দিকে ঘুঘনি পাউরুটি পাওয়া যায়। একদিন খেয়ে আসিস।” 
        “আচ্ছা।” 
        “এক কাজ কর একদিন সকালের দিকে আমাদের বাড়ি চলে আয়। আমি তোকে ওখানে নিয়ে গিয়ে এক প্লেট ঘুঘনি খাওয়াবো। খেলেই বুঝবি। ছুটির সময় তোকে আমাদের বাড়ির ঠিকানা বলে দেবো।” এর পর আর কথা এগোলো না। থার্ড পিরিয়ডের স্যার ক্লাসে ঢুকে গেলেন। অঙ্ক ক্লাস। স্যার আসার পরপরই ক্লাসে এলেন স্কুলের দপ্তরি। সমীরণকে প্রধান শিক্ষক ডেকেছেন। 


২ 

সমীরণের সমস্যাটা বেশ জটিল। ফাইভে যারা ভর্তি হয় তারা প্রাইমারী স্কুল থেকে অনলাইন টিসি নিয়ে আসে৷ এই অনলাইন টিসিতে ছাত্রের একটা আই ডি নম্বর থাকে। সেই নম্বরের মধ্য তার যাবতীয় তথ্য থাকে। নাম বাবার নাম ঠিকানা আধার নম্বর ব্যাঙ্ক ডিটেইলস সব। এটা বাংলা শিক্ষা পোর্টালের মাধ্যমে। প্রাইমারী থেকেই ছাত্রদের বাংলা শিক্ষা পোর্টালে নাম তোলা হয়। কেউ এক স্কুল থেকে অন্য স্কুল যেতে চাইলে অনলাইনে ট্রান্সফার আউট করে অনলাইন টিসি দেয়া হয়। সেই আই ডি দিয়ে নতুন স্কুলে গিয়ে ট্রান্সফার ইন করলেই সে ভর্তি হয়ে যায়। বাংলা শিক্ষা পোর্টালে নাম না থাকলে সরকারপুষ্ট স্কুলগুলোর কোনো ছাত্রছাত্রী সরকারি সুযোগসুবিধা পায় না। ছাত্রছাত্রীদের স্টাইপেন্ডের টাকা বা এই জাতীয় আরও অনেক সুবিধা আটকে যাবে। 
        ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির জন্য প্রায় দুই বছর পর গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত ক্লাস শুরু হয়েছে। নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত ক্লাস আগে দুবার শুরু হলেও আবার বন্ধ হয়েছে। নতুন স্কুল খুব অল্প সময়ে বেশ ভালো লেগে গেছে। অবশ্য বেশীদিন হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। এখন মার্চের মাঝামাঝি। এর মধ্যেই নতুন বন্ধুদের সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে সমীরণের। প্রতিদিন স্কুলে আসে সে। ফার্স্ট বেঞ্চে রাহুলের পাশে বসে। পড়াশোনায় দু’জনেই ভীষণ ভালো। একে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার প্রতিযোগিতাও আছে তাদের মধ্যে। 
        সমীরণের সমস্যাটা হলো সে ভর্তির সময় কোনো অনলাইন টিসি জমা দেয়নি। ভর্তির করাতে এসে তার বাবা বলেছিলেন সে পড়তো একটা বেসরকারি কেজি স্কুলে। সেখান থেকে অনলাইন টিসি হয় না। প্রাইমারীতে পড়লে তবেই অনলাইন টিসি পাওয়া যায়। বিষয়টা কিছুটা আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে ভর্তি নিয়ে বলেছিলেন বাংলা শিক্ষা পোর্টালে নতুন করে নাম তুলে দেবেন। সমীরণের যাবতীয় ডকুমেন্টস স্কুলে জমা দিতে বলা হলো। সে জমা দিলো। এবার স্কুলের করণিক এগুলো অনলাইনে তুলে দেবেন। আইনবিরুদ্ধ হলেও কিন্তু এমন ছোটোখাটো ব্যাপার গ্রামের স্কুলে জলভাত৷ সব স্কুলেই কমবেশি হয়৷ আর এটা তো অজ গ্রামের একটা স্কুল। বেশীরভাগ অভিভাবক সচেতন নন। 
        প্রধান শিক্ষকের ঘরে ঢোকার পর তিনি সমীরণকে বললেন, “তুমি কি এই মুহূর্তে কোনো প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র ?”
        সমীরণ অবাক হয়ে গেলো কথাটা শুনে। সামলে নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, “না স্যার। আমি তো শুধু এই স্কুলেই পড়ি।” 
        “কালিকানগর প্রাথমিক বিদ্যালয় চেনো ?” 
        “না স্যার চিনি না। এই স্কুলের নাম প্রথম শুনছি।” 
        “কিন্তু তোমার ইনফরমেশন বলছে তুমি এখন কালিকানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। সেটাও আবার ক্লাস ফোর।” 
        “না স্যার আমি তো একটা কেজি স্কুলে পড়তাম। ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর থেকে লকডাউনের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। তাই স্কুলে যেতে হয়নি।” 
        “বেশ। তোমার বাবাকে স্কুলে ডাকা হয়েছে। আসার পর এই বিষয়ে কথা বলবো।” 
        “কি হয়েছে স্যার ? আমি তো ক্লাসে কোনো গণ্ডগোল করিনি। কারো সঙ্গে মারামারিও করিনি।” 
        “সেটা করোনি। তারজন্য তোমার বাবাকে ডাকিনি। তবে তোমার ভর্তি নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছে। বাবার সঙ্গে কথা বলে দেখি তার কিছু সমাধান করা যায় কিনা।” 
        “আচ্ছা স্যার।” 
        “তুমি এখন বাইরে দাঁড়াও। তোমার বাবাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তিনি এলে তোমাকে আবার ডাকবো।”


৩ 

“আপনি সমীরণকে ভর্তি করানোর সময় বলে গেলেন ও কেজি স্কুলে পড়তো বলে ওর বাংলা শিক্ষা পোর্টালে নাম ওঠেনি। তখন বলা হয়েছিলো এখানেই নতুন করে নাম তুলে দেয়া হবে পোর্টেলে তাই তো ? মনে আছে ?” 
        “হ্যাঁ স্যার মনে আছে।” সমীরণের বাবা স্কুলের ফোন পেয়েই চলে এসেছেন। মুখোমুখি বসেছেন প্রধান শিক্ষকের সামনে। 
        “এখানে নতুন করে নাম তোলার জন্য ওর যাবতীয় ডকুমেন্টসের জেরক্স চাওয়া হয়েছিলো আপনার কাছে।” 
        “হ্যাঁ স্যার। আমি কয়েকদিন আগে এসে দিয়ে গেছি সব।” 
        “হ্যাঁ দিয়েছেন আর তার পরেই যত জটিলতা ধরা পড়েছে। সমীরণের ডকুমেন্টস নিয়ে বাংলা শিক্ষা পোর্টালে নাম তোলার সময় সমস্যাটা ধরা পড়েছে। সেখানে দেখাচ্ছে এই নামের ছাত্রের নাম কালিকানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে। ওখান থেকে অনলাইন টিসি না আনলে এখানে নাম তোলা যাবে না। আর ওখান থেকে ফোর পাশের টিসি বেরোবে না। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট বের করলে সেটা ক্লাস থ্রি পাশের বেরোবে। যেটা নিয়ে অন্য কোনো স্কুলে ফোরেই ভর্তি হতে পারবে ও। এখানে আমাদের কারো কোনো হাত নেই। কাজেই বুঝতেই পারছেন এই মুহূর্তে সে ওই স্কুলের ছাত্র৷ আমাদের স্কুলের নয়। এবার আপনি বলুন ব্যাপারটা কী ?” 
        সমীরণের বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন “ওকে গত বছর ওখানে থ্রিতে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু সমীরণ কিছু জানে না৷ ও তো দুই বছর কোনো স্কুলেই যায়নি। কোভিডের আগে একটা কেজি স্কুলে পড়তো বলে ওর ধারণা ওখান থেকেই এখানে এসেছে। কালিকানগর প্রাইমারী সম্পর্কে ও কিছুই জানে না।” 
        “ওখানে ও ক্লাস ফোরে পড়ে এখন।” 
        “হতে পারে। আমি ঠিক জানিও না। আমি তো স্যার পড়াশোনা কিছু জানি না। এইসব ব্যাপারে অত বুঝি না। সামান্য চাষি মানুষ। সবাই বললো প্রাইমারীতে ভর্তি করে রাখতে তাই করেছিলাম। তখন তো বুঝিনি এসব সমস্যা হবে।” 
        “আপনি কী সব না বুঝেই করেছেন ?” 
        “হ্যাঁ স্যার। আমি কিছুই জানি না।” 
        “তাহলে শুনুন। এই সমস্যার জন্য ওকে এই স্কুলে রাখতে পারছি না৷ ওর বয়স অনুযায়ী ও ফোরে পড়ে। এই বছর ও ফাইভে পড়তে পারবে না। তাই আমি বলবো প্রাইমারীতে ক্লাস ফোর পড়ে সামনের বছর নিয়ে আসুন। তখন ভর্তি করে নেবো। যেহেতু ওর নাম বাংলা শিক্ষা পোর্টালে উঠে আছে। আর ওর নিজস্ব একটা আই ডি তৈরী হয়ে গেছে তাই ওকে ফাইভে ভর্তি হতে হলে ওই আইডি দিয়েই হতে হবে যেখানে ফোর পাশ লেখা থাকবে। যেটা সামনের বছর ছাড়া সম্ভব নয়।” 
        সমীরণের বাবা অবাক হয়ে তাকালেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “কিছুই কি করা যাবে না স্যার ?” 
        “গেলে কি আমি সেটা করতাম না ? আপনি প্রাইমারীতে গিয়ে কথা বলুন দেখবেন সেখানেও একই কথা বলছে।”
        “সমীরণকে কি তাহলে নিয়ে যাবো স্যার ?” 
        “হ্যাঁ অবশ্যই। ও তো এই স্কুলের ছাত্র নয়। এখানে থাকবে কি করে ?” বলেই দপ্তরিকে বললেন ফাইভের ঘর থেকে সমীরণের ব্যাগ নিয়ে আসতে। 
        কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সমীরণের বাবা। তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন কৌতূহল ভরা চোখে সমীরণ বাবার দিকে চেয়ে আছে। 


৪  
পুরোনো স্কুলে ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই সমীরণ অনুভব করলো ক্লাস ফোরের সবাই ওর খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। এখানে ওর বেশ ভালো লাগছে। কাগজেকলমে পুরোনো হলেও এটা একদিকে ওর নতুন স্কুলই। কারণ এখানে আগে কোনো দিন তাকে আসতে হয়নি। এই প্রথম ক্লাস করছে সে। ফাইভ থেকে ফোরে নেমে আসার পর যে পরিমাণ কষ্ট হয়েছিলো তার থেকে অনেক বেশী আনন্দ পাচ্ছে এখানকার বন্ধুদের পেয়ে। মাত্র তো একটা বছর। তারপরেই তো আবার হাইস্কুলে যাচ্ছে সে। দেখা হবে রাহুলের সঙ্গে। হোক না উঁচু কাস। ওকে শিবেনকাকার দোকানের ঘুঘনি খাওয়াতে হবে। ওর যে এক প্লেট ঘুঘনি পাওনা আছে।
 
পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments

  1. গৌর বৈরাগীর গল্পে ডাবলু ভীষণ জীবন্ত। অমিত মজুমদারের গল্পটিও সুন্দর।

    ReplyDelete