জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র- ৩/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                                               
তৃতীয় পর্ব   
     
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                 
              
হয়তো একটা ঝোঁকের বশে অথবা দৈব অভিপ্রায়ে দ্রৌপদী কথাগুলি বলেছিলেন অথবা তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু তখন যা হবার তা হয়ে গেছে। অঙ্গাধিপতি কর্ণ দ্রৌপদীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক তিক্ত মধুর হাসি হাসলেন। অতঃপর সন্তর্পনে ধনুক থেকে জ্যা মুক্ত করে যথাস্থানে নামিয়ে বললেন "কল্যাণী, আপনি সুখী হোন, সুস্থ থাকুন। আমার জন্য আপনাকে মৃত্যু কেন, কোন দুঃখই বরণ করতে হবে না"। তারপর ঊর্ধ্বাকাশে দৃষ্টিপাত করে তাঁর আরাধ্য দেবতা সূর্য দেবতাকে প্রণাম করে সেই সঙ্গে তাঁর অন্তরের বেদনা নিবেদন করে গম্ভীর পদক্ষেপে লক্ষ্যভেদস্থল থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে নিজের আসনে যেয়ে উপবেশন করলেন। আর দ্রৌপদী সেই সময় অনুভব করলেন এত রূঢ় বাক্য প্রয়োগ না করাই বোধহয় বিধেয় ছিল। বাক্যবাণ অপর পক্ষকে কতখানি আহত করতে পারে বিশেষতঃ যিনি সত্যিকারের একজন বীর, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা না করেই তিনি বলেছিলেন অথবা তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু মুখের বাক্য একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। কর্নের উজ্জ্বল মুখশ্রী, আভিজাত্যপূর্ণ পদক্ষেপ, তাঁর ব্যবহার, তার বীরত্ব হয়ত দ্রৌপদীর মনে কোