জ্বলদর্চি

টরিসেল্লির পরীক্ষা ও বিজ্ঞানের রুদ্ধ দ্বার /সৌমেন রায়


টরিসেল্লির পরীক্ষা ও বিজ্ঞানের রুদ্ধ দ্বার

সৌমেন রায়                                                                       

সপ্তদশ শতকে ইউরোপে তখন রেনেসাঁ পরবর্তী নবযুগের বিজ্ঞান সবে মাথা তুলছে। সে প্রাণ রস শোষণ করছে প্রাচীন ভারত, গ্রিক ও আরব্য বিজ্ঞান থেকে।প্রাণবায়ু সংগ্রহ করছে স্বাধীনতাকামী, নতুনত্বের পূজারী নবীন ইউরোপীয় মনন থেকে। সেই সময় একটা সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলো। সাধারণ চোষক পাম্পের সাহায্যে 32 ফুটের অধিক নিচ থেকে জল তোলা যাচ্ছিল না। গ্যালিলিও(1564-1642) তখন স্বমহিমায় বিরাজমান। তিনি একটি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলেন।কিন্তু সেটা তেমন যুতসই হলনা। গ্যালিলিওর মৃত্যুর কয়েক বছর পর তার ছাত্র টরিসেল্লি ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে একটা পরীক্ষা(1746) করলেন। পরীক্ষাটি দীর্ঘদিন ধরে সপ্তম অষ্টম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইতে খুব নিরীহভাবে অবস্থান করছে। আমরা বিজ্ঞান শিক্ষকরা ততোধিক উদাসীনতার সঙ্গে পড়িয়ে আসছি। কিন্তু ওইটুকু একটা পরীক্ষা যে বিজ্ঞানের কতগুলি দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এই লেখা সেই বিষয়ে।

                   টরিসেল্লী একটা খোলা মুখ পাইপে পারদ ভরে সেটিকে পারদ পূর্ণ পাত্রে উপুড় করে দিলেন। তারপর বিস্মিত চোখে দেখলেন নলের মধ্যে পারদ ৭৬ সেমি উচ্চতা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে, পাত্রে পড়ে যায়নি। ঘটনাটি দেখে তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তার মতামতটি জানালেন। বললেন বায়ুমন্ডলের চাপ ধরে রেখেছে ওই পারদ স্তম্ভকে। খুব সাহসের সঙ্গে বললাম এই কারণে তখনও চার্চ গুলি বেশ শক্তিশালী আর সম্পদশালীও বটে। তাই বাইবেল বিরোধী বা চার্চ বিরোধী কথা বললে কোপে পড়তে হতো। কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে পুড়ে মরতে হয়েছে ব্রুনোকে। গ্যালিলিওর মত নিষ্ঠাবান ক্যাথলিকের বিচার হয়েছে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে বলার জন্য। সেখানে ভুল স্বীকার করে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি। কোপার্নিকাস তার সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্ব ভাবনা লুকিয়ে রেখেছিলেন বহুকাল, চার্চের ভয়ে। মৃত্যু শয্যায় তিনি হাতে পান নিজের লেখা বইটি। তাই পারদের দাঁড়িয়ে থাকা 'ঈশ্বরের ইচ্ছা' না বলে 'বায়ুমণ্ডলের চাপের ইচ্ছা' বলতে সাহস লাগে বৈকি।এজন্য অবশ্য টরিসেল্লী কে কোনো অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি। হয়তো চার্চ কর্তৃপক্ষ এটিকে সামান্য ব্যাপার ভেবে মাথা ঘামাননি। কিন্তু সহজে বিজ্ঞানীমহল মেনেও নেয়নি। কোনকালে অবশ্য নতুন জিনিস খুব সাদরে গৃহীত হয়নি।অনেক পরে পাস্কাল একটি নল নিয়ে পাহাড়ে উঠে নেমে প্রমাণ করেন যে  কথাটা সত্য। পারদের ক্ষেত্রে যেটা 76 সেন্টিমিটার জলের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ৩২ ফুট। কারণ জলের থেকে পারদ অনেক ভারী। জল বায়ুমন্ডলীয় চাপে 32 ফুট মত উঠে আসে আর চোষক পাম্প সেটাকে তুলতে পারে অর্থাৎ সাধারণ পাম্পের সাহায্যে জল 32 ফুটের বেশি তোলা যায় না।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

     নলের মধ্যে ৭৬ সেমি পারদ এর উপরের অংশটি ছিল শূন্যস্থান। এই শূন্যস্থানই হয়ে উঠল নাটের গুরু। খ্রিস্টের জন্মের আগেই ডেমোক্রিটাস (আরো আগে ভারতের কনাদ, গৌতম) পরমাণুর কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন শূন্যস্থানের কথা। কিন্তু প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের বিরোধিতায় তা তেমন কলকে পায়নি। অ্যারিস্টটল শূন্যস্থানের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। নিজের সময়কাল থেকে এক হাজার বছর অধিক কাল তিনি ছিলেন বিজ্ঞান জগতে প্রবল পরাক্রান্ত। যদিও তার পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত তথ্যই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেউ এই একটি বাক্য পড়ে অ্যারিস্টটল কে অশ্রদ্ধা না করে বসে। তার জীববিজ্ঞানের উপর কাজগুলি অধিকাংশ ছিল অভ্রান্ত। তাছাড়া বিজ্ঞানে ভ্রান্তির ও কিছু মূল্য আছে। ‘লাইসিয়াম’ নামে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে তিনিই প্রথম সংঘবদ্ধ গবেষণার পথ দেখান। যাই হোক শূন্যস্থান এখন আর কোন দার্শনিক তত্ত্ব রইল না, বাস্তবে তা তৈরি করা গেল। এরপর ফরাসি গাসডি ফিরিয়ে আনলেন কনা ও শূন্যস্থান যুক্ত পরমাণুর ধারণা। পরমাণু গঠন নিয়ে নাড়াচড়া শুরু হল তার ফলেই পরবর্তীকালে ডালটন, অ্যাভোগাড্রো, রাদারফোর্ড, বোর প্রভৃতি বিজ্ঞানীর হাত ধরে গড়ে উঠলো আজকের অনু পরমাণুর জগৎ(1808-1913)।

           শূন্যস্থান বিজ্ঞানী মহলে একটা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। অনেকেই চেষ্টা করতে লাগলেন শূন্যস্থান সৃষ্টি করার। প্রথম পদক্ষেপটি করলেন অটো ফন গেরিক। এই ধনবান উদ্যোগী পুরুষটি ছিলেন জার্মানির ম্যাকডেববা্গ শহরের মেয়র। তিনি একটি জলপূর্ণ পাত্র থেকে জল বের করে সেখানে শূন্যস্থান সৃষ্টি করেন। এরপর বের করেন বায়ু নিষ্কাশন পাম্প। তারপর করলেন বিখ্যাত অর্ধ গোলক পরীক্ষা। দুটি বিরাট আকারের অর্ধ গোলক জুড়ে বানালেন একটি গোলক। তার থেকে বের করে দিলেন  বাতাস। তারপর দেখালেন ওই গোলকের এক একদিকে ১৬টি করে ঘোড়া জুড়ে তবে পৃথক করা গেল অর্ধ গোলক দুটিকে(1656)। বায়ুর শক্তি দেখে সকলে চমকে উঠলো।

   ফন গেরিকের বায়ু নিষ্কাশন পাম্পের উন্নতি সাধন করলেন রবার্ট বয়েল(1627-1671)। বয়েল ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। রয়েল সোসাইটির প্রাণপুরুষ বয়েল আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তাও ছিলেন। বয়েলের সহযোগী ছিলেন হুক। তখনকার দিনে সম্ভ্রান্ত লোকেরা শখের বিজ্ঞান চর্চা করতেন, আর সেই কাজে বেতন দিয়ে সহযোগী রাখতেন। হুক এমনই এক সহযোগী ছিলেন।তিনি অবশ্য সহযোগী হয়ে থেকে যাননি। নিজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন বিভিন্ন শাখায়। পাম্পের উন্নতি করতে গিয়ে বয়েলকে কাজ করতে হচ্ছিল প্রসারিত ও সংকুচিত বায়ু নিয়ে। সেখান থেকে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন আমাদের দশম শ্রেণীতে পড়া বয়েল সূত্র।

          বয়েল শূন্যস্থান নিয়ে আরো বিভিন্ন পরীক্ষা করেন। তিনি দেখান শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে শব্দ যেতে পারে না,আলো পারে। আরো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্যবেক্ষণ করেন। বলেন যে শূন্যস্থানের দহন বা জীবন কোনটাই সম্ভব নয়। অর্থাৎ বায়ুর মধ্যে এমন কোন উপাদান আছে যেটি আগুন জ্বলতে সাহায্য করে এবং প্রাণের পক্ষে অপরিহার্য। মানে বয়েল প্রায় আবিষ্কার করেই ফেলেছিলেন অক্সিজেন।পরে কাজটা  করেন  প্রিস্টলি(1774)।তিনি তিনি পারদের অক্সাইডের ওপর লেন্সের সাহায্যে সূর্যালোক ফেলে অক্সিজেন সংগ্রহ করেন। প্রিস্টলি কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড সহ বহু যৌগ আবিষ্কার করেন ।বিজ্ঞানী শিলি প্রায় একই সময়ে পৃথকভাবে অক্সিজেন তৈরি করেন। প্রিষ্টলি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ফরাসি বিপ্লবকে সমর্থন করায়  পুড়িয়ে দেওয়া হয় তার বাড়ি। তিনি চলে যান নিউইয়র্ক। কিছুকাল আগেই ক্যাভেন্ডিশ আবিষ্কার করেছেন হাইড্রোজেন(1766)। তবে এ দুটির তাৎপর্য উপলব্ধি করেন  ল্যাভসিয়ার। তিনি এগুলির প্রকৃত ধর্ম ব্যাখ্যা করেন ও রসায়নকে হাত ধরে সাবালক করে তোলেন। স্বদেশ, সমাজ ও বিজ্ঞানের অক্লান্ত কর্মী লাভোসিঅর কে ফরাসি বিপ্লবের সময় মাত্র ৫০ বছর বয়সে গিলোটিনে হত্যা করা হয়(1794)।বিপ্লব শুরু হলে তা যে  সর্বদা মঙ্গলদায়ক নাও হতে পারে এ তার প্রমাণ। সে অবশ্য ভিন্ন কথা। এই যে বয়েল সূত্র বা অক্সিজেন আবিষ্কার আসলে শূন্যস্থান তথা টরিসেল্লির পরীক্ষার উপজাত।

            শূন্যস্থান আবিষ্কারের পর তা ব্যবহার করে খনির মধ্যে জমে থাকা জল তুলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছিল। তারপর বায়ু শক্তি দেখে অনেকেই ভাবছিলেন যে এমনিভাবে বাষ্প শক্তিতে যদি কোন ভাবে কাজে লাগানো যায়। এই দুটো মিলে বাষ্প ইঞ্জিনের নকশা অনেকেই তৈরি করেছিলেন। বিজ্ঞানী হাইগেন্স এর সহযোগী দনি প্যাপা একটি নকশা বানিয়ে সেটি কার্যকরী করার জন্য রয়েল সোসাইটির কাছে ১৫ পাউন্ড অর্থ সাহায্য চান। কিন্তু সে আবেদন ব্যর্থ হয়। এই প্যাপা ডাইজেস্টার বলে একটি যন্ত্র নির্মাণ করেন যেটি আমাদের প্রেসার কুকারের আদি রূপ। যাই হোক সেই ইঞ্জিন শেষ পর্যন্ত বানালেন( নিউকোমেন বলে প্রায় পড়াশোনা না জানা একজন কারিগর(1712)। তার বানানো ইঞ্জিন কয়লা খনিতে ব্যবহার করা হতো প্রায় ষাট সত্তর বছর। এমন একটি ইঞ্জিন সারাতে গিয়ে জেমস ওয়াট তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন আলাদা শীতক। ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বেড়ে গেল(1765)। আরো কিছু উন্নতি ঘটিয়ে তা বস্ত্র শিল্পসহ অন্যত্র ব্যবহার হতে ললাগলো

  যানবাহনের কাজে লাগাতে তার শক্তি আরো বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল,প্রয়োজন ছিল সেটিকে আরো হালকা করার। সেই কাজটি করলেন কয়লা খনি অঞ্চলের এক স্বশিক্ষিত যুবক স্টিফেনশন(1827)। তিনি পাতের উপর ট্রেন চালিয়ে গতিতে পরাস্ত করলেন ঘোড়াকে। আরো পরে পরে কিছু তাত্ত্বিক ও ব্যবহারই উন্নতি ঘটিয়ে বাষ্প ইঞ্জিনের হাত ধরে আসে পেট্রোল, ডিজেল চালিত গাড়ি(1897)। সে অবশ্য আরো অনেক পরের কথা। এইযে বাষ্প শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্রযুগের সূচনা হলো এর পিছনেও কিন্তু এই টরিসেলির নিরীহ পরীক্ষা। অন্তত ভাবনাটি  'শূন্যস্থান' থেকে উদ্ভূত।

              সুতরাং দেখা যাচ্ছে একটি সামান্য পরীক্ষা কিভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার দ্বার অর্গল মুক্ত করতে পারে। সেই মতো সামান্য যুক্তিবাদিতা  অর্গল মুক্ত  করতে পারে আমাদের মনের দ্বার, আলোকিত করতে পারে মনের অনেক অন্ধকার স্থান। বিজ্ঞান শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য সেই যুক্তিবাদী মন তৈরি করা।

জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇

Post a Comment

0 Comments