জ্বলদর্চি

নলসংক্রান্তি /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৪২

নলসংক্রান্তি

ভাস্করব্রত পতি

"নল নল নল / মহাদেবের বােল / ধান ফোল / অ্যায় আছে কী? / সব শনি ভূঁয়ে লুকা / অ্যায় আছে ঝােট পাট / সব শনির মাথা কাট / অ্যায় আছে সুকা / সব শনি ভুঁয়ে লুকা" ---

গ্রাম বাংলার একটি অন্যতম চিরন্তন ঐতিহ্য তথা লোকাচার হল এই 'নলসংক্রান্তি'। এই ছড়া সেই কৌলিক লোকাচারের। আশ্বিনের সংক্রান্তি এলেই ধানগাছ তথা ফসলের দেবী 'লক্ষ্মীর সাধভক্ষণ' করানোর রীতি বা উপচার হোলো এই 'নলসংক্রান্তি' বা 'নলপোঁতা' বা 'ডাকসংক্রান্তি' বা 'সারধরা' বা 'ডাক সাঁকরাত' ( ডাক সংক্রান্তি )। পুরুলিয়াতে একে বলে 'জিহুড়'। নলসংক্রান্তি'র মতো এই আশ্বিন মাসের সংক্রান্তিতেই উত্তর দিনাজপুর জেলার কৃষকরা ভালো ফলন, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, পোকামাকড় দমন করার আশায় 'ক্ষেতিপূজা' বা 'খোজাগরি' বা 'ভোগা দেওয়া' নামে প্রায় একই ধারার একটি লোকাচার পালন করে। 

প্রসূতিকে যেমন প্রসবের আগে 'সাধভক্ষণ' করানোর চল আছে, তেমনি আশ্বিন মাসের শেষ দিন যখন ধানের শিষ এসে যায়, তখন ঢলঢলে জমিতে তথা আসন্নপ্রসবা লক্ষ্মীকে নানা খাদ্য সহকারে সাধভক্ষণ করানোর রীতি রয়েছে এই নলসংক্রান্তির মাধ্যমে। 

কিন্তু আজকের চূড়ান্ত ব্যস্ততার জীবনে এই চিরন্তন লোকঘরানাটি প্রায় অবলুপ্তির পথে। এখন গ্রামেগঞ্জে প্রায় দেখাই যায়না নল বাঁধার আয়োজন। শিষযুক্ত নলগাছে প্রথমে 'বরোজ' বাঁধতে হয়। এই বরোজ বাঁধতে গেলে প্রয়োজন হয় বড়সড় পাতা। একাজে ব্যবহার করা হয় বোড় পাতা বা বাজবরণ গাছের পাতা। সেই পাতায় একটা বিশেষ মিশ্রণ মুড়ে নতুন পাট দিয়ে বাঁধতে হয় নলগাছে। প্রথমেই সংগ্রহ করতে হয় কালমেঘ, কাঁচা হলুদ, বনকেঁউ, ঘেঁটু পাতা, চিংড়ি মাছ এবং নলগাছ। কিছু এলাকায় নল বা সরকাঠির সাথে বোড় গাছের পাতায় মুড়ে শালুক ফুল, নিম, হলুদ, আদা, কেতকী পাতা, কালোমেঘ, বেলপাতা, সিঁদুর সহযোগে মিশ্রন করে বাঁধা হয়। এসব দিয়েই 'বরোজ' বাঁধতে হয়। আর মাঠ জুড়ে বোল দেওয়া হয় "ছোট বড় ধান ফুলে ফুলে"।
কোথাও কোথাও উপচারের ক্ষেত্রে একটু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বোড় গাছের পাতায় মোড়া হয় বন কেঁউ, তেঁতুল, অন শরষা, কাঁকুর লাড়ি, ওল, বেল, নীল আদা, পাটের ছাল দিয়ে। এরপর এসব একসঙ্গে গুঁড়ো করে মন্ড বানিয়ে তুলসী তলায় রাখা হয়। বেলপাতা, শালুক, সিঁদুর সহযোগে গৃহস্থের কর্তা নলকাঠিতে পূজো করেন প্রচুর ধান ফলনের প্রার্থনা জানিয়ে। পরের দিন খুব ভোরে সূর্যোদয়ের আগেই মাঠে গিয়ে জমির ঈশান কোনে পোঁতা হয় ঐ নলগাছ। আতপ চাল, ফল, মিষ্টি একসঙ্গে মেখে দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় বাড়িতে। সবশেষে একঘটি জল মাঠ থেকে নিয়ে এসে গৃহস্থ চাষি সবার মাথায় ছড়িয়ে দেন। বাকি জল বাড়ির চালে বা ছাদে ছড়িয়ে দেন। 

নলসংক্রান্তিতে দু'ধরনের নল দিতে হয়। নিরামিষ নল দিতে হয় মন্দিরে। আমিষ নল দিতে হয় জমিতে। আমিষ নলে শুকা মাছ দিতে হয়। কিন্তু দুই ধরনের নলেই দেওয়া হয় নানা ধরনের গাছের পাতা। ওইদিন খেতে হয় নিমপাতা। আসলে জেলার মানুষের বারাে মাসের তেরাে পার্বণের সাথেও এভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছে। 

পুরুলিয়ায় 'জিহুড়' তথা নলসংক্রান্তির উপচার অবশ্য একটু আলাদা। এখানে এদিন সকালে পান, সুপারি দিয়ে সকাল বেলা গৃহকর্তা, ভাগচাষি, পুরোহিত ধান ক্ষেতে গিয়ে মা লক্ষ্মীকে দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে আসেন। দুপুরবেলা (ঠিক বারোটার আগে) একটি বড় মান পাতায় ভাত, ডাল, পাঁচ রকমের তরকারি, পাঁচ রকমের ভাজা, চাটনি, পায়েস ধান ক্ষেতের লক্ষ্মীমাকে নিবেদন করা হয়। এদিন খামার বা ধান মাড়াইয়ের জায়গা গোবোর, মাটি দিয়ে নিকোনো বা পরিস্কার করেন চাষিরা। এদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় সন্ধ্যা বেলা টানা এক মাসের জন্য 'আকাশপ্রদীপ' জ্বালানো। এদিন সন্ধ্যা থেকেই কীর্তনীয়ারা এক মাসের জন্য সকাল সন্ধ্যা নাম সংকীর্তন করে গ্রাম পরিক্রমা শুরু করে। পুরুলিয়াতে এটি "টহল দেওয়া" বলে পরিচিত থাকলেও অন্যান্য স্থানে একে বলা হয় 'বেড়াকীর্তন' বা 'নগরকীর্তন'। সন্ধ্যাবেলা সংকীর্তনের মূল সুর থাকে রাধামাধবকে ঘুম পাড়ানো। আর ভোরে থাকে ঘুম ভাঙানোর গান। আসলে গোটা গ্রামকে বেড় করে নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের আয়ুবৃদ্ধি সহ সুস্থতা এবং উন্নতি কামনা করা হয়।

পুরুলিয়ার জিহুড়ের মতোই উত্তর দিনাজপুরের খোজাগরির উপচার পদ্ধতিও আলাদা। একটি মাটির হাঁড়িতে খৈল, লেবুপাতা, নিমপাতা একত্রে মিশিয়ে সেই মিশ্রণ বাঁশের তৈরি বিশেষ পাত্রতে করে নিয়ে ক্ষেতের জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বাড়ির পাশে ধানের জমির এক কোণার বাঁশ ও পাট কাঠি দিয়ে একটি ছোট্ট চালা ঘর তৈরি করা হয়। চালার উপর কাদা দিয়ে ছোট উঁচু ঢিপি বানানো হয়। একে 'লক্ষ্মীর ঘর' বলে। আর বাড়িতে তৈরি হয় আতপ চাল, খাঁটি দুধ দিয়ে সুস্বাদু পায়েস। তা নাড়া হয় কলা ডাঁটা দিয়ে। ওই পায়েস হরি মন্দিরে তুলসী তলায় এবং ক্ষেত জমিতে তৈরি লক্ষ্মীর ঘরে প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যের সময় জমিতে ভোগা বা প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা মাঠ আলোকিত করা হয় দীপাবলীর মতো। নলসংক্রান্তি পালনে দক্ষিণ বঙ্গে ভোর বেলা জমিতে উপচার পালিত হয় আর উত্তর বঙ্গে খোজাগরিতে রাতের বেলা উপচার পালিত হয়। আসলে রাতে ঐ প্রদীপের আলোতে জমির ক্ষতিকর পোকামাকড় ছুটে এসে পুড়ে মারা যায়। এতে ফসলের লাভ হয়। আর চাষীরা মাঠে গিয়ে বলে (সূত্র : যোগেশ চন্দ্র বর্মণ) --
"সবারে ধান আউল বাউল / হামার ধান ধর্মের চাউল", "সোরা সোরা লাই লই দূরপালা / আয় মা লক্ষ্মী হামার রীতি", "হাঁসের ডিমা, কচুর ফুতি / আয় মা লক্ষ্মী হমোর ভিতি", "পোক মাকর সব দূর যাক" ইত্যাদি।

