জ্বলদর্চি

জীবন-মৃত্যুর আড়ালে /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান-২০

জীবন-মৃত্যুর আড়ালে

নিশান চ্যাটার্জী


নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা চিরকালীন। অনেকেই রয়েছেন যাদের বয়স ধরা খুবই শক্ত। আবার অনেকের অল্প বয়সেই বার্ধক্যের ছাপ পড়ে যায়। এই বিষয় নিয়ে এবং সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় উঠে আসা তথ্য ই আজকের আলোচ্য বিষয়। বার্ধক্যের বিষয়টি খুবই জটিল এবং রহস্যময়। গত বেশ কয়েকদশক ধরে এই বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। একটি জীবকোশ যতদিন বাঁচবে, কতবার সে বিভাজিত হবে অর্থাৎ তার আয়ু কত হবে তা কেমন ভাবে নির্ধারিত হয় সেই সম্পর্কে এখনো স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়নি। ক্যালিফোর্নিয়া র সেকোয়া ন্যাশনাল পার্কে তিন চার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকা  উদ্ভিদ রেড উড ট্রি আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও সর্বপুরাতন জীব। এর উচ্চতা ১০০ মিটারের বেশি। অন্যদিকে দেখা যায় অনেক মরশুমি উদ্ভিদ একবছরের বেশি বাঁচে না।

 প্রতিদিনই জীবের দেহকোশের মৃত্যু ঘটে, যেমন প্রতিদিনই দেহের শতকরা একভাগ লোহিত রক্তকণিকার মৃত্যু ঘটে। তরুণ দেহে এই মৃত্যু সংকেত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে না।  অথচ বার্ধক্যের পর যখন মৃত্যু ঘটে তখন দেহের অধিকাংশ কোশ জীবিত থাকলেও এই মৃত্যু কে রোধ করা যায়না। এই সমস্যা উদ্ভিদ জগতেও প্রবল। বহু প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে যারা একবার ফুল দিয়েই মারা যায়, শত চেষ্টা করেও তাদের বাঁচানো যায়না কারণ তাদের সারা অঙ্গেই বার্ধক্যের সংকেত ছড়িয়ে পড়ে এবং অবধারিত ভাবে শিকড় সহ পুরো গাছ ই শুকিয়ে যায়। এই ধরণের বার্ধক্যকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সার্বিক বার্ধক্য (overall senescence), কিন্তু এদের বীজের মধ্যে ভ্রুণটি দিব্যি বেঁচেথাকে। এটি প্রায় তিন বা তার বেশি বছর বেঁচে থাকতে পারে। প্রশ্ন হলো কত বেশি বেঁচে থাকতে পারে? বেশ কিছুকাল আগে মাঞ্চুরিয়ায় হ্রদের তলদেশ থেকে কয়েকটি পদ্মবীজ পাওয়া গিয়েছিল তার খোসা গুলি প্রায় জীবাশ্মে পরিণত হয়েছিল, যার বিবরণ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এদের বয়স নির্ধারণ করেছিলেন প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার বছর। 

তার পরবর্তীতে কয়েকজন বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায় এই বীজগুলো ওয়াশিংটন ন্যাশনাল পার্কে এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে অঙ্কুরিত করানোর চেষ্টা করাই হয় এবং তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। মনে রাখতে হবে বীজের মধ্যে ভ্রুণটি ততদিনে জীবিত ছিল। কিন্তু কি কারণে বা কোন রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে এটি সুদীর্ঘ জীবন লাভ করল সেটা জীব বিজ্ঞানীদের কাছে এক নতুন প্রশ্ন। সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে একটি জীবকোশ কতবার বিভাজিত হতে পারে। একটি জীব কোশের প্রতিটি ক্রোমোজোমের প্রান্তে টেলোমিয়ার নামে একটি অংশ থাকে, প্রতিবার বিভাজনের সময় এই টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য একটু একটু করে কমতে থাকে, যখন তা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে যায় তখন কোলের বিভাজন বন্ধ হয়ে যায়।ওই কোশ তখন মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণায় জানা গেছে ক্যান্সার কোশ অসংখ্য বার বিভাজিত হয় কারণ সেখানে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য প্রতিবার বিভাজনের সময় ছোট হয়না। কোনো ভাবে ক্যান্সার কোশের এই টেলোমিয়ার যদি ছোট করা যায় বা একেবারে বাদ দেওয়া যায় তাহলে এই রোগের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। বীজের মধ্যে ভ্রূণ কোষগুলির বিভাজন সামান্যতম তাই তাদের টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য অক্ষুন্ন থাকে হয়তো তাই জন্য এরা বহুকাল জীবিত থাকে। বীজের মধ্যে বিভাজন নূন্যতম হওয়ার কারণ হল বিপাকীয় হার কমে যাওয়া। অর্থাৎ ওই বীজের মধ্যে বিশেষ অবস্থায় বিপাকীয় ক্রিয়ার হার কমে যাওয়ায় ভ্রূণকোশ গুলি বার্ধক্যগ্রস্থ হয়নি। লিকুইড নাইট্রোজেনের মধ্যে জীবের দেহকলা ইত্যাদি সংরক্ষণ করলেও অতি কম তাপমাত্রায় বিপাকীয় ক্রিয়ার হার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আবার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের টম জনসন জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবের আয়ুস্কাল দ্বিগুণ করতে সক্ষম হন। তিনি মাটির মধ্যে বসবাসকারী এক বিশেষ প্রজাতির নিমাটোডের দেহকোশের ১৩০০০ জিনের মিউটেশন ঘটিয়ে তাদের আয়ুস্কাল বাড়িয়েছিলেন। এই পরিবর্তিত জিনটির নাম তিনি দিয়েছিলেন Age-1। 

সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদাহরণের থেকে একথা স্পষ্ট যে অপরিমিত ভোজন বার্ধক্যের অন্যতম কারণ। তাই ভোজনরসিক বাঙালিকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments