জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়

নির্মল বর্মন

কবি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় বিশ শতকের চল্লিশের দশকের কবিদের মধ্যে, যাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি , পদপ্রদীপের আলোয় মুখরিত হয়ে উঠতে পারেনি অথচ প্রতিভার অলিন্দে যাদের কবিতা, সর্বজন উল্লেখযোগ্য ছিল তাদের মধ্যে একজন। বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে ' র সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতি বিতৃষ্ণা , সাম্যবাদী মনোভাবাপন্ন এবং পাশ্চাত্য কবিতার সাবলীল দক্ষতা , তিনি বাংলা কাব্যজগতে ছড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।
কবি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় , বিমলচন্দ্র ঘোষ ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মতো সংগীতরসিক ছিলেন। সংগীতের ভাবনা ধরেই আরেক সংগীত পিপাসু বিষ্ণু দে ' র সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা। "পরিচয়" ও " কবিতা" পত্রিকার সঙ্গে চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন ।কবির আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার বেজগাঁও তে । যদিও কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতার বউবাজারে। পড়াশোনা, প্রতিষ্ঠা সবকিছুই রাজধানী শহর কলকাতাতে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
১৯৩৮ থেকে "কবিতা" পত্রিকায় নিয়মিত কলম ধরতেন , ফলত ' পরিচয়' ও 'কবিতা' পত্রিকায় গ্রন্থ সমালোচক হিসাবে সব সময় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন । ১৯৩৮ এর পৌষ সংখ্যা কবিতা পত্রিকাটি 'রাজকুমার' নামক তার উল্লেখযোগ্য কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল । ইংরেজ শাসকদের প্রতি তীব্র ব্যঙ্গবান নিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা, এই কবিতায় পরিলক্ষিত হয় । যেমন----
"জলবায়ু মাটি আবার তোমার হাতে,
জনসম্পদে করো কোম্পানি ঠেসে
শেয়ার- বাজার 'তেজমন্দি'র সাথে
গড়াগড়ি যায় তোমার পায়েতে এসে"।
বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষিতে তিনি কলম ধরেছিলেন।  হয়তো সুসমালোচনা হয়নি। কিন্তু তার বর্তমানের সীমাহীন কদর্যতাকেও তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ ---
"আজ অবশেষে জনগণে  মিশি নেতা।
অ্যাসেমব্লি হল জমাট করো কি সাধে?
ক্রেতা - বিক্রেতা তুমিই তাদের সেথা।
রক্তের দাগ ঢাকবে আর্তনাদে"।
চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ হল "বর্ষ শেষ ও অন্যান্য কবিতা" ১৯৩৮ , "বসুন্ধরা " ১৯৪২ , "কয়েকটি প্রেমের কবিতা" ১৯৫৫। এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা নিয়মিত প্রকাশ্ করেছিলেন।

'বর্ষশেষ ও অন্যান্য কবিতা' কাব্যগ্রন্থে মধুসূদনের বাচনভঙ্গির সঙ্গে শ্রমিক কৃষকদের শোষণ মহাজন ধনিদের স্বার্থ সিদ্ধি , সাম্রাজ্যবাদী শোষণ,  সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবকে কবি বিদ্রুপের বাণে জর্জরিত করেছেন উদাহরণস্বর---
"ছেলেবেলা থেকে পিতার কাছেতে খালি
মন্ত্র নিয়েছি - কোথায় এবং কিসে।
সাফাই চুরির পাই কত হাততালি
দিন অভাজন কৃতজ্ঞ-কুর্নিশে"। (প্রাইভেট প্রপার্টি)।

চঞ্চলকুমারের "বসুন্ধরা" কাব্যগ্রন্থে দেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির চালচিত্র বর্তমান দিনেও প্রাসঙ্গিক।যেমন--
"শত্রুমিত্র বোঝাপড়া হবে শেষে।
সুযোগ বুঝে সময় মতো
মন্দ কিবা জন মন্ত্রণা--
শেয়ালে ছাগলে কোলাকুলি হয় দেশে"।
কবি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়ও কিছু রোমান্টিক কবিতা , প্রেমের কবিতা এবং মার্কসীয় বিশ্বাসের কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। 'বসুন্ধরা' কাব্যগ্রন্থের প্রকৃত মুগ্ধতার ছবি "পট পরিবর্তন" কবিতায় পেয়ে থাকি‌।
"শ্রান্ত ঘোড়ার মুখের ফেনার মতো
হালকা মেঘেরা ভরা পূর্ণিমা রাতে
ছিটিয়ে আকাশ চলে গেল উত্তরে।
শরৎ এল কি শিউলি ঝরানো প্রাতে"?

'সাহিত্যপত্র' পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে বহু প্রবন্ধ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন; উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হল
'প্রতীচ্য সঙ্গীত - রূপ', 'বাঙলা গানের সমস্যা' ও, 'প্রতীচ্য মধ্যযুগ ও কবিতা অনুবাদ' প্রভৃতি ! ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ অবধি 'সাহিত্যপত্র' র সম্পাদক নিয়োজিত হয়েছিলেন চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়।
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ "কয়েকটি প্রেমের কবিতা" সনেট প্যাটার্নে রচিত , আবার ১৯৬৫ তে মার্কিন মূলুকে পুঁজিবাদীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কবিতা "উত্তরসূরী"
 পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল-- উদাহরণস্বরূপ --
সে - জন দুধও খাবে তামাকও খাবে
  (তাই নিরপেক্ষ)
সে বলছে, বানাব, এই দুনিয়াটাকেই
বানাব  জাদুঘর
দেশ-বিদেশের খুলি
(তারা থাকবে পাশাপাশি)
গান নয় গল্প নয়
দ্যাখো, কী ক্ষমতা গুলির।( সে জন)

কবি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় সময় সমাজ সমকালীন সচেতনতায় পরিপূর্ণ একজন কবি ,  যিনি জীবনের ভ্রষ্টাচার, সুবিধাবাদ ও  সাম্রাজ্যবাদী শোষণ প্রভৃতি কে বাংলা কাব্য ও কবিতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

Post a Comment

0 Comments