জ্বলদর্চি

ক্ষিতীশ সাঁতরা (গল্পকার, গীতিকার, লোক গবেষক এবং সংগ্রাহক, ভগবানপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ২৯

ক্ষিতীশ সাঁতরা (গল্পকার, গীতিকার, লোক গবেষক এবং সংগ্রাহক, ভগবানপুর)

ভাস্করব্রত পতি

"টাকা সঙ্গে যাবেনা, পয়সা সঙ্গে যাবেনা
সোনাদানা গয়নাগাটি, একদিন তোর হবে মাটি,
এক টুকরো কাপড়ও কেউ, অঙ্গে দেবেনা
টাকা সঙ্গে যাবেনা, পয়সা সঙ্গে যাবেনা।

অনেক জমা অনেক জমি, কত না দেশ বিদেশ ভূমি
তৈজসের গুমর নিয়ে, বারেক বাড়ি বারেক কমি
সাড়ে তিন হাত জমির বেশী, কেউ তো দেবেনা।
সোনাদানা গয়নাগাটি, একদিন তোর হবে মাটি,
এক টুকরো কাপড়ও কেউ, অঙ্গে দেবেনা
টাকা সঙ্গে যাবেনা, পয়সা সঙ্গে যাবেনা।

পূজ্য পিতা মা জননী, পুত্র কন্যা ভাই ভগিনী
মিলে লাখো স্বজন বান্ধব, শুধুই পথের চেনাচিনি।
শেষের বান্ধব শুধুই হরি, আর কেউ সঙ্গে হবেনা।
সোনাদানা গয়নাগাটি, একদিন তোর হবে মাটি,
এক টুকরো কাপড়ও কেউ, অঙ্গে দেবেনা
টাকা সঙ্গে যাবেনা, পয়সা সঙ্গে যাবেনা"---

অতি সহজ সরলভাবে আমাদের সমাজের চিরন্তন রূপটি যিনি গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন, তিনি মেদিনীপুরের বর্ষীয়ান কবি, গবেষক, গল্পকার ক্ষিতীশ সাঁতরা। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নীরবে নিভৃতে সাহিত্য সেবা করে চলেছেন মেদিনীপুরের মাটিতে। 

এই মুহূর্তে চারিদিকে চলছে টাকা পয়সার ছড়াছড়ি। সেখানে ক্ষিতীশ সাঁতরার লেখা গানে সনজিৎ মণ্ডলের কন্ঠ হয়তো কারোরই চোখ খুলে দেবেনা, কিন্তু সামাজিক বার্তা দেবেই দেবে। যদিও টাকা পয়সা অর্থ সম্পদ নিয়ে আমাদের দূর্বলতা এবং লোভ সেই আদিম কাল থেকেই। 
১৯৪১ এর ২০ শে আগষ্ট কেলেঘাইয়ের পাড়ে ভগবানপুরের পশ্চিমবাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
বাবা হৃদয়নাথ ও মা কিরণমালা দেবীর পরিবারে ছিল সাহিত্য চর্চার বাহুল্য পরিবেশ। হৈমবতী দেবী ছিলেন তাঁর ঠাকুমা। তিনিও ছিলেন কবি। তেমনি পিতামহ যাদবচন্দ্র ছিলেন একজন বিদ্যোৎসাহী মানুষ। প্রাচীন পুঁথি 'পূর্ণ মাসীর জন্মপালা'র লিপিকার তিনি। এটি এক বীরাঙ্গনা নারীর জন্মকাহিনী। 

তাঁর বেড়ে ওঠা কেলেঘাইয়ের জলের জোয়ার ভাটাকে আঁকড়ে ধরে। নদীর স্রোতের মতোই খরস্রোতা তাঁর কলমের গতি - 'আমার একটা আকাশ ছিল / আকাশে রামধনু ছিল / আর ছিল এক নদী / পাহাড় থেকে সোজাসুজি সাগর অবধি'। পড়ন্ত বিকেলে রোদের চহট যখন নদীর জলে পড়ে প্রতিবিম্বিত হয়, তখন তিনি আত্মমগ্ন হয়ে আত্মীকরণ করেন প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ। স্বভাবকবির গেঁয়েলি ভাবনার জারকরসে তখন সিঞ্চিত হয় কবিতার শিরা উপশিরা। আর তখন 'রোদ্দুরটা' কবিতায় ভেসে ওঠে কথার ইমারত -- 'রোদ্দুরটা রোদ্দুর নয় যেন একটা বাঘ / দুপুরবেলা আকাশ থেকে / ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত পা ছুড়ে / চোখ দুটো ঠিক আগুনভাঁটা / কি ভয়ানক রাগ'। 

