জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী-১৪/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী       
        
চতুর্দশ পর্ব   
      
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

দীপকরাগ না মেঘমল্লার 

আজ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ দিন যা তানসেনের জীবনে ইতিপূর্বে আসেনি। ভবিষ্যতেও হয়তো এই দিনের কথা লেখা হয়ে থাকবে। দ্বিপ্রহরের কিছু পূর্বে তানসেন কন্যা স্বরস্বতীকে নিয়ে শিবিকায় করে দেওয়ানী-আমের উন্মুক্ত চত্বরে প্রবেশ করলেন। শিবিকা থেকে তিনি বীণাযন্ত্র নিয়ে সরস্বতীর হাত ধরে নামতে তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হলেন কবিবর বীরবল, বাজবাহাদুর, আবুল ফজল প্রভৃতি নবরত্ন সভার সদস্যবৃন্দ। এদের দেখে সরস্বতী তাদের পাদস্পর্শ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। তারা সরস্বতী আশীবার্দ করে বললেন "আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সংগীত সভায় তোমার অবদান যেন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকে"। বীরবল তানসেনের হাত ধরে বললেন "আজ সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে সংগীতের জয়গাথা ঘোষিত হবে"। আবুল ফজল বললেন "আমি যে কথা বলে এসেছি মিঞা তানসেনের মত সঙ্গীতজ্ঞ বিগত পাঁচশত বৎসরের জন্মায়নি এবং ভবিষ্যতেও জন্মাবে কিনা সেকথা আজ দিল্লিবাসীরা প্রত্যক্ষ করবেন। সত্যের জয় হবেই"।            

দরবার কক্ষে হয়তো শ্রোতৃমন্ডলীর স্থান সংকুলান হবে না সেই জন্য এই উন্মুক্ত স্থানে সংগীত সভার আয়োজন করা হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানের উপরে চারিদিকে সামিয়ানা টাঙিয়ে যেমন রৌদ্রতাপের তেজ হ্রাস করার ব্যবস্থা হয়েছে তার সাথে যমুনার থেকে কিছু পরিমানে শীতল বাতাসও আসবে। সম্রাটের সিংহাসন যেখানে বসানো হয়েছে তার উপরে চন্দ্রাতপ। তাঁর আসনের একদিকে সংগীত মঞ্চ যেখান থেকে তানসেন সংগীত পরিবেশন করবেন, অন্যদিকে নবরত্ন সভার সদস্যবৃন্দ এবং অন্যান্য গায়কদের আসন। তারপরে দিল্লীর অভিজাত আমীর ওমরাহদের বসার ব্যবস্থা। যেদিকে সংগীত মঞ্চ তার পাশের স্থানে চিকের আড়ালে হারেমের বেগমদের ও অন্যান্য নারীদের বসার ব্যবস্থা। আজকের এই সঙ্গীত সভায় হারেমের দাসী বাঁদীরা মায় খোজা প্রহরীরাও এসে উপস্থিত হয়েছে। সকলের শেষে দিল্লীর আমজনতার বসার ব্যবস্থা। সকলেই প্রায় এসে গেছেন। সভাস্থলকে দেখে মনে হচ্ছে যেন জনসমুদ্র। সম্রাট আকবর এখনও এসে পৌঁছাননি। সকলেই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন সম্রাটের আগমনের পরে কখন সঙ্গীত সম্রাটের হাতের বীণাযন্ত্রের ঝঙ্কারে সংগীতস্থল কেঁপে উঠবে।                

অল্প সময় পরেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের শব্দে এবং দ্বারীর উচ্চকণ্ঠের নিনাদে সম্রাটের আগমন বার্তা ঘোষিত হল। সম্রাট এসে সিংহাসনের বেদীতে উঠে দাঁড়াবার পরে সবাই তাকে অভিবাদন জানালেন। সবাইকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে নিজে সিংহাসনে উপবেশন করলেন। সম্মুখে তাকিয়ে দেখলেন উন্মুক্ত চত্বর যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এক ঝলক দেখে নিয়ে তিনি দেখলেন তাঁর পাশের মঞ্চে তানসেন বীণাযন্ত্র নিয়ে নিজের আসনে বসে আছেন এবং তানসেনের আসনের নীচের ধাপে তাঁর কণ্যা সরস্বতী অন্য একটি বীণাযন্ত্র নিয়ে বসে আছে। তানসেনের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন "আপনি প্রস্তুত?" 

তানসেন বললেন "হ্যাঁ জাহাঁপনা"। তানসেনের দিকে তাকিয়ে তাঁর ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। তানসেনের দিকে চেয়ে আবছা হাসি, বিনিময় করে বললেন “তাহলে আপনি শুরু করুন”। সম্রাটের  নির্দেশ পাবার পরে তানসেন কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হয়ে গুরু হরিদাস স্বামী ও ঘাউস মহম্মদকে স্মরন করে কোলের উপরে রুদ্রবীণা তুলে নিয়ে দীপক রাগের আলাপ শুরু করলেন। সরস্বতীর দিকে একবার তাকিয়ে ইশারাতে ইঙ্গিত করলেন যেন সঠিক সময়ে সে শুরু করে। সমগ্র শ্রোতৃমন্ডলী নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে যেন এক অনাগত প্রলয়ের প্রহর গুনছেন। ধীরে ধীরে তানসেনের হাতের আঙুলগুলির স্পর্শে রুদ্রবীণা প্রাণ পেয়ে ঝঙ্কার তুলল। সমগ্র সংগীতস্থল রুদ্রবীণার ঝঙ্কারে ও তানসেনের কণ্ঠের জাদুতে মন্দ্রিত হতে লাগল। ধীরে লয় থেকে ক্রমশঃ দ্রুতলয়ে যখন রুদ্রবীণা ঝঙ্কৃত হতে শুরু করলো তখন সভাস্থলের সকলেই অনুভব করলেন যমুনার থেকে এতক্ষন যে শীতল বাতাস আসছিল তা' বন্ধ হয়ে সঙ্গীতস্থল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রাঙ্গণের নিচের গোলাপ বাগিচার ফুল ও পাতাগুলি গরম বাতাসের তাপে ঝলসে যাচ্ছে। বাতাস ক্রমশ এত উত্তপ্ত হতে শুরু করল যে সভাস্থলের পুরুষেরা তাদের উষ্ণীষ ও পাগড়ী খুলে রাখতে বাধ্য হল। সম্রাটের সিংহাসনের সামনে একটি প্রদীপদানীতে প্রদীপ রাখা ছিল সেটিও দপ করে জ্বলে উঠলো। সম্রাটের দুপাশে যে বাঁদীরা তাঁকে পাখার বাতাস করছিল অধিক তাপে তাদের হাত থেকে পাখাগুলি নামিয়ে রাখতে বাধ্য হল। কোনদিকে তানসেনের ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে একমনে বীণায় ঝঙ্কার তুলে দীপক রাগ গেয়ে যাচ্ছেন।    

আগুনের তাপে সঙ্গীত সভাস্থল প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। কেবলমাত্র নবরত্ন সভার সদস্যরা অসহ্য গরমেও বসে আছেন। যে কুচক্রীদের পরামর্শে সম্রাট আকবর এই সংগীতের আয়োজন করেছিলেন তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে আগেই পালিয়ে গেছে। প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা থেকে এক সময়ে যেখানে হারেমের রমনীরা বসেছিলেন সেই চিকে আগুন ধরে গেল। তাঁরা ভয়ে দিগবিদিক শূন্য হয় আলুথালু বেশে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। প্রহরীরা চিৎকার করে বলতে লাগলো " আগ লাগ গ্যয়া, সব তফাৎ যাও"। দীপক রাগের প্রভাব দেখে সম্রাট ভাবলেন তানসেন কোন মিথ্যা কথা বলেন নি। এদিকে দেখতে দেখতে আগুনের তাপে তানসেনের সমস্ত শরীর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল, হাতের আঙ্গুলের চামড়াগুলি পোড়ার এক উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে। অসহনীয় এই পরিস্থিতিতে দীপক রাগকে প্রশমিত করার জন্য যে মেঘমল্লার রাগ গাইবার কথা ছিল কন্যা সরস্বতীর বিপদের সময় সেই রাগের গায়কী রীতি তার স্মরণে এলোনা। সে একপ্রকাশ বিবশ হয়ে বললো "পিতা আপনি বন্ধ করুন"। এই কথা বলে সে আসনের উপরে অচৈতন্য হয়ে পড়ল।             

এদিকে আগুনের শিখা এক সময়ে সম্রাটের মাথার উপরে টাঙ্গানো চন্দ্রাতপ স্পর্শ করল। সম্রাটের দেহরক্ষীরা তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাবার উপক্রম করতে তিনি রাজী হলেন না, কারণ তাঁর কথাতেই তো আজকের এই সংগীতের আয়োজন। তিনি সঙ্গীতস্থল ছেড়ে চলে গেলে তাঁর অপযশ ঘোষিত হবে। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন "মিঞা তানসেন, বন্ধ করুন দীপক রাগ"। কিন্তু তানসেন যেন তখন পাগলের মত হয়ে দীপক রাগ গাইছেন।                         

এমন সময় সঙ্গীতস্থলে ছুটে এলো এক উদভ্রান্ত যুবতী যে তানসেনের হাত থেকে রুদ্রবীণা ছিনিয়ে নিয়ে নামিয়ে রাখলো। তানসেন সেই মূহূর্তেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন। আর সেই যুবতী সরস্বতীর কাছে থাকা বীণা নিয়ে শুরু করলো মেঘমল্লার রাগ। কি অপূর্ব, স্নিগ্ধ সেই সুর। ধীরে ধীরে সঙ্গীতস্থলের অগ্নিময় বাতাস প্রশমিত হয়ে শীতল বাতাস বইতে শুরু করল। আকাশের বুকে একখন্ড কৃষ্ণবর্ণ মেঘের সঞ্চার হয়ে ধারাবর্ষন শুরু করল। গোলাপ বাগিচার গাছের কান্ডগুলিতে নূতন পত্রোদ্গমের সূচনা দেখা যাচ্ছে। সম্রাট সহ যে কয়েকজন সঙ্গীত স্থলে বসে ছিলেন তারা অনুভব করলেন এ এক অন্য রাগ। এই রাগের মধ্যে সৃষ্টির সজীবতা আছে, দীপক রাগের মত ধ্বংসকারী নয়। সম্পূর্ণ রাগটি গাওয়ার পরে সঙ্গীত স্থল সকালের মত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। চন্দ্রাতপে এবং চিকের আগুন প্রহরীরা আগেই নিভিয়ে ছিল।                        

যুবতীর গানের শেষে সম্রাট ও নবরত্ন সভার সদস্যরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন "কে তুমি এসে আমাদের সকলের জীবন বাঁচালে? এই রাগের নাম কি যার মধ্যে রয়েছে নারীর কমনীয়তা ও সৃষ্টির সজীবতা?" 

যুবতী বলল "আমার নাম রূপোয়াতী। আর এই রাগের নাম মেঘমল্লার"। এই কথা বলে ত্বরিতগতিতে সে সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। 
                                                                 ক্রমশঃ

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments