জ্বলদর্চি

স্বপ্নের সওয়ারী /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

স্বপ্নের সওয়ারী  

চিত্রা ভট্টাচার্য্য 


ব্রুকলিনের গগন চুম্বি অট্টলিকার ২৪ তলার ফ্লোরের ব্যালকনিতে কফির মগ হাতে মধুরা এসে দাঁড়ালো।এখোনো রাতের আঁধারের ছায়ার ঘোর রয়েছে ভোরের আলোয় আকাশ কাঁচাহলুদের রঙ নেয়নি। দূরের সুউচ্চ বাড়ি গুলো শ্লেট রঙের কুয়াশায় ঢাকা। আরো বহু দূরের প্রান্তে শেষ সীমানায় যে পাহাড়ের ঢেউ খেলানো শীর্ষ গুলো এই ব্যালকনি থেকে দেখা যায় তারা শ্বেত শুভ্র বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে শীত ঘুমে কাতর। সেখানে সূর্যের আলোর প্রতিফলনে মনে হয় নাগাধিরাজ স্বর্ণ মুকুটে সেজেছে। এখানে দাঁড়ালে তামাঙ্গ দুনিয়া যেন  কোলাহল শূন্য লাগে ,ব্যস্ত ব্রুকলীনের শহুরে জীবনের যাবতীয় হৈ হল্লা সব সেই নীচের তলায় জমিতে ফেলে এসে মুক্ত আকাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কাটানো অল্প কিছু মূহুর্ত ও বেশ মূল্যবান। বিশেষ করে হসপিটালে এমার্জেন্সি কেস থাকলে সারা রাত ডিউটির পর ঘরে ফিরে এসে মধুরার প্রতিদিন সকাল বেলা এতো উঁচুতে এই ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়িয়ে  নিজের সাথে বোঝাপড়ায় কাটানো ওর প্রতিদিনের অভ্যাস। গত দুটো সপ্তাহ ধরে এক মৃত্যু পথ যাত্রী দূরারোগ্য ক্যান্সার আক্রান্ত পেশেন্টের সাথে অহর্নিশি লড়াই চলেছিল যমে মানুষে। সাত দিন ধরে মোটেই অবকাশ হয়নি সারা রাত চোখের পাতা বোজার। ডাক্তারীর পাঠ নিতে এসে প্রথম দিকে টানা এ ভাবে রাত জাগতে খুব কষ্ট হলেও এখন বেশ অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ডক্টর স্যামুয়েল স্যার সার্জারীর পর ওকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই অর্দ্ধমৃত ২৬ বছরের তরতাজা যুবক --সিরিয়াস পেশেন্টটি কে সুস্থ করে তোলার। সে নির্দেশ ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নততর প্রভাবে আপাততঃ সে বিপদ সীমা মুক্ত ,ওর পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। ডক্টর স্যামুয়েল স্যার পেশেন্ট কে দেখে এবং  চেক আপ করে ভীষণ আনন্দিত। আজ মধুরা ভারী নিশ্চিন্ত, নিজেকে মনে হচ্ছে মুক্ত এক বিহঙ্গের মত। সাফল্যের আনন্দে সে অনায়াসে খুশিতে উড়ে যেতে চায় প্রসারিত ঐ নীলাকাশের বুকে।    
                                                                                               ব্রুকলিনে এখন বসন্ত এসে গেছে। নবীন বসন্তের দাপটে শীত বুড়ো গুটিসুটি মেরে আত্মগোপন করে লুকোচুরির খেলায় মেতেছে।রঙিন উত্তরীয় উড়িয়ে ঋতু রাজের আবির্ভাবে  মার্চ এপ্রিলের এই সময়টা ভারী মনোরম।গ্রাম নগরের উপকণ্ঠে  চেরী ফুল ফোঁটার ধুম পরেছে ,ফুলের বাহারে অপরূপ সাজে সেজেছে দিগ্দিগন্ত। ,আসা যাওয়ার পথের ধারে  বেশ দৃষ্টি নন্দন সে দৃশ্য।   চলার পথে এতদিন প্রায়ই চোখে পরতো পাতা ঝরা ন্যাড়া গাছ গুলোর ডালপালা কঙ্কালের মত, দু পাশে যেন লম্বা বাহু ছড়িয়ে দিয়ে  নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে। পাতা বিহীন সরু ডাল গুলোতে নানান রঙের ফুলের  বাহার। কিছু ডালে কুঁড়ি ফুল হয়ে ফোঁটার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত। দূর থেকে দেখলে মনে হবে থোকা থোকা শুভ্র মেঘ বুঝি তার রঙ পাল্টে গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। ডক্টর রুবিনার খুব প্রিয় এই চেরী ফুল ফোঁটার সময় টা। চিকিৎসা বিদ্যার সাথে খোঁজ রাখে ইতিহাসের ,দর্শন শাস্ত্রের ,নানা দেশের ভাষাভাষীর সংস্কৃতির। মধুরার থেকে তিন বছরের সিনিয়র পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হাসিখুশি ভারী প্রাণ চঞ্চলা রুবিনা সেবা কে জীবনের ব্রত মনে করে। ওর  ভারত সম্পর্কে জানার অদম্য কৌতূহল। বিশেষ করে পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ও জিজ্ঞাসা মধুরাকে ও অনুপ্রাণিত উজ্জীবিত করে। বিবেকানন্দের লাইফ হিস্ট্রি বইটা  কত বার যে পড়েছে তার ঠিক নেই। মধুরা ,অদৃজা দুজনেরই বেশ ভালোলাগে ওর নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব। সেদিন হসপিটালের করিডোর পেরিয়ে বাগানের পথ ধরে   চলার সময় ন্যাড়া গাছ গুলো দেখিয়ে রুবিনা বলেছিল, চেরী ফুলের উৎসবের ইতিহাস। আমেরিকায় ১০০ বছরের ও বেশী পুরোনো চেরী উৎসব শুরু হয় ১৯১২ সালে ২৭শে মার্চ। ওয়াসিংটনের মেয়র কে চেরী গাছ উপহার দিয়েছিলেন জাপানের রাজধানী টোকিওর মেয়র। তাই সেই সময় থেকে ওয়াসিংটন ডিসি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য চেরির গাছ। শুধু নিউইয়র্ক ব্রুকলীন নয় সারা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে এখন চেরী ব্লসমের ফোঁটার বাহারে প্রকৃতি সেজে উঠেছে অপরূপ সাজে। রুবিনা এমনি     শত শত অজানা তথ্যের ভান্ডার। মধুরা বলাকার মত পাখা মেলে নিমেষে বাতাসের থেকেও দ্রুত গতিতে  ভেসে যায় আজ অনেক দিন পর দেশ ঘরে ফেরার উত্তেজনায় মন ভারী চঞ্চল। রাতে ফ্লাইট , এখনো প্যাকিং সারা হয়নি।                                                                                           এতক্ষণ পরে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে তোয়ালে হাতে রেডি হয়ে এলো অদৃজা। হাতের কাজ ফেলে বন্ধুর সাফল্যে খুশি হয়ে আহ্লাদে ঝাঁপিয়ে পরে পিঠ চাপড়ে কনগ্রাটস জানায়। অতর্কিত আক্রমণে অন্যমনস্ক মধুরার কফির মগ থেকে কিছুটা তরল ছলকে পরলে ও সামলে নিয়ে বন্ধুর দিকে   কপট রাগ দেখাতেই ,বিকেলে দেখা হবে বলে অদৃজা নিমেষে দৌড় লাগায়। ওর হসপিটালে এমার্জেন্সি ডিউটি ভিজিটিং আওয়ার সকাল আটটা থেকে। বিদেশের মাটিতে পা দিয়ে  দেবদূত সম অদৃজা কে পেয়েছিল আপন সখার মত। রাঢ় বাংলার অজ পাড়া গাঁয়ে বেড়ে ওঠা আজন্ম পরিচিত গ্রামের মেঠো পথ মাঠ প্রান্তর গাছ গাছালির ছায়া বন বাদার ধানের ক্ষেত নদী নালা ছেড়ে মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন ,মাটির ঘরে খড়ের চালের দাওয়ায় দিদা ,ঠাকুমার মুড়ি ভাজার গন্ধ ছেড়ে -- এই বিদেশের মাটিতে অচেনা বিলাস বহুল যান্ত্রিক শহরের হুল্লোড়ে গতিময় জীবনে পা দিয়ে যখন দু চোখ ফেঁটে জল উপচে পড়ছিল ,-কলকাতার শহুরে মেয়ে দুরন্ত প্রাণচঞ্চলা অদৃজা কোথা থেকে পাহাড়ি ঝর্ণার মত ঝরঝর করে হেসে ওর শীতল হয়ে যাওয়া হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিয়ে , বিবর্ণ ফ্যাকাসে মুখে রক্তিম আভাসের ছোঁয়া দিয়ে জাগিয়েছিল অভয়ের বাণী। বন্ধুত্বের বন্ধনে দৃঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরায়  মধুরার মনের যত দ্বিধা ,ভয় সঙ্কোচ তখনই সব কর্পূরের মত উবে গিয়েছিল। ওদের দুজনেরই চেহারায়   অদ্ভুত মিল। ফরেনার বন্ধুরা একসাথে দেখলেই বলে টুইন সিস্টারস। ছিপছিপে গড়ন , লম্বায় দুজনেই একই মাপের পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি , বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্ট চেহারা। হলদে ফর্সা গায়ের রং চঞ্চল হাসিখুশি অদৃজা। মধুরা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা বেশ গম্ভীর এবং সিরিয়াস।    

                                                                               এর আগে শহর জীবনের সাথে মধুরার পরিচয় শুধু জয়েন্ট এন্ট্রান্সে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর মফঃস্বল শহর বাঁকুড়ার মেডিকেল কলেজে পড়তে যাওয়া। যদিও  কয়েক বার লেখাপড়া ও পরীক্ষার সূত্রে কলকাতার শহরে মেডিকেল কলেজ এসেছিল।  আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য মেডিকেল এক্সাম G ,R, E, TOEFL  ইত্যাদির পর U.S. Govermenter স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকার এই জনারণ্যের বিশাল বিলাসী শহরে এসে যেন অথৈ সাগরে ডুবে যাওয়া। ব্রুকলীনে আসার আগে শুধু জেনেছিল আমেরিকার এক শহরে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ও পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ক্রমশঃ জেনেছে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্ক সিটির পাঁচটি কাউন্টির একটি নিউইয়র্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জনবহুল কাউন্টি এই ব্রুকলীন। তারপরের গল্পটা একদম অন্যরকম। এখানের এতো বিশাল বড়ো   ক্যাম্পাসে ঢুকেই  মেডিকেল স্কুলে অদৃজা কে রুমমেট পেয়ে ওদের একা থাকার দিন গুলো আনন্দ ঘন হয়ে উঠেছিল। দুজনেই যেন দুজনের নিবিড় আশ্রয় স্থল। অদৃজা বেরিয়ে গেলে একাকী মধুরা কফি তে চুমুক দিতে ও ভুলে যায়। আকাশ পাতাল অন্তহীন ভাবনা দল বেঁধে মাথায় গিজগিজ করে। সাত বছর আগে সেই প্রথম ব্রুকলিনের দিন গুলোর অভিজ্ঞতা মনে পড়ে , ফেলে আসা অতীতের ছায়া তলে অসহায়ের মত ও একাকী ঘুরে বেড়ায়।                                                                                                                                                   এখান থেকে স্পষ্ট দেখাযায় নিউইয়র্ক সিটির আইকন ব্রুকলিনের ব্রিজ। তার ই ওপর দিয়ে নিত্য নতুন মডেলের বিশাল গাড়ি গুলো কে খেলনা গাড়ির মত লাগছে। সেকেন্ডে সহস্র গাড়ি ছুটছে তীর বেগে। ওর ভারী প্রিয় এই সাসপেনশন সেতুটি টি  যা ম্যানহাটন এবং ব্রুকলিন কাউন্টির মধ্যবর্তী ইস্ট নদী জুড়ে বিস্তৃত।বিশালাকার টাওয়ার অসংখ্য ক্যাবল দিয়ে ধরে রাখা নিউইয়র্কের এই অন্যতম মহামূল্যবান ব্রিজ টি ওদেরএকাকীত্বের সাথী। সুযোগ পেলেই ওদের প্রিয় জায়গা ঊনবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যের নিদর্শন ১,৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ঝুলন্ত সেতুটি বেড়াতে গিয়েছে। কর্মব্যস্ত এই সেতুটিতে প্রতিনিয়ত সহস্রাধিক গাড়ির চলাচল ওদের মুগ্ধ করে রাখে। আর মন জুড়ে থাকে মুখরা প্রাণ চঞ্চল ইস্ট রিভারের আকর্ষণ ঐ প্রাণের বন্ধু অদৃজার মত। প্রথম দিকে উইকেন্ডে এলেই অদৃজা মধুরা  সম্বিৎ নাজমা সুধীর-- সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছে টাইম স্কোয়ারে কিম্বা সেন্ট্রাল পার্কে বাইকে অথবা পেডিক্যাব ট্যুরে।পরে ঐ দলে লিসিয়া ,জন ,হেনরী ,অটোম ও যোগ দিয়েছিল।  এক সাথে উইকেন্ডে কাছেপিঠের নতুন জায়গায় বেড়িয়েছে , পিকনিক করেছে এক অদ্ভুত সুন্দর বন্ডিং তৈরী হয়েছে স্বদেশী বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে। তবে বেশীর ভাগ সময় অদৃজার সাথে  টাইম স্কোয়ারের তীব্র আলোর ঝলকানিতে ঝকঝকে শপিং মল গুলোর রমরমা দেখে ওদের চোখ ঝলসে উঠতো। বেড়াতে গিয়ে দেখেছে ওপেন এয়ার কনসার্টের চিৎকার ড্রাম পেটানো যেন সবসময় উৎসব লেগেই আছে। কখনো মন কেড়ে নিয়েছে ইষ্ট নদীর ধারে   নিরালায় বসে উদাসী যুবকের একমনে ভায়োলীন বাজানো। এমন উচ্ছল উন্মুক্ত প্রাণবন্ত জীবন যৌবনের বাঁধনহারা রূপ  তরুণ -তরুণী ,নারী -পুরুষের সমান অধিকার ,অবাধ মেলা মেশা , মুক্ত প্রাণের আবেগের মিলন ,একই টেবিলে বসে পান আহারে সময় কাটানো অথচ কেউ ই কারোর ব্যক্তিগত জীবনে অযাচিত মাথা ঘামায় না। দেশ গাঁয়ের সংস্কৃতিতে যা অকল্পনীয়। কতদিন ওরা বেড়াতে বেরিয়ে চলে গিয়েছে হাডসন নদীর ধারে।পাশেই তরতাজা ঘাসের সবুজের কার্পেটে ঢাকা খেলার পার্ক। বসন্তে বা গ্রীষ্মে বাচ্চাদের পারাম্বুলেটারে নিয়ে মায়েরা নানা রঙের পোশাকে সেজে ঘুরে বেড়ায়। অদৃজার সাথে কতবার পায়ে হেঁটে এ শহর ঘুরে বেড়িয়েছে।  ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে  বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখেছিলো এতো উন্নত দেশ তবু ও মানুষ গুলোর মন কেমন সংস্কারাচ্ছন্ন। এই ব্রিজটির একটি অংশে নিউইয়র্কের নব বিবাহিত কাপলরা একদিকের রেলিঙে নিজের নাম ও তারিখ লিখে তালা ঝুলিয়ে চাবি ছুড়ে দেয় ইস্ট নদীর গভীর জলে কারণ তাদের সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকবে এই বিশ্বাসে। এবং প্রতিদিন হাজার হাজার জুটি এভাবেই তালা ঝুলিয়ে যায়। মধুরার মনেপড়ে  যায় ,এই লোকাচার টা যেন ঠিক দেশ গাঁয়ের বাড়ির মা ঠাকুমাদের মত। কত বার দেখেছে সংসারের সুখ শান্তি শুভ কামনায় ওদের পলাশকুঁড়ি গাঁ থেকে মা ঠাকুমারা যেত গন্ধেশ্বরী নদীর বাঁকে  শীতলা দেবীর থানে বুড়ো বট অশ্বত্থের গায়ে লাল সূতোয় সাত পাক জড়িয়ে ঢিল বাঁধতে। সেখানে যে শিউলিবনা ,গোগড়া ,ধবন আর কাঁটাবনি ছাড়াও আরো কত আশেপাশের ছোট ছোট পাড়া গাঁ গুলো থেকে সবাই জড়ো হতো বিশেষ কোনো পূজার দিনে মানত করতে।চোখ বুজলেই দেখতে পায় গন্ধেশ্বরীর ছোঁয়াতে উঁচু নীচু রুক্ষ পাথুরের গায়ে ক্ষেত গুলো কেমন শস্য শ্যামলায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 'পলাশকুঁড়ি ' নামটা মনে মনে উচ্চারণেই  মিষ্টি সুরে কানে এসে বাজে।                                                                 
     আজকাল  প্রায়ই মাকে মনে পড়ছে। অনেক দিন দেখেনি ফোন বা ভিডিও কল ও হয় না , প্রত্যন্ত গ্রামে দুর্বল নেটওয়ার্ক তো আছেই এবং তার সাথে আছে দিন রাতের ব্যাবধান। কফির মগে কফি ঠান্ডা জল হয়ে গিয়েছে। শেষ চুমুক দিতে গিয়ে ওর বারবার মনে হয় মায়েরা যেন ঐ ঝুলন্ত সেতু টার মতই সর্বংসহা। সারাদিন রাত ধরে ঐ সেতুর ওপর চলে অভাবনীয় কত সহস্র  চাকার ঘর্ষণ ,কত মানুষের পদার্পণ। ঠিক তেমন করেই সংসারের মায়েদের যেন দায়িত্ব সবার সুবিধা অসুবিধা অভাব অভিযোগের সুরাহা করে মুখে হাসিটি ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রতিবাদ হীন হয়ে দৈনন্দিন জীবনে ঘাত প্রতিঘাতের  সাথে সংসারের সব অত্যাচার কেমন নীরবে সহ্য করে যাওয়া।                                           
 গত কয়েকদিন ধরে ঘরে ফেরার হাতছানিতে দুইবন্ধু ভারী মশগুল ,কত রকম প্ল্যান চলে দুজনের মধ্যে। দেশের মাটি তাদের ডাকছে। ভেবেছিলো কফির কাপ টা শেষ করে বিছানায় টান হবে। নিদ্রাহীন চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে ,ঘুম আসেনা। সেই কবে স্কলারশিপ পেয়ে মেডিকেল পড়তে এসেছিল তারপর কোভিড নাইটিনের পাল্লায় পড়ে দুটি বছর সমস্ত পৃথিবী স্তব্ধ। ও দেখেছে এতো কর্মব্যস্ত শহর এতো সুসজ্জিত নগরী যেখানে সেকেন্ডের বিরতিতে রাস্তায় চলে হাজার হাজার গাড়ি ,২৪ঘন্টা ওয়ালমার্ট শপিংমল স্কুল কলেজ গুলো জমজমাট থাকে সেখানে শ্মশানের নিস্তব্ধতা --সব জন শূন্য। রাস্তা গুলো প্রাণ হীন নিশ্চল সরীসৃপের মত পরে আছে। এয়ারপোর্ট গুলোতে সারি দিয়ে এয়ারবাস গুলো স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে নিজস্ব আর্থিক সমস্যা ছাড়াও সময়ের প্রবাহে কেরিয়ারের চাপে লেখাপড়া রিসার্চ ক্লাস সেমিস্টার হসপিটাল রুগী জন্ম মৃত্যুর টানাপোড়ন ইত্যাদি নিয়ে বৈচিত্র্য হীন ধরা বাঁধা জীবন। কতকাল ভুলে ছিল মাতৃভূমি কে। ডক্টর হয়ে হসপিটালের কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপে জড়িয়ে আজ সাত বছর , বাড়ি ফেরা হয়নি। গত দুটো বছর ধরে সারা পৃথিবী ময় কী এক অজানা ভাইরাস কোভিড ১৯ /আক্রান্ত অসহায় মানুষ কে ,কি অসহনীয় মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করে মরতে দেখেছে --  তারা শুধু অসহায়ের মত আর্তের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে। মৃত্যু পথ যাত্রী কে শেষ শান্তি টুকু দিতে পারেনি। প্রতিদিন এই হস্পিটালের এক শাখায় শত শত মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখেছে। সুস্থ সমর্থ তরতাজা প্রাণ ভাইরাসের প্রকোপে  বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এত উন্নত ধনীর দুনিয়াতে ও মরণ রোগ নীরবে মানুষের শরীরে বাসা বেঁধেছে ,অনেক উন্নততর চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও  সামান্য চিকিৎসা করার সুযোগ টুকু ওরা পায়নি। এখানে সকালে দুপুরে সন্ধ্যায় রাতে কোভিড আক্রান্ত অসহায় মানুষের হাহাকার ,সার সার সাদা কাপড়ে ঢেকে  প্লাস্টিক কভার ব্যাগে মুড়ে কফিন বন্দি লাশ। ট্রাক গুলো ক্রমাগত হসপিটাল কম্পাউন্ড  ছেড়ে কোথায় যে উধাও হয়েছিল তার খবর কে রাখে ?  ওর ভাবনায় জড়ায় ঐ দুর্দিনে দেশের বাড়ির জনপদ বা ঐ প্রত্যন্ত গাঁয়ের দীন হীন হত দরিদ্র মানুষ গুলোর কেমন করে দিন কেটেছে ? সেখানে যে এমন উন্নততর হাসপাতাল নেই এমন চিকিৎসা ব্যবস্থা ও নেই।  বিদেশে আসার আগে মা কে কথা দিয়েছিলো , গ্রামের বাড়িতে মায়ের পাশ টি তে সম্পূর্ণ উপযুক্ত এক ডক্টর হয়ে ফিরে আসবে। নিজের মাতৃভূমি তে আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুচিৎসক হয়ে মন দেবে দশের সেবায়। কিন্তু প্রাজ্ঞ ডক্টর স্যামুয়েল ওর  শিক্ষা গুরু,ওনার সান্নিধ্যে এসে এক বিশাল জ্ঞানের দরজা সহসা খুলে গিয়েছে। মানব শরীরের স্নায়ু অন্ত্র তন্ত্র অলিগলি শাখা প্রশাখা ধমনীতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে কত যে বিস্ময় অজানা তথ্য এই সাত বছরে খুব সামান্যই তার হদিশ পেয়েছে। ডক্টর স্যামুয়েল স্যারের প্রেরণায় চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে অগাধ গভীর সাগরে ডুব দিয়ে পড়ার জগতের ভিতরে প্রবেশের পর দেখেছে সামনে রয়েছে এই প্রশান্ত মহাসাগরের মতই বিশাল জ্ঞানের সাগরের অন্তহীন জলরাশি যা পাড়ি দিয়ে শেষ করা কোনো কালে ও সম্ভব নয়। অথচ ডাক্তারি পাশের সার্টিফিকেট পেয়েছে। কিন্তু সে অর্থে ডক্টর হয়ে ও তার মনের তৃষ্ণা একটু ও মেটেনি।                                                                                           
   রাত গভীরে ফ্লাইট।  সিঙ্গাপুরে পৌঁছে ব্রেক নেবে , তারপর   কলকাতা ফিরবে। এখন ঘুমোনো দরকার। নিদ্রা বিহীন রাত আজো কাটাতে হবে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসেই।  প্রায় ২৪ ঘন্টা মহা শূণ্যের বায়ু সমুদ্রে ঠায় এক ভাবে বসে থেকে ক্লান্তিকর ভেসে বেড়ানো। মধুরা ওয়াশ রুমে ঢুকে স্নানের পর ব্রেড বাটার ওমলেট অরেঞ্জ জুসে ব্রেকফাস্ট সেরে একটা মেডিকেল জার্নাল হাতে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে কে তাকে নিয়ে চলেছে একেবারে ঘুমের রাজপুরীতে। বিকেল পাঁচটায় অদৃজা এসে না ধাক্কা মারলে হয়তো সারা রাতই অচেতনের মত ঘুমিয়ে থাকতো। ফোন খুলে দেখে অজস্র কল মিস হয়ে বেজে গিয়েছে তবুও ওর অসময়ের ঘুম ভাঙেনি।  নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বিলাসী সোফায় ডুবে আধো ঘুমে আধো জাগরণে ওরা দুজনেই।  রাত প্রায় বারোটা ,সহজ সারল্যে ভরা চোখে অদৃজা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে,-পৃথিবীর যাবতীয় বিলাস বহুল মনোমুগ্ধ কর দ্রব্য সামগ্রীর সম্ভারে এই ধনতান্ত্রিক দেশ গুলোর এয়ারপোর্ট সাজানো। নিজের মনে  কয়েকবার পাক খেয়ে ঘুরে দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছে। এর আদি অন্তের কোথাও তল পায় না। রাতে গাইনো ডিপার্টমেন্টের সুধীর আর নাজমা এসেছিল সী অফ করতে। ওদের হসপিটাল লাইফে বন্ধুত্বের এই বন্ধন প্রগাঢ় ,সবার সাথে সবার যোগাযোগ। অদৃজার মুগ্ধ চোখে ক্লান্তি নেই লম্বা মোটা কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। বন্দরের বন্ধনকাল কাটিয়ে নিকষ কালো আকাশের বুক চিড়ে প্লেন গুলোর ঘড়ি ধরে ক্লান্তিহীন ওঠা নামা দেখছে। দীর্ঘ্যদেহী রাত কিছুতেই শেষ হতে চায় না।          ঘড়িতে তিনটে বাজলে বোর্ডিংপাস হয়ে গিয়েছে।  সিট বেল্টের ফাঁসে নিজে কে জড়িয়ে তন্দ্রালস চোখ মেলে মধুরা দেখলো সোনার কাঠি ছোঁয়ানো রূপকথার দেশ টি কে পিছনে ফেলে U,S,এয়ার ওয়েসের সিঙ্গাপুর গামী প্লেনটি এয়ারপোর্ট ছেড়ে সুদূর আকাশের মহা শূন্যে এগিয়ে চলেছে। নীচেপড়ে রইলো আলোয় আলোময় ঝাঁ চকচকে শহর ,চেরী ফুলের বাগানে ঘেরা সাধনার পীঠস্থান হসপিটাল , আর সেই ব্রুকলীন ব্রীজ।                                                                                                   পূবের আকাশের কোণ ঘেঁষে ডিমের কুসুমের মত রাঙা সূর্য উঠে বসলো কালো আকাশের যত কালিমা সব মুছে দিয়ে। ভোরের আকাশ সোনালী রোদের চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সদ্য ঘুম ভাঙা পৃথিবীর দিকে। মেঘের সামাজ্যের ওপর দিয়ে বিশালকায় দুই পাখা মেলে প্রবল গতিতে প্লেন  নিমেষে পার হয়ে চলেছে এক দেশ থেকে আরেক দেশের প্রান্ত সীমায়। অদৃজা কানে হেড ফোন গুঁজে চোখ বুজে আছে। মধুরা এখোনো মগ্ন ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি চারণে।  সেই কবে মার কাছে গল্প শুনেছিল ,কলকাতায় সে বারে নকশাল আন্দোলনের ঠিক পরেই  শ্রাবণ মাসের এক ভরা বর্ষার দিনে মা র পিতৃ সম সুবোধ কাকা তার পৈতৃক গ্রাম বাঁকুড়ার অজ পাড়া গাঁয়ের বাড়ি থেকে কাঠির মত রোগা শ্যামবর্ণা  মেয়ে সর্বানী কে প্রাইভেটে ক্লাস টেনের মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়াতে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায় ওনার দিদির বাড়িতে। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই ছিলেন  সুবোধ কাকা, দরিদ্র পিতৃহীন অপুষ্টিতে ভোগা রুগ্ন মেয়ে সর্বানীর অসাধারণ মেধা ও লেখা পড়ায় আগ্রহ ও একাগ্রতার পরিচয় পেয়ে জেদ ধরেছিলেন মেয়েটিকে যথার্থ শিক্ষিত করে তুলবেন।  তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল একটু সাহায্য করলেই এ মেয়ে একদিন গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবে। গ্রামের মেয়ে শহুরে জীবনে অভ্যস্থ হতে প্রথম দিকে অসুবিধা হলেও পরে নিজ গুনে সব বাঁধা জয় এবং পরকে আপন করে সে সংসারের নানাবিধ ঘরোয়া কাজে যুক্ত হয়ে একে একে যথেষ্ট সম্মানের সাথে স্কুল কলেজের সীমা পেরোনোর পর বাঁকুড়ার সেই গ্রামেই ফিরে এসে সরকারের প্রাইমারী স্কুলের চাকরী নিয়ে  ধীরে ধীরে  উন্নতির পর প্রাথমিক স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হয়ে ছিলেন মধুরার মা সর্বানী। সেদিন  থেকে আজো তিনি শিক্ষাব্রতী হয়ে অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন গ্রামীণ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। মা সর্বানী দেবী সুবোধ দাদুর অনুপ্রেরণায় নিজেকে ভাবতেন মানুষ গড়ার কারিগর। মধুরার মত আরো কত গ্রামের ছেলে মেয়েদের যে তিনি   মানুষ করে গড়ে তুলে জীবনের পথে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার নজির  এই প্রত্যন্ত গ্রাম গুলোর প্রায় ঘরেই    ছড়িয়ে আছে। গ্রাম আজ অনেক এগিয়েছে আর সেই অজপাড়া গাঁ নেই ,পথ ঘাটের পরিবর্তন হয়েছে প্রাথমিক থেকে স্কুল মাধ্যমিক ,উচ্চমাধ্যমিকে পরিবর্তিত  হয়েছে। আজ সেই মহাপ্রাণ সুবোধ দাদু ইহলোকে নেই। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন গ্রামটিকে স্বয়ং সম্পূর্ণ  করে তোলার তাই মা সর্বান্তঃকরণে ভাবেন  মধুরা ডাক্তার হয়ে ফিরে এসে গাঁয়ের হাসপাতালের উন্নতি করবে  মানুষের সেবার কাজে নিজেকে নিয়োগ করবে। যদিও আজ সে একজন চিকিৎসক, কিন্তু আজ সময়ের স্রোতে ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। সামনে এক স্বপ্নময় জগৎ তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকে। সে স্বপ্ন দেখে ওমনি এক নিখুঁত নিটোল আধুনিক হস্পিটালের যাকে বাস্তবে সফল করার জন্য তার যে এখোনো বহু পথ চলা বাকী। মায়ের ইচ্ছে কে শ্রদ্ধা জানিয়ে আদর্শ হাসপাতাল সে গড়ে তুলবেই কিন্তু এখনই তা মোটেই সম্ভব নয়। ওর স্বপ্ন সফল করতে হলে এখন ও যে বিস্তর জ্ঞানের পথ পরিক্রমা বাকী। আর আদর্শ হসপিটাল গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার সাথে করতে হবে বিশাল অঙ্কের টাকার ও উপার্জন। প্রথমেই  অন্ততঃ কুড়ি বিঘা জমি চাই , শাসন যন্ত্রের সহায়তা চাই ,পাশাপাশি গ্রামের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের পাশে চাই ,সরকারের অনুমোদন চাই , চাই বিশাল টাকার মজুত ,আরো অনেক কিছু চাই। যা দেশের বাড়িতে থেকে মোটেই সম্ভব নয়।  কিন্তু মা কে কেমন করে বোঝাবে? মা যে বড়ো অবুঝ অভিমানী।                                                                                             দুদিন হলো কলকাতার সল্টলেকে অদৃজার বাড়িতে ওরা আবার নব আনন্দে জেগে উঠেছে। এখানে মার্চ এপ্রিলে খাঁ খাঁ রোদ ঝলমল ডাহুক ডাকা আলসে দুপুর।কাঠফাঁটা রোদ মাথার ওপরে নিয়ে রুদ্র বৈশাখ তার জ্বালাময়ী দৃষ্টিতে সব রঙ রূপ রস শুষে নিয়ে মলিন গৈরিক তপস্বিনীর বেশে সাজিয়েছে ধরণীকে। ফেলে আসা ব্রুকলীনের সাথে আবহাওয়া বা পরিবেশের কোনো মিল নেই ,তবু নিজের জায়গা নিজের দেশের মাটিতে পা দিলেই মন এক অনবদ্য সুখানুভূতিতে ভরে ওঠে।  সকাল হতেই দুই বন্ধুতে মিলে বাঁকুড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। রাঙা মাটির ধূলি ধূসরিত পথ এঁকে বেঁকে দূর থেকে দূরান্তরে মিশে গিয়েছে অনামী ছোট্ট গাঁয়ের প্রান্তে। সেখানে বিশাল মাঠের শেষ সীমানায় দূর দেশ গামী রেললাইনের কেবেলের তারের ওপর বসে থাকে নিঃসঙ্গ ঘুঘুর দল। সুনসান দুপুরের মধ্যগগনে অনবরত তার বিষণ্ণ রব মৃত্যুপথ যাত্রীর গোঙানীর মত লাগে। জ্বলন্ত আকাশের তলে রক্ত রাঙা পলাশ ছড়িয়ে দিয়েছে রক্তিম আগুনের শিখা। নারিকেলের মাথা গুলো স্থির অনিশ্চিত আশঙ্কায়। দূর থেকে দেখা যায় শালের ঘন বন ,তাল তমাল কিংশুকের ঝাঁকড়া মাথা গুলো উন্নত শিরে সটান দাঁড়িয়ে আছে স্থবিরের মত। দামোদরের বাঁক পেরিয়ে রাঢ় বাংলার বাঁকুড়া অঞ্চলের প্রত্যন্ত এক গাঁয়ে মধুরা দের খড়ের চালের ঘর। সেই আগে যেমন টি ছিলো। অদৃজা মধুরার সাথে এসেছে  শিকড়ের  সন্ধানে। ওর ও যে হারিয়ে যাওয়া ছোট বেলা এই গ্রামে অজয়ের তীরের আশেপাশে কেটেছিল দিদুনের বাপের বাড়িতে।  নাম হারা ছোট্ট সে গাঁয়ের ধূসর রাঙা মাঠের শেষে ধানের ক্ষেতের আলধরে চলে দূরে নদীর পার ধরে হেঁটে গেলে গ্রামের শেষপ্রান্তে ইটভাঁটার মোটা নল লাগানো চিমনীর মাথা থেকে কালো ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে সর্পিল গতিতে আকাশে মেশে। সরু শাখা নদী বয়ে যায় ধানের ক্ষেত,কাশের বন পেরিয়ে একবারে শেষ সীমানায়। ছলাৎ ছল শব্দে তরতর করে বয়ে চলেছে ক্ষীণ স্রোতস্বীনি। দেখে মনে হবে শান্ত মরা নদী। মধুরা বলে আষাঢ় শ্রাবণে যে নদী অঝোর বৃষ্টির ধারায় চঞ্চলা কিশোরীর মত উচ্ছলা হয়ে উঠে  দিক ভ্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকে আর ভাদ্রে সে হয়ে যায়  ভরা যুবতীর মত প্রগলভা। দেখ   ,সে এখন কেমন চৈত্র মাসেই জল শুকিয়ে মরা নদী। যত রাজ্যের আবর্জনায় নদীর গতি পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে যত দূর দেখা যায় চড়া জেগে উঠেছে। ওর খুব মন খারাপ হয়ে যায় ,বিদেশে প্রকৃতির ওপর এমন অন্যায়  অত্যাচার কখনো কোথাও দেখেনি। অদৃজার হাতে লাল সবুজ কাঁচের চুড়ি গুলো রিনরিন করে বেজে ওঠে। গতকাল সল্টলেকে বসন্তের উৎসবে সবলা মেলায় গিয়ে পথের ধারের এক দোকান থেকে হাত ভরা গুচ্ছের কাঁচের চুড়ি কিনেছে। অদৃজার পাগলামি দেখলে কে বলবে ও আমেরিকার এক নাম করা শহরের প্রতিষ্ঠিত হসপিটালের ডক্টর সে । ও গ্রামের যা দেখে তাতেই অবাক হয়ে যায়। বিস্মিত চোখে তন্ময় হয়ে দেখে কেমন খড়ের চালা মাটির বাড়ি হলুদ ফুলে ভরা সর্ষের ক্ষেতে ছোট্ট টুনটুনি পাখি গুলো ঘুরে বেড়ায়। সবুজ ধানের ক্ষেতের শিসে উষ্ণ বাতাসে ঢেউয়ের দোলা লাগে। ছাতারে মৌটুসী বুলবুলি পাখি দের অবাধ মিলন মেলা ধানের ক্ষেতে ,তার  ধুধু মাঠ গাছ পালা সব মিলিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের মাধুরীতে ভরে উঠেছে গ্রামীণ পরিবেশ। মধুরার মনে হয় সাত বছর আগে যেমন টি গ্রাম কে দেখে গিয়েছিল সে যেন ঠিক তেমন টাই আছে শুধু ভাই বোন অজয় সুতপা আরো বড়ো হয়ে গিয়েছে। ওরা ও কর্ম  জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।      
                                                                                      এখানেই মাঠের প্রান্তরে ,ধানের ক্ষেতে ,ঘাসের বনে মাটির ঘরের দাওয়ায় চাপা পড়ে আছে মার শৈশব।  ছোটবেলার অলিখিত গল্পের ধূসর পাতা গুলো। মধুরা একলা হেঁটে চলেছে বিস্মৃত প্রায় অতীতের ধূলি ধূসরিত পথে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা লাভের পর পিতৃহীন সর্বানী ছোট দুই বোন ও ভাইয়ের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে। তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে যখন নিজের সংসারে ব্রতী হয়েছিল তখন বেশ বয়স। মধুরার বাবা মফস্বল শহরের পোস্ট অফিসে চাকরি করলে ও অনেক বেশী ব্যস্ত থাকতেন ছোট্ট এক ফালি জমি নিয়ে। কৃষি কাজ ,ফসল ফলানো মাটি ঘাটা ছিল তাঁর নেশার মত। মধুরার চোখের সামনে আয়নায় পুরোনো দিনের ছবি গুলো স্পষ্ট ভেসে ওঠে।        
    এমন গরমের দিনে বিকেল বেলায় নদীর পার থেকে ফুরফুরে দক্ষিণা বাতাস বয়। খেয়া ঘাটের পাড়ানী নৌকায় আনাগোনা চলে। সেই সময় মাঝি মাল্লাদের হাঁক ডাক গান শোনা যেত ,নৌকা গুলো নদীর  চড়ায় আটকে গেলে সবাই মিলে হেইয়ো হেইহো করে ঠেলাঠেলি চলতো। গন্ধেশ্বরীর ক্ষীণ স্রোতা শাখা নদী শিলাবতীর তীর ওদের বড়ো আপন। গ্রীষ্মে জল শুকিয়ে বালুর চড়ায় হাসির লহরী তুলে অবাধ মুক্তির আনন্দে মন মাতিয়ে খেলে বেড়ায় কচি কাঁচাদের দল। ছোট্টো তিন ভাই বোন কে নিয়ে খেলায় মাতে মধুরার এগার বছরের দিদি। বটের ঝুড়িতে দোল খেয়ে বালুর চড়ে দুর্গ ,প্রাসাদ গড়ে তোলে ওদের ছোট্ট ছোট্ট কচি হাতে সারা গায়ে বালি মেখে।সন্ধ্যে হলে ঘরে ফিরে হ্যাজাকের আলোয় পড়তে বসে মা র কাছে। একই বয়সী একই রকম দেখতে দুই যমজ ছোট ভাইবোন অজয় আর সুতপা কে নিয়ে ওর আর দিদির পুতুল খেলার ঘর অবর্ণনীয় আনন্দ ময়। সময় গড়িয়ে চলেছিল কান্না হাসির দোল দুলুনিতে ভাল মন্দ মিশিয়ে। একদিন বিনামেঘে বজ্রপাতের মত বৈশাখী ঝড় সব ওলট পালট করে দিলো ,মা সর্বানীর  তিল তিল করে গড়ে তোলা সাজানো সংসার বালির প্রাসাদের মত  ঝুর ঝুর করে ধ্বসে গেল। এক গ্রীষ্মের প্রখর তাপের দুপুরে মধুরার বাবাকে অচৈতন্য পাওয়া গেল ধানের ক্ষেতে জলার ধারে ,গ্রামের সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তেমন কোনো চিকিৎসার সুবিধা নেই ,বেশীর ভাগ দিনই ডাক্তার বাবুর হদিস মেলে না ,পরিবহন ব্যাবস্থাও তথৈবচঃ। শহরের হাসপাতালে পৌঁছনোর পথেই বাবা হার্টফেল করেছিলেন। আর সে বছরই আশ্বিন মাসে পূজার সময় তিন দিনের অজানা জ্বরে হঠাৎ দিদি বেহুঁশ হয়ে যাওয়াতে গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঠিক মত রোগ নির্ণয়ের আগেই খেলার সঙ্গী প্রাণ প্রিয় দিদি সুজাতা ও  বিসর্জনের বাজনার সাথে ওদের একা করে দিয়ে পাড়ি দিলো না ফেরার দেশে। ছোটবেলার সেই নির্মম দিন গুলোর কথা মধুরা হয়তো সারা জীবনে কখনো ও ভুলতে পারবে না। সে সময় মা কে দেখেছিল কেমন করে অন্তরের জ্বালায় জ্বলে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতে হয়। গাঁয়ের স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির জন্য অনেক চেষ্টা অনেক লেখা লেখি অনেক ভাষণ অনেক কাগজ পত্র অনেকের বিরাগ ভাজন হওয়া সত্ত্বেও হয়নি বিশেষ কোনো সুরাহা। সেই সময়ে ছোট্ট মধুরা তখন ই মনে মনে স্থির করেছিল বড়ো হয়ে ওকে ডাক্তার হতে হবে। গ্রামে এক আদর্শ বড়ো হসপিটাল গড়ে তুলবে যেখানে একটা প্রাণ ও এমন বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় মারা যাবে না। সেই থেকে মাদাম কুরি কে করেছে ওর জীবনের ধ্রুবতারা। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ,সিস্টার নিবেদিতার লাইফ হিস্ট্রি ওর কণ্ঠস্থ। ডক্টর রুবিনার মত ও যে চায় পেশেন্ট দের জন্য জীবন কে উৎসর্গ করে দিতে। এই কদিন ভোরবেলায় ঘুম ভাঙার পরেই একাকী  সূর্য্যের তাপ চওড়া হবার আগেই বেরিয়েছিল গ্রামাঞ্চলের লোকজন দের সাথে আলাপ করতে  ,তাদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনেছে ,গাঁয়ের পথে প্রান্তরে যেখানে চাষ বাস হয়না একেবারেই রুক্ষ পাথুড়ে জমি পরিত্যাক্ত হয়ে পরে আছে তারই খোঁজ খবর নিয়েছে। দিন রাত মনের মাঝে কিছু গড়ে তোলার কল্পনায় বুঁদ হয়ে থেকেছে। এরই মধ্যে দুদিন আগে অদৃজা শহর থেকে ফিরে এলে মধুরা ভাই বোনের সাইকেল দুটো নিয়ে দুজনে চলে গিয়েছে শুশুনিয়া পাহাড়ের পায়ের কাছে আদিবাসী দের গাঁয়ে। শাল মহুয়ার বনে পথ হারিয়ে সে এক বিশ্রী কান্ড বনের ভুলভুলাইয়ায় শুধু ঘুরে মরে।   শাল পাতা কুড়োতে আসা আদিবাসী ছেলে রুকুয়া আর ফকিরার সাহায্যে  দুলালকুঁড়ির পথ  চিনে  গাঁয়ে  ফিরে আসে ।গল্পে গল্পে রুকুয়া ফকিরা দুজনেই  কথা দিয়েছে ডাক্তার দিদিদের হাসপাতাল গড়ে তোলার জমির খোঁজ ওরা ঠিক দিয়ে দেবে।      
      
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
                                                                      বেলা বেড়ে চলেছে আর কিছুটা সময় পরেই ওদের এই গ্রামের মায়া ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে বেরোতে হবে।  আজ রাত গভীরে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে আবার যাত্রা শুরু। বিদায়ী বেলায় মায়ের পাশে চুপটি করে দাঁড়াতেই মা বিষণ্ণ মুখে  নির্বাক চোখে চেয়ে থেকেছে শুধু। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি মেয়ের উচ্চা কাঙ্ক্ষার স্বপ্ন পূরণের আশায়। অন্তরালে হয়তো আঁচলের কোণায় চোখ মুছেছিল। এতো বছরের চেষ্টায় বর্তমানের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে যে তার গ্রাম আজ ও বঞ্চিত।বারবার মনে হয়েছে আদর্শ গ্রাম সুস্থ স্বাস্থ্য নিকেতন গড়ে তুলতে কোনোদিনই হয়তো মধুরা কে আর পাশে পাবে না। কিম্বা মধুরা যেদিন ওর স্বপ্নের হসপিটাল এ গ্রামে গড়ে তুলবে ততদিনে কি আর সর্বানী এ ধরাধামে থাকার সুযোগ পাবে ? তবু ও নতুন আশায় আবার জাল বোনে তৃষিত মায়ের বুক। এই দুই সপ্তাহ কত যে  আনন্দে সবার সাথে মিলে মিশে কাটলো তা শুধু মধুরা অদৃজা দের অন্তরের অনুভবের। বিদেশের সাথে তুলনায় এই গরিব দেশ টা সব দিক দিয়ে হেরে গেলে ও এ দেশের মানুষের আন্তরিকতা গ্রাম বাংলার এমন মধুর স্নেহ মায়া মমতার বাঁধন এমন ঐকান্তিকতা বোধহয় পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া যাবে। মন খুব খারাপ লাগছে মায়ের শূন্য ঘর শূন্য মনের দিকে চেয়ে। তবু স্বপ্নের মায়া জালে জড়িয়ে মধুরা যে আরো ও এক দূরের পৃথিবীর ডাক শুনতে পেয়েছে। ওরা যে মায়ার বাঁধন কাটিয়ে চলেছে তারই সন্ধানে।ও জানে এখন থেকে ওর জীবন বাঁধা গতে নয় --সব বাঁধা তুচ্ছ করে , সংসারের যাবতীয় প্রলোভন জয় করে এক সত্য কে প্রতিষ্ঠা করতে হলে ---,চলতে হবে কঠিন রূঢ় বাস্তবের পথে। ও যে দশের ভার মাথায় নিয়ে আগামীর পথ পাড়ি দিতে চায়। ও যে সেই ছোটবেলায় দেখা স্বপ্নের সওয়ারী. ...


   

Post a Comment

4 Comments

  1. ্খুবভালো বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ লেখা

    ReplyDelete
  2. ভালো হয়ে ছে!আরও লেখ!সেজদি!!

    ReplyDelete
  3. সত্যিই খুব ভাল লাগল লেখাটা পড়ে।জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন মনে হয় লড়াই করার চেষ্টা করেও যেন আর পারছি না।সেই সময় তোমার এই লেখা ভীষণ অনুপ্রাণিত করল।এইভাবেই হাল না ছেড়ে মধুরা ও তার মায়ের মতো সব প্রতিকূলতা কাটাতে পারলে সাফল্য আসবে।ই

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো দিদি।এতো সুন্দর বর্ণনা করলে যে আমেরিকা আর বাঁকুড়া সবটাই স্পষ্ট দেখতে পেলাম যেন।মধুরা আর অদৃজার মতো ডাক্তারের খুব প্রয়োজন আমাদের যারা নির্লোভ হয়ে শুধু মানুষের সেবাকেই ব্রত করবে জীবনে।স্বপ্নের সওয়ারি এককথায় অনবদ‍্য গল্প।

    ReplyDelete