জ্বলদর্চি

অজানা পথে ( দ্বিতীয় পর্ব ) /মিলি ঘোষ

অজানা পথে ( দ্বিতীয় পর্ব )

মিলি ঘোষ


ঘন ঘোর অন্ধকার। একটা কাক পর্যন্ত ডাকে না। রাহী উঠে পরে ঘুম থেকে। বাড়ির সকলের জন্য সকালের খাবার করে রেখে, নিজে রেডি হয়ে সকাল ছ'টার মধ্যে স্কুলের তালা খুলতে ছোটে রাহী।
এভাবেই তো প্রায় সাত বছর কেটে গেল। বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে লোকের বাড়ি কাজে বেরোয়। 
এক একদিন বাড়ি ফিরে ঘুমে ঢুলে পড়ে রাহী। 
ছেলে টুটুন বলে, "মা, একটু ঘুমিয়ে নাও। যেতে হবে না কাজে।"
টুটুনের তখন স্কুলের সময়। যদি কোনওদিন বাড়ি থাকে, মায়ের ক্লান্তি দৃষ্টি এড়ায় না ওর।
ছেলের কথায় মা আরও যেন সজাগ হয়। তাড়াতাড়ি করে কাজে বেরিয়ে পরে।
তবু টুটুনকে নিয়ে রাহীর চিন্তার শেষ নেই। ছেলেটা পড়তে চায় না একেবারে। ফুটবল খেলার দিকে খুব ঝোঁক। বিকেল হলেই বাস রাস্তার ওধারে একটা বড়ো মাঠে গিয়ে হাজির হয়। রোজ মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে বড়ো দাদাদের খেলা দেখে। একদিন সাহস করে বলেছিল ওদেরই একজনকে, ও খেলতে চায়। ওর আগ্রহ দেখে একটা সুযোগ দিয়েছিল দাদারা। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই ডাক পায়। কোথায় কোথায় খেলতে যায়, একটু দূরের দিকে। নিয়ে যায় ওকে। মনে হয় টুটুনের খেলা ভালোই লেগেছে ওদের। 

রাহী পড়া নিয়ে বেশি কিছু বললেই টুটুন বলে, "আমি ঠিক পাশ করে যাব। ফেল করেছি আজ পর্যন্ত ?"
না, ফেল তো টুটুন করেইনি। বরং রেজাল্ট ভালোর দিকেই। 
রাহী তাও  টিক টিক করে। ভাবে, মেয়েটার মতো, ছেলেটার যদি একটু পড়াশুনায় আগ্রহ থাকত!
তা ঠিক। মেয়ে বুবুনকে নিয়ে রাহীর ভাবতে হয় না।
কোনওদিন বলতে হলো না, বই নিয়ে বস। 

২০০ দিয়ে শুরু করেছিল। সাত বছরে রাহীর স্কুলের মাইনে বেড়ে হয়েছে ৬০০, অর্থাৎ প্রতি বছর টাকা বাড়ানো হয়নি। রাহী বাধ্য হয়ে শাড়িতে ফলস পার বসানোর কাজ শুরু করল। এ কাজটা অবশ্য ও স্কুল চলাকালীন কাজের চাপ কম থাকলে কিছুটা করে, বাকিটা রাতে। তাতে অবশ্য পলির কোনও আপত্তি নেই। স্কুলের সব কাজ ঠিকঠাক হলে আপত্তি থাকার কথাও নয়। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
রাহীর বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে থাকে মনামী। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে সংসার। সে'ও স্বামীকে হারিয়েছে অনেক বছর। কাজের লোকের খোঁজে ছিল। পাকেচক্রে রাহী এসে পরে তাঁর বাড়িতে।
রাহীর ফোন নম্বর বলার স্টাইল দেখে খটকা লাগে মনামীর।
জানতে চায়, "তুমি কি পড়াশুনা করেছ ?"
কীসের ছোঁয়া পেয়েছিল রাহী, সে রাহীই জানে।
দু'চোখ উপচে জল আসে তার। 
    "হ্যাঁ দিদি, এইচএস-এ ব্যাক পেয়েছিলাম। তারপর আর বাবা পড়াতে পারেনি। আমি এ'কাজে প্রফেশনাল নই।" 
    "দেখো, কোনও কাজই তো ছোটো নয়। তবু, তুমি তো বাচ্চাদেরকে পড়াতেও পারতে।"
    "না দিদি। সেরকম নামডাক না থাকলে কেউ পড়াতে দিতে চায় না। আর খুব কম টাকা দেয়। ওতে চারজনের সংসার কী করে চালাই!"
    "তোমার হাজব্যান্ড কিছু করেন না ?"
একটু মিনমিন করে বলল রাহী, "ও তো অসুস্থ।"
উত্তর দেবার ভঙ্গিতেই বুঝে গেছে মনামী, রাহী শেষ কথাটা সত্যি বলছে না। এই নিয়ে তাই আর কোনও প্রশ্ন করেনি মনামী। 

সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেল, রাহী একদিন না এলে মনামীর ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যত গল্প রাহীর সঙ্গে। রাহীও উজাড় করে দেয় দিদির কাছে সব যন্ত্রণার কথা। 
একদিন বলল, "দিদি, কাল আসতে একটু দেরি হবে। মেয়েকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যাব।"
      "জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করবে ?"
      "হ্যাঁ, দিদি। কোনদিন মরে টরে যাব।"
      "জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করছ ভালো কথা। তবে মরার কথা এখনই ভাবার দরকার নেই।"
      "তবু, ওরা তো বাঁচবে। নাহলে, যে'টুকু যা জমিয়েছি, ওর বাবা তো তাও শেষ করে রাখবে।"
      "তিনি কি একদমই কিছু করেন না ?"
      "জোর করে কাজে পাঠালেও যায় না। মদ খেয়ে আমার টাকাগুলো শেষ করছে।"
এরপরে আর কথা বাড়ায়নি মনামী।

রাহীর মেয়ের তখন সামনেই মাধ্যমিক। ছেলের আরো দু'বছর পরে। মাঝেমাঝে কাজ করতে করতে উঠে এসে ব্যাগ খুলে একটা ছোটো ফোন বার করে বাড়িতে ফোন করে রাহী। সেখানেও, ওই মাপের একটা ফোন রয়েছে। ছেলেই ধরে, যদি ছুটির দিন থাকে।
   রাহী শুরু করল, "কী করছেন, খেলছেন ? খেলুন, খেলুন, আর একটু খেলুন।"
 ওদিক থেকে কী উত্তর আসছে বোঝা যাচ্ছে না।
  আবার রাহী, "দিদি কী করছে ?"
     "পড়ছে।"
 এই উত্তরটা স্পষ্ট। মনামীর এধার থেকে বুঝতে কোনও অসুবিধা হলো না। 

তারই মধ্যে কোনওদিন পলির ফোন আসে, "তুই শিগগিরি যা। চালের ভ্যান আসছে।"
অর্ধেক বাসন মাজা অবস্থায় ফেলে রেখে কোনও রকমে হাত ধুয়ে, "দিদি একটু আসছি" বলে রাস্তা দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে গেল রাহী।
মনামীর মতামতের কোনও তোয়াক্কাই করল না। কারণ, পলির আদেশ ওর কাছে শিরোধার্য। আশা একটাই। একদিন ওই স্কুলে একটা সরকারী চাকরি হবেই হবে।

মনামী একদিন রাহীকে বলল, "তোমার নিজের বয়স তো তুমি ভালো করেই জানো রাহী। তবে, চাকরি পাওয়ারও যে একটা বয়স থাকে, সেটা কি তুমি জানো না ?"
ঘর মুছতে মুছতে বলল রাহী, "সে তো ঠিকই। আসলে স্কুলটার সঙ্গে এমন জড়িয়ে গেছি, ছাড়তে পারছি না।"
তবু, আশার ছলনে ভুলি।
মনামী বলল, "সে তোমার যেখানে মন চায়, করতেই পারো কাজ। তবে সরকারী চাকরি তোমার হবে না, এটুকু বলতে পারি।" 
আসলে পলির প্রতি কৃতজ্ঞতা ছাড়াও ওই স্কুলটার প্রতি একটা মোহো রাহীর আছে।

মাঝেমাঝে মনামী জানতে চায়, "তোমাদের ফ্ল্যাটটা কতদূর ?"
      "সে যেমন ছিল, পড়েই আছে। হাতই দেয় না।"
      "তোমরা বলো না ? ভাড়ার টাকাও তো প্রমোটারকে গুনতে হচ্ছে। দেরি করে লাভটা কী হচ্ছে তার ?"
      "অনেক বলা হচ্ছে। খালি ঘোরাচ্ছে। ছ'বছর হয়ে গেল।"
      "তোমার দাদাকে বলো, বলতে।"
      "বলে তো দাদা। অন্য ফ্ল্যাটে নাকি হাত দিয়েছে। ওটা হলে পরে ধরবে।"
মনামী বোঝে, এদের খুঁটির জোর নেই।  

বুবুন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে রাহী ওকে ফোন করে বিরক্ত করতে চায় না বা ওর দিক থেকেও কোনো ফোন আসে না। 
দুপুর দু'টোর সময় হঠাৎ হয়ত টুটুনের ফোন এল।
     "মা, ক'টুকরো আলু দেব ?"
     "সবার নামে নামে এক টুকরো করে দে। আর দিদিকে জিজ্ঞেস করে চাল নিবি।"
কোনওদিন আবার টুটুন ফোন করে বলল, "মা, কখন ফিরবে ? খিদে পেয়েছে খুব।"
      "এই তো হয়ে গেছে, আর পনেরো মিনিট।"
ফোনের কথোপকথন যে'টুকু কানে আসে, মনামীর নিজেকে অপরাধী লাগে।
এক একদিন বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। 
বলে, "থাক। আজ আর সিঁড়ি মুছতে হবে না। তুমি বাড়ি যাও।" 
বারান্দায় দাঁড়িয়ে লড়াকু রাহীর চলে যাওয়া দেখে মনামী। দুই হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে নির্জন রাস্তার এক ধার দিয়ে মাথা নিচু করে এক মনে হেঁটে যায় রাহী। 

বুবুনের মাধ্যমিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে মনামীর
গল ব্লাডার অপারেশন হলো। তবু রাহীকে ছুটি দিল মনামী।
বলল, "পরীক্ষার ক'দিন আসতে হবে না।"
      "আপনার তো কষ্ট হবে দিদি।"
      "সে আমি চালিয়ে নেব।"
মনামী জানে, রাহীর বর নড়েও বসবে না। রাহীকেই দৌড়তে হবে।

ফার্স্ট ডিভিশন ছুঁই ছুঁই করেও ছুঁতে পারল না বুবুন। মার্কশিট নিয়ে এসে মনামীকে প্রণাম করে গেল। অঙ্ক আর ফিজিক্যাল সায়েন্সে ৩৫ / ৩৬ করে পেয়েছে। বাকি সব বিষয়ে ষাট, সত্তরের ঘরে নম্বর। যা করেছে, সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। প্রতিটি বিষয়ের পেছনে একজন করে শিক্ষক নিয়ে বিশাল রেজাল্ট করার ইঁদুর দৌড়ে নিতান্তই বেমানান বুবুন।
এবার নড়েচড়ে বসল রাহী। ছেলেকে অঙ্ক করানোর জন্য মনামীকে অনুরোধ করতে লাগল। মনামী নিজেই তখন পড়ানো কমিয়ে দিয়েছে, শারীরিক কারণে। 
বলল, "কিছু দরকার হলে দেখিয়ে দেব। কিন্তু ওই ভাবে দায়িত্ব নিয়ে আর সম্ভব না গো।"
তবে বুবুনের রেজাল্ট দেখে বিস্তর খুশি মনামী, একটু অন্যভাবে বুবুনের পাশে দাঁড়াল। ওর এডমিশন ফি, টিউশন ফি যতটা মনামীর পক্ষে সম্ভব, রাহীর হাতে তুলে দিল। 
তারপরেও বইপত্র যখন যেমন পেরেছে কিনে দেবার চেষ্টা করেছে। 
মনামী মনে প্রাণে চাইল, অর্থের অভাবে যেন রাহীর ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ না হয়।

অঙ্ক-বিজ্ঞানের ভূত ঘাড় থেকে নামিয়ে প্রায় গঙ্গায় স্নান করে নতুন উদ্যমে, নতুন স্কুলে বুবুন ইলেভেনের পড়া শুরু করল এবং প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম দশেই স্থান করে নিল।

Post a Comment

1 Comments

  1. খুবই সুন্দর। রানীর পথচলা সার্থক হোক।

    ReplyDelete