জ্বলদর্চি

কিন্নর রায় / বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১৭  

কিন্নর রায়  

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


বিশ শতকের সত্তরের বছরগুলির উত্তাল সমাজ-রাজনৈতিক আবহে যে সমস্ত লেখকেরা বাংলায় কলম ধরেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যমত তরুণ-তুর্কি-লড়াকু লেখক কিন্নর রায় (জন্ম-১৯৫৩)। শৈশব-কৈশোর কেটেছে হাওড়ার বালি অঞ্চলে। পরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন দক্ষিণ কলকাতায়। বড়ো হয়েছেন রাজনৈতিক আবহে। তাঁর বাবাও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্নর ছোটোবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন। যৌবনে নকশাল পন্থী রাজনীতির সূত্রে জেল খেটেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কাছেই নরক’ (১৯৮১)-এ সেই জেলযাপনের কথা এসেছে। পরবর্তীকালে লেখা ‘মৃত্যু কুসুম’ উপন্যাসেও। এই দুটি আখ্যান ছাড়াও ‘অন্ধকোকিলের গান’, ‘ব্রহ্মকমল’, ‘সোনার মাছি’, ‘নিরপেক্ষ’, ‘রেড করিডরের জানালা’, ‘পতনের পর’ ইত্যাদি আখ্যানে প্রকটভাবে এসেছে সময় এবং রাজনীতির কথা ; নকশাল এবং বামপন্থী আন্দোলনের নানান প্রসঙ্গ। কিষাণজির আত্মবিসর্জন তাঁকে মুগ্ধ ও ব্যথিত করেছে। তাঁর সেই ভাবনার প্রকাশ ‘রেড করিডরের জানালা’। আবার পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন পতনের পর’ (২০১১)। ‘হনন ঋতু’-তে বামপন্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। ‘নিরপেক্ষ’ উপন্যাসেও এসেছে আর-এস-এসের উত্থানের প্রসঙ্গ। এই রাজনৈতিক অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে কিন্নর রায়ের গল্পের আলোচনা সম্ভব হবে না।

হাতের অক্ষর ভালো ছিল বলে ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনৈতিক ইশতেহার লিখতেন। জরুরি অবস্থার অবসানের পরে জেল থেকে বেরিয়ে খবরের কাগজের অফিসে যাতায়াত শুরু করেন। আর তখনই মনে হয়, তাঁর নিজের কথা নিজেকেই বলতে হবে। এইভাবে তিনি গল্প লিখতে এলেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সন্ন্যাসী ও লেখক তারাপদ ব্রহ্মচারীর। তাঁর সাহচর্য কিন্নরের সাহিত্যচর্চাকে ত্বরান্বিত করে। 

রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বাস থেকে উঠে আসে কিন্নরের গল্প। তাঁর প্রতিটি আখ্যানে প্রধান্য পেয়েছে সময়। এক অর্থে বলা যায় সময়ই তাঁর সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। 
  
কিন্নর রায়ের একটি গল্পের নাম ‘ভারতবর্ষ—১৯৯০’ (‘আজকের সাহিত্য’, প্রথম সংখ্যা, ১৯৯১)। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতবর্ষের ধর্মীয় চালচিত্র কেমন ছিল ১৯৯০-এ, তা-ই গল্পটির বিষয়। নামকরণ থেকে প্রাথমিকভাবে তাই বোঝা যায়। এ গল্পের কেন্দ্রে একটি মুসলিম পরিবার। বাংলার নয়, বিহারের। ভোজপুর জেলার শাহাপুর থানার পুনিয়া গ্রাম। এখানে এক ঘর মাত্র মুসলমান পরিবার। তাদের বাড়িতেই আছে মুরগা-মুরগি। গোটা গ্রাম জেগে ওঠার জন্যে ভোরের প্রথম শব্দটি শুনতে পায় মুরগার ‘বাগ’-এ। এ পরিবারের বড়ো ছেলে রসুল ইক্কাবালা। ছোটো সাব্বির। আর মা বাবা। ভাগড়ের জলে খেলে, অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো করে কেটে যায় সাব্বিরের দিনগুলি।  

এ গ্রামে শিবালা আছে। কালী মন্দির আছে। সেখান থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু গ্রামে কোনও মসজিদ নেই। ফজর আছর মগরেব বা এশা— কখনই আজান শোনা যায় না। পঁয়ষট্টিতে বাস্তুত্যাগের পর রসুলদের বাবা এইখানে এসে আস্তানা গড়েছিলেন। এখানেও আবার তাড়া খেতে হল। বাস্তুচ্যুত হলেন আবার।

রসুল প্রতিদিন কাচ্চি পেরিয়ে পাকা রাস্তার ওপারে উঠে আসে তার এক্কা নিয়ে। এটাই তার রুজি-রোজগারের জায়গা। বেশ কয়েক বছর পর এখানেই তাকে শুনতে হয় ‘সব পাকিস্তানি কো মারকে ভাগা দো’। এই শব্দ তাকে শঙ্কিত করে তোলে। তাকে উদ্দেশ্য করেই এই আওয়াজ। তার সবুজ লুঙ্গি, নীল পাঞ্জাবি খুব সহজেই তাকে ‘পাকিস্তানি’ বানিয়ে দেয়। অথচ এই পোশাক তো যে কোনও গরীব ভারতবাসীরও হতে পারে। পোশাকের জন্য অথবা তার নামের জন্য ইউনিফর্ম পরা পি. এ. সি.-র কাছে ‘পাকিস্তানি’ হয়ে যায়। সরকারি পোশাক পরা শান্তিরক্ষকদের কাছে খুব সংকোচে বলে তার নাম। সে জানত না মীরাটে পি. এ. সি. গুলি চালিয়ে সংখ্যালঘু নিধনে নেতৃত্ব দেয়। তার পোশাকের রঙ, খাদ্যাভাস, ধর্মীয় রীতিনীতি— যার অনেকটাই মানার সময় পায় না রসুল, তা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে তারা।

নেহাতই গাড়ি খারাপ হওয়ার দরুন রাইফেল ও ইউনিফর্মধারীরা রসুলের টাঙায় চেপেছিল। আর তার নাম শুনে ‘পাকিস্তানী’ আখ্যা দেয়। এক কবন্ধ সন্ত্রাস তাড়া করে বেড়ায় তাকে। গলা দিয়ে খাবার নামে না রসুলের। পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার যুদ্ধের কথা মনে পড়ে। তখনই তারা বিশ মাইল দূরের গ্রাম ছেড়েছিল রাতারাতি। তখনও একই কথা শুনেছিল— “শালে পাকিস্তানি লোককে মারগে পাকিস্তান ভাগাও।” সাত-আট ঘর গরীব মুসলমান পরিবার ছড়িয়ে গেল সাত-আট গাঁয়ে। 
রসুল বুঝতে পারে না তাকে কতটা মুসলমান আর কতটাই বা ভারতীয় হয়ে উঠতে হবে। সে তো নিজেকে মুসলমান হিসেবে আলাদা কোনও গুরুত্বই দেয়নি এতদিন। গরীব মানুষের বেঁচে থাকাটাই নিয়মিত যন্ত্রণা। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সবুজ লুঙ্গি, নীল কুর্তা তো ময়লা আটকানোর রঙ। তার জামা-লুঙ্গিও একটাই। মাথা হেঁট করে কুঁকড়ে থাকতে হয় তাকে। 

রসুলের ভাই সাব্বির বন্ধুদের কাছে শেখা ছড়া আওড়ায় বাড়ি ফিরে— “এক ধাক্কা আউর দো/বাবরি মসজিদ তোড় দো।” তারপর, “হম হ্যায় সব কামকা/বাচ্চা রামকা।” সাব্বির এসবের অর্থ বোঝে না, নতুন শেখা বুলির ঘোরে থাকে শুধু।

এর মধ্যে এক শীতের দুপুরে রসুল তার ভাঙা এক্কা নিয়ে ফেরে। করসেবকরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে এক্কা দখল করে। সে বিনীতভাবে গন্তব্যে যেতে না চাওয়ায় এই অবস্থা তার। ভাড়ার বদলে দু-একটি ধর্মীয় চড় থাপ্পড়ও জুটে যায়।

রাতে ধাক্কা পড়ে বাড়ির দরজায়। খাপরার চালে মাটির ঢেলা এসে পড়ে। ধাড়ি ছাগলটাও চুরি হয়ে যায় একদিন। অগত্যা অন্ধকারে ব্ল্যাক-আউটের রাতে যাত্রা শুরু করতে হয় আরও দূরে। রসুলের আব্বাজানের মনে পড়ে যায় পূর্বস্মৃতি—

“কত দূরে, কোথায় ? শুধুই নিজের কওমের মানুষের কাছাকাছি। এককাট্টা হয়ে ছুরি শানাব, বন্দুকে টোটা ভরব, লাঠিতে তেল মাখাব—আমরা মুসলমান, শুধু এটুকুই আমার পরিচয়! অথচ আমার ইসলাম, আমার ইমান তো তা বলে না। তার সাদা, গোল টুপি পরা পাকা মাথাটি বেদনায়, বিষাদে সামনে বারবার ঝুঁকে পড়ছিল।”

সাব্বিরের বন্ধুরা আবার একটা ছড়া বানায়— “সাব্বির পাকিস্তানি ভাগ গ্যয়া/ডরকে মারে চলা গ্যয়া।” কোনোরকম দাঙ্গা ছাড়াই, আগুন বন্দুকের শব্দ বাদ দিয়েই একটা আস্ত বাড়ি জমির দখল যে পাওয়া যায় তা দেখল পুনিয়া গ্রামের মানুষ। দেখলাম আমরাও। দেখল গোটা ভারতবর্ষ।

এই গল্পটি যখন লেখা হয় তখনও বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়নি। সর্বদা মুসলিমদের সন্ত্রস্ত হয়ে জীবন কাটাতে হয়। আসলে এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকতে হয় এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে। বারবার বিপন্ন হতে হয়। তাড়া খেতে হয়। ধর্মানুমোদিত পথে না হাঁটলেও ধর্মীয় আচরণ না মানলেও নিস্তার নেই। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ধর্ম। আমরা নাম দিয়ে ধর্মকে চিনি, ধর্মীয়-আচরণ দ্যাখে নয়। বিপন্ন সংখ্যালঘু-মানস এ গল্পের পাঠকও ছুঁতে পারেন। 

কিন্নর নিজেকেও একজন বিপন্ন, প্রান্তিক এবং সংখ্যা লঘু মানুষ মনে করেন। আর সেই চৈতন্য থেকেই সদা সন্ত্রস্ত প্রান্তিক মানুষদের বারবার তাঁর লেখার বিষয় করে তোলেন।     

পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান আপাতদৃষ্টিতে একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বসবাস করলেও ধর্মীয় জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক আচার আচরণ মেনে চলেন। ঐতিহাসিক কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই অবহেলারও শিকার। কিন্নরের বহু গল্পে উন্মোচিত হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিম জীবনের বিচিত্র স্বরূপ। তাঁর ‘ধর্মসংকট’ গল্প সংকলনটির প্রায় সবকটি লেখায় এসেছে মুসলিম প্রসঙ্গ। ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী গল্পের সংকলন এটি। 

‘ধর্মসংকট’ (‘প্রমা’, মার্চ ১৯৯২) গল্পটি ধারণ করে আছে সংখ্যালঘুদের বিপন্নতার গভীর চিহ্ন। গরীবদের বরাবরই নানাভাবে বিপন্ন হতে হয়। তাদের বিপন্নতার কথা কিন্নর বহু গল্পে তুলে ধরেছেন। অন্যান্য লেখকদের লেখায়ও যখন মুসলমানের বিপন্নতার কথা আসে, সাধারণভাবে তখন দ্যাখা যায় দরিদ্র মুসলিমদের। কিন্তু শুধু গরীব মুসলমানদের বিপন্ন হতে হয়— তা নয়, বড়োলোক, উচ্চপদাধিকারীদেরও এই বিপন্নতার শিকার হতে হয় এই বাংলায়। ধর্মের স্থায়ী দাগ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় সবসময়। ‘ধর্মসংকট’ গল্পের মনজুর হাসান, বেয়াল্লিশ। পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি। একটু চাপা নাক, দৃঢ় চিবুক। নিখুঁত কামানো গালে নীলচে আভা। সুরভিত আফটার শেভ— ওল্ড স্পাইস। চোখে স্টিল ফ্রেমের বাইফোকাল। মস্ত সরকারি অফিসার। সুসজ্জিত অফিস-চেম্বার। অফিসের পাশের চেম্বারে বসেন বিজন। কাজের দায়িত্ব, পে-স্কেল, ডেজিগনেশন— সবই সমান সমান। এমনকি টেব্‌ল ঢাকা কাচ, ভিজিটিং কার্ড...—সবই হুবহু মনজুরেরই মতো। তবুও বিজন বিজনই। আর সে মুসলমান। তার অন্য কোনও পরিচয় নেই। 

বিজন অফিসে ঢুকেই মনজুরকে বলে, আপনাদের টিম তো বরদলৈ ফাইনালে উঠল। ‘আপনাদের টিম’ —কথাটা কানে বাজে মনজুরের। বিজন মহামেডান স্পোর্টিংয়ের কথা বলছে। সে মাত্র এক বছর হল এসেছে অফিসে। আর এর মধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মনজুর হাসান শুধুমাত্র ইসলামী নামটুকুর জোরে মহামেডানের সাপোর্টার। 

এভাবে জোর করে তাকে ঠেলে দেওয়া হয় একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। চিরকালই এভাবে ধ্বস্ত হয়েছে সে। বাবার নাম অতুল আলি মন্ডল— তা নিয়ে ছোটোবেলায় হিন্দু সহপাঠী থেকে শিক্ষকরাও নানাভাবে উপহাস করেছে। কোণঠাসা করে রাখতে চেয়েছে। ৬৪-এর ‘হজরতবাল’ দাঙ্গায় তারা পালিয়ে এসেছিল খড়িবেড়ে। ৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বলা হয়েছিল পাকিস্তানের সাপোর্টার। সন্ত্রস্ত সর্বদা— “আস্তে আস্তে কারা যেন বলে দিয়েছে, তোমরা মহামেডান স্পোর্টিং, পাকিস্তানের সাপোর্টার। আমরা কেউ ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে টিভি-র সামনে বসে ইমরান, মিয়াদাঁদ, সেলিম মালেক বা কাদিরের প্রশংসা করতে পারি না। —পাকিস্তানী। পাকিস্তানের দালাল। শালা কাটুয়া...কাটা...।”

মুসলিমরা গো-মাংস খায় তাই নাকি তাদের শরীরে গরম বেশি। সন্তান অনেক। বুদ্ধি কম। ইহুদি খ্রিশ্চানরাও তো গো-মাংস খান তাঁদের বেলায় শুনতে হয় না এমনটা। আমাদের দেশে মুসলমানদেরই শুনতে হয় এমন অভিযোগ। মনজুরের অফিসের আলমারিতে কেউ লাগিয়েছিল লাল-হলুদ স্টিকার— “গরব সে বোলো হম হিন্দু হ্যায়।” কলেজের ব্যাচমেট শ্রেষ্টা সেন তাঁর হয়নি শুধু সে মুসলিম বলে। এরকম কত কত অপমান জমে আছে তার মনে। 

অথচ আজহারউদ্দিন, জাকির হুসেন, ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ, আমজাদ আলি খান, বিলায়েত খান, বড়ে গোলাম আলি, ফৈয়াজ খাঁ, পতৌদি, কিরমানি, মুস্তাক আলি, মহম্মদ নিশার, আব্বাস আলি বেগ, সেলিম দুরানি, দিলীপকুমার, সুরাইয়া, মধুবালা, মীনাকুমারী, নার্গিস, কামাল আমরোহি, মহম্মদ রফি, নৌশাদ আরও অনেকে যেমন সম্মান পেয়েছেন তার এক অংশও কি কোনও ইসলামি দেশে অন্য ধর্মের মানুষ ইদানীংকালে পেয়েছেন। 

উল্লেখ করা যেতে পারে— কিন্নরের লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এই তথ্য-নির্ভরতা। প্রাসঙ্গিক নানান তথ্য আখ্যানে বারবার উঠে আসে। অনেক সময় এই তথ্যবাহুল্য তাঁর গল্পের গতিকে খানিকটা শ্লথও করে দেয়। কিন্তু সেই তথ্যগুলির প্রামাণ্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সাল-তারিখসহ উঠে আসে সেইসব তথ্য। ফলে তাঁর গল্পপাঠে সাহিত্যরস অনুধাবনের পাশপাশি অনেককিছু জানাও যায়।   

৩০ অক্টোবর ১৯৯০। অফিসের বাইরে আসে মনজুর। ট্যাক্সি নিয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’-র অফিস। চাপা উল্লাস সেখানে। খবর আসছে, ইউ-এন-আই, পি-টি-আই। রাম জন্মভূমি দখল হয়ে গিয়েছে। মসজিদের গুষ্টি তুষ্টি করে দিয়েছে। বাবরি মসজিদের মাথায় গেরুয়া পতাকা। অফিসের সকলে যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করছে। শঙ্কিত মনজুর বাথরুমে গিয়ে আয়নায় ভালো করে দেখে কোথাও মুসলমানি চিহ্ন আছে কিনা।

রাতে সেদিন বাড়ি ফিরে দ্যাখে, সকলে অপেক্ষায় তার। পাড়া সুনসান। সকলের কানে ট্রানজিস্টার। রাত সাড়ে আটটার বিবিসি তার অযোধ্যার সংবাদদাতার কণ্ঠস্বর সোজাসুজি শুনিয়েদিল, মসজিদ ভাঙা হয়েছে। 

উল্লেখ করা দরকার, ১৯৯২-এর ৬-ই ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনা সকলের জানা। কিন্তু তার আগে ১৯৯০-এর ৩০-শে অক্টোবরেও আক্রান্ত হয়েছিল একবার বাবরি মসজিদ। এই গল্পে তার কথাই বলা হয়েছে।

১৯৯২-র ৬-ই ডিসেম্বরের পরবর্তী দাঙ্গা, সংখ্যালঘু নিধন ইত্যাদি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। লেখালেখিও হয়েছে। সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা যেন তখনই শুরু হল। আপাতভাবে তেমনই মনে হয়। কিন্তু বাস্তব তো উল্টো কথা বলে। সংখ্যালঘুরা জানে সে কথা। ৬-ই ডিসেম্বরের আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। সেই পর্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের সামাজিক অবস্থান, দাঙ্গা-সন্ত্রস্ত সামগ্রিক মুসলিম মানসের চেহারাটা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরেছেন কিন্নর তাঁর একের পর এক গল্পে। মনে রাখা প্রয়োজন এই গল্পগুলি লেখাও হয়েছে ৬-ই ডিসেম্বরের পূর্বে। ফলে গল্পগুলির একটি ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। একাধারে সাহিত্য এবং সামজিক দলিল। এক নিষ্ঠুর সময়ের চালচিত্র ধরা পড়েছে। ধরা পড়েছে ভারতবর্ষের মানবিক মানচিত্রও। 

সন্ত্রাসবাদ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা শুধু ‘ধর্মসংকট’-এর গল্পগুলিতে নয়, কিন্নরের আরও বহু গল্প-উপন্যাসের বিষয় হয়ে উঠেছে। বেনারসের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘বালিঘড়ি’ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে। ‘স্বপ্নপুরাণ’-এ ইসলামের সংকট বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘ছায়াতরু’, ‘জাদু চিরাগের রাতদিন’ ইত্যাদি উপন্যাসেও ইসলামিক অনুষঙ্গ এসেছে। শুধু মুসলিম সংখ্যালঘুরা নন, অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সমাজ এবং ধর্মীয় যাপন নিয়ে বহু আখ্যান রচনা করেছেন তিনি। ‘অগ্নিপুরুষ’-এ এসেছে পার্শি, ‘তুষিত স্বর্গের আলো’-তে নিপীড়িত বাঙালি বৌদ্ধদের সংকট, ‘চারুকেশী’-তে বৌদ্ধ তান্ত্রিক, ‘ক্রুশবন্দী’-তে খৃষ্টধর্মের মানুষদের কথা। আবার ‘সুর সুন্দরী’র কেন্দ্রে আছেন একজন তান্ত্রিক দেবী। চৈতন্যদেবকে নিয়েও লিখেছেন মহাকাব্যিক আখ্যান ‘শ্রীচৈতন্যকথা’।  

শুধু মানুষের বিপন্নতা নয়, কিন্নরের আখ্যানে বারবার উঠে এসেছে বিপন্ন পরিবেশের কথা। তিনি বিশ্বাস করেন, পরিবেশের সংকট প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার সংকট। এই সংকট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিন দশকেরও বেশি আগে তিনি লিখেছিলেন ‘প্রকৃতিপাঠ’ (১৯৯০) উপন্যাস। আজকের পরিবেশবাদী সাহিত্য-সমালোচনায় বারবার উঠে আসে তাঁর এই ‘প্রকৃতিপাঠ’, ‘মেঘপাতাল’, ‘ধূলিচন্দন’ ইত্যাদি আখ্যানের কথা। কিশোর গল্প-উপন্যাসের মধ্যেও রয়েছে লেখকের পরিবেশ সচেতনতার স্বাক্ষর। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘নীলফামারির নীলগাই’, ‘মেঘচোর’, ‘কুমীর কুমীর’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলির কথা। তাঁর বহু গল্পেও ধরা আছে পরিবেশের সর্বনাশের খতিয়ান।     
 
পরিবেশের বিপন্নতার মূলে রয়েছে প্লাস্টিকের যথেষ্ট ব্যবহার। কিন্নর রায়ের ‘অনন্তের পাখি’ (‘শারদীয়া প্রমা’, ১৪০৩) গল্পে এসেছে প্লাস্টিক দূষণ, পলিব্যাগ-সংক্রান্ত মারাত্মক সংকটের কথা। বাজার থেকে সবকিছু আমরা পলিব্যাগে ভরে নিয়ে আসি। বহু বছর থলে নিয়ে দোকানে যেতে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু এত পলিথিন যাচ্ছে কোথায় ? এই প্রশ্ন তুলেছেন লেখক। গল্পের ষাট বছরের অনন্তের দোকানের নাম ‘সর্বমঙ্গলা স্টোর্স’, স্টেশনারি কাম জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার্স। না চাইলেও প্লাস্টিক বিক্রি করতে হয় তার দোকানে। হারপিকের সঙ্গে প্লাস্টিকের মগ ফ্রি। চায়ের সঙ্গে জার। খদ্দেররা পলিপ্যাকে জিনিস নিতে চায়। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় দোকান খোলে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে এই শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। তার ভাবনায় ফিরে আসে শৈশব স্মৃতি।

বাড়িতে বিড়াল আছে। পেঁচুরাম তার নাম। একটা বুটি নামের টিয়াও। বাড়ির পিছনের মস্ত বড়ো পুকুরটাকে ডোবা হতে দেখেছে সে। সেই ডোবাও বুজে গেল একসময়। বিড়ালকে পাখিকে চাতালে খেতে দিলে এখন জল ছাড়া, ঘর হারানো বক আসে ভাত খেতে। খায়। উড়ে যায়। অনন্তের স্বপ্নেও আসে এই বক। সাদা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বলে, “আইস। চলিয়া আইস।” দোলামোচড়া পলিপ্যাক উড়ে আসে তার মশারির কাছে। কথা বলে— “এখন কোথায় যাই বলতে পারেন ? ছাই মাখা পলিপ্যাক কে নেবে! ... খবরের কাগজের, এমনি কাগজের ঠোঙা পঁচে। শালপাতা পঁচে। মাটিতে মিশে যায়। আমরা তো সহজে পচি না। আমরা কোথায় যাব অনন্তবাবু ?” 

তার মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলায় প্লাস্টিকের ফুল-ঝাড়ু কিনতে আসা মেয়েটা পলিপ্যাকে ঝাঁটা দিতে বলেছিল। গেল সনে লক্ষ্মীমূর্তিও পলিপ্যাকে নিয়েছিল। “এত পলিপ্যাক যাইব কোথায় ?”   

সে ঘুমের মধ্যে দ্যাখে— “বিশাল একটা জল আর জলের বুকে শালুক, পদ্মের বদলে লাল নীল সবুজ সাদা অনেক অনেক পলিপ্যাক। মরা মাছ কিংবা কচ্ছপের পিঠ হয়ে তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে বুঝি। কেউ বা চুপসে মিশে আছে জলের সঙ্গে। সেই সব রঙ চটে যাওয়া পলিব্যাগের গায়ে ভিতু চাঁদের আলো। দু-এক ফোঁটা দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির কান্না।” গোটা জলাভূমি ঢেকে আছে নানান রঙের পলিব্যাগে। তাদের বাড়িতে ভাত খেতে আসা বাসা-হারানো বকটি গম্ভীর মুখে বসে জলের পাড়ে।  

“আমি প্রতি রজনীতে ক্রৌঞ্চদ্বীপে উড়িয়া যাই ও প্রভাত সূর্য উদিত হইবার পূর্বেই ফিরিয়া আসি। কারণ আমার প্রতি শাপ আছে, শহরে-নগরে, মনুষ্যের কাছাকাছি থাকিবার ফলে যে ক্লেদচিহ্ন জমিয়াছে আমার সর্ব শরীর ঘিরিয়া, তাহা ক্রৌঞ্চদ্বীপের রমণীয় ঊষাকাল দেখিবার উপযুক্ত নহে। ক্রৌঞ্চদ্বীপের প্রথম আলো দেখিলেই আমি পূর্বোক্ত শাপে ভস্মীভূত হইব। কিন্তু হে মৃত ও অর্ধমৃত পলিব্যাগ সকল— তোমাদের এই ক্লেদ তো আমি ক্রৌঞ্চদ্বীপে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারিব না। হায়! তোমাদিগের কী হইবে— বলতে বলতে বক বড় করে শ্বাস ফেলল।”     

ঘুমের মধ্যে অনন্ত শোনে— “শুধু পেট ফোলা বা চুপসে যাওয়া বাতিল পলিব্যাগেরাই নয়, গোটা জল, যার ওপর জমেছে রঙিন সাদা পলিব্যাগের সারি— বাঁচাও বাঁচাও বলে কেঁদে উঠছে। অনন্ত অনেক চেষ্টা করেও আশেপাশে বকটিকে আর খুঁজে পেল না। জল শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল”। অনেককাল আগে লেখা এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। 

কিন্নর মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছেন। মৃত্যুবোধকে গভীরভাবে অনুভব করেছেন। শুধু মানুষের মৃত্যু নয়, মনুষ্যত্বের মৃত্যু, রাজনৈতিক নীতিনৈতিকতার মৃত্যু, পরিবেশের মৃত্যু... সবই ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। তাই তাঁর অধিকাংশ লেখায় ক্রিয়াশীল থাকে এক ধরনের বিষাদবোধ।      

বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতা তাঁর গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। গল্পের বিষয় বৈচিত্র্য লক্ষ করবার মতো। জীবনে নানান অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। সময়ের নানান রঙ তাঁর গল্পের পরতে পরতে ধরা পড়েছে। লেখকের গভীর সমাজ-চেতনার স্বাক্ষর তাঁর গল্প। সেখানে যেমন উঠে আসে চোখে দ্যাখা বাস্তবতা ; তেমনি তাঁর গল্পে ফ্যান্টাসি, পরাবাস্তবতার মাধ্যমে গভীর গভীরতর কোনও সত্যকে ইঙ্গিত করেন। বামপন্থী এই লেখকের লেখায় মাঝে মাঝে উঁকি দেয় শাণিত ব্যঙ্গও।

‘বাঞ্ছাকল্পতরু’ (‘চতুষ্কোণ’, শারদ ১৪০৮) গল্পে গোলকায়নের নামে ভোগসর্বস্বতার প্রতি লেখকের তীব্র বিদ্রুপ প্রকাশিত। সাধু গদ্যে গল্পটি লেখা। এর চরিত্ররা সব গাছ। তারা তো মানুষের ভাষায় কথা বলে না। গাছেরা যে যার নিজেদের যন্ত্রণার কথা বলেছে, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছে সমস্যা নিয়ে। রসালের গায়ে আর স্বর্ণলতিকার পেলব নেই। কারণ, পোকামারার ওষুধ। “বিশ্বজোড়া দুর্দান্ত সংকরায়ণ ও পেটেন্ট ফাঁদের ফলে অসাধারণ সমস্ত হাইব্রিড আম আসিতেছে বাজারে।” তাই রসালের কদর নেই। নিমের দুঃখ, “ভারতের নিম ভারতীয়রা শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের অনুমতি ব্যতীত নিজ ইচ্ছা মতো ব্যবহার করিতে পারিবে না।” আবার “পেটেন্ট শৃঙ্খলে নারিকেল বৃক্ষের বন্ধনদশা আসিবার সম্ভাবনা বিপুল।” 

ভারত পাকিস্তানের বাঁশমতি চাল টেক্‌সমতি নাম নিয়েছে। “আমেরিকার সাহেবরা সংকরায়ণের মাধ্যমে টেকস্‌মতি তৈয়ারি করিয়া আমাদিগকে পথে বসাইয়াছে।” কেনটাকি চিকেন, চীনা সাইকেল, জুতা, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ছাতা, কোরিয়া জাপানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সবই জলের দরে পাওয়া যাবে। “গ্যাময় ও গ্লোরিফ্লেম নামের দুইটি বিদেশি কোম্পানি তাহাদের শ্যাম্পু, সাবান, লিপস্টিক লইয়া দ্বারে দ্বারে পঁহুছিয়া যাইতেছে। দ্রব্যের দাম অধিক। কিন্তু ইহাতে নাকি রূপ খোলে, সুতরাং রূপটান হিসেবে অনেকেই উক্ত প্রসাধন সামগ্রী ক্রয় করিতেছে। কেহ-বা রাতারাতি ধনী হইবার নিমিত্ত উক্ত দুই কোম্পানির এজেন্ট হইয়া যাইতেছে। কিছু টাকা লাগাইয়া এজেন্ট হওয়া। তাহার পর অন্যদের পাকড়াইয়া এজেন্টকরণ। এই রূপে বৃত্ত সম্পূর্ণ হইতেছে। তখন সেই এজেন্ট আবার অন্য এজেন্ট পাকড়ায়। এইভাবে চলিতে থাকে।”

এ ব্যাপারে গ্রামগুলোও পিছিয়ে নেই। টিভি-সংবাদপত্রের কল্যাণে গ্রামে গ্রামে এখন বডি ফ্রেশনার, হেয়ার রিমুভার, শ্যাম্পু, বডিস্প্রে, পারফিউম, ময়েশ্চারাইজার, সানক্রিম, বডি লোশন সবই ঢুকে পড়ছে। পণ্যায়নের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গছলে কিন্নর এ গল্পে একটা মজার ঘটনা এনেছেন— “জলাশয়— তাহা পুষ্করিণী, দীর্ঘিকা অথবা খরস্রোতা নদী যাহাই হউক না কেন, সর্বত্রই চন্দ্রের খণ্ডিতাংশ মিলিতেছে। সেই খণ্ডিতাংশ দুই হস্ত ডুবাইয়া অঞ্জলিবদ্ধভাবে তুলিবার উপক্রম করিলেই গাত্র মার্জনীর সাবান হইয়া যাইতেছে।” এই বর্ণনা গল্পের প্রথমে। শেষও হয়েছে এই প্রসঙ্গে— এক অতি উৎসাহী জলে নেমে জল থেকে খণ্ডচন্দ্র তুলে পরীক্ষা করতে চাইল সত্যি সত্যিই বিজ্ঞাপনের ময়েশ্চারাইজার ও ল্যানোলিন যুক্ত সাবান পাওয়া যায় কিনা। করতলে সাবান তুলে এনে উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে। হর্ষের কারণ জানতে আগ্রহী জনতা এগিয়ে এসে দেখল, “সেই রক্ত মাংসের রমণী পুত্তলিকাবৎ। স্থির। তাহার হস্ত পদ বদন গণ্ডদেশ বক্ষ— সমুদয় অঙ্গই সাবানে পরিণত হইয়াছে। শক্ত সাবান। সাবানে নির্মিত মনুষ্য মূর্তি।” বিভিন্ন জলাশয়ে এরকম ঘটনা একসঙ্গে ঘটল। পঞ্চায়েত প্রধান এর পেছনে সি-আই-এ, না আই-এস-আই জানার জন্য চামচাকে ধমক-ধামক দেন। “বহুজাতিকের প্রতিনিধি আসিয়া শক্ত সাবানে পরিণত রমণী শরীর সংগ্রহে ব্যস্ত হইল। ইহার নিমিত্ত তাহারা কিছু মূল্য ধরিয়া দিয়াছিল সাবানে পরিণত পরিবারের মানুষজনের হস্তে। বলাবাহুল্য, পঞ্চায়েত প্রধান, তাঁহার চামচা ও তস্য চামচা অবশ্যই এ বাবদ পরিমাণ মতোই দস্তুরি পাইয়াছিলেন।”  

সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিন্নর। তাঁর গল্প কিছুটা রিপোর্টাজধর্মী। গোলকায়নের নামে ভোগসর্বস্বতার আক্রমণ থেকে গ্রামগুলিও যে রেহায় পায়নি কিন্নর তা দেখিয়েছেন সাংবাদিকের নিরপেক্ষতায়। ফ্যানটাসি চমৎকারভাবে এসেছে এখানে। মনন-বিচার এবং সমাজ-জিজ্ঞাসা এই গল্পটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।  
 
কিন্নর রায়ের প্রিয় চরিত্র চে গুয়েভারা। তাঁকে নিয়ে বহু আখ্যান এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর একটি গ্রন্থের নাম ‘চে গুয়েভারার কঙ্কাল ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। হেন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে চর্চা করেননি তিনি। মৌলিক আখ্যানের পাশপাশি ভোটের ছড়া, ‘লুপ্ত জীবিকা’, ‘কলকাতার পাখি পোষা ও মাছধরা’ ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। সবই তাঁর সিলেবাসের অন্তর্গত। কিন্নর সর্বার্থেই একটি তথ্যভাণ্ডার, জীবন্ত অভিধান। আজও যে কোনও বিষয়ে দরকার হলে তাঁর দ্বারস্থ হন বহু লেখক। 

আসলে তিনি একজন সমাজ-গবেষক। যে কোনও বিষয় নিয়ে লেখার আগে তা নিয়ে অনুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন। বিষয়টিকে ভালো করে অনুধাবন করেন। তাই তাঁর আখ্যানগুলি এক দিক থেকে গবেষণাধর্মী ডিসকোর্স হয়ে ওঠে। 

সাহিত্যিক নন, স্পষ্ট বক্তা এই লেখক নিজেকে একজন ‘অক্ষরকর্মী’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। কিন্নর রায় প্রধানত একজন নাগরিক লেখক। তাঁর লেখার মধ্যে একটা আর্বানিটি আছে। নগর-জীবনের নানান সমস্যা নিয়ে রচিত তাঁর প্রথা-ভাঙা গল্পগুলি পাঠকের কাছে আবিষ্কার নিয়ে হাজির হয়। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ নয়, স্বাতন্ত্র্যে এবং নিজস্বতায় পরিপূর্ণ মানুষদের প্রতি অধিক আগ্রহ তাঁর। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে মহাসময় অধিক গুরুত্ব পায়। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনৈতিক বিপর্জয়জনিত মানুষ এবং সময়ের নানা ছবি তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। গল্পে উপস্থাপিত লেখকের সমাজ-সচেতন মন্তব্যগুলি পাঠককে বিচলিত করে। সমাজ-সময় সম্পর্কে সচেতনও করে।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. বাংলা গল্পের পালাবদলের পথে কিন্নর রায়ের পালা কবে আসবে,এই ভাবনা শুরু হতেই আজ পেলাম। আবারো আলোচকের চোখ দিয়ে
    গল্পগুলো পড়তে পড়তে অনেক গুলো জানলা খুলে গেল। হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক আশ্রিত গল্পে যে কিন্নর ব্যতিক্রমী তা আর একবার প্রমাণিত। বিশেষত ধর্মসংকট গল্পটির আলোচনার কথা আলাদা করে বলতেই হয়।
    পরিবেশের বিপন্নতা নিয়ে আলোচকের অস্থিরতা আগেই টের পাওয়া গিয়েছে। কিন্নরের দুটি গল্পের আলোচনায় সে অস্থিরতা যেন আরো তীব্রতায় বাজল।
    বিশ্বজিৎ যথার্থই বলেছেন যে কিন্নর রায় সমাজ গবেষক। তবে ওঁর গল্পে আর্বানিটি প্রাধান্য পেলেও গ্রাম জীবন একেবারে উপেক্ষিত হয় নি। আলোচনাটি মনোজ্ঞ। জোর করে পড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

    ReplyDelete