এই জেলায় একটি প্রবাদ খুব বিশ্বাস করে মানুষজন -- 'আশ্বিনে রান্ধে কার্তিকে খায় / সে যে বর চায়, সেই বর পায়'। তাই নমঃশূদ্র, কৈবর্ত জনজাতির মহিলারা সারাদিন উপোষ করে থাকে। ফল কিংবা রুটি খায়। ভাত খায়না। রাতে ভাত রান্না করে জল ঢেলে রেখে দেয়। পরের দিন সকালে সবাই স্নান সেরে সেই পান্তা ভাত খায়। অনেকটা ঠিক অরন্ধন উৎসবের মতো।

'নলপাদা' গ্রামনামটিতে (নল + পাদা) মেলে নলগাছের উপস্থিতি। এখানে 'পাদা' অর্থে কোড়া বা লােধা ভাষায় অচষা পতিত জমি বােঝায়। অর্থাৎ যে অচষা পতিত জমিতে নল গাছের বন রয়েছে তাই 'নলপাদা'। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় এই নলগাছ কৃষিভিত্তিক লােকাচার নলসংক্রান্তিতে প্রধান উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। 

নলসংক্রান্তি লোকাচারের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গাছগুলি হলো নল, কালমেঘ, কেন্দু বা কেঁউ, ঘেঁটু এবং হলুদ। এইসব গাছের একটু উদ্ভিদগত পরিচয় জেনে নেওয়া যাক। নল গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Phragmites karka বা Amphidonax karka বা Arundo karka। সংস্কৃতে নল বা নলখাগড়া গাছকে বলে নল্ব। এছাড়া হিন্দিতে নরমল, তেলুগুতে ভুঙ্গুগুরু, কন্নড়ে দেবনাল, গুজরাটীতে নালী বলে। এছাড়াও একে চেনা যায় লালবংশ, মৃদচ্ছদ, বংশপত্র, মৃদুপত্র, ছিদ্রান্ত, বিভীষণ, শূন্যমধ্য, দীর্ঘবংশ, ধমন, পোটগল, নাল, কীচক, কুক্ষিরন্ধ্র্র, দীর্ঘবংশ নামেও। ভার্বিনেসী গোত্রের ভাঁট বা ঘেঁটুর বিজ্ঞানসম্মত নাম Clerodendron infortuatum। সংস্কৃতে একে ঘন্টক, ঘন্টাকর্ণ এবং ওড়িয়াতে গেঙ্গুটি বলে। হরিদ্রা বা হলুদকে আমরা চিনি কৃময়া, বিষঘ্নী, হরিতা, বর্ণদাত্রী, বরা, জনিষ্ঠা, গৌরী, বরাঙ্গী, বরবর্ণীনি, মঙ্গল্যা, লক্ষ্মী, ভদ্রা, বিলাসিনী, শোভনা, শোকা, হরবিলাসিনী, জরন্তিকা, যোষিৎপ্রিয়া, পীতা, হরিদ্রী, দীর্ঘরাগা, কাঞ্চনীবর্ণীনি, শিবা, সুবর্ণা, স্বর্ণবর্ণা, হরিদ্ররঞ্জনী নামেও। জিঞ্জিবারেসী গোত্রের এই হলুদের বিজ্ঞানসম্মত নাম Curcuma longa। একে সংস্কৃতে রজনী, কোঙ্কনিতে হলদি, গুজরাটীতে হলদর, তেলুগুতে পসুহ, ফার্সিতে জবতচোর, ওড়িয়াতে হলদ, কন্নড়ে অর্শিনা বলে। কেন্দু তথা গাব গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Diaspiros melamonylon। কালমেঘ বা কেলাবাসরকে ওড়িয়াতে ভুঁইনিম্ব, সংস্কৃতে কিরতে, যবতিক্তা, মহান্তি, হিন্দিতে কিরয়াত বলে। বাসকাদিবর্গের এই বর্ষায়ূ গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Andrographis paniculata।

'বরোজ' বাঁধার জন্য বেছে নেওয়া হয় গ্রামের কোনো মোড়ল বা মক্কেল শ্রেনীর বাসগৃহ। মূলতঃ সন্ধ্যার পরই একাজে জড়ো হতেন গ্রামের মানুষ। পাঁশকুড়ার হাউর অঞ্চলের সাহড়দা গ্রামের গুরুপদ মাইতি, মদন আদক, শঙ্কর কর, মৃত্যুঞ্জয় কর, সন্তোষ কর, গোপাল মেট্যা, আরতি পানিগ্রাহী, মন্টু সামন্ত, মনোরঞ্জন ভুঁইয়ারা প্রতি বছর যান গ্রামের মোড়ল 'কর'দের বাড়িতে। প্রায় তিন চার ঘন্টা ধরে চলে নল বাঁধার কাজ। সেইসাথে ঐ মোড়লের বাড়িতে চলতো খাওয়া দাওয়া। তিনিই খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ কাজের সময় ঘনঘন হরিধ্বনি দেওয়া বাধ্যতামূলক। এভাবেই কথাবার্তা, চিৎকার, খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে শেষ হোতো নলগাছে বরোজ বাঁধার কাজ। হরিধ্বনির সাথে শাঁখ, ঘন্টা, কাঁসর বাজানোর রেওয়াজও রয়েছে।

নল পোঁতার সময় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ছড়া উচ্চারিত হয়। কোথাও কোথাও বলা হয় -- "অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি / যা রে পোক ধানকে ছাড়ি / এতে আছে শুকতা / ধান ফলবে মুকতা / এতে আছে কেঁউ / ধান হবে সাত বেঁউ / এতে আছে হলদি / ধান ফলবে জলদি / এতে আছে ওল / মহাদেবের ধ্যান করি / বোল হরিবোল।"

এই ছড়াটিই অঞ্চলভেদে কোথাও কোথাও এইভাবে গাওয়া হয় -- "অন শরষা কাকুর লাড়ি / ধান ফলবে গাড়ি গাড়ি / এথরে আছে ওল / বুড়া মহাদেব কী হরিবোল / এথরে আছে নীল আদা / ধান ফলবে গাদা গাদা / এথরে আছে কেঁউ / ধান ফলবে বেঁউন বেঁউন / এথরে আছে খুদমালিকা / এথরে আছে ওল / মহাদেবের ধ্যান করে /  বলরে হরিবোল।"

পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি এলাকায় ছড়াটি এরকম -- "এইরে (এতে) আছে কাঁকুড় নাড়ি (শশা গাছের অংশ) / ধান ফলিব কাঁড়ি কাঁড়ি / এইরে আছে ঝোট পাটা / সবু পোকার মাথা কাটা / এইরে আছে ওল / মহাদেবের নামে হরিবোল।" খেজুরী এলাকায় নলসংক্রান্তির যে ছড়াটির প্রচলন রয়েছে তা হলো -- "এতে আছে ভাঁটপাতা / কাঁচা হলুদ নিমপাতা / এতে আছে চিংড়ি শুকা / পোকা মাকড় সব ভুঁয়ে লুকা / এতে আছে কেঁউ / শনি করে মিঁউ মিঁউ / এতে আছে ওল / মহাদেবের বোল / গোড়ায় দিলাম জল / ধান ফোল"। এরপর তিন আঁচলা জল নল গাছের গোড়ায় ঢেলে প্রনাম করতে হয়।

ভাষাগত পার্থক্য মেলে অন্য এক এলাকায় উচ্চারিত এই ছড়াটিতে -- "রণ সরিষা কাকুঁড় নাড়ি (শশা গাছের কান্ড) / যারে পোকা ধানকে ছাড়ি / এইরে (এতে) আছে কাঁকুড় নাড়ি /  ধান ফলবে কাঁড়ি কাঁড়ি / এতে আছে কেঁউ / ধান হবে আড়াই বেঁউ / এতে আছে শুকতা / ধান হবে গজমুক্তা / এতে আছে ঝোটপাট / সব পোকার মাথা কাট / এতে আছে ওল / মহাদেবের নামে বোল হরিবোল।"

একটু অন্যভাবে এই ছড়াটিই বলা হয় এভাবে -- "এতে আছে কেঁউ / ধান করে মেউ মেউ / এতে আছে বড়ের খড় / ধান মাচা করে কড় কড় / এতে আছে সুক্তা / ধান ফলবে গজমুক্তা / এতে আছে শুকা / পোকামাকড় লুকা / এতে আছে ওল / মহাদেবের বোল / এবার ধান ফোল।"

