জ্বলদর্চি

শচীন দাশ /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১৬ 

শচীন দাশ 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


শচীন দাশ (১৯৫০-২০১৬) বিশ শতকের সত্তরের বছরগুলির একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। সুন্দরবনের বাদা অঞ্চল-লাট অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশ ও তার মানুষজন, তাঁদের বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই, দৈনন্দিনতার নানান সমস্যা উঠে আসে তাঁর গল্পে। বস্তুত এখানকার মানুষদের সামগ্রিকভাবে বোঝা সম্ভব হবে না সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রেক্ষাপট ছাড়া। জল-জঙ্গল বেষ্টিত আবহে মানুষদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। নদী-নালা সমুদ্র, অরণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে অজস্র লৌকিক-অলৌকিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস। নিম্নভূমির এই জল-জঙ্গলের পারিপার্শ্বিকতায় বেঁচে থাকা মানুষদের জীবনবোধের আখ্যান তাঁর গল্প। শচীন দাশের গল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য— সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রাত্যহিকতা, মুসলিম মানস।   

জলজঙ্গলের দ্বীপভূমিতে মানুষ বাঁচার তাগিদে কত বিচিত্র পেশাকে যে বেছে নেন! বাংলার অন্য কোথাও হয়তো সেই পেশার কোনও অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। সুন্দরবনের মাটি ও মানুষকে না জানলে বোঝা যাবে না পেশাগুলির গুরুত্ব এবং বৈশিষ্ট্য। যেমন ‘বাওয়ালি’— এই অঞ্চলের মানুষদের একটা বিশেষ পেশা। গাছকাঠুরেরা যখন জঙ্গলে গাছ কাটতে যান, তখন দলের সঙ্গে থাকেন একজন বাওয়ালি— বাউলে। জঙ্গলেরও একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম মেনে চলতে হয় সকলকে। আর নিয়ম ভাঙলে অসন্তুষ্ট হন বনবিবি। তখন চুপি চুপি এগিয়ে আসে অরণ্য বিভীষিকা— বাঘ। সবার অলক্ষে এগিয়ে এসেই গাছকাটাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিমেষে পিঠে তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে পালিয়ে যায়। এভাবে কত গাছকাঠুরে মারা গিয়েছেন বনের ভেতরে বেঘোরে। মানুষের বিশ্বাস— বনবিবিই তাঁদের ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন দল থেকে। তাই কাঠকাটারা সাতবিবিরথানে পুজো-হাজোত দিয়ে জঙ্গলে যান। আর সঙ্গে নেন একজন বাওয়ালি। বাওয়ালিরা কাঠকাটাদের পাহারা দেন। বাঘ পড়লে নড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মন্ত্র পড়ে বাঘ তাড়ান। আর অবসর সময়ে নৌকায় বসে দলের সবাইকে নানারকম গল্প শোনান। 
এই বাওয়ালিরই গল্প ‘বনবিবির বাওয়ালি’ (মার্চ ১৯৮০)। গল্পের কেন্দ্রে আছে সানা বাউলে। তার বাবা ছিলেন বিখ্যাত বাওয়ালি। বাবার কাছ থেকেই সানা শিখেছিল মন্ত্র। তবে বাবার কাছ থেকে সবকিছু শিখতে পারেনি। বাবা ছিলেন গুণীন। জঙ্গল ঘেঁটে ঘেঁটে ঔষুধি শিকড়-বাকড় তুলে নিয়ে আসতেন। সেই শিকড় হাতে নিয়ে মুঠো ঘোরালে বিষাক্ত সাপও ফণা নামিয়ে পালাত। এহেন আশ্চর্য ক্ষমতাশালী মানুষও একদিন জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন! কিছুদিন পরে সানাকে ফেলে তার মা সনাতন গিরির সঙ্গে পালিয়ে গেল। মা চলে যাওয়ার পরে বহু কষ্টে চেয়েচিন্তে, নির্জলা উপোষ থেকে বড়ো হয়েছে সানা। আর শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছে এই পেশা।

কিন্তু বাওয়ালিদেরও দিন শেষ হয়ে আসছে ক্রমশ। এখন বাওয়ালিদের তেমন সঙ্গে নেয় না কেউ। নিলেও দু-চার টাকা ঠেকিয়ে দেয়। বাওয়ালি প্রথার উপরে মানুষের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। বনবাবুরাও বোমার লাইসেন্স তুলে দিচ্ছেন গাছকাটাদের হাতে। গাছ কাটতে নামার আগে জঙ্গলের ভিতরে বোমা ফাটিয়ে বাঘকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। বোমার শব্দে ভয় পেয়ে বাঘও আসে না কাছে। নিশ্চিন্তে গাছ কাটা চলে। তবে মউলিরা বোমা ফাটায় না। মাঝে মাঝে মউলিরা বাঘের ভয়ে সঙ্গে নেয় বাওয়ালিদের। কিন্তু তাও এখন আর নেয় না কেউ।

সানা কাজ পায় না। অনাহার দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী তার। এরমধ্যে একবার বহর আলির কাঠকাটার গোনায় ডাক পায় সে। টাইম কাটাবার জন্য কিস্‌সা বলতে বলতে চলে নদী সমুদ্র পেরিয়ে সপ্তমুখীর মোহানার দিকে। “কত রকম, কত ঘরের হরেকরকম কিস্‌সা। নানান সব গল্প। কখনও বাঘ শিকারের, কখনও দেব-দেবীর, কখনও বা নানা দেশের বংশের গল্প-গাঁথা। এক-একবার ঘটনা বলে, গল্প জমিয়ে তোলে, আবার মাঝে মাঝে দু-একটা গান অথবা ছড়া। ও বউ ঢেঁক্‌সিলেতে আয়/ তর ধরি দুকোন পায়।/ চালকোট্টা মোর কেঁইড়ে দে যা/ বাজারে বয়ে যায়।। কিংবা— হাট ভাঙিল বেলা যে যায়/  তোরা পার হবি কার নায়।/ যে লইবে বনবিবির ভার/ তারে দিব সংসারের দাঁড়।।” 

তারপর দ্বীপে পৌঁছে গম্ভীর সুরে মন্ত্র পড়ে দ্বীপবন্দী করে সানা— “পুবে হাম্‌জার বন্ধ্‌/ দক্ষিণে কোলেফ আল্লার বন্ধ্‌/ পশ্চিমে সোলেমান পয়গম্বরের বন্ধ্‌/ উত্তুরে ভানু বসকরের বন্ধ্‌ ...”। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সব আয়োজন বৃথা হয়ে যায়! বিকেলের দিকে সোরগোল ওঠে। গাছ কাটতে কাটতে নাদু শেখ একবার বনের ভেতরে কী জন্যে গিয়েছিল, সেই সময় ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়ে তাকে টেনে নিয়ে যায় বাঘ। শুনে লাফিয়ে ওঠে সানা। মুখ থেকে তার কদর্য গালাগাল বেরোতে থাকে। একটা মশাল নিয়ে দৌড়ে যায় জঙ্গলে। তার পঁচিশ বছরের বাউলে জীবনে কোনওদিন বাঘ পড়েনি সামনে। যদিও সে বলে বাউলে জীবনে অনেক বাঘকে টুটি টিপে ধরে নাচিয়েছে। হাতের নড়ি দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে অনেক বাঘকে নদী পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এইসব গালগল্প না বললে লোকে তাকে ডাকবে না। নাদু শেখের ভুক্তাবশিষ্ট দেহের কিছু অংশ অন্তত নিয়ে ফিরতে না পারলে বাউলে জীবনে তার ধিক্কার নেমে আসবে। বহর আলিরা তাকে বিশ্বাস করবে না।

জঙ্গলের মধ্যে সানা ভয় পায়। একটা ডাক শুনতে পায় সে। মনে হয় তার হারিয়ে যাওয়া বাবা ডাকছেন তাকে। মনে পড়ে অনাহারে কাটানো দিনগুলির কথা। হঠাত কান্নায় ভেঙে পড়ে সে— “বাপ! যদি মোর বাপ হোস, তবি মোরে লিয়ে যা। মোর পেটি বড়ো খিদি— আক্কুসির মতো খিদি। খিদি মোর ছেইলে আর বউডার পেটি। খিদির জ্বালায় মুই বাউলে হয়ে ঘুরি বেড়াই। যেমুন তেমুন বলি পয়সা জুটিয়ে আনি— কিন্তুক একন আর জোটে না। তুই নে বাপ, মোরে এইস্যে লিয়ে যা...”। 

চিৎকার করে ওঠে সানা। মর্মন্তুদ দারিদ্র্য প্রতিদিন কাহিল করে দিচ্ছে তাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপবাসীদের অলৌকিকতায় বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। আর নানান বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পেশাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই পেশা হারানো মানুষদের তীব্র হাহাকার গল্প হয়ে উঠেছে শচীনের হাতে। সুন্দরবনের বাস্তব সত্য এখানে সাহিত্যের সত্য হয়ে উঠেছে। লেখক আখ্যানে লোকায়ত অলৌকিক বিশ্বাস গল্পের বিষয় করে তুললেও তাকে প্রশ্রয় দেননি। বিজ্ঞান-মনস্ক লেখক তাই গল্পের শেষে অন্য একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন— “সানা কিছু টের পায় না। তবে চোখ বোজার আগেই নজরে আসে, বিশাল অরণ্য ভেদ করে দুটো জ্বলজ্বলে নীল চোখ যেন তার ঘাড়ের ওপরে এসে পড়েছে।”  

বাপ নয়, বাঘ কেড়ে নেয় তাকে। হয়তো মস্ত বড়ো গুণীন সানার বাবাকেও হারিয়ে যেতে হয়েছিল এভাবেই! এভাবেই হারিয়ে যায় তারা। আর লোকমানসে ছড়িয়ে পড়ে অন্য কোনও মিথ। না-হলে যে মিথ্যে হয়ে যাবে বাওয়ালি সম্পর্কে লালিত মানুষের আজন্মের ধারণা। 

শুধু বাওয়ালি নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরকম আরও কত কত পেশা যে প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে! মানুষ পেশাহীন হয়ে পড়ছেন, অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এ-সবই শচীন দাশের বিভিন্ন গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।                                     

শচীন দাশ একজন নদীবিশেষজ্ঞ। তাঁর কত গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের বিষয় হয়ে উঠেছে নদী। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গল্পের নাম ‘নদী মিথ্যে বলে না’ (‘প্রতিদিন’, শারদীয়, ১৪১১)। এই নামে তাঁর একটি গল্প সংকলনও রয়েছে। ‘নদী মিথ্যে বলে না’ (২০১৫) তাঁর জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত শেষ গল্পগ্রন্থ। পিয়ালির মেয়ে আয়েশার বিয়ে হয়েছিল চন্দনেশ্বরের বর্ধিষ্ণু পরিবারে। সিরাজুদ্দিনের ছেলে কওসরের সঙ্গে। বিয়ের কিছুদিন পরেই কওসর চলে গেল আরবে, তেলের দেশে। অনেক টাকা উড়ছে সেখানে। তেলের টাকা। একবার যেতে পারলেই হল। গিয়েই চিঠি দিয়েছিল বাপকে। আলাদা করে আয়েশাকেও। তারপর আর কোনও খবর নেই তার।

শিক্ষিতা আয়েশাকে বড়ো ভালোবাসে তার শ্বশুর-শাশুড়ী। তবুও কিছুদিন পরে আয়েশার বাবা ফজর আলি তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। শোনা যাচ্ছিল কওসর নাকি ওদেশে বিয়ে করেছে আবার। দেশে ফিরবে না। ফজর মেয়ের বিচ্ছেদের মামালা করবে। বিয়ের ব্যবস্থা করবে আবার। কিন্তু আয়েশা রাজি হয় না এতে। তার পাওয়া বরের একটি মাত্র চিঠি গোপনে নদীর পাড়ে এসে বারবার পড়ে। আর বরের কথা ভাবে। তার ভালোবাসামাখা চিঠি পড়তে পড়তে শিউরে শিউরে ওঠে। 

ডিভোর্সের কাগজে সই করে না। তারই উদ্যোগে খোঁজ নেওয়া হয় সরকারি অফিসে, পাসপোর্ট অফিসে। কোনও হদিশ পাওয়া যায় না। তখন তার আর কাগজে সই না করে উপায় থাকে না। ফজর পাত্র পছন্দ করে রেখেছিল। শিক্ষিত পাত্র। ইদ্যত শেষ হবার অপেক্ষা শুধু। তারপর হলুদ নিয়ে যাওয়া। 

ইদ্যত শেষ হওয়ার ঠিক আগেই সিরাজের কাছে একটা চিঠি এল উর্দুতে লেখা। গাঁয়ের হাজিসাহেব পড়ে জানান, ছেলে তার বেঁচে আছে। কিন্তু আহত। আকশপথে ধেয়ে আসা বোমারু বিমানের ফ্যালা বোমায় একটা পা তার চলে গেছে। ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে পারলেও মন পড়ে আছে গ্রামে। একজন শুভানুধ্যায়ী বন্ধু চিঠিটি লিখে দিয়েছেন। তিনি আরও লিখেছেন, কওসর সবসময় একজনের কথা বলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। আয়েশা তার নাম। চিঠি সে নিয়মিত দিয়েছে কিন্তু চিঠি যাওয়ার মতো অবস্থা নয় সেদেশের। 

সিরাজ দৌড়ে আসেন পিয়ালি। কিন্তু আয়েশা তখন নদীর পাড়ে বারবার পড়া সেই চিঠি নিয়ে। কওসরের চোখের তলায় সে আবিষ্কার করেছিল অতল দিঘি। সেই দিঘি নদী হয়ে গেছে। আর সে জানে নদী কখনও মিথ্যে বলে না। 

এতো নদীরই গল্প। নদীদেশের মেয়ের নদীর প্রতি অপার বিশ্বাসের গল্প। নদী তার জলধারা দিয়ে কত কত কথা বলে চলে সর্বদা। সকলে সেই নদীর কথা বুঝতে পারে না। আয়েশা তো পারে। নদীর সঙ্গে খুব ভাব তার। তাই যখন তখন সে দৌড়ে আসে নদীতে। নদীও বুঝতে পারে তার ভাষা। নদীই তাকে জানিয়েছিল তার স্বামীর কথা। সেই বিশ্বাসে শেষ পর্যন্ত চিড় ধরেনি। নদীকে এখানে সর্বশক্তিমান একটা চরিত্র করে তুলেছেন লেখক। 
  
তেলের লোভে আমেরিকার ইরাক দখল করার যুদ্ধে আমাদের এই বাংলার বহু মানুষেরও সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাংলার যে সমস্ত মানুষ সেখানে কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাঁরা। তাঁদের পরিবার। প্রধানত এখানকার মুসলিম পরিবারের মানুষরাই সেখানে যেতেন কাজের সন্ধানে। আর আমেরিকান বোমা ইরাকিদের জীবনকে যেমন শেষ করে দিয়েছে, তেমনি বাঙালিদের জীবনও তছনছ করে দিয়েছে। শচীন দাশের বহু গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে মুসলিম জীবন ও মুসলিম মানস। প্রচলিত মুসলিম-জীবন নির্ভর গল্পগুলির থেকে শচীনের লেখায় উঠে আসা মুসলিম যাপন অনেকটা স্বতন্ত্র।     

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্যাখা যায় ধর্মীয় গোঁড়ামি আচ্ছন্ন করে রাখে একটা বড়ো অংশের মুসলিমদের। কেউ সেখান থেকে বেরোতে চাইলে সমাজে তিনি একঘরে হয়ে যান। আর যে কোনও গোঁড়ামি থেকে মানুষ বেরিয়ে আসেন তাঁর শিক্ষা দিয়ে। শিক্ষা সমাজকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার অভাব ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে আজও। এক-দুজন যদিও-বা লেখাপড়া করে গোঁড়ামি মুক্ত হন, তাদের পুরো সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বলা তো যায়-ই না, বরং বহু ক্ষেত্রে সমাজচ্যুত হতে হয় তাঁদের।

শচীন দাশের ‘ধর্ম-যুদ্ধ’ (‘সাপ্তাহিক বর্তমান’, জুন ১৯৯৪) গল্পে এরকম একটি বিষয় উঠে এসেছে। সুন্দরবন অঞ্চলের সোনাখালির বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবারের ছেলে জয়নাল। মায়ের উৎসাহেই উচ্চশিক্ষালাভ করেছে। কলকাতায় চাকরি করে। লেখালিখিও করে নিজে। বাবা চাননি সে কলেজের পাঠ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ুক। কিন্তু তার মা খুব আধুনিক। তাঁর গোপন কলসির মধ্যে আছে বন্দে আলি মিঞার কবিতার বই। নিজে পদ্যও লেখেন। কিন্তু আর পাঁচটা মুসলিম নারীর মতো স্বামীকে ভয় পান। 

জয়নালের বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর এই ছেলেও চাকরি না করে জমির চাষবাস দেখাশুনা করুক। নিকে করে সংসার করুক অন্যান্য ভাইদের মতো। ধর্মীয় আচরণ পালন করুক। কিন্তু জয়নাল নামাজ পড়া, রোজা রাখা তো দূরের কথা, কবে এসব চলে যায় মনেই থাকে না। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে দ্যাখে সবকিছুকে। তার কাছে ধর্ম পালনের থেকে জরুরি মানবিক আচরণ পালন। বাড়ি এসে ভাই-দাদাদের ছেলেপুলেদের হাঁস-মুরগির ছানার মতো ঘুরতে দেখে বিরক্ত হয়। একবার ঘুরিয়ে মাকে বলেও ছিল সে কথা। বাবার কানে যেতে বিরক্ত হয়েছিলেন। বাবাকে সে যুক্তি দিয়ে সব বোঝাতে চায়। কিন্তু বাবা বিরক্ত হন। 

বিয়ের প্রসঙ্গে সে মাকে বলেছিল পছন্দসই মেয়ে হলে যেকোনও ধর্মের হলেও অসুবিধে নেই তার। এরমধ্যে গ্রামে মিথ্যে খবর আসে জয়নাল হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। বাবা চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠান। সে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু মায়ের কথাকে ফেলতে পারে না। মায়ের চিঠি পাওয়া মাত্রেই দৌড়ে আসে। বাড়ি পৌঁছেই বাবার কঠোর বাক্য শোনে। তিনি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছেন। তার সম্পত্তির ভাগ পাবে না। বাড়িতেও যেন না আসে সে।

জয়নাল বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। রাস্তায় দ্যাখা পায় পুঁটলি হাতে মায়ের। তার জন্য তিলে পিঠে বানিয়েছিলেন। তা-ই এনেছেন। বাবা তাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে তাতে তার দুঃখ নেই। মাকে সে জানায়— “ও সবে আমার সত্যি প্রয়োজন নেই মা! শুধু প্রয়োজন আছে বাবাকে বোঝাবার...যদি কোনওদিন বোঝাতে পারি—”।

সেই আশা নিয়েই জয়নাল এগিয়ে যায় সামনের দিকে। নিজেদের সাম্প্রদায়িক সত্তাটুকুকে আঁকড়ে নিয়ে বাঁচতে চায়নি বলে পিতার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করতে হল। মনুষ্যত্বকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল বলে বঞ্চিত হয়েছে সম্পত্তি থেকে। বাধ্য হয়েই এভাবে ছিন্নমূল হয়ে যেতে হয় শিক্ষিত আধুনিক মুসলিম যুবকদের। শহরেই স্থায়ী হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও ফিরতে পারে না গ্রামে। আর গ্রামের মুসলিমরা পড়ে থাকেন গ্রামে। আগের মতোই অন্ধকার আঁকড়ে। তাই সামগ্রিকভাবে একটা সমাজ সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে পারেন না! 
 
রাজনীতি সচেতন লেখক শচীন দাশ। তীব্র রাজনৈতিক বোধ থেকে উঠে এসেছে তাঁর বহু গল্প। একসময় তেভাগা আন্দোলনের শরিক হয়ে উঠেছিলেন এই বাদা অঞ্চলের মানুষজন। সেই আন্দোলনকে বিষয় করে যেমন তিনি গল্প লিখেছেন, তেমনি মানুষের পরিবর্তিত রাজনৈতিক চেতনাকেও সমান দক্ষতায় গল্পের বিষয় করে তুলেছেন। সময়ের হাত ধরে মানুষের বোধ, রাজনৈতিক বিশ্বাস যেমন বদলে যায়, তেমনি বদলে যায় মানুষের সামগ্রিক যাপনও। মানুষের সমাজ-রাজনৈতিক মূল্যবোধের স্বরূপও বদলে যায়। এই বদলও সাবলীলভাবে উন্মোচিত হয়েছে তাঁর গল্পে।

সমসাময়িক ডিম্যান্ড থেকেই যেন শচীন দাশ লিখলেন ‘দু’রঙের মানুষ’ (‘আজকাল’, ২০১১)। এই গল্পে গ্রামীণ দলীয় রাজনীতির চিত্রটি তুলে ধরেছেন শচীন। এটিও লাট অঞ্চলের মানুষদের গল্প। আয়লা পরবর্তী সময়ের পরিবর্তিত রাজনীতি এসেছে এখানে। ঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষের জীবনটাও তো বিপন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেই রকম এক পরিস্থিতিতে বাঁধ মেরামতের কাজ করতে গিয়েছিল নওসাদ। ঠিকাদার তাকে কাজও দিয়েছিল। কিন্তু নতুন পঞ্চায়েত মেম্বার মতিউল এসে সেই কাজ কেড়ে নেয়। কারণ তার জবকার্ড নেই। জবকার্ড ছাড়া সঙ্গত কারণে কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ একসময় জবকার্ড ছিল তার। ঝড়ে হারিয়ে গেছে তা। কিন্তু সেই কার্ড দিয়েছিল পুরনো পঞ্চায়েত বোর্ড। এখন বোর্ড বদলেছে। অন্য রাজনৈতিক দলের বোর্ড। পুরনো কার্ড মানবে না তারা। নতুন করে কার্ড করতে হবে। 

তার আবেদনও করেছিল নওসাদ। কিন্তু কার্ড পায়নি। পাবে কী করে! আবেদন করলে তো চলবে না। রঙ বদলাতে হবে। রাজনীতির রঙ। মতিউল স্পষ্ট করে বলে রঙ বদলালে বাড়ি তৈরির শন পাবে। দিল্লি থেকে আসা ত্রাণের টাকাও পাবে। নওসাদ চুপ করে থাকে। কাজ পায় না। নদীতে জাল নিয়ে যায় শুধু।

এর মধ্যে একদিন দ্যাখে তার বন্ধু খয়রন বনসৃজনের কাজে যাচ্ছে। জবকার্ড পেয়েছে সে। নওসাদ অবাক হল খয়রনের কাজ পাওয়ায়। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তার। লাট অঞ্চলে যখন আন্দোলনের ডাক এসেছিল তখন নওসাদ আর খয়রনের দাদুই গেছিল নদী পেরিয়ে। তারপর তেভাগা আন্দোলন। নওসাদের দাদু ফেরেনি। একসময় আন্দোলনেরও শেষ হয়। নওসাদ খয়রনের বাবারা গিয়েছিল একসময়। তারপর সেই দুজন ফিরে এসেছিল দুটো রক্তবর্ণ পতাকা নিয়ে। দুজনের ভূমিতে পুঁতেছিল সেই রক্ত পতাকা। 

পরদিন খয়রন আসে তার কাছে। বলে রঙ পাল্টালেই জবকার্ড পাবে— “বলতিছি কী অঙটা তুই পাল্‌টায়েই নে নওসাদ। দিনকাল বড় খারাপ পড়তিছে। গা-গেরামের রকম দেখেছিস! এমনটা ছ্যালো কোনোদিন—”।

নওসাদ চুপ করে থাকে শুধু। সে জানে রঙ কি পাল্টানো যায় ? এ রঙ যে তার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে। ঘষলেও যে ওঠে না। বরং আরও জাঁকিয়ে বসে।

দলীয় রাজনীতি মানুষের প্রাত্যহিকতায় অমোঘ হয়ে উঠেছে। দলীয় পতাকা আশ্চর্যভাবে সেই দলের নির্দিষ্ট রঙ হয়ে গেছে এখন। যে কোনও একটা রঙে দেগে দেওয়া হচ্ছে মানুষকে। রাজনীতি ছাড়া রঙের পৃথক কোনও অস্তিত্বই নেই। রঙ— দলীয় রাজনীতি— জীবন একই সূত্রে গাথা। পরিবর্তিত জীবনবোধের এই গল্পই লিখেছেন শচীন দাশ। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নতুন কিছু নয় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে। কিন্তু শচীনের এই গল্পে তার অন্য এক বয়ান। ক্ষমতার বিপরীতে গিয়ে তাঁর এই উচ্চারণ আলাদা করে চোখে পড়বে।

জল-জঙ্গলের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা নিম্নভূমির মানুষদের জীবনযাপনের গল্পই শুধু নয়, শচীনের বহু গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে অন্য অনেক সমাজ-রাজনৈতিক-মানবিক সমস্যা। ছিটমহলের মানুষদের নিয়ে বহু গল্প লিখেছেন তিনি। ‘ছিটমানুষের বেত্তান্ত’, ‘ছিটমহলের ভূমি’, ‘ছিটপাখি’, ‘ছিটমানুষ’ ইত্যাদি গল্পের নামকরণের মধ্যেই রয়েছে ‘ছিট’ শব্দের ব্যবহার। বস্তুত ছিটের মানুষদের সমস্যার শেষ নেই। সেই সমস্যাও আমাদের চেনা ছকের সমস্যার থেকে একেবারেই আলাদা। ছিটমহল এবং ছিটের মানুষদের যাপন সম্পর্কে আজও সচেতন নন বহু মানুষ। সেদিক থেকে বাংলা গল্পের পরিধি অল্প যে কয়েকজন লেখকের হাতে ব্যাপ্ত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নাম শচীন দাশ।              
 
রাজনৈতিক বোধ এবং সময়চেতনা শচীনের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁর গল্পে উঠে এসেছে গ্রামীণ পরিবেশ এবং নিম্নবর্গের মানুষ। তীক্ষ্ণ সমাজ-সচেতনতা থেকে উঠে এসেছে শচীন দাশের গল্পগুলি। সমাজ-অর্থনৈতিক বিপর্জয় সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি তাঁর। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই ও লৌকিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পরম্পরা। হঠাত করেই কয়েক বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন তিনি। সুভদ্র, পণ্ডিত মৃদুভাষী শচীন আমৃত্যু সৃজনে ছিলেন, গল্পে ছিলেন। এভাবে চলে না-গেলে নতুন সময়ের, নতুন সমাজের আরও আরও কত যে গল্প পেতাম আমরা! সেই সব গল্প সময় ও রাজনীতির অন্য কোনও স্বতন্ত্র স্বর ধারণ করত।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments