জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৫৫/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫৫

সে দিনটার কথা আজও মনে আছে। ২৫/০৪/১৪ তে  খান সাহেব কে নিয়ে  কলকাতা যাচ্ছিলাম। মোহনপুর ব্রিজ পার হয়েছি, বানু মাসির(আজহারউদ্দিন খানের স্ত্রী) ফোনে দুঃসংবাদ পেলাম, নাজিম আহমেদ আত্মহত্যা করেছেন।  মিউনিসিপ্যালিটির চ্যেয়ারম্যান বলে নয়, উনি সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ ছিলেন। কবিতা লিখতেন, এই সব নানা কারণে আমরা পরস্পরকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। উনি  বলতেন, আপনি তো আমাদের মেদিনীপুরের গর্ব। 
    ৭ মে মেদিনীপুরে লোকসভা ভোট হল। ভোট দিতে যাইনি। ইচ্ছে করেনি। ১২ মে ভোটের রেজাল্ট আউট হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বেশকিছু বুথে কারচুপির অভিযোগ থাকায় আগামিকাল ওইসব বুথে আবার ভোট হবে। ১৬ মে ভোটের রেজাল্ট আউট হল। বিজেপি একাই সরকার গড়বে। কংগ্রেসের একেবারে বেহাল  দশা। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট একেবারে মুছে গেছে বললেই হয়, মাত্র দুটি আসন পেয়েছে। এর অর্থ এদেশে মুসলিমদের দুর্দিন শুরু হল। যাক, এসব পরিবর্তনে আমাদের কিছু এসে যাবে না।

পার্কের ছবি।


      সবরকম ব্যবস্থা করে ২২ মে ইংল্যান্ড রওনা হলাম এয়ার ইন্ডিয়ার  ফ্লাইটে। এবার আমরা হিথরো যাব না, দমদম থেকে সম্ভবত অমৃতসরে ফ্লাইট ল্যান্ড করল। ওখানকার যাত্রীদের নামিয়ে আমাদের দিল্লি নিয়ে এল, এখানে ফ্লাইট চেঞ্জ করে ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ইন্টার ন্যাশনাল  এয়ারপোর্টে পৌঁছে বারমিংহামের ফ্লাইটে চড়লাম। ফ্লাইট উড়ান দিলে আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসী মনটাকেও মেঘের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। মন আমার এখন মেঘের ভেলায় চড়ে পিছন পানে ধেয়ে চলেছে। গত এক বছরের সব স্মৃতি মনের পর্দায়  ভেসে উঠছে। তাই মাঝে মাঝে আমার মনটাকে আঁধার করা কালো মেঘ ছেয়ে  ফেলছে। তখন সবকিছু ঝাপসা দেখছি। কপোল বেয়ে বৃষ্টির ধারার মত জল ঝরে চলেছে। মাঝে মাঝ্যে হেসেও ফেলছি পাগলির মত। কখন কি করলাম, খেলাম মনে নেই। যেহেতু এখন(গ্রীষ্মকালে) ভারতের সঙ্গে ইংল্যান্ডের  ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময়ের পার্থক্য, তাই দিনে দিনেই বারমিংহাম এয়ারপোর্টে  পৌঁছে গেলাম। এখানে হুইল চেয়ার নিয়ে ঝামেলা হল।ইমিগ্রেসনের সময় খান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, এক সাড়ি পরা ভদ্রমহিলা কী বলছিলেন বুঝতে পারছিলাম না। তখন একজন হিন্দিভাষী মহিলা এসে বললেন, উনি দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারছেন যখন, তখন ওনার হুইল চেয়ারের প্রয়োজন নেই। ওই ভদ্র মহিলাকে চেয়ার ছেড়ে দেওয়া হোক। আমি বললাম, আমরা দমদম থেকে হুইল চেয়ার বুক করে এসেছি প্রয়োজন বলেই তো। কেন চেয়ার ছাড়ব? খান সাহেবকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেই ঠেলে নিয়ে লাগেজ নিতে গেলাম। আমার লাগেজ প্রথমেই পেয়ে গেলাম। ওনারটা পেলাম প্রায় আধঘণ্টা পরে। তারপর লাগেজ ট্রলিতে উঠিয়ে দুজনে ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে এলাম। বারমিংহাম থেকে নটিংহাম কম বেশি ৫০ মিনিট সময় লাগে বলে শুনেছি। গত বারের সেই জাভেদই আমাদের নিতে এসেছে, সঙ্গে দীপ। আজকের দিনটা খুব বড় মনে হচ্ছে। এখনো সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছি। এখানে তখন বিকেল ৬ টা। গাড়িতে উঠেই দেশে ভাই মনিকে ফোন করলাম। ও অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। 

নীনাদি ও আমি।

    এবার আর হাসপাতালের কোয়ার্টারে নয়। ওরা অ্যাপেলডোর এভিনিউতে বাড়ি কিনেছে, সেখানেই পৌঁছালাম। মেয়ে নাতনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নাতনিকে বুকে জড়িয়ে শান্তির প্রলেপ পেলাম। তারপর সব স্নান খাওয়া সেরে যখন  বিছানায়  গেলাম তখন আমার ফোনে সময় দেখলাম ২ বেজে ২২ মিনিট। বেশি ক্লান্তিতে ঘুম আসেনা। আমারও তাই হল, যদিও ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম জানিনা। সকালে উঠে জামাকাপড়, ওষুধপত্র গুছিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে দীপ কফি বানিয়ে দিয়ে গেল। কফির কাপ হাতে নিয়ে পর্দা সরিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম। মাঝখানে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ফুটপাত। তারপরেই সারি দিয়ে একই রকম বাংলো ডিজাইনের বাড়ি। রাস্তার ওপাশেও তাই। এদেশে সেটাই নিয়ম। এক একটি এলাকার বাড়ি ও  বাড়ির চারপাশ একই রকম হতে হবে। সব বাড়ির সামনে ও পিছনে লন রয়েছে। নিজের নিজের বাড়ির সামনে বা ফুটপাত ঘেঁসে যে যার গাড়ি রেখেছেন, বাকি অংশে বাগান করেছেন। পিছনে অনেকে কিচেন গার্ডেন করেছেন। তাছাড়া  এই লনে জামাকাপড় শুকনো হয়। তারজন্য উলটানো ছাতার  ফ্রেমের মত দেখতে একটা স্ট্যান্ড রয়েছে। ফ্রেমের চারদিকে তার জড়ানো রয়েছে। আমি তো সাড়ি পরি, তাই আমাকে তার খাটাতেই হবে। যদিও সূর্যের মুখ কম সময়ই দেখতে পাওয়া যায়। কাপড়জামা রুমহিটিং এই শুকনো করতে হয়।
    ২০১২ সালে পাকিস্তানের মালালা  ইউসুফজাহান নামে যে কিশোরী শিক্ষার  অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল বলে  এবং তালিবানি অত্যাচারের কথা বিবিসির একটি মাধ্যমে বল্গ লেখার অপরাধে স্কুল বাসের মধ্যে তাকে বেশ কয়েকটি গুলি করা হইয়েছিল, তাকে বারমিংহামে নিয়ে এসে জটিল চিকিৎসার  মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা হয়। সেই সময় থেকে মালালা এখানেই থাকে। এই  ২০১৪ তে ভারতের কৈলাশ সত্যারথির সঙ্গে যুগ্মভাবে মামালাও নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। মালালা এখন পর্যন্ত নোবেল জয়ীদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ।
    জারা গতকাল থেকে বায়না ধরেছে, আমাকে ওর সাঁতার দেখতে যেতে হবে। তাই আজ বাবলির গাড়িতে ওর সাঁতার দেখতে বের হলাম। মেয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে কোনোদিন ভেবেছিলাম কি? ভাবিনি তো কত কিছুই। তবুও তো সেইসব ঘটেছে। যা অবধারিত তা একদিন ঘটবেই, কেউ আটকে রাখতে পারবে না। আমিও তাই পারিনি। কত ছোট ছোট বাচ্চা, দুই-আড়াই বছর বয়স হবে, বাবা নিয়ে জলে নেমেছে, ডোবাচ্ছে, জলে ছেড়ে দিচ্ছে। দেখে আমার ভীষণ ভয় করছিল। জারা সাঁতারের পর কিছুক্ষণ খেলেধুলা করল। এখানে কত রকম মজার খেলার ব্যবস্থা রয়েছে।
      আমার কষ্ট, মনখারাপ আমার ভিতরে রেখে সবার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করছি। ওরা আজ লুচি আলুরদম খাবে বলেছিল, সকাল থেকে উঠে  সেটাই বানালাম। কাজের মধ্যে থাকলেও মন যেখানে যাওয়ার সেখানে পৌঁছেই যায়। সব কথা বিস্তারিত লিখতে চাইনা। লেখা সম্ভবও নয়। হাজার প্রশ্ন মনে জাগে। যার কোনো উত্তর নেই, উত্তর হয় না।
    আবার একটা সকাল, আবার একটা দিন। তুই কাজিকে পছন্দ করিস না জানি, কিন্তু ওর মেয়ে-জামাইকে খুব আপন ভাবতিস, বিশ্বাস করতিস। ওরা তো আরও খারাপ। ওরা আমাদের নামে মিথ্যে বলে বেড়াচ্ছে। ওদের ইন্ধন যোগাচ্ছে আমাদেরি সামনের বাড়ির প্রতিবেশী। জানিস তো, ওই মহিলা বরাবরই আমাদের, বিশেষ করে আমাকে ঈর্ষা করে। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কত নিচে যে নামতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। থাক ওসব কথা, তোর সঙ্গে রাতে কথা হয়, এটুকুই আমার সান্ত্বনা। তুই ভাল থাকিস, আমি আর কিছু চাইনা। 
    আজ প্রায় এক বছরের বেশি সময় পর বাবলিদের এক বন্ধুর বাড়ির অনুষ্ঠানে গেছলাম। তাও বাবলির জোরাজুরিতে। মাড়োয়ারি ওরা, মেয়েটি চেহারা ও বাংলা কথা শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিলনা আমার। অনেকে মিলে আমাকে কবিতা শোনানোর জন্য বলাতে, শোনাতে বাধ্য হলাম। সবাই প্রশংসা ও করল। তাতে কি আমার ব্যথা জুড়লো? তা তো হওয়ার নয়।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
    আজ দীপ নটিংহামের বাইরে একটি পার্কে আমাদের বেড়াতে নিয়ে গেছল।  এখানে অনেক লেকও আছে। শুনলাম মাটির তলায় প্রত্যেকটা লেকের সঙ্গে  প্রত্যেকটার লিঙ্ক আছে। পার্কে কতরকমের ফুল! একটা ভাঙ্গা মঠ রয়েছে, আর রয়েছে কবি বাইরনের বাড়ি, তাঁর প্রিয় কুকুরের সমাধি, আরও অনেক কিছু। উনি হাঁটতে পারছিলেন না, কষ্ট হচ্ছিল। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। আজ  টি- টোয়েণ্টির ফ্যাইনালে কে কে আর জিতেছে। তাই এখানকার প্রবাসী বাঙ্গালিরা খুব খুশি। দেশের বাইরে থাকলে দেশের প্রতি টানটা মনে হয় বেড়ে যায়। আমার তো বাড়েই।
    আজ সকাল থেকেই মেঘলা। এরকম ওয়েদার হলে আরও বেশি মনখারাপ হয়। এখানকার ওয়েদারই এরকম, সারাবছর ধরে হয় বৃষ্টিপাত, নয় তুষারপাত হয়েই চলে। তার মধ্যে টেম্পারেচার মাইনাসে নেমে যায়। এসব মানিয়ে নিয়েই এখানকার মানুষ বেশ আছে।

Post a Comment

0 Comments