উল্লেখ্য যে দেবাদিদেব মহাদেবের নামোচ্চারণ করে গাওয়া হবে প্রায় সবক্ষেত্রেই - "ওলে বোলে মহাদেবের বলে, ধান ফুলে ফুলে।" পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর অঞ্চলে ধান জমিতে নলগাছ পোঁতার সময় চাষীরা আওড়ান -- "রাই সরিষা প্যাকাটি খাড়ি / বোড় পাতায় কাকুড় নাড়ি / ওল গোল মানের পাত / ভজ গোঁসাই দুধের ভাত /  ছোট বড় ধান ফুলো / ছোট বড় ধান ফুলো।" অঞ্চলভেদে কোথাও কোথাও বলা হয়, "নল পড়ল ভুঁয়ে /  যা শনি উত্তর মুয়ে"।

মুসলিম কৃষকেরাও জমিতে নল পোঁতার সময় ছড়া আওড়ান। তাঁরা বলেন -- "হিন্দুয়াকা যোহি বোল / হামরা ভি ওহি বোল / ধান ফো ও ল / ধান ফো ও ল"। উত্তর দিনাজপুরের মুসলিমরা একে “গাড়ি গড়ি” বলে। এই গাড়ি গড়ির উপচার হিসেবে একটি মুরগি গোলা ঘরের দরজায় কুরবানী করে। বাড়িতে কেবল কচুর তরকারি ও মুরগির মাংস রান্না হয়। এতে কোনো রকম লংকা, হলুদ দেওয়া হয় না। কেবল কালো ধোনিয়া চালের ভাত কলা পাতায় রেখে খাওয়ার চল রয়েছে। আর ধানের জমিতে প্রদীপ জ্বেলে এঁরা বলে -- "গাড়ি গুড়ি কচুর ফুতি / আয় মা লক্ষ্মী হামার ভিতি"।

আসলে আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে আমন ধানের গর্ভকাল। তাই ধান তথা লক্ষ্মীকে সাধভক্ষণ করানোর রীতি বাঙালি হিন্দু সমাজের বহুদিনের চল। ভোরবেলা বিশেষভাবে তৈরি নলগাছগুলোকে বিভিন্ন স্থানে পুঁতে দিতে হয়। প্রথমেই তুলসীমঞ্চে দিতে হবে। এরপর বাড়ির চালে বা ছাদে রাখতে হবে। ডাক ঝোড়াতে এবং পুকুরেও একটি করে নলগাছ রাখতে হবে। সবশেষে প্রতিটি ধানজমিতে পুঁতে দিতে হয় একটি করে নলগাছ।

এই নলসংক্রান্তি উৎসবের সাথে একটু অন্য ধরনের উপচারও পালন করা হয়। একে বলে 'আলি' বা 'আলুই' খাওয়া। নলসংক্রান্তিতে 'আলুই' খাওয়ার চল বহু পুরোনো। আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় একটা চুবড়িতে রাখতে হয় নিমপাতা, চালকুমড়োর ডাঁটা, কালমেঘ, নটে শাক, তালের গজড়, পুঁই গাছের ডোগা এবং কাঁচা হলুদ। এবার ঐ চুবড়িটিকে প্রথমে পুকুরে ডোবাতে হয়। এই চুবড়িকে বলে 'ডাক ঝোড়া'। এর সাথে পুঁটুলিতে কিছু আতপ চাল বেঁধে রাখতে হয়। এবার পুকুরে ডাক ঝোড়াটি ডোবানোর পর ঝোড়া থেকে নির্গত জল সংগ্রহ করতে হয় ঘটিতে। যা দিয়েই ঐসব সব্জিগুলিকে বেটে প্রস্তুত করা হয় 'আলুই'। তখন শাঁখ বাজাতে হয়। সংক্রান্তির দিন জমিতে নল পোঁতার পর এই বাটা আলুই, ভিজানো আতপ চাল এবং তাল গজড় খাওয়ানো হয় সকলকে। এদিন ৭ ধরনের শাক খায় বাড়ির সবাই। এই আলুই আসলে পুরোপুরি শরীরের রোগ নিরোধক নানা দ্রব্যের মিশ্রন।

আগেকার দিনে ধান গাছে কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হতোনা। বদলে এই নলগাছ কেন্দ্রীক বিভিন্ন মিশ্রনকে ভেষজ কীটনাশক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এই নলসংক্রান্তির মধ্যে অনেকগুলো বিজ্ঞানভাবনা রয়েছে। এই নলকাঠির পাতাতে বিভিন্ন ভেষজ পাতা বাঁধা থাকে। এগুলোর গন্ধে ধান গাছের ক্ষতিকারক পোকা জমিতে আসবেনা। তাছাড়া জমিতে থাকা ক্ষতিকর বিভিন্ন পোকামাকড়, ইঁদুর শিকার করার জন্য শিকারি পাখি প্যাঁচা ধান জমিতে পোঁতা নলকাঠির উপর বসতে পারে। উল্লেখ্য, চাষিরা ধানকে লক্ষ্মী বলে মানে। আর এই লক্ষ্মীদেবীর বাহন হোলো প্যাঁচা। ফলে এক্ষেত্রে অদ্ভুতভাবে বিজ্ঞান ও ধর্ম জড়িয়ে গিয়েছে। তাছাড়া, ধানের জমিতে নল পোঁতার অছিলায় চাষিরা চাষের অগ্রগতি দেখার একটা সুযোগ পায় ইত্যবসরে। এ প্রসঙ্গে ড. প্রবালকান্তি হাজরা জানিয়েছেন, "নলের সঙ্গে যে সব দ্রব্য মিশিয়ে বাঁধা হয়েছে সেগুলির বেশির ভাগই তেতো, যা পোকা মাকড়ের কাছে অরুচিকর। ফলে ক্ষেতে আসবে না। এছাড়া ক্ষেতে নল পোঁতা থাকলে তার উপর নানা ধরণের পাখি বসতে পারে। ধানের ক্ষেতে যে সব পোকা লাগে সেগুলি ধরে ধরে খেয়ে নেয়। ঐ নলে বাঁধা পুঁটুলিতে মাছের শুকো থাকায়, ওর লোভে ও গন্ধে পাখি এসে নলে বসবেই। বোধ হয় একেবারে যাতে না খেয়ে নিতে পারে, তাই নানারকম দ্রব্য মেশানো হয়। বারে বারে পাখি এসে বসে, আর ধানের পাতায় বসা পোকা মাকড় ধরে ধরে খায়। বর্তমানে কৃষি-বিশেজ্ঞরা ক্ষেতে আসা পোকা ধরার জন্য ফাঁদ ও নেটের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু শতশত বৎসর আগে সাধারণ গ্রামের চাষি তাঁদের চিন্তা অনুযায়ী ক্ষেতের ফসল রক্ষার জন্য যে উপায় বার করেছিলেন, তা আদৌ উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত, রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন কাব্যে শিবের যে ধান চাষের কথা বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে, সেখানে চাষি শিবও ডাক সংক্রান্তিতে তাঁর চাষের ক্ষেতে নল পুঁতেছিলেন। দুশো বছর আগেও বাংলায় এই আচার পালন করা হতো"।
এই নলগাছ হোলো বহু প্রজনন শক্তির অধিকারী। মানুষের বিশ্বাস এই নলখাগড়া গাছের মতোই ধানগাছগুলো হয়ে উঠুক গর্ভিনী। তাই নলগাছ পোঁতা হয় জমিতে। আর আলুই সম্পূর্ণ ভেষজ গাছগাছালি দিয়েই বানানো হয়। এই মরসুম আসলে পরিবর্তনের সময়কাল। ফলে রোগজ্বালা আক্রমনের সম্ভাবনা থাকে। এসবের হাত থেকে রেহাই পেতেই কৃষিজীবী মানুষের একান্ত ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ হোলো এই নলসংক্রান্তি উৎসব। 

কবি ড. রজতকান্তি সিনহা চৌধুরী তাঁর 'ডাকসংক্রান্তি' কবিতায় লিখেছেন - "হাত রাখি ডাগর গতরে / শিষ থেকে ওশ ঝরে পড়ে / হয়গ্রীবা নুয়ে আসে / ঘরমুখো আমনের খেতে / আজ ডাকসংক্রান্তির ভোরে / ধানের সোনার শিষে ঘন হচ্ছে দুধ / নবান্নের গন্ধ ভেসে আসে / পাকা ভুঁয়ে মৃত্যুরও মৌতাত ভেসে যায় / আকাশের নির্লিপ্ত কপালে / ডাকসংক্রান্তির ভোরবেলা / হাতের শিরার মতো পড়ে আছে নদী / জলের জ্বালানি ফসল ফলাতে একশেষ / সূর্যও স্খলিতপ্রভ দক্ষিণ অয়নে / সিংহকেশরের মতো শস্যের জৌলুশ / ডাকসংক্রান্তির চক্রবালে লেগে আছে"।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments