জ্বলদর্চি

ড. দীপেন্দ্রনারায়ণ রায় /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩৭

ড. দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়

ভাস্করব্রত পতি 

সেটা ১৯৯৯ সাল। আজ থেকে ২৪ বছর আগেকার কথা।তখন বেতন বাবদ মাসকাবারে মিলতো ৫৬ হাজার টাকা! চূড়ান্ত আয়েসি ভাবেই কাটিয়ে দিতে পারতেন ম্যানেজমেন্টের এই চাকুরিজীবীটি। কিন্তু, তাঁর মননে, চিন্তনে এবং হৃদয়ে এক লড়াকু মহিলার প্রতিচ্ছবি। তিনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসময় লাল বাংলার বুকে এক অন্যতম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। স্রেফ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অদম্য ভালোবাসায় এবং জনসেবামূলক কাজের একনীষ্ঠ ইচ্ছায় দেখিয়ে ছিলেন 'ছাপান্ন ইঞ্চি' বুকের ছাতি। রগরগে বেতনের চাকরি ছেড়ে নিজেকে বিলিয়ে দেন 'মা মাটি মানুষ' এর দলে। রাজনীতির অন্দরমহলে ঢুকে পড়া এই কর্মঠ পুরুষটি কিন্তু তাঁর কাজের প্রতি সততা, আগ্রহ আর একাগ্রতা দিয়েই জয় করেছেন মেদিনীপুরের মানুষের মন।

তিনি রাজনীতির বেসাতি করলেও জেলার ইতিহাস সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে রক্ষার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করেননি নিজেকে। মাথা উঁচিয়ে, বুক ফুলিয়ে আর মেরুদন্ডকে সোজা রেখে পা উজিয়ে চলতে ভালোবাসেন। কাঁটা বিছানো পথকে তিনি ফুলেল পথ ভেবেই সদর্পে মাড়িয়ে চলেন। মানুষের পাশে থাকেন, মানুষকে পাশেই রাখেন। 

ড. দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়। সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান। আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক চাদরে মোড়া থাকলেও সেটাই তাঁর প্রকৃত পরিচয় নয়। রাজনীতির দুয়ার ছাড়িয়ে জেলাবাসীর কাছে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন একজন লোকসংস্কৃতি গবেষক এবং লেখক হিসেবে। দীপেন্দ্রনারায়ণের বাবা ডাঃ ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। সেসময় ব্রিটিশরা তাঁর মাথার দাম রেখেছিল পাঁচ হাজার টাকা। ফলে পারিবারিকভাবেও একটা ঐতিহ্য এবং গরিমার ইতিহাস বহন করে নিয়ে চলেছেন তিনি।


দীর্ঘদিন ধরে তাম্রলিপ্ত নিয়ে গবেষণারত‌। আগামী মে মাসে তাম্রলিপ্ত বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে মুখ্য বক্তা তিনি। একসময় বর্ধমানের 'সীমায়ন' পত্রিকায় লিখতেন। কিন্তু রাজনীতির আবর্তে এসে সেই লেখালেখি তে কিছুটা ভাটা এলেও তা মোটেও থামেনি। করোনা পরবর্তী অধ্যায়ে তাম্রলিপ্ত রাজবাড়িতে পরপর দু বছর ধরে আয়োজন করেছেন আন্তর্জাতিক সেমিনার। বিভিন্ন দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন বক্তারা। তমলুক তথা মেদিনীপুরকে বিশ্বের সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন নিগূঢ় তাম্রলিপ্ত চর্চার মাধ্যমে।

প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন। আদ্যোপান্ত মেধাবী ছেলে পরবর্তীতে পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতি নিয়ে মেতে উঠলেন। ১৯৮৫ তে মাদ্রাজ (চেন্নাই) গেলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানে গিয়ে তিনি A.M.I.A.E. পাশ করেন ও পরেB Tech পাশ করেন। পাশ করার পরে তিনি Century Technical Institution এ কিছু সময়ের জন্য শিক্ষকতা করেন। চেন্নাইতে থাকাকালীন রাজনীতির গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন জি কে মুপানর, এস নারায়নের মতো পরিনত নেতাদের। কিন্তু ঐ লেখালেখিটা ছাড়তে পারেননি। 
এর পাশাপাশি তিনি P.G. Diploma in Marketing Management ও পাশ করেন। তাছাড়া Institute of Mechanical Engineers (India), Institute of Jute Technology সহ বিভিন্ন Institute থেকে বিভিন্ন সময়ে Specialised Training সহ ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন কোর্স উত্তীর্ণ হন। সেইসাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। MBA marketing ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু এই বছরেই তিনি পারিবারিক কারনে চাকুরি ছেড়ে, একটি ঔষধ কোম্পানীর consultant হিসাবে কাজ শুরু করেন। চাকরির প্রয়োজনে আমেরিকা, বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। আর এইসব যাত্রার মাধ্যমে চাকরির পাশাপাশি সেখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পাঠ নিয়েছেন নিজের মতো করে। ২০২১ এ মধ্যপ্রদেশের সিহোরতে শ্রী সত্য সাঁই ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি অ্যাণ্ড মেডিকেল সায়েন্স থেকে ড. দীপক কুমারের তত্ত্বাবধানে লাভ করেন PhD ডিগ্রি। তাঁর গবেষণার উপজীব্য‌ বিষয় ছিল THE ROLE OF ETHICS IN ADVERTISING AND THE EFFECTS OF SOCIAL MEDIA ON MARKETING।

১৯৯৬ সালে তিনি Reserch Plus Inc - এর পূর্বাঞ্চলের Sales executive হিসাবে কোলকাতায় আসেন। পরে তিনি Regional Sales Manager পদে উন্নীত হয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চল সহ বাংলাদেশ, ভূটান, নেপালেরও দায়িত্বে ছিলেন। এই সময়েই তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোমিওপ্যাথির উপর একটি সার্টিফিকেট কোর্সও করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়কালে তিনি কাজ করেছেন TTK PHARMA, D K ASSOCIATES, TVS SUJUKI, HELICOPTER CORPORATION OF INDIA, RESEARCH PLUS INC (America) তে।

চেন্নাইতে থাকাকালীনই শুরু করেন "তাম্রলিপ্ত রাজকাহিনী" লেখার কাজ। সেসময় সিভিল সার্ভিসে যাওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। তাই ওখানে গিয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরি এবং কোন্নেকারা লাইব্রেরিতে কার্ড করেন। নিয়মিত যেতেন। পড়াশোনা করতেন। এরপর তমলুকের টুনু মুখার্জি তাঁর সেই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহটাকে আরো উসকে দেন ধীরে ধীরে।

তাম্রলিপ্ত রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন মহারাজ ময়ূরধ্বজ। তারপর রাজত্ব করে গিয়েছেন তাম্রধ্বজ, হংসধ্বজ, গরুড়ধ্বজ, বিদ্যাধর, নীলকন্ঠ, জগদীশ, চন্দ্রশেখর, বীরকিশোর প্রমুখ। এই রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণ রায়। তিনি ছিলেন ৬২ তম রাজা। দীপেন্দ্রনারায়ণ উল্লেখ করেছেন, "সুতরাং ৫০ বছর গড় ধরলে মহারাজ তাম্রধ্বজ থেকে ৩০০০ বছর হয়। সুতরাং তাম্রলিপ্ত রাজার কৌরব পক্ষে যোগদান এবং এই বংশের বর্তমান বংশধরগণ ইতিহাসের সত্যতা প্রমাণ করে"।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
তাম্রলিপ্তরাজ ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজাদের মধ্যে অন্যতম ছিল। কথিত আছে, তাম্রলিপ্তরাজ কৌরবপক্ষে যোগদান করেছিলেন। অবশ্য পরাজিত হয়েছিলেন। সেসময় তাম্রলিপ্তবাসী সৈন্যরা যে বিপুল তেজ বিক্রম শৌর্য এবং নৈপুণ্য দেখিয়েছিল, তার বিবরণ মেলে সঞ্জয়ের বিবরণে। এই রাজবংশের টোটেম হল 'ময়ূর'। বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম সেই ময়ূর রাজবংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মনি ভৌমিকও এসেছিলেন সেই তাম্রলিপ্ত রাজবাড়িতে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে নিজেকে পার্টির স্বার্থে যুক্ত করেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেন। ২০০০ সালে পৌরসভার নির্বাচনে প্রথম জয়লাভ। ঠিক দু বছর বাদে হলেন উপ পৌরপিতা। এরপর ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত টানা উপ পৌরপিতার দায়িত্ব সামলে ২০২০-২০২১ পর্যন্ত পৌরসভার BOARD OF ADMINSTRATOR এ আসীন হন। ২০২১ থেকে তাম্রলিপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান। 

তমলুকের বুকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম মিটিং হয়েছিল ধারিন্দা মাঠে। সেসময় টাটা সুমো থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভ্যর্থনা করে স্টেজে নিয়ে গিয়েছিলেন দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়। তখন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন কাল। আসলে প্রথম থেকেই বাংলার লড়াকু নেত্রীর কর্মকাণ্ডকে হৃদয় দিয়ে শ্রদ্ধা করেন। একসময় রাজ্য তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন। পরে জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি হন।  শিশির অধিকারীর সভাপতিত্বে টানা ছ'বছর মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ পদে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০১৩ থেকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা রেড ক্রশ সোসাইটির সম্পাদক পদে আসীন। এর সাথে তাম্রলিপ্ত জনস্বাস্থ্য কৃষি ও কুটির শিল্প মেলা, আদি তাম্রলিপ্ত সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি, পূর্ব মেদিনীপুর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন, তাম্রলিপ্ত ময়নাগড় কাশীজোড়া মহিষাদল হেরিটেজ কমিটি, তমলুক রাজাবাজার সহায়তা সংঘের সম্পাদক পদেও থেকেছেন। জেলার গরিমা তুলে ধরতে তাঁর প্রয়াস প্রণিধানযোগ্য।

Post a Comment

1 Comments