তাঁর কলম ছুঁয়ে বেরিয়েছে রাবন বধের পালা, মিথ্যুক, লড়াই, মঙ্গলকাব্যের গল্প, পুরনো পাতার বাঁশি, ঈশ্বরভাগ্যে পাথরবাটি, স্বপ্নলোকের চাবি, মজাদার ঘন্টাবাদক, ছড়রা, চিংড়িমাছ, বিদ্যাসাগর, পূজনীয় পিতৃদেব, রাহুমুক্ত, শিরোনামহীন, বড়দের ছেলেবেলা, কাঠঠোকরা, ঘুঁটে ও অন্যান্য প্রবন্ধ, গীত সঙ্গীত, জননী, প্রাচীন সাহিত্যের গল্প, কাল্লু গুণ্ডার গপ্পো, সৃষ্টি সম্ভব, রজনীগন্ধা ইত্যাদি কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটিকা, শিশু জীবনী, উপন্যাসের সম্ভার। মেদিনীপুরের কবিগান ও কবিয়ালদের নিয়ে খুব শীঘ্রই আত্মপ্রকাশ করবে এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সম্পাদনা করেন 'মাটি' পত্রিকার। এছাড়াও আমরা তৈরি, অভিযাত্রী, জোট পত্রিকার পরিচালনা করতেন। তাঁর লেখালেখির জন্য বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিশেখর কালীদাস রায়দের সঙ্গে গড়ে ওঠে যোগাযোগ। যা তাঁকে নানাভাবে পরিশীলিত হতে সাহায্য করেছে। আসলে তিনি ভালোবাসেন জনগন। পছন্দ করেন জনমত। মানুষের সাহচর্য ছাড়া তাঁর হাই ওঠে না। ঘুম আসে না। এজন্যই 'জনমত' কবিতায় তাঁর অসাধারণ উপলব্ধি নিজেই প্রকাশ করেছেন -- 'জনমত হোক তৈরি মিথ্যার হব বৈরী / মেকি যাহা হোক ধ্বংস / লোপ পাক যত কংস'।

আকাশবাণীর জনপ্রিয় গীতিকার ছিলেন তিনি। অজস্র গান লিখে চলেছেন এখনও। তাঁর গানে উঠে এসেছে প্রেম বিরহ প্রকৃতি পরিবেশ জীবনতত্ত্ব আর যন্ত্রনার চিত্র। তাঁর লেখা "যদি কারো সুখের সঙ্গে" গান গেয়েছেন আশা ভোঁসলে এবং "দুঃখ যে দেয় সে তো" গেয়েছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।  এছাড়াও তাঁর লেখা গানে গলা মিলিয়েছেন অমৃক সিং অরোরা, অমর পাল, অসীমা মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত মাইতি, শম্ভু মুখোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, দীনেন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীরা। এরকম অসংখ্য গান লিখে গৌরবান্বিত করেছেন নিজেকে। উজ্জ্বল করেছেন মেদিনীপুরকে।

আসলে তিনি কথাকার। সমস্ত শরীর দিয়ে কথা বলেন। আপাদমস্তক একজন কথাপ্রেমী। পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ছলকে ওঠে কথার ঝড়। তিনি গল্পকার হলেও গল্প লেখেননা। গল্প বলেন। যা আমরা পাই সাদা কাগজের পিঠে। আর খোঁজ করেন পরশপাথরের। এই অন্বেষনের নির্যাস হলো -- 'পরশ পাথরের আজ পেলাম ছোঁয়া / লোহামন হল সোনা, নেই আর ভাবনা / হৃদয়ে ভালোবাসার উজান ধারা, কী যে করি / ফাগুনের আগুন জ্বলে মরি মরি মরি মরি'। তেমনি 'পাথর' কবিতায় তাঁর স্বগতোক্তি 'সইতে সইতে কেউ বা ভাঙ্গে / কেউ বা পাথর হয়ে যায় / অল্প ঘায়ে কাচ গুঁড়ো হয় / পাথরের কি বয়ে যায়'?

চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর নান্দনিক চেতনা প্রতিভাত। বাস্তববাদী ভাবনার মিশেল তাঁর সৃষ্টিসুখের আঙিনায়। অসংখ্য পত্র পত্রিকার প্রচ্ছদশিল্পী তিনিই। তিনি তো থামতে জানেন না। তিনি ভালোবাসার কাঙালি। কিন্তু নিজের অপরাগতা স্বীকার করে নিয়ে অনায়াসে বলতে পারেন "ভালোবাসা দিতে যাকে পারিনি গো কোনো দিন / ভালোবাসা চাই তাঁর কি করে"?

ঠাকুমা হৈমবতী দেবীকে অমর রাখতে বাড়িতে গড়ে তুলেছেন "হৈমবতী দেবী সংগ্রহশালা"। মেদিনীপুরের প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং উপাদানগুলিকে পরম মমতায় রক্ষা করার জন্য তৈরি করেছেন এই প্লাটফর্ম। এই মিউজিয়ামে রয়েছে ছাপাখানার অসংখ্য ব্লক। যা আজ আর ব্যবহৃত হয়না। কিন্তু সযতনে গুছিয়ে রেখেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে। রয়েছে টেরাকোটার সামগ্রী এবং নানাবিধ পত্র পত্রিকা ও বইয়ের সম্ভার।

সৃজন সাহিত্য সম্মান, অজগর সাহিত্য পুরস্কার, অনুপত্রী সাহিত্য সম্মান, নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী সম্মান, বালিচক সাহিত্য সংসদ স্মারক সম্মান, পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার, লোককৃতি সাহিত্য সম্মান, সর্বভারতীয় শিশু সাহিত্য সম্মেলন স্মারক, মেছেদা সাহিত্য একাডেমী সাহিত্য সম্মান পেয়েছেন জীবনের বিভিন্ন সময়ে। যদিও এইসব পুরস্কার তাঁর কাজের মাপকাঠি নয়। তিনি আপনভোলা এক পথিক। প্রত্যন্ত মেদিনীপুরের বুকে বসে চর্চা করেন ইতিহাস। চর্চা করেন সংস্কৃতি। চর্চা করেন সাহিত্য। আর ৮৪ বছর বয়সেও কেলেঘাইয়ের কাদামাটি মাখা বুড়ো কবি ক্ষিতীশ সাঁতরা নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে লিখে ফেলেন -- 'চলতে চলতে পথে, হয়তো অনেক হবে ভুল / তার মাঝে যদি ফোটাতে পারি কখনো একটা ফুল / হয়তো জীবন আকাশে হতেও পারে / অনেক তারা দিয়ে থাকবে ভরা'।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments