জ্বলদর্চি

অজানা পথে ( তৃতীয় পর্ব ) /মিলি ঘোষ

অজানা পথে (তৃতীয় পর্ব)
মিলি ঘোষ

কী এক অজানা ভয়ে পৃথিবী কাঁপছে। ঘরের বাইরে পা রাখতে মানুষের ভয়। বাড়িতে কেউ এলেও ভয়। গৃহকোণই যেন একমাত্র আশ্রয় স্থল। সমগ্র বিশ্ব এক সঙ্গে লড়ছে। বাঁচার লড়াই।
এ এক অদ্ভুত জগৎ। এমন জগৎ আগে কখনও দেখেছে কি কেউ ? 
ছোটো ছোটো বাচ্চারা স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে বসে অনলাইন ক্লাস করছে, অর্ধেক ড্রেস পরে। বহু মানুষ কাজ হারিয়ে বাড়িতে বসে, নয় তো ভ্যানে করে সব্জি বিক্রী করছে। কেউ বা নয় ঘণ্টার বদলে পনেরো ঘণ্টা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। পুরো সিস্টেমটাকে মুড়ির টিনের মতো ঝাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাহীরও স্কুল বন্ধ। কাজের বাড়ি থেকেও ছুটি দিয়ে রেখেছে। সবই অনন্তকাল। কারণ, কেউ জানে না, কবে আবার সেই চেনা পৃথিবীটাকে ফিরে পাওয়া যাবে। 

রাহীর স্কুলের চারজন শিক্ষকের মধ্যে দু'জনের রাহীর টাকাটা পকেট থেকে বার করতে গা কড় কড় করছিল। রাহী তো এখন বাড়িতে। কাজ করবে না, টাকা কীসের ? অকাট্য যুক্তি! নিজেরা কিন্তু বাড়ি বসেই টাকা পাচ্ছে প্রতি মাসে। আর যে স্কুলের শিক্ষক সংখ্যা চার এবং তাঁদের মানসিকতার এই বহর, সে স্কুলের পড়ুয়ারা যে কত অনলাইন ক্লাস করছে, তা না বললেও চলে।
তখন অবশ্য পলি দাঁড়িয়েছে রাহীর পাশে।
বলেছে, "ওকে এখন ছাড়িয়ে দিলে, ও হয়তো পরে আর আসতে চাইবে না। তখন ওর কাজগুলো কিন্তু আপনাদেরই করতে হবে। আমি করব না। কারণ, আমি তো টাকা দিতে চেয়েছি আর আমার শরীরও ভালো না।"
বাধ্য হলেন সবাই রাহীকে বহাল রাখতে।
কাজের বাড়ি নিয়ে রাহীর চিন্তা নেই। তারা প্রতি মাসে ওর প্রাপ্য টাকা দিয়ে যাচ্ছে সময় মতো। 

রাহী ফুর্তিতেই আছে। কাজ নেই, অথচ টাকা আসছে। সরকার প্রদত্ত বিধি নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাহী এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। ফোন করলেই গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ছুটির আমেজে রাহী, গলি থেকে রাজপথে পাড়ি জমাল। তবুও রাহী অক্ষত থাকল। একটার পর একটা সংক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল, রাহী ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বরং খাটনি কমে যাওয়ায় চেহারায় কিছুটা গ্ল্যামার এল।

ঢেউয়ের ওঠা নামার সঙ্গে পা ফেলে দুনিয়া চলতে লাগল। রাহীকেও তাই আবার কাজে যেতে হচ্ছে। কিন্তু, মনামীর শরীরটা যেন ঠিক বশে নেই আর। কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল, তবে কী ....
সন্দেহ মনে দানা বাঁধতেই মনামী নিজেকে একদম আলাদা করে ফেলল। যা আশঙ্কা করা হয়েছে, তাই হলো। রিপোর্ট এল মেয়ে মধুরার ফোনে, পজিটিভ।
রাহি তখন বাসন মাজছিল। মধুরা গিয়ে রাহীকে বলল, "তুমি বাড়ি চলে যাও। মা'র পজিটিভ এসেছে।"
রাহী কোনওরকমে মাজা বাসন ধুয়ে রেখে বাড়ির দিকে ছুটল।
এবার মধুরা এসে, একটা দূরত্ব রেখে মা'কে  বলল, "কনগ্র্যাচুলেশনস! তোমার পজিটিভ এসছে।" 

বাড়িতে থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলতে হলো। তবে ছোবল ভালোই খেয়েছিল, মনামী। ওর মেয়ে একার হাতে সব সামলে দিল।
আর ঠিক একদিন বাদে বাদে রাহী ফোন করতে লাগল, "কেমন আছেন, দিদি ? কিছু এনে দেব, বাজার টাজার ?"
যা লাগত, রাহী এনে দিত। প্রতিবেশীদের কয়েকজনও পাশে ছিলেন।
মনামী বলে দিয়েছিল রাহীকে "তুমি প্যাকেটটা বাইরের দরজায় আলগা করে ঝুলিয়ে রেখে চলে যেও। ফোন করে দিও, মেয়ে নিয়ে আসবে। দরজায় হাত দেবে না কিন্তু।" 
মনামী সুস্থ হয়ে, বাড়ি স্যানিটাইজ না করা পর্যন্ত রাহী একভাবে করে গেল। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
মাধ্যমিক না দিয়েই টুটুন প্রথম ডিভিশনে পাশ করল এবং মা'কে বলল, "দিদি সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছিল আর আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করলাম।"
রাহী বলেছে ছেলেকে, "দিদি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে আর তুই না দিয়ে।"
মনামী শুনে বলল, "ওকেই বা বলছ কেন ? ওর কী দোষ! পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেলে ও হয়তো ভালোই করত।"
      "হ্যাঁ দিদি, পরীক্ষা দেবার সুযোগটুকুও ওরা পেল না। আবার কত ছেলে পড়াশুনা না করেই পাশ করে গেল।"

সে বছর উচ্চ মাধ্যমিকও, কিছুটা হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। অনেকেরই দুটো কী তিনটে পরীক্ষা দেওয়া হয়েছে। বুবুন অবশ্য এডুকেশন বাদে বাকি পাঁচটা পরীক্ষাই দিতে পেরেছে।
তুখোড় রেজাল্ট করল বুবুন। বাংলা ছাড়া বাকি সব গুলোতেই আশির ওপরে নম্বর। ইংরেজিতে ৮৬ পেয়েছে, সেই নম্বরটা এডুকেশনে দেওয়া হয়েছে। রাহী কিন্তু নিজে থেকে একবারও এডুকেশনের নম্বর বলেনি।
মনামীই জানতে চাইল, "যে সাবজেক্টটা দিতে পারেনি, ওটাতে কত দিল ?"
       "ওটা ওই ইংলিশের নম্বরটাই দিয়ে দিয়েছে।"
রাহীর সততা দেখে মুগ্ধ হলো মনামী।

পরের বছর মধুরার বিয়ে।
তাই, বুবুনের পড়াশুনার জন্য সামান্য কিছু টাকা রাহীর হাতে দিয়ে মনামী বলল, "এখন তো চাপে আছি। বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর দেখি কী করতে পারি।"
হাঁ হাঁ করে উঠল রাহী।
বলল, "না, না, দিদি। লাগবে না। ও তো বাচ্চাদেরকে পড়ায়। আর যদি স্কলারশিপ পেয়ে যায়, তো ভালোই ।"
স্কলারশিপ পেয়েছিল বুবুন।
মনামী এত খুশি হলো, যাকে পারল, তাকেই বলল, বুবুনের রেজাল্টের কথা। 

একদিন রাহীর জামাকাপডের দিকে তাকিয়ে মনামী জানতে চাইল, "কোথাও যাবে নাকি ?"
    "হ্যাঁ দিদি, একটা মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয়। ওর বাবা, মা দু'জনেই চাকরি করে।"
    "কোথায় স্কুল ?"
    "বাগবাজারে।"
    "তুমি এখন বাগবাজারে যাবে! তারপর ফিরে রান্না বসাবে ?"
    "না, এই ক'দিন মেয়ে করে নেবে। ওর বাবাকেও বলে এসেছি।
    " এই ক'দিন মানে ?"
    "ওদের যে সব সময়ের মাসি আছে, ও বাড়ি গেছে। বৌদি তাই আমাকে বলল।"
    
বলতে বলতে বাড়ি থেকে ফোন। বোধহয় বরের।
রাহী বেশ কড়া গলায় বলল, " কী হয়েছে কী ?"
ওদিক থেকে কী উত্তর এল বোঝা গেল না।
আবার রাহীর কড়া নির্দেশ, "ভাতটা বসাও।"
মনামী ভাবল, যাক কিছু তো করুক ওর বর। রাহী আবার বাকি কাজে হাত লাগাল।
মনামী ভাবছে, রাহী কখন বাড়ি ফিরবে আর কখন খাবে! 
ফ্রিজ থেকে কিছু বার করে রাহীকে দিয়ে বলল, "এটা খেয়ে তারপরে যাও।"
রাহী খেতে খেতেই দৌড় লাগাল।
পায়ে চটি গলাতে গলাতে বলল, "এই মেট্রো ধরে যাব আর আসব।" 

পরের দিন কাজে আসতে মনামী বলল, "কাল কখন ভাত খেয়েছ, রাহী ? বিকেল পাঁচটা ?"
     "হ্যাঁ, ওই পাঁচটায় খেয়ে আবার ছ'টায় বেরোলাম।"
     "বিকেলেও কাজ আছে ? তাহলে ফলস বসাও কখন ?"
রাহী মাথা নিচু করে অল্প অল্প হাসতে থাকে।
মনামী জানতে চাইল, "নতুন কাজ নিয়েছ আবার ?"
      "না দিদি, চেম্বারে যাই। ওই বাজারের সামনে।"
      "চেম্বারে মানে ? কোনও ডাক্তারের চেম্বার ?"
      "হ্যাঁ দিদি।"
      "সেখানে কী করো তুমি ?"
      "ওই নাম লিখতে হয়। কাজ কিছু নেই তেমন। বসেই থাকি। পেশেন্ট কম থাকলে ফলস বসাই বসে বসে।"
      "এর পরেও তুমি চেম্বারে যাও ? নিজের শরীরটার কথা একটু ভাবো রাহী। সারাদিনে এতটুকু বিশ্রাম নেই!"
রাহী একটু লজ্জিত মুখে হাসে আর বলে, "এক হাজার টাকা দেয়। বলল, কাজ তেমন নেই। ভিড় কম থাকলে ফলসও বসাতে পারব। তাই রাজি হলাম।" 
রাত সাড়ে ন'টায় শরীরটাকে টানতে টানতে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরে রাহী। তারপর আবার রাতের রুটি বানায়।

এই হলো রাহী। ছেলেমেয়ে দু'টোকে একটু মানুষের মতো মানুষ করার আশায় কী পরিশ্রমই না করতে পারে! 

মনামী ভেবে পায় না, ভোর চারটে থেকে রাত
এগারোটা পর্যন্ত একটা মানুষ কী করে একভাবে
কাজ করতে পারে! 

একসময় মনামীকেও একার হাতে শিশু কন্যাকে বড়ো করতে, অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু কাজের ধারা আলাদা। রাহীর সঙ্গে মেলে না। মনামী যা করেছে, রাহী হয়তো পারবে না। আবার রাহী যা পারে, মনামী তা পারবে না। অথচ, লক্ষ্য একই।

শরীরের রক্ত, জল করে সংসারকে টেনে যাচ্ছে, এমন কত শত মানুষ আছে দুনিয়ায়। 
রাতের ট্রেনে দেখা যায়, বিধ্বস্ত হকাররা বাড়ি ফিরছে। আবার কোন্ ভোরে উঠে এদের রওনা দিতে হয়, বিক্রির জিনিস নিয়ে। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত এমন হাজারো মানুষ, সারা জীবন শুধু যুদ্ধই করে গেল দুটো গ্রাসাচ্ছ্বাদনের জন্য।
পৃথিবী, তাদের ক'জনের খবর রাখে! 

(চলবে)

Post a Comment

0 Comments