জ্বলদর্চি

পৌষালী রোদ /সুলতা পাত্র

পৌষালী রোদ 
     
সুলতা পাত্র


ভাই - বোন রত্না ও ধ্রুবর আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। দুজনেই ফাস্ট হয়েছে। রত্না ক্লাস সিক্সে পড়ে, ধ্রুব ক্লাস এইটে। বরাবরই ওরা পড়াশোনাতে ভালো। 

     প্রদীপ ও পৌষালীর মনে একটাই চিন্তা, মেয়ে রত্না ও ছেলে ধ্রুবকে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা। একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে কম মাইনের চাকরি করেন প্রদীপ, ছোট্ট এক তলা একটি বাড়ি আছে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ, প্রদীপের বেতনে চলে না কম পড়ে যায়। তাই প্রদীপ অফিস থেকে ফিরে, একটি মোবাইল দোকানে কাজ নিয়েছেন। পৌষালী নতুন কাপড় কিনে ছেলে, মেয়েদের ছোট ছোট জামা, বালিশের কভার, এইসব তৈরি করেন। কোন রকমে সংসারটা চলে যায়, দুজনের আয়ের পয়সায়। 
    
      বাবা-মাকে এত পরিশ্রম করতে দেখে, রত্না ও ধ্রুবর
 খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তখনই মায়ের আকুতি মেশানো কথাগুলো, কানের কাছে এসে ধ্বনিত হয়।  'তোরা মন দিয়ে পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি পেলে,আমাদের এই পরিশ্রম সার্থক হবে। আমি বুঝতে পারি, আমাকে আর তোদের বাবাকে এত পরিশ্রম করতে দেখে তোদের মন খারাপ হয়। আজ একটা কথা বলি শোন,এখন আমাদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা আছে।যখন ক্ষমতা থাকবে না, তখন আমাদের জন্য চিন্তা করবি। 
  এখন তোদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাক তোরা,     এটাই হবে আমাদের পরম পাওয়া'। 
        রত্না ও দাদা ধ্রুব মায়ের কথাগুলোর  মর্যাদা দেবার জন্য মন দিয়ে পড়াশোনা করে। সেই প্রতীক্ষীত দিনের অপেক্ষায় থাকে, যেদিন ওরা ভালো চাকরি পেয়ে, বাবা-মাকে এত পরিশ্রম আর করতে দেবেনা।ওঁদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে।    
 
        যে পাড়াতে ওদের বসবাস, সেখানে বর্ধিষ্ণু পরিবারের সংখ্যা বেশি ছিলো। প্রদীপ পাড়াতে একজন সৎ ও আদর্শ চরিত্রের মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও,যেহেতু কম মাইনের চাকরি করতেন সম্মান সেইভাবে পেতেন না। 
        মনে কষ্ট নিয়ে ও প্রদীপ কিন্তু মনের জোর হারাননি।  সংসারের হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। তাঁর বিশ্বাস ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়ে যখন ভালো চাকরি পাবে, এবং সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সকলে বলবে,- 'প্রদীপ একজন উপযুক্ত বাবা'। আর স্ত্রী পৌষালী কে উদ্দেশ্য করে বলবে, -'সত্যিই ভদ্রমহিলা রত্নগর্ভা'। 
        মানুষ যখন মন প্রাণ দিয়ে কিছু চায়, তখন পৃথিবীর সবাই যেমন আকাশ, বাতাস, জল, গাছপালা, ফুল, ফল, পশুপাখি, আলো, মানুষ, প্রকৃতির সবাই তাকে সাহায্য করে। 
        বাবা-মা হলেন সবচেয়ে বড় ত্যাগি। তাই ঈশ্বরের চেয়ে আগে, বাবা-মাকে স্থান দেওয়া হয়। যেসব সন্তানরা তাদের বাবা মা কে ভালবাসে, সম্মান করে, দেবতা ও তাদের আশীর্বাদ করেন। 
        স্বাচ্ছন্দ না থাকলেও সুখে দিনাতিপাত করছিলেন  প্রদীপ। তঁ।র ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে। প্রত্যেকটি সংসারের নানা রকম ঝড় ঝাপটা কমবেশি আসতেই পারে, জীবন তো আর অংকের মত হয়না, যে নির্দিষ্ট একটা  বাঁধাধরা ছকে চলবে। 
      যখন ধ্রুব ক্লাস নাইনে পড়ে, পৌষালী হঠাৎ একদিন বাথরুমে পা স্লিপ করে পড়ে যান। কোমরে চোট লাগে, ডাক্তারবাবু পুরো বিশ্রামে থাকার নির্দেশ দেন, আপাতত ছয় মাস। সংসার চলবে কি করে , তাই ধ্রুব বাধ্য হয়ে টিউশন করতে শুরু করে।পয়সা দরকার তো! মায়ের আয় একদম বন্ধ।বাবার পক্ষে ছেলে-মেয়ের টিউশন নেবার বেতন, স্কুলের বেতন, বই ,সংসার খরচ, সবকিছু সামলানো যে সম্ভব নয়। 
      রত্না সংসারের সব কাজকর্ম ও রান্না করে স্কুলে যায়। এ ছাড়া উপায় ছিল না। এর মাঝে  ভাই - বোন মায়ের দেখাশুনো করতো,তা সত্ত্বেও পরীক্ষার রেজাল্ট কিন্তু ওদের খারাপ হয়নি। দুজনে ক্লাসে প্রথম হয়েছে। 
      রেজাল্ট শুনে পৌষালী ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দাশ্রু চোখে নিয়ে বলেন,-'তোরা আমাদের অহংকার।ভাগ্য করলে এমন সন্তান পাওয়া যায়, কজন বাবা-মা তোদের মত সন্তান পেয়েছে বলতো'? 
      প্রদীপ ছেলে মেয়েকে আশির্বাদ করে বলেন, - 'তোরা অনেক বড় হবি।তোদের দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হবে, ঈশ্বর তাদের নিশ্চয়ই সুখী করবেন'।...

      পৌষালী যদিও এখন অনেকটা ভালো,  কিন্তু বেশিক্ষণ কাপড় সেলাইয়ের মেশিন চালাতে পারেননা। কোমরের যন্ত্রণা হয়। ছেলেমেয়েকে লুকিয়ে চেষ্টা করেছিলেন, মেশিনটা যাতে চালাতে পারেন।ধ্রুব কে তাহলে টিউশন পড়াতে দেবেন না। 
         রত্নার চোখে পড়ে যায়,  স্কুল থেকে এসে দেখে মা মেশিনে বসে সেলাই করছে। দাদা ধ্রুব এলে জানায়, কারণ সে জানত দাদা একমাত্র পারবে মায়ের মেশিন চালানো বন্ধ করতে। মাকে তারা আর কষ্ট দেবে না। 
         যদিও পৌষালী মেয়েকে বলেছিলেন, 'তুই তোর দাদাকে কিছু বলিস না মা, তোর দাদা টিউশন করলে ওর পড়াশোনার হয়তো ক্ষতি হবে। পরপর উঁচু ক্লাস হচ্ছে তো'? 
       ধ্রুব রত্নার কাছ থেকে সব শুনে, মাকে অনুরোধ করে, 'লক্ষী মা আমার, আমাকে সপ্তাহে দুটো দিন টিউশন পড়াতে দাও । তুমি ভালো থাকলে দেখো, তোমার ছেলেমেয়েরা ঠিক ভাল রেজাল্ট করবে'। 
       বাধ্য হয়ে পৌষালী ছেলের কথা ফেলতে পারেন না, মেশিন চালানো বন্ধ রাখেন। বাড়িতে শুধু রান্না টুকু করেন, মেয়ে-বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাচা কুচি, সবকিছু সামলে স্কুলের পড়াশোনা করে। পরিবর্তে পৌষালী ছেলে মেয়েকে স্কুল টাইমে ভাত মেখে খাইয়ে দেন। মায়ের হাতে মাখা ভাত তৃপ্তি করে খেয়ে ওরা স্কুলে যায়....

        এভাবে চলছে পৌষালীর সোনার সংসার। ধ্রুব টিউশন পড়ানো বন্ধ করেনি, রত্না ও মাকে রান্না করা ছাড়া কোনো কাজ করতে দেয় না। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ধ্রুব এবং রত্নার পড়াশোনার প্রতি নজর রাখেন,কয়েকজন শিক্ষক ক্লাস ছুটির পর অনেক সময় ওদের স্পেশাল ভাবে পড়া বুঝিয়ে দেন।  উনারা ধ্রুব এবং রত্নার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিলেন, ওদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল নয়। সব স্কুলে যেসব ছেলে মেয়েরা ভাল পড়াশুনা করে, তাদের প্রতি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্পেশাল নজর থাকে। রত্না এবং ধ্রুবর বেলাতেও তাই হয়েছিলো , ওদের কে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বই দিয়ে ও সাহায্য ও করতেন। 

       পাড়া-প্রতিবেশীদের ভুল ভাঙ্গে, তাঁরা বুঝতে পারেন অর্থ থাকলেই মানুষ সবকিছুর অধিকারী হতে পারে না। যদিও সমাজে বেঁচে থাকতে গেলে, অর্থ ছাড়া কোন কিছু সম্ভব নয়। প্রদীপ ও পৌষালীর ছেলে-মেয়ের সাফল্যে তাঁরা অবাক হয়ে যান। এত পয়সা থাকতেও তাঁদের সন্তানরা কিন্তু ধ্রুব ও রত্নার মত হতে পারেনি। 
       মানুষ সবকিছু নকল করতে পারে ভাগ্য নয়।  ভাগ্য একান্ত ব্যক্তিগত,নিজেকে তৈরি করতে হয়। আত্মবিশ্বাস থাকলে, ক্ষমতার বাইরে ও অনেক কাজ করা যায়, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের ওভাবে সাধ্যের মধ্যে থাকা কাজগুলো, অসম্ভব হয়ে ওঠে। 
       প্রদীপ ও পৌষালীর জীবনে কত ঝড় ঝঞ্ঝা গেছে, তবুও উনারা সেই ঝড়ের দমকা হাওয়াতে ভেঙে পড়েননি। তেমনি উনাদের ছেলেমেয়ে রত্না ও ধ্রুব হারায়নি  তাদের আত্মবিশ্বাস। 
       দুই ভাইবোন স্কুল ফাইনাল ও হায়ার- সেকেন্ডারি তে রেকর্ড নাম্বার নিয়ে স্টার পেয়েছে। এখন রত্না একটি ভালো কলেজে, ফিজিকস এ এম. এস. সি.পড়ছে। ধ্রুব কলকাতাতে এমডি করছে। ধ্রুব পরিকল্পনা করে রেখেছে, এমডি করেই স্কলারশিপের টাকা তে, আমেরিকা থেকে এফ. আর. সিএস. ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরে আসবে। কালের স্রোতে দিন, মাস, বছর চলতে থাকে। . ....

       রত্না বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি তে আসতো। কষ্ট হতো ঠিকই কিন্তু যেহেতু দাদা ধ্রুব কে বাইরে থাকতে হয়, তাই রত্না বাবা-মাকে ছেড়ে থাকেনি। ভাই বোন দুজনে স্কুল ফাইনাল এর রেজাল্টের পর , স্কলারশিপের টাকা তে পড়াশোনার খরচ চালায়।ধ্রুব অবশ্য সব সময় দু একজন কে টিউশন পড়িয়েছে। কলকাতাতে পড়ার সময় মাসি মনির বাড়িতে থাকতো ও মাসিমনির বাড়ির পাশে দুটো ছেলে কে টিউশনি পড়াতো .......
       কয়েক বছর পর আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ,  আজ রত্না আই. পি. এস. অফিসার। ধ্রুব কলকাতাতে একটি নামকরা নার্সিংহোম এর ডাক্তার। কলকাতাতে দুই ভাই বোন বিশাল বড় জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করছে।......
       বাড়ির না হওয়া পর্যন্ত স্মৃতিবিজড়িত পুরনো বাড়ি থেকে ভাইবোন কর্মস্থলে আসে।পাড়ার লোকেরা প্রদীপ ও পৌষালী কে  বলেন, -'আপনারা আমাদের পাড়ার গর্ব। দূরে চলে গেলে ও এই বাড়িটি দেখিয়ে সবাইকে আপনাদের কথা বলতে পারবো'।......
       এক বছরের মধ্যে  নতুন বাড়ি কমপ্লিট হয়ে যায়।  বিশাল বড় আকারে, দোতলা বাংলাে বললেও ভুল হবে না। ছেলে ধ্রুব তাদের বাবা-মা কে বলে বাড়ির নাম 'পৌষালী প্রদীপ' রাখা হবে। 
       বাবা প্রদীপ বলেন, -' না খোকা তোর মায়ের নাম পৌষালী, আর তোরা দুজন পৌষালীর রোদ্দুর। বাড়ির নাম 'পৌষালী রোদ' দিলে কেমন হয়'? 
       মেয়ে আবদার করে বলে, -' তোমার নামটা যে থাকলো না বাবা'? 
      -' প্রদীপ তো পৌষালী রোদের মধ্যে থাকে না মা। সে থাকে রাতের আলো হয়ে, সকলের খুশি দেখে সে মিটমিট করে আড়ালে হাসে। নাইবা থাকল আমার নাম , আমি থাকবো তোদের পাশে পাহারাদার হয়ে'। 
      স্ত্রী পৌষালী এইসব কথা শুনে বলেন, -' তুমি যে কি সব কথা বলো, পাহারাদার হয়ে থাকবে কেন? আমার মাথায় কিছু ঢুকে না বাপু'। 
      প্রদীপ হেসে উত্তর দেয়, -' বেশি বুঝে কাজ নেই, তুমি দেখো তো গৃহপ্রবেশ এর ভালো দিন কবে আছে? বাড়িতো প্রায় কমপ্লিট হতে যায়'। 
      "পৌষালী রোদ" এই নামে গেটে নাম প্লেট লাগানো হয়। গৃহ প্রবেশ ফাল্গুনের দশ তারিখ।  অর্থাৎ বাইশে ফেব্রুয়ারি। 

      ভালো থাকার ভালো উপায় হলো, ভালো থাকতে জানতে হয়।অপেক্ষারা অপেক্ষাদের সাথে অপেক্ষা করে। 'পৌষালী রোদের' ঝুলন্ত বারান্দা অপেক্ষা করে আছে তার প্রিয় মানুষগুলো তার কাছে কবে আসবে। এই বারান্দা তখন ভালবাসার রামধনু মাখা আলো ছড়িয়ে দেবে,বাড়ির ভেতরে। রামধনু মাখা আলো ও নিজেকে ধন্য মনে করবে, এই মিষ্টি মধুর সম্পর্ক গুলো কে কাছে পেয়ে।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments