জ্বলদর্চি

বাংলা সাময়িকপত্র : সেকাল থেকে একাল একটি পর্যালোচনা /সুজিতকুমার বিশ্বাস

বাংলা সাময়িকপত্র : সেকাল থেকে একাল একটি পর্যালোচনা

সুজিতকুমার বিশ্বাস
 
আধুনিক জীবনে সাময়িকপত্রগুলির দায়িত্ব ও অপরিহার্যতা যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সে কথা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। অতীতের উপর ভিত্তি করে সাময়িকপত্রগুলি একটি সমান্তরাল গুরুত্ব স্থাপন করেছে। একে ইতিহাসের উপাদান ও সময়ের দলিল বলা হয়ে থাকে। আজও বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখে পুরাতন সাময়িকপত্রগুলি উপাদান হিসাবে সাহায্য করে থাকে। সাময়িকপত্র যে শুধু প্রয়োজনীয় সংবাদ পরিবেশন করে তা শুধু নয়, সমকালীন চিন্তাধারা ও কর্মপ্রচেষ্টাকেও উল্লেখমাত্রায় প্রভাবিত করে। সাময়িকপত্র একদিকে যেমন মানব মনকে বিশ্বমুখীন করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি স্বদেশ ও স্বজাতি সম্পর্কেও পূর্ণমাত্রায় সচেতন রাখে। জাতীয় জীবনে একটি সার্থক সাময়িকপত্র নিরপেক্ষতার ভূমিকা বজায় রাখে। প্রত্যেক দেশেই পরাধীনতার কলঙ্ক মোচনে জাতীয়তাবাদী সাময়িকপত্র যে ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে এক কথায় ব্যক্ত করা যায় না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সন্ধ্যা, যুগান্তর, বঙ্গবাসী, অমৃতবাজার পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। অব্যর্থ প্রচারমাধ্যম হিসাবে সাময়িকপত্রগুলির তুলনা নেই। দেশের স্বল্পশিক্ষিত বৃহত্তর জনসাধারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের একমাত্র উপায় সাময়িকপত্র। এর ঐতিহ্য, সংকট, সম্ভাবনা তাই আলোচনার বিষয়। সংক্ষেপে এই পর্বগুলি আলোচনা করা হল দৃষ্টান্তের নিরিখে। 
 
    সাময়িকপত্রগুলির ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে তাৎপর্যমূলক। বিবিধ পত্রপত্রিকার সীমাবদ্ধতার মাঝে সাময়িকপত্র এক উল্লেখ অবস্থান। আমাদের পাঠক্রম জুড়েও তার সাবলীল প্রকাশ। সাধারণজ্ঞান বিষয়েও এই তথ্যগুলি এসেছে স্বাভাবিক ভাবে। ‘বেঙ্গল গেজেট’ ছিল ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ভারতের প্রথম প্রধান পত্রিকা যা ১৭৮০ সালে যাত্রা শুরু  করে। এই পত্রিকায় পাঠকদের চিঠি প্রকাশিত হত নিয়মিত। এসব চিঠিতে যেমন থাকত কলকাতা সহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের নানা অভাব-অভিযোগ ও অসুবিধার কথা, তেমনি থাকত প্রশাসনের দুর্নীতি ও অন্যায়ের খবর। ‘দিগদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। জন ক্লার্ক ও মার্শম্যান এর  সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো এটি। শ্রীরামপুর মিশন থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা ছিল এই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকাটি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন থেকে।এটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রতি শনিবার এই পত্রিকা প্রকাশিত হত। হিন্দু ধর্মকর্মে বিরুদ্ধাচরণ করে খ্রিস্টধর্মের মহিমা কীর্তন এর উদেশ্য ছিল। এই পত্রিকায় এগুলি  প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন ধরনের সংবাদ শিল্প-সংস্কৃতি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কিত প্রবন্ধ পত্রিকাতে প্রকাশিত হত। এর ভাষা ছিল সহজ এবং সরল। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের  সম্পাদনায় ‘বঙ্গাল গেজেট’ প্রকাশিত হত। এটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটি সুন্দর সংক্ষিপ্ত এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষায় লেখা। বেসামরিক নিয়োগ এর  অনুবাদসমূহ সরকারি প্রজ্ঞাপন ও নীতিমালা প্রভৃতি  পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলত। পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। সংবাদ কৌমুদী ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে  প্রকাশিত হয়। পত্রিকার কর্ণধার ছিলেন রামমোহন রায়।  ধর্ম রাষ্ট্রনীতি বিজ্ঞান দেশ-বিদেশের নানান সংবাদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। জনসাধারণের কল্যাণ সাধনই ছিল এই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য। ‘সংবাদ কৌমুদী’ ছিল ব্রাহ্ম সমাজের মুখপাত্র। এই সময় ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ‘সংবাদ প্রভাকর’ ‘জ্ঞানান্বেষণ’ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হয়। ‘সোমপ্রকাশ’ ‘বঙ্গদর্শন’ ‘ভারতী’ ‘সাধনা’ পত্রিকাগুলি উল্লেখযোগ্য। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
     সাময়িকপত্র বর্তমান যুগের জনজীবনে এক অপরিহার্য অঙ্গ। কেন না রবীন্দ্রনাথের  মতে “সংবাদপত্র যতই অধিক এবং অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না”।আসলে ঘরে বসে সকাল-সন্ধ্যায় নিখিলবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হল সংবাদপত্র। বেতার ও দূরদর্শনের  সংবাদ শোনার সময় বা সুযোগ যাদের নেই, অবসর সময়ে তারা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে নেন। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার তীব্র মানসিক কৌতূহল, ধর্মীয় বাদানুবাদ ও রাজা মহারাজাদের গোপন সংবাদ প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে সাময়িকপত্রের প্রথম প্রচলন। চিন দেশে সর্বপ্রথম মুদ্রণ যন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও  সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। পরে ইতালি, জার্মানি এবং রানি এলিজাবেথের   সময়  ইংল্যান্ডের  সংবাদপত্র প্রচলিত হয়।
       এশিয়ার সর্বপ্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র হিকিসের ‘ক্যালকাটা গেজেট’(১৭৮৯) শ্রীরামপুরের মিশনারীদের প্রচেষ্টায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে উইলিয়াম  কেরির  সম্পাদনায় ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়। ‘দিগদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্পণ’। মিশনারীদের ধর্মীয় অপপ্রচার রুখতে রামমোহন রায় ১৮২১ সালে প্রকাশ করেন ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ ও ‘সম্বাদ কৌমুদী’। জনজীবনে প্রথম থেকেই এই সব  সাময়িকপত্রগুলির গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ কোনো ইস্যুতে জন অভিব্যক্তি হল জনমত। যেমন-সতীদাহ, সাগরে সন্তান বিসর্জন, বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ, নীলবিদ্রোহ প্রভৃতি। এসব  নিয়ে সারা দেশব্যাপী যে আন্দোলন ও জনমত গড়ে উঠেছিল তার পশ্চাতে ছিল সৎ ও নির্ভীক সাময়িকপত্রের ভূমিকা।  সুতরাং প্রথম যুগে সাময়িকপত্রগুলি তার  যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে।  
       সাময়িকপত্র এখন লোকশিক্ষা ও আমোদপ্রমোদের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী। কেন না সাময়িকপত্র বর্তমানে বিশ্বদর্পণের কাজ করছে। শুধু সংবাদ প্রচার নয়, সাহিত্য  বিজ্ঞান শিল্প দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে চিন্তাশীল প্রবন্ধ প্রকাশ এর দায়িত্ব আজ সে গ্রহণ  করেছে। রাজনীতি এবং অর্থনীতি এখন সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে সাময়িকপত্রের এক বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায় আদর্শ   সাময়িকপত্রে জনশিক্ষা ও আমোদ প্রমোদের বিষয়টিও অবহেলিত নয়। যাত্রা নাটক  থিয়েটার ও সিনেমার খবর এবং নানা শিক্ষামূলক প্রবন্ধ সম্বলিত ক্রোড়পত্রও  বর্তমানে সাময়িকপত্রের উল্লেখযোগ্য সংযোজন। 
   মুখের কথাকে এখন মানুষ খুব বেশি বিশ্বাস করে না, আস্থা তার ছাপা কথায়। সাময়িকপত্রে প্রকাশিত বক্তব্য তাই জনজীবনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সরকারপক্ষীয় এবং সরকারবিরোধী সাময়িকপত্র সংবাদের বিকৃতি ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে  থাকে। কিন্তু নিরপেক্ষ সাময়িকপত্র গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী।  সরকারের ভুলত্রুটির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ এবং ভালো কাজের প্রশংসা করে জনগণের মধ্যে সরকার সম্পর্কে এক বিশেষ মানসিকতা তৈরি করে দেয়। তাই সৎ ও সাহসী  সাময়িকপত্রের কণ্ঠরোধ ভিন্ন স্বেচ্ছাচারী শাসকের আর গতি থাকে না।  নেপোলিয়ন  তাই বলতেন, “আমি এক শত বেয়নেটকে যত না ভয় পাই, তার  চেয়ে অনেক বেশি ভয় করি তিনটি সংবাদপত্রকে”। কারণ সাময়িকপত্র জনগণের  মনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে যায়। সাধারণ মানুষ সাময়িকপত্রে ছাপা খবরকে  অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। সাময়িকপত্র কীভাবে জনমত গঠন করে রাজশক্তির পতন ঘটায় তার প্রমাণ আমেরিকার ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে   সরকারের  আগ্রাসী মনোবৃত্তির সংবাদ প্রকাশের পর জনমত বিপক্ষে চলে যাওয়াই নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আবার সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠাতেই সাম্প্রতিককালের সীমান্ত সমস্যা ও  সীমান্ত যুদ্ধের প্রসঙ্গ বিস্তৃতভাবে প্রকাশিত হওয়ায় সারাবিশ্ব নড়েচড়ে বসেছে। যদিও এ ব্যাপারে দূরদর্শনের প্রত্যক্ষ দৃশ্য অনেক বেশি ক্রিয়াশীল বলে মনে হয়েছে।
      পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বশক্তি বিত্তবানদের হাতে কেন্দ্রীভূত। সাময়িকপত্র বিত্তশালীদের  অর্থ ছাড়া প্রকাশিত হতে পারে না। তাই বৃহৎ পুঁজি সাময়িকপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জনগণ এবং সরকারকে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে বৃহৎ পুঁজির হাত থেকে সংবাদপত্রকে মুক্ত করতে। অসত্য সংবাদ পরিবেশনের জন্য সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইন কে পুস্তকের মধ্যে স্থিত না রেখে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সাময়িকপত্র সৎ  এবং বলিষ্ঠভাবে জনজীবনে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারবে।
      আধুনিক জীবনে সাময়িকপত্রের দায়িত্ব অপরিহার্যতা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। এটি যে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সংবাদ পরিবেশন করে তা নয়, সমকালীন চিন্তাধারা ও কর্মপ্রচেষ্টাকেও উল্লেখ মাত্রায় প্রভাবিত করে। সংবাদপত্র একদিকে যেমন মানুষকে অবগত করে তোলে অন্যদিকে তেমনি স্বদেশ ও স্বজাতি সম্পর্কেও পূর্ণমাত্রায় সচেতন রাখে।
    কিন্তু বর্তমান সময়ে সাময়িকপত্রগুলির অনেক সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ছে। সেগুলি সঙ্কট কি না সময় বিচার করবে। সাময়িকপত্রগুলির একটি নিজস্ব  ধারণা বলবত করতে চাইছে। তার ফল কখনো কখনো হয়ে উঠছে মারাত্মক। কোনো কোনো সাময়িকপত্র সরকার পক্ষের থেকে লাভজনক কিছু অর্জন করে মিথ্যা সংবাদ জনমানসে প্রচার করছে।। অনেক প্রয়োজনীয়  সংবাদ সরকারের পক্ষে যাবে না ভেবে সেগুলি ছাপানো হচ্ছে না। আমাদের এখানে পত্রিকাগুলি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। এর ফলে বহু পাঠক পত্রিকা পাঠ করার প্রতি অনিহা দেখাচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমানে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে যাবার ফলে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। বহু দেশে অনেক পত্রিকার ছাপা সংখ্যা বন্ধ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। শুধু মাত্র ই-পেপার আপলোড দেওয়া হচ্ছে ওয়েবসাইটে। পাঠক  পড়ে নিচ্ছেন পিডিএফ সংস্করণ। আজকের দিনে বাংলাদেশ ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা ও সাময়িকপত্র সহজে পাঠ করে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সহজে সাময়িকপত্র পড়ে নিচ্ছেন অনেকেই। এর অন্য রকম সুবিধা আছে।
    তবু আমরা আশাবাদী। সাময়িকপত্রকে সহজেই সংকটে আবদ্ধ হতে দেব না আমরা। সুধীসমাজ সেই কাজ করে দেখাবে। রুখে দাঁড়াবে প্রতি মুহূর্তেই। কারণ সাময়িকপত্র আমাদের অলঙ্কার। আমাদের বেঁচে থাকার রসদ। সাময়িকপত্র যদি না থাকে যদি প্রকাশিত না হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে একটা সভ্যতার পতন অবশ্যম্ভাবী। আমাদের কলকাতা থেকে প্রকাশিত ঐতিহ্যশালী আনন্দবাজার পত্রিকা শতবর্ষ পার করেছে এর মধ্যেই। এটা নেহাত কোনো ছোটো কথা নয়। সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এটি অন্যতম সাফল্যের সংবাদ। সাময়িকপত্র আমাদের অভিভাবক হয়ে বেঁচে থাকুক চিরকাল।


Post a Comment

0 Comments