জ্বলদর্চি

কবি জীবনানন্দ দাশের খড়গপুরের দিনগুলি /অর্ণব মিত্র

কবি জীবনানন্দ দাশের খড়গপুরের দিনগুলি 

অর্ণব মিত্র 


এক রবিবার সকালবেলায় খড়গপুর কলেজের সামনে নতুন ভোটদাতা পরিচয় পত্র বানানোর জন্য আবেদন নিয়ে পৌঁছিয়েছি। কোথায় যেতে হবে জিজ্ঞেস করাতে গার্ড বলল ‘ওই যে পুকুরের ওদিকে একদম কোনের দোতালা বিল্ডিং। ওটা বাংলা বিভাগ,ওর নীচের ঘরটায় চলে যাও’। কাছে গিয়ে দেখি ঘরটা তালাবন্ধ। বি – এল-ও অফিসার তখনও আসেননি। আসপাশটা একটু ঘুরতে লাগলাম। কলেজের উত্তরে বাঁ-দিকে কোণে এই বিল্ডিংটি দোতালা সাদা রঙের। বিল্ডিং-এর ডানদিকে অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য একটি পাকা মঞ্চ বানানো আছে। বাংলা বিভাগের দোতলা ভবনটির সামনের বারান্দা দিয়ে সিঁড়ি উপরে চলে গেছে। চোখে পড়ল সিঁড়ির মুখেই ভবনের সামনে একটি আবক্ষ মূর্তি।কাছে গিয়ে দেখি মূর্তিটি কবি জীবনানন্দ দাশ-এর।

কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালে, অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশালে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশুনা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপনা দিয়ে। তিনি কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি সেখানে ছিলেন ইংরাজী ভাষার অধ্যাপকের পদে। এরপর তিনি সেই চাকরি ছেড়ে কলকাতার দক্ষিণে বাঘেরহাট পি,সি কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। তবে সেখানেও তিনি স্থায়ী হতে পারেননি। এরপর তিনি তাঁর জন্মস্থান বরিশালের কাছে ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার জন্য যান। কিন্তু কিছুকাল পরে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় ভৌগোলিক ভাবে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ-স্থান দুটি আলাদা দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে তারা সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা তাঁর আর করা হয়নি। কলকাতায় এসে আবার তিনি অধ্যাপনার চাকরি খুঁজতে থাকেন। তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশ তাঁর জন্য দিল্লির একটি কলেজে অধ্যাপকের চাকরির খোঁজ করেন। সেই সময় খড়গপুর কলেজ থেকে ইংরাজী বিভাগের অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। 


২ 
শ্রী হিমাংশুভূষণ সরকার পূর্ববঙ্গ থেকে এসে ১৯৪৮ সালে খড়গপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কবি এই কলেজের অধ্যাপক পদটির জন্য আবেদন করেন ও নির্বাচিত হন। সেই সময়ের মধ্যে তাঁর অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ও জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। বেরিয়েছে তাঁর বিখ্যাত ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেই সময় কলেজে সরোজ কুমার ভট্যাচার্য ছিলেন ইংরাজী বিভাগের একমাত্র অধ্যাপক। তাঁর একার পক্ষে বিভাগ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। ১৯৪৯-১৯৫০ শিক্ষাবর্ষে কলেজের ইংরাজী বিভাগের অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করায় এরপর তিনি নির্বাচিত হন। তাঁর চাকরির অভিজ্ঞতা ও কবিখ্যাতির জন্য খড়গপুর কলেজে তাঁকে তড়িঘড়ি ও সহজেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয় ও তিনি কাজে যোগ দেন ১৯৫০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। তখন খড়গপুরের ইন্দায় কলেজের নিজস্ব ভবনটি হয়নি। ক্লাস হত খড়গপুরের দক্ষিণে কৌশল্যায় সিলভার জুবিলি হাইস্কুলে। তাই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় স্কুলভবনের ছাত্রাবাসের একটি একক ঘরে।


কলকাতা থেকে খড়গপুরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। কবি জীবনানন্দ দাশ একবার চলে আসেন খড়গপুরের পরিবেশ ও কোথায় থাকবেন দেখবার জন্য। খরগপুরে এসে তিনি কলেজের পরিবেশ,কর্মীদের আচরণ দেখে খুশী হয়েছিলেন ও কলকাতায় গিয়ে অধ্যক্ষ ‘হিমাংশু’বাবুকে কাজে যোগদানের সম্মতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নির্জনতা প্রিয় ও অল্পভাষী। ছুটি পেলেই কলকাতার   বাসায় চলে যেতেন তাঁর পরিবারের কাছে। খড়গপুরে কারখানা,রেলের বিভিন্ন কার্যালয়, রেল-কোয়ার্টার,ট্রেন-লাইনের ধারে লালমাটির পথ,পুকুর, ধানক্ষেত দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি।

সিলভার জুবিলি হাইস্কুলের ছাত্রাবাসের ঘরে ছিল তাঁর কলকাতা থেকে আনা কিছু বই,একটি খাট ও বিছানাপত্র। ছাত্রাবাস দেখাশোনার জন্য থাকতেন কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক পুলিন বিহারী পাল। তাঁর সাথে অল্পসল্প কথা হত শুধু। শোনা যেত ক্লাসের সময়টুকু ছাড়া বিশেষ বাইরে বেরতেন না লাজুক ও আত্মমগ্ন এই কবি। তবে কবির ছিল সন্ধ্যাবেলা বেড়ানোর অভ্যাস। তবে কবি কি বেড়ানোর জন্য কৌশল্যামোড় যেতেন,বা হাঁটতে যেতেন স্কুলের ডান দিকে চারতলা কোয়ার্টার-এর লাল মাটির পথ ধরে। সেই সময় কৌশল্যা কেমন ছিল!কবির সেই সময়ের কোন রচনায় কি খড়গপুরের প্রকৃতি, পরিবেশ বা থাকার অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে!। 
শোনা যায় কলকাতা থেকে দূরে থেকে স্ত্রী-ছেলেমেয়ের জন্য উতলা হতেন ও প্রায় প্রতি সপ্তাহের শেষে কলকাতা চলে যেতেন। তবে কয়েকমাস থাকার পর খড়গপুর কবির ভাল লেগে যায় ও শেষে তিনি পাকাপাকি ভাবে খড়গপুরে থাকবার কথাও ভেবেছিলেন। তবে কলকাতায় স্ত্রী বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি স্ত্রীকে রেখে ফিরে আসতে পারেননি।পরে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ও তাঁর খড়গপুরের কলেজের চাকরি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। শেষে কয়েকমাস কাজ করার পর ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের পর তিনি আর বিভিন্ন কারণে খড়গপুরে আসতে পারেননি ও তাই অধ্যাপকের চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। এই বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকার-কে লেখা চিঠিগুলি কলেজের করণিক উজ্জ্বল কুমার রক্ষিতের কাছে এখনও রাখা আছে। কবির জন্মের ১০০ বছর পূর্তিতে খড়গপুরে কবির জন্ম শতবর্ষ কমিটির তরফ থেকে কলেজের বাংলা বিভাগের সামনে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর এই আবক্ষ মূর্তিটি। খড়গপুর কলেজে তাঁর বেতন ছিল ১৫০ টাকা(বেসিক)ও ডি,এ ছিল যৎসামান্য। আর এখানে তাঁর চাকরির সময়কাল ছিল মাত্র ৫ মাস ১২ দিন।

তথ্যসূত্র- প্রাবন্ধিক উজ্জ্বল কুমার রক্ষিত, কবি ও প্রাবন্ধিক কামরুজ্জামান, আনন্দবাজার পত্রিকা।


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments