জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১০৯

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১০৯
সম্পাদকীয়,
খেলতে ভালোবাসে না, এমন কেউ আছে নাকি? তারমধ্যে ফুটবল হলে তো কথাই নেই। শীত পড়ার এই আমেজে ২০২২, ফিফা বিশ্বকাপ আজ শুরু হচ্ছে। ৩২ টি দেশ থেকে প্রতিযোগীরা তাতে অংশগ্রহণ করছে। কাতারে এই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। আমি জানি তোমরাও টিভিতে দেখবে। তাবলে নিজেরা খেলবে না কেবলই অন্যের খেলা দেখবে তা তো হয় না। এবারের প্রচ্ছদে সুদীপ আঙ্কেল পুরুলিয়ার একটি গ্রামের দুটি ছোটো বন্ধুর খেলার  মুহূর্তের ছবি তুলে পাঠিয়েছেন। কি মজা না, ওদের সঙ্গে কে খেলছে জানো? ওদের ঠাম্মা। আরেবাবা ঠাম্মা দাদুরা শুধুই কি বসে বসে শীতে কাঁপে কিংবা শীতে ভূতের গল্প বলে নাকি, খেলেও তো। বীথি আন্টির গল্পে আবার বুনির ঠাম্মারা শিউলি ফুল তোলে। তারপর? তারপর হয়তো সেই শিউলির মালা গাঁথে। কে জানে আর কি কি করে! সেটা স্বপ্নের জানলা বলতে পারবে। আরে না রে বাবা, আমি বানিয়ে বলছি না। স্বস্তিকা দিদি তো লিখেছে দুগগা ঠাকুরের মতো দেখতে শিউলি বলে মেয়েটা শিউলি ফুলের মালা গাঁথছে। শিউলির কথায় জয়াবতীর কথা মনে পড়ে গেল। মস্ত বদ্যি হয়েছে সে। চিকিৎসে শুরু করেছে গো। বলে কিনা, সকালের জলপান খাবে রাজার মত, দুপুরের খাওয়া সাধারণ গেরস্তর মতো, আর রাতের খাওয়া খাবে সাধু সন্ন্যাসীর মত। ভাবতে পারো? এ যে আধুনিক ডাক্তারদের মতো কথা কয়। তৃষ্ণা আন্টিকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারা গেল না। তবু মনে রেখো, শিউলি ফোটার দিন শেষ হয়ে এল বলে। মানে স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা শুরু। তাই তো পীযূষ আঙ্কেল ইংলিশে মুশকিল ছড়ায় পড়ার কথা মনে করিয়েছেন। তোমরা যারা ছবি এঁকেছো / আঁকো, তাদের বলি শীতের খেলার ছবি এঁকে পাঠাও। খেলা চলুক বিশ্ব জুড়ে। খেলতে খেলতে খেলা দেখতে দেখতে ছোটোবেলা পড়তে ভুলো না কিন্তু। -- মৌসুমী ঘোষ।


ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
পর্ব ৩৪

তৃষ্ণা বসাক

ভগ্যিস তখন ঘরে সব্বো ছাড়া কেউ ছিল না। অন্য মেয়েটি ধুনো জ্বেলে আনতে গেছিল, নিলে কী যে হত ভেবে পায় না পুণ্যি। জয়াবতী এত উতপ্টাং কথা বলতেও পারে, বাবা, বাবা। জমিদারমশায়ের কানে গেলে আর রক্ষে আছে? তিনি হয় গুমখুন করবেন, নয়তো এ গাঁ থেকে তাদের বাস উঠিয়ে ছাড়বেন। এখন না হয় তারা সোনাটিকরিতে থাকে, চিরকাল তো আর থাকবে না, শিক্ষে শেষ হলে এ গাঁয়েই ফিরে আসতে হবে। তাছাড়া শুধু কি নিজেরা? ওর মা, খুড়ি খুড়ো, জয়াবতীর মা, বাপ ভাই –সব তো এখানে। তারা কোথায় যাবে? ভেবে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল পুণ্যির। সে চোখ পাকিয়ে দুটো কড়া কথা বলতে গেল তার গঙ্গাজলকে। ওমা, কাকে বলবে? সে মেয়ে তো তখন ওষুধের পেঁটরা বার করে হাঁটকে উটকে খল নুড়ি বার করে ফেলেছে, আর তাতে কী ঘষে যাচ্ছে একমনে। বড় খলনুড়ি তো বেজায় ভারি, সবখানে নিয়ে যাওয়া যায় না, তাই জয়াবতী পাতু কামারকে দিয়ে ছোট্ট এতটুকু একখানা খল নুড়ি তয়ের করে নিয়েছে। সেটাতে সে একমনে কীসব মেড়ে চলেছে একমনে, তার সেই একাগ্র মূর্তি দেখে কার এমন বুকের পাটা যে কিছু বলে?
মাড়া হয়ে গেলে একটা ছোট্ট পাথরের বাটি, ঠিক ঠাকুরের মধুপর্কের বাটির মত, তাতে সেই ওষুধটুকু ঢেলে, তাতে একটুসখানি
মধু মিশিয়ে জয়া পেরজাপতিকে বলল ঠাকমাকে মুখটা একটু ফাঁক করতে, তারপর সে ঠাকমার জিভে সেই ওষুধ ফেলল দু ফোঁটা। খানিকক্ষণের মধ্যে ভোজবাজির মতো কাজ হল। ঠাকমা চোখ মেলে বলল ‘ও বউমা, ঠাকুরমশাইকে একটু পাঁজিটা দেকে দিতে বলো তো, এই সপ্তায় আর একটা ভাল তিথি আছে শুনেচি’
গলা ক্ষীণ, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কথা।জয়াবতী বলল ‘গরম দুধ নিয়ে এসো এখনি। খেয়ে উনি ঘুমোবেন। ঘুম ভাঙলে দুধ সাবু কলা বা দুখানা লুচি, যা চাইবেন খেতে, দেবে। খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াতে হবে, নইলে ওষুধে কাজ হবে না। এই ওষুধ তয়ের করে রেখে গেলাম, দুধটা খাওয়া হলেই আমরা চলে যাব। এখন আর থাকার দরকার হবে না। কাল আবার আসব, সকালের দিকেই’
সব্বো বেশ কাজের মেয়ে দেখা গেল। সে ছুটোছুটি করে গরম দুধ নিয়ে এল ফুঁ দিতে দিতে, তারপর একটু একটু করে অনেকটাই খাইয়ে দিল ঠাকমাকে। জ্যাবতী ঠাকমার মুখের ভাব লক্ষ্য করছিল বসে বসে। আধশোয়া হয়ে খাচ্ছেন ঠাকমা, তাঁর চোখ আধখোলা, একটু যেন বল পেয়েছেন শরীরে, মনে হল তার। খানিকটা খাওয়ানো হতেই সে বলল ‘ থাক, আর কাজ নেই খাইয়ে। দুব্বল শরীর, বেশি নিতে পারবে না একসঙ্গে। সবাইকেই বলি, একবারে বেশি খাবে না কেউ, যাই খাও অল্প অল্প করে, পেটের এক কোণ খালি রেখে খাবে। দেখে যেন মনে না হয় এই তোমার শেষ খাওয়া, একটু পরেই তোমাকে শূলে চড়ানো হবে। আর একটা কথা বলি, সকালের জলপান খাবে রাজার মত, দুপুরের খাওয়া সাধারণ গেরস্তর মতো, আর রাতের খাওয়া খাবে সাধু সন্ন্যাসীর মত। মনে থাকবে তো?’
ঘর থেকে যাদের বার করে দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা কমবয়সী আবার এসে জুটেছে ঘরে। তারা হাঁ করে গিলছিল জয়াবতীর কথা। বশীকরণ করলে যেমন অবস্থা হয়, তেমনি অবস্থা তাদের, ঘাড় কাত করতেও ভুলে গেছে যেন।
ঠিক সেই সময়ে দরজার বাইরে একটা ভারি পায়ের আওয়াজ বাজল, গম্ভীর গলায় চৌকাঠের ওপার থেকে কে যেন বলল ‘কী মনে রাখতে বলা হচ্ছে শুনি? ‘
সেই শুনে ঘরে জড়ো হওয়া ভিড় নিমেষে ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল।
মিহিন ধুতি পরা, গায়ে একটি উড়নি জড়ানো, লম্বা, কিন্তু মোটা না, বরং বেশ পাতলা গড়নের সুন্দর একটি মানুষ ঘরে ঢুকে এলেন। তাঁকে দেখে জয়াবতী বেশ অবাক হল। মেয়েগুলো যেভাবে উধাও হয়ে গেল, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, ইনিই হচ্ছেন জমিদারমশাই। আসার আগে কল্পনা করেছিল লম্বা তো বটেই, বিশাল মোটা সোটা, গণেশ ঠাকুরের মত মস্ত ভুঁড়ি থাকবে, আর অসুরের মত দাঁত কিড়মিড় করা রাগী রাগী মুখ-এমন কাউকে। তার বদলে যিনি এলেন, তিনি লম্বা হলেও মোটা মোটেই নন,  আবার রোগাও নন, দোহারা গড়ন, গলার আওয়াজ বেশ ভারি বটে, কিন্তু অসুরের মত দাঁত কিড়মিড় করা চেহারা তো নয়, বরং মা দুগগার মায়ের মাথার ওপর যে শিবের পটখানি থাকে, তার মত এক আশ্চর্য শান্ত রূপ, তবে চোখ দুটি বোজা নয়, খোলা। আর জয়াবতী লক্ষ্য করল সেই চোখ দুটিতে খেলা করছে কৌতুক। বাইরে থেকে সব কথাই তিনি শুনেছেন,  সে তো বোঝাই যাচ্ছে। এখন তিনি কী শুধুবেন সেটাই দেকার। জয়াবতী দেখল উমাশশীর তেমন কোন পরিবর্তন নেই বটে, কিন্তু পুণ্যি আর পেরজাপতির মুখ শুকিয়ে গেছে। ওদের ভয় দেখে ভারি রাগ হল জয়াবতীর। এই মেয়েগুলো তো এ বাড়িতে থাকে, তারা ভয় পেতে পারে, দোষ করে থাকলে বা না থাকলেও বাড়ির মানুষ বকাঝকা করে, মা যে বলে হাঁড়ি কলসি পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি লাগেই। কিন্তু তারা তো বাইরের মানুষ, কথায় বলে অতিথি নারায়ণ, তার ওপর বদ্যি, এসেছে এঁরই মায়ের চিকিচ্ছের জন্যে। তারা ভয় পাবে কেন?
সে গম্ভীর মুখে বলল ‘সে কতা বলচি জমিদারমশাই, তার আগে আপনার চটিজোড়া চৌকাঠের বাইরে ছেড়ে আসুন, রুগীর ঘরে রাজ্যের ধুলোবালি ঢুকলে অসুখ বেড়ে যাবে যে’ একথায় জমিদারমশাই যত না চমকালেন, তার চেয়েও বেশি চমকাল পুণ্যি, পেরজাপতি, উমাশশী, আর দরজার বাইরে ভিড় করা মেয়েরা। জমিদারমশাইকে চটি খুলে আসতে বলছে, বুকের পাটা কি এ মেয়ের, বাপরে! সবাই দম বন্ধ করে ভয়ানক কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিল। এই বুঝি ওকে দশ ঘা বেত মারার আদেশ দেন জমিদারমশাই, কিন্তু তার বদলে তিনি বললেন ‘এহেহে, বড় ভুল হয়ে গেছে মা, মাপ করো, বেখেয়ালে চলে এসেছি, মার ঘরে আমি কোনদিন চটি পরে ঢুকিই না’
চটি ছেড়ে ভেতরে এসে জমিদারমশাই দেখলেন, তাঁর মা বিছানায় আধশোয়া হয়ে রেয়েছেন, তাঁর চোখ খোলা, মুখে ক্লান্তি বটে,তবে একটা শান্তির ভাবও স্পষ্ট, তিনি পেরজাপতির হাতখানি নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন ‘কী নাম তোমার মা?’
দেখে জমিদারমশাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কাল সারারাত কী ভয়ে ভয়ে কেটেছে। মাকে ফিরে পাবার আশাই ছেড়েছিলেন। এই মেয়েটি কি জাদু জানে?
তিনি জয়াবতীর দিকে ফিরে বললেন ‘মা তোমার হাতে কি জাদু আছে? যে মানুষটা কাল চোখ খলেনি সারাদিন সারারাত, আজ সে উঠে বসে কথা কইছে! আমার মাকে সারিয়ে তুললে, বলো কী নেবে? মটরমালা না পান্না বসানো বাজুবন্ধ?’
জয়াবতী খরখর করে বলল ‘আপাতক পালকিকে বলুন, বাড়ি যাব, সেই ভোরে রওনা দিয়ে এসেছি কিনা। ওরা সবাই ক্লান্ত। আর দেবার কিছু নেই। ইনি তো আমারও ঠাকমা। তবে   পরে একটা জিনিস চাইব, দেবেন তো?’
জমিদারমশাই কৌতূকমাখা চোখে দেখেন তাকে ‘কী চাও বলো মা, আমার সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয় দেব’
‘আমাদের ছিখেত্তর যাবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে’ (ক্রমশ)
 
স্নেহা দাস, অষ্টম শ্রেণী, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর


স্বপ্নের জানালা
বীথি ব্রহ্ম 

আমি ছোট্ট বুনি। এটা  আমার ডাকনাম। আরও নাম আছে। কিন্তু এই নামেই সবাই ডাকে। বাড়ির মধ্যে আমি সবার ছোট। একেকজন একেকটা নামে ডাকে। প্রথম প্রথম সব নাম ভুলে যেতাম। এখন অসুবিধা হয় না। আমার ঠাম্মি  আমার নাম বুনি রেখেছে। আর সব নাম হারিয়ে ফেলে শুধু বুনিটাই সবার মুখে মুখে ফেরে। আমার ভালো নাম ‘শুভদ্বীপ’। ওই নামে স্কুলের বন্ধুরা আর ম্যামরা ডাকে।
      রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠি আমি। অবশ্য এই ক’মাস ধরে। লকডাউনের মধ্যে ঘরে বসে অনলাইনে babyland - এর কিছুদিন ক্লাস করেছিলাম।  একটুও ভালো লাগে নি। কোনো ম্যাডামও , স্যারকে চিনতাম না। কোনো বন্ধুর সাথে মিশতে পারি নি। নাম জানি না কারো।
      বাবা-মায়ের কাছে শুনি অধিকাংশ বাচ্চা-ই ভোরে উঠতে চায় না। আর স্কুলে না যাওয়ার জন্য ছুঁতো খোঁজে। আমার ব্যাপারটা বেশ মজার- ই লাগে।
      ভোরে উঠেই জানালা দিয়ে তাকাই। পাশেই একটা মন্দির। সবাই মঠ বলে। অনেক প্রভু ও সন্ন্যাসী  থাকেন ওখানে। মন্দিরের বাগানের দিকে চোখ যায়। বাগান ভর্তি ফুল। আগে নাম জানতাম না। দিদিভাই ও পুপুর কাছে নাম শুনেছি। সাদা টগর, জুঁই, বোগেনভেলিয়া, বেলি, রঙিন সূর্যমুখী আর নানা রঙের দোপাটি আর অনেক সবুজ ঝাউ গাছ।  দেখে দেখে আর জানলা থেকে সরতে ইচ্ছা করে না। গেটের ওপরে ঝুলন্ত মাধবীলতা ও মালতীলতা। লালচে হলুদ হয়ে ঝুলে থাকে।
       আমার পুপু আমায় রোজ বলে- “ওই বাগানে মাঝ রাত্রিরে পরী আসে। মঠের প্রভুরা দেখেন। লাল, নীল, হুলদ, সবুজ পরী এসে কিছু ফুল নিয়ে যায়।“
আমি ভোরে উঠেও কোনোদিন পরীদের দেখিনি। ঘুম থেকে উঠেই কাঁচের জানলা দিয়ে তাকাই নীচের বাগানে। শুধু দেখি বেশ কয়েকজন ঠাম্মা টগর ফুল সাজিতে তুলছেন।
      কয়েকদিন পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছি। মাধবীলতা বিতানে দাঁড়িয়েছি। ঠাম্মারা বলেছেন- “কি গো বুনি-বাবু , ঘুম ভেঙ্গে গেল।“ আমার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর পরনে প্যান্ট। পায়ে হাওয়াই চটি। চুল এলোমেলো। আমি উত্তর দিয়েছি- “অ্যাঁ ভেঙ্গেছে। কিন্তু ঠাম্মু তোমরা কি ভোরের পরী দেখেছ?”
      ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললেন- “ও বুঝেছি! তুমি বুঝি পরী দেখতেই ভোরবেলা মন্দিরে এসেছ?”
      আমি  মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলেছিলাম- “অ্যাঁ ঠাম্মু। আমি একনো  ঠিক বুঝি না, সত্যি পরী আসে গো? “
      শুনে একজন ঠাম্মু ফুলের সাজি নামিয়ে বললেন- “ আহা বেচারা তাই প্রায়ই মন্দিরের বাগানে আসো, কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে যাও !” 
   আরেকজন ঠাম্মু বললেন, “আমরা রোজ ভোরে আসি তো! যদি পরীদের দেখা পাই তোমাকে ডেকে নেব।“
      আমি ওখান থেকে বাড়িতে চলে  আসি । তারপরে স্কুলের জন্য রেডি হতে থাকি। মা দুধ-রুটি খাইয়ে দেয়। বাবা জামা-প্যান্ট পরিয়ে দেয়। আর দিদিভাই আমার ব্যাগ-জলের বোতল। আমি কিন্তু অন্যমনস্ক থাকি। চোখ বারেবারে জানলায় চলে যায়। 
      ওরা জিজ্ঞেস করে- “কিরে বারবার ওদিকে কি দেখছিস!”
      ঘরের কেউ-ই জানেনা আমি ভোর ভোর মন্দিরে যাই। জানতে পারলে আমাকে খুব বকবে। দিদিভাই-ও জানেনা। শুধু ভোরে ওঠে আমার পুপু। ও জানে আমি ওখানে যাই। ও কিছু বলেনা। ঘরের জানলা দিয়ে আমায় ইশারা করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলে।
      বাড়ির সবাই ভাবে আমি খুব পড়ায় মনযোগী, তাই স্কুলে যাই। আসলে আমি স্কুলের খেলার মাঠটা খুব পছন্দ করি। সব চাইতে বেশি পছন্দ করি বাসের জানলায় বসতে। বাবা,মা-দিদিভাই আমাকে বাসে তুলে দেয়। বাসের আঙ্কেল হাত ধরে আমাকে একটা সিটে বসায়। আমি কিন্তু ঘষটে ঘষটে জানলার ধারে বসবই। জানলার ধারে গিয়েই জানলার ফ্রেমে নিজের মুখ সেট করে নিই। বাড়ির সবাইকে টা-টা দিতে দিতে বাসটা অন্য একটা বন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে দাড়ায়, ওই বন্ধুর নাম রামু। ওকে ওঁর মা ও দিদি বাসে তুলে দেয়। ও উঠে বাসে সিট খুঁজতে থাকে। আর আমি?
      জানলা দিয়ে দেখি- রামুর দিদিকে। রামুর চাইতে একটু লম্বা। একটা লাল রঙের গেঞ্জির জামা পরে। সেটার মস্ত দু’টো পকেট। লাল পকেট থেকে পুঁচকে দু’টো বিড়ালছানা উঁকি মারে। আমি গলা বাড়িয়ে মিয়াঁও করি। ওরাও উত্তর দেয়- “মিয়াঁও।” তরপরে ওদের টা-টা করি। পুঁচকে ছানা দু’টো অনেকক্ষণ ধরে ডেকেই যায়। মনে হয় বলে আমরাও বাসে চড়বো। আমার খুব খুব ভাললাগে ওদের।
      সেদিন পুপু জিজ্ঞেস করেছিল- “কিরে বুনি স্কুলে  সবার চাইতে তোর কি ভালো লাগে? “
      আঁদো আঁদো করে বলেছিলাম- “রামুর দিদির পকেটের ম্যাঁওদের আমার খুব ভালো লাগে।“ বলেই তিড়িং বিড়িং করে নেচেছিলাম।
      পুপু-র মুখটা হা হয়ে গেছিল। এতো বড়! ঠিক আমার স্বপ্নের বাসের জানলার মতো!

শুভঙ্কর সেন,পঞ্চম শ্রেণী,সোদপুর হাই স্কুল,উত্তর ২৪ পরগণা

ইংলিশে মুশকিল
পীযূষ প্রতিহার

ইংরেজি নিয়ে দাদা বড় মুশকিল
কাইট মানে ঘুড়ি আর আকাশের চিল।
ব্যাট থাকে ক্রিকেটে আর ওড়ে রাতে
রাইট সাইড হবে গেলে লেফট হাতে।
মাউসের কাজ বল কত কাটাকুটি
কম্পিউটারে দেখ তার নেই ছুটি।
ফ্যান মানে ভক্ত ও ফ্যান মানে পাখা,
ওয়াচ মানে ঘড়ি বুঝি আর বুঝি দেখা।
এইসব কত কথা মনে রাখি বলো তো
মুশকিলে পড়ে গেছি, এইবার ছাড় গো।

শুভশ্রী সরকার, সপ্তম শ্রেণী,সুখচর শতদল বিদ্যায়তন
উত্তর ২৪ পরগণা


শিউলি মাখা
স্বস্তিকা চট্টোপাধ্যায়
বটানি অনার্স, শ্রীরামপুর মিশন কলেজ, হুগলি


ছাতিমতলা গ্রামে পড়ন্ত বিকেল । সেন'বাড়ির দুর্গা দালানে পঞ্চমীর আগের দিনের প্রস্তুতি তুঙ্গে । বনেদী  জমিদার পরিবারে বংশপরম্পরায় প্রতিমা গড়েন মিস্ত্রী পরিবার । বিগত চার বছর ধরে প্রভাত মিস্ত্রী এই দায়িত্বে রয়েছেন । এখন,দুর্গা প্রতিমার হাতে একে একে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন তিনি । সামনে ছয় বছরের মেয়ে শিউলি পা ছড়িয়ে বসে । ফুলের গন্ধ মেখে মালা গাঁথছে সে ,বিকেলের আহ্লাদী রোদে মুখশ্রী এক্কেবারে সেন বাড়ির দুর্গা প্রতিমার মত জীবন্ত দেখাচ্ছে । মালা গাঁথতে গাঁথতে  এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে চলছে সে তার বাবাকে। 
  - "বাবা ; মা দুগ্গার দশটা হাত !!"
প্রভাত হেঁসে উত্তর দেয়- , " হ্যাঁ মা ,তাকে জগৎ সংসারের কাজ সামলাতে হয় কি'না"
- "বাবা! আমার কি করে তাহলে দুগ্গা ঠাকুরের মত দশটা হাত হবে ?!" 
  প্রশ্নের  উত্তর না পেয়েই আনমনে খেলতে চলে যায় শিউলি ।
 এরপরে বছর ষোলো কেটে গেছে । শিউলির বাবা আর নেই । ফলত আর অবান্তর প্রশ্ন করেনা সে , খালি এই স্বার্থপর জগতকে বুঝতে চেষ্টা করে , হেরে যায় বার বার । পাঁচ -ছয়  বছর আগে প্রবল শীতে নিজের চোখের সামনে ,বাবাকে কাতরে কাতরে বিছানায় মিলিয়ে যেতে দেখেছে সে । কিন্তু, কিছুই যে করার ছিলনা । সেন বাড়ি থেকে একটা পুরনো কম্বল দিয়েছিল বটে তবে, সেটা দিয়ে জ্বরের কাপুনি থামানো যায়নি । তখন বাড়িতে  অনটন । চাল , পরনের কাপড়ের কথা চিন্তা করে রাতে দুচোখের পাতা এক হয়না ।মা ,মানসিক স্থিরতা হারিয়েছে ; কই? তখন তো মা দুগ্গা দশটা হাতের একটাও বাড়ায়নি । জগৎ সংসারের খোঁজ সে কি আদৌ রাখে ? তবে এক্কেবারে শেষে যখন হারানোর আর কিছুই নেই মা দুগ্গা কেবল মানবিকতার হাত বাড়িয়েছিল । চাকরির appointment letter ।

                    ছাতিমতলা গ্রামে এখন এক জ্যান্ত দুগ্গা মায়ের বাস , তার হাতে ভারী ভারী অস্ত্র নেই আছে ভালোবাসা , মানবিকতা ,স্নেহ ,মায়া ।সে কোনো জ্যান্ত অসুর বধ করেনা ; বধ করে দারিদ্রতা অসহায়ত্বতাকে । শরৎকালে কাশবনে দুর্গা সেজে ক্যামেরা লেন্সের সামনে ঘোরে না তবে অসহায় বাচ্চাদের কোলে তুলে নেয় , উলঙ্গ উন্মাদদের চিকিৎসা করায়, ঘরহারাদের ঘর দেয় চাল দেয় কাপড় দেয় , সর্বহারাদের সবকিছু দিয়ে ভরিয়ে দিতে চায় । 
                     কাল দুর্গা পঞ্চমী । হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা সেন 'দের দুর্গা দালান । বাবা'কে জিজ্ঞেস করা শেষ  প্রশ্নের উত্তর পায় সে মনে মনে ।কালে কালে কত ভয়ানক অসুর বধ হলো কিন্তু কই রাতের গভীর অন্ধকারে একলা ছাদের কোণে দাড়িয়ে থাকা অসহায় মানুষগুলোর টলটলে চোখের জল থামলো কি? আসলে এই সমাজে এখন শিউলির মত জ্যান্ত  দুগ্গা মায়ের  ভীষণ দরকার ।


পাঠপ্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ১০৭ পড়ে দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর যা লিখলেন) 

জ্বলদর্চি  ছোটবেলা বিশেষ সংখ্যা ১০৭ এ মৌসুমী (ঘোষ)দির সুন্দর সম্পাদকীয় টি পড়ে ফেললাম সঙ্গে অপু পাল মহাশয়ের তোলা ফটোটিও খুব সুন্দর অর্থ বহন করছে। এ যেন পুজো শেষে মায়ের চলে যাওয়ার ছবি আর সকল সন্তানের রূপক যেন ওই বাচ্চা ছেলেটি ও তার চোখের জল।

এরপরে সেই গুরুত্বপূর্ণ ধারাবাহিকটি আছে, যেটা পড়ার আগ্রহ সেই প্রথম দিন থেকে আছে,তৃষ্ণা বসাকের লেখা "জয়াবতির জয়যাত্রা"। আজকের লেখাটি একটু বড় হলে ভালো লাগতো যাই হোক। পুণ্যিদিদি ও পেরজাপতির কথোপকথন  শুনে খুবই ভালো লাগলো যেমন, সেরকম আবার খারাপ লাগলো পুন্যি দিদির ভাই জন্মানোর সময় মা মারা যাওয়ার ঘটনায়।
এরপরে দেখতে পাই সপ্তম শ্রেণীর একটি ছোট্ট ছাত্রি শুভশ্রী সরকারের আঁকা একটি সুন্দর ছবি।
শ্রীছন্দা বোসের লেখা "গরিবের দীপাবলি"কবিতাটি খুব সুন্দর ছন্দ মেলানো কবিতা।
বিপ্লব চক্রবর্তীর লেখা বড় গল্প "ঘোষাল বাড়ির ডাকাতি"একটি টানটান উত্তেজনার গল্প। বড় জ্যেঠার অসীম সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
এরপরেই মন ভালো করে দেওয় শ্রেয়া ব্রজবাসীর আঁকা সুন্দর ছবি দেখলাম।

প্রথম শ্রেণীর ছাত্র সায়ক সরকারের "টুই" ছড়াটি ভীষণ ভালো লাগলো, এ যেন তার মনের কথা।

নতুন সংযোজন সুব্রত দেবের তৈরি "শারদ শব্দছকটি" সমাধান করতে বেশ ভালই লাগছিল।
সবশেষে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, সম্পাদক মহাশয় মৌসুমী ঘোষের অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে যা প্রতি সপ্তাহান্তে "জ্বলদর্চি ছোটবেলা" পত্রিকা কে প্রতিবারই নতুন করে সমৃদ্ধ করছে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments