জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৪২/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৪২

এখানে একঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়ে আমাদের নিয়ে বাস রওনা দিল। এখানে কাছাকাছি লোকালয় চোখে না পড়লেও একটা খুব সুন্দর হোটেল রয়েছে। বাসে যেতে যেতে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে লেকটা দেখা গেল। মাঝে মাঝে অবশ্য গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিল। আমরা আরও দুর্গম পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছি। কোনও লোকালয় দেখছি না, মাঝে মাঝে  পশু খামার দেখতে পাচ্ছি। কোথাও গাছের ফাঁকে ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাসের গতির কারণে দুষ্টু ঝর্ণাগুলোকে কিছুতেই ক্যামেরাবন্দি করা যাচ্ছে না। আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সেইসঙ্গে ঝড়ো বাতাস। পাহাড় তো আছেই,  মাঝে মাঝে নাম না জানা বড় বড় লেক দেখতে পাচ্ছি। প্রকৃতির এমন ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আগে কখনো দেখিনি। এসব লেকের নাম গাইড নিজেও জানেন না। কেউ বলছেন নদী, কেউ বা সমুদ্র, আবার কেউ বলছেন, না না এগুলো লেক। জঙ্গল, পাহাড় আর লেক দেখতে দেখতে আমরা  পৌঁছালাম ইউরোপের সর্বচ্চ পর্বতমালা ‘বেন নেভিস’ এর পাদদেশে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। তার মধ্যেই আমরা বাস থেকে নেমে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। পাহাড়ের চূড়া মেঘে ঢাকা।
 পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা ঝর্ণা দেখা গেলেও ক্যামেরায় ধরা পড়ছে না। বেন নেভিসে হুইস্কি কারখানা রয়েছে, সঙ্গে রেস্টুরেন্ট ও টয়লেট রয়েছে। গাইড বললেন, কারো ইচ্ছে গেলে এখানে লাঞ্চ করতে  পারেন। একটা ছোট্ট রুমে বড় পর্দায় দেখানো হল কে কীভাবে হুইস্কি আবিস্কার করেছিলেন। তারপর আমাদের পাস দেওয়া হল কারখানায় কিভাবে হুইস্কি তৈরি হচ্ছে তা দেখার জন্য। অন্যদের সঙ্গে আমরাও যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছি কারখানায় ঢোকার জন্য, তিব্র কটু গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল। আমরা নেমে এসে ঘুরেঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম এবং ছবিও তুললাম। কারখানার বাইরে  মদ রাখার জন্য কালো রঙের বড় বড় কাঠের বড় বড় পিপে রাখা আছে।  বাসে ওঠার সময় কয়েকজনকে হুইস্কির বোতল ব্যাগে ভরতে দেখলাম।
      এখান থেকে বাস আমাদের নিয়ে গেল একটা মস্ত কার পার্কে। পাশেই শপিংমল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। গাইড এখানে সবাইকে লাঞ্চ করে নিতে বললেন।  কিন্তু বাস থেকে তো নামা যাচ্ছে না, অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে ছোট ছাতা  আছে, কিন্তু এই বৃষ্টিতে কাজ দেবে না, ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। দেখলাম  গাইড বাসের পেট থেকে নীল সাদা অনেকগুলো বড় বড় ছাতা বের করে  প্রত্যেক ফ্যমিলিকে একটা করে দিচ্ছেন। আমরাও একটা ছাতা পেলাম।খান সাহেব বাস থেকে নামলেন না। ওনাকে খেতে দিয়ে আমি শপিংমল ঘুরে এলাম। তমালরা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে গিয়ে আমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। আমি খেতে চাইছিলাম না, কিন্তু খেতেই হল।
    এবার আমরা চলেছি এনভারনেস, আমাদের শেষ গন্তব্যস্থান। মেঘ বৃষ্টির মধ্যেই বাস ছুটতে ছুটতে ওপরে উঠছে। দূরে একটা পাহাড়ের সাদা মত কী দেখা যাচ্ছে, কেউ বুঝতে পারছি না। কেউ বলছেন ঝর্ণার জল, আবার কেউ বলছেন বরফ জমে আছে। তারপর কাছে আসতে বোঝা গেল, ওটা জল বা বরফ কিছুই না।পাহাড়ের ওপর ওইভাবে সাদা রং করা হয়েছে। কেন? তা জানিনা। হয়ত আমাদের বোকা বানানোর জন্য!
    এখন একটা লেকের পাস দিয়ে চলেছি। কিছুক্ষণ পর লেকটা হারিয়ে গেল। সাড়ে পাঁচটার সময় আবার লেকটা দেখতে পেলাম। বেশ শান্ত, লেকের জলে প্রচুর বোট ভাসছে। ছটার দিকে জানলাম, আমরা এনভারনেসে ঢুকে পড়েছি। ক্রমশ প্রকৃতি, পরিবেশ, সব কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।আকাশ ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে।লেকের জল একেবারে স্থির, কোনো বোট বা লঞ্চ ভাসছে না। কোনো লোকালয় দেখছি না। এক সময় লেকের পাড়ে বাস থামল। গাইড বললেন, এই হল ‘লকনেস’(এদেশে ‘লেক কে লক বলা হয়)। এই লেকেই মনস্টারের বাস বলে কথিত। আপনারা নেমে চবি তুলতে পারেন, কিন্তু ২০ মিনিটের বেশি সময় দেওয়া যাবে না। একথা শুনে অনেকেই রেগে গেলেন। তখন ড্রাইভার এই বলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন যে, আমাদের একঘণ্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছাতে হবে। তাছাড়া আমাদের বাসের একমাত্র ড্রাইভার মিস্টার টনির বয়স ৬২ বছর, ওঁর কথাটাও তো ভাবতে হবে?
                      যাইহোক, আমরা একটা ঢাল রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে একটা নিচু প্রাচিরের গায়ে দাঁড়ালাম। সামনে তারের বেড়া দেখে বরাবর এগিয়ে গিয়ে একটা  গেট দেখতে পেলাম। কিন্তু তালা বন্ধ। বাধ্য হয়্যে তারের বেড়ার এপাশ থেকে  লেকের ছবি তুললাম। জলের ধারে একটা ভাঙ্গা দুর্গ দেখা যাচ্ছে। কাছে যেতে  পারলাম না বলে খারাপ লাগছে। তবে লেকের জল আর ওপাড়ের জঙ্গল, মেঘলা আকাশ, সব মিলিয়ে কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। লেকের জলে বা জঙ্গলে কোনো ভয়ঙ্কর জন্তু থাকা অস্বাভাবিক নয়। এখানে আর কিছু করার ছিলন, তাই  বাসে উঠে বসলাম। বাস আমাদের ৪০ মিনিটের মধ্যে হোটেলের সামনে দাঁড়াল। রাস্তার ওই সাইডে ভিক্টোরিয়া শপিং সেন্টার। বাস থেকে নেমেই চোখে পড়ল রেল  স্টেশন। হোটেল আর স্টেশনের সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় কয়েকটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলের বিশাল অটোমেটিক দরজা খুলে গেলে ভিতরে ঢুকে  প্রথমেই চোখ পড়ল ওপরে ওঠার সিঁড়িতে। পুরনো দিনে রাজা রাজড়াদের বাড়িতে যেমন সিঁড়ি দেখা যায়, ঠিক তেমন। ওখান থেকে চোখ সরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে  দেখি রিসেপ্সন কাউণ্টাররে পাশে যারা বসে আছেন তাঁদের মধ্যে দুজন ভদ্রমহিলার চেহারা ও পোশাক দেখে বুঝলাম এরা এশিয়ান। ভারতীয়ও হতে পারেন। তাদের একজন হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইণ্ডিয়ান? আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলে  আরও প্রশ্ন ছুটে এল, আমরা ইণ্ডিয়ার কোথায় থাকি? আমরা কোথা থেকে এসেছি? ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি ওঁদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওনারা মুম্বাইয়ে থাকেন, এখানে  ফ্যামিলির সঙ্গে বেড়াতে এসেছেন। সম্পর্কে ওঁরা দুই বোন। এক বোন কলকাতায় কিছুদিন ছিলেন। আজ ওনারা হোটেল ছাড়ছেন।
      ইতিমধ্যে খান সাহেব চাবি পেয়ে গেছেন। এখানেই চাবি সিস্টেম, অন্য হোটেলগুলিতে কার্ড সিস্টেম ছিল। এই হোটেলে তমালরা পাশাপাশি না হলেও একই  ফ্লোরে রুম পেয়েছে। লিফট দিয়ে উঠে নিজেদের রুম খুঁজতে গিয়ে দেখলাম সর্বত্র বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। করিডোরের দেওয়ালে দেওয়ালে পুরনো দিনের (নিশ্চয় দামি) পেন্টিং লাগানো আছে। রুমের ভিতরটাও তাই। খুবই সুন্দর করে সাজানো। এছাড়াও প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুরই সুব্যবস্থা রয়েছে। আসলে আমাদের মত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের তখন হোটেল বাসের অভিজ্ঞতা খুব একটা ছিল না। সেই জায়গায় বিদেশের এই মানের হোটেল কেমন হতে পারে তা ধারণাতেই ছিলনা। স্নানে ঢুকে দেখলাম, সেখানেও বডি ওয়াস, বডি লোশন,  সাবান, শ্যাম্পু, হ্যান্ড ওয়াস, টিসু পেপার, সবই আছে। চারখানা সাদা  টাওয়েল গরম হচ্ছে। স্নান সেরে বেরিয়ে রুমে থাকা হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে চুলটা একটু শুকিয়ে নিয়ে শাড়ি শাল গায়ে চড়িয়ে নিচে নেমে দেখি সবাই ডিনারে চলে গেছেন রাজধানী রেস্টুরেন্টে। আসার সময় বাস থেকে রেস্টুরেন্টটা দেখেছি, এই ফুটেই পড়বে। আমরা দুজনে হাঁটা দিয়েছি যখন, তমালের ফোন পেলাম, কাকিমা, কোথায় আপনারা? আসলে স্নানের সময় ঠাণ্ডাজল গরমজল এডজাস্ট করতে পারছিলাম না। ওখানেই অনেক সময় চলে গেছে। ফুটপাত ধরে হাটতে হাঁটতে  একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে ও আর একটু এগিয়ে যেতে বলল। কোহিনূরের মত বড় নয় রাজধানী রেস্টুরেন্ট। তবে মোটামুটি সাজানো। আগের দুটি রেস্টুরেন্টেই টিভিতে বীর জারা সিনেমার গান শুনে মনে হয়েছিল সিনেমাটি এদেশেও খুব জনপ্রিয়। এই রেস্টুরেন্টে হিন্দি গান শেষ হতে বাংলাদেশের বাংলা গান শুরু হল। জানলাম এই রেস্টুরেন্টের মালিক একজন বাংলাদেশি মুসলিম। শুধু তাই নয়, ম্যানেজার, থেকে ওয়েটার সবাই বাঙালি। আমাদের সঙ্গে ওঁরা বাংলায় কথা বলছিলেন। ডিনারে রয়েছে, ভাত, ডাল, নান, সবজি, চিকেন, ডিম, ও কিছু ব্রিটিশ ডিশ। খেতে বসলাম, তখনও চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে দেখে একজন বললেন, রুমে গিয়ে ভাল করে চুল শুকনো করে শোবেন। তা না  হলে সকালে আর কথা বলতে পারবেন না।

                            ক্রমশ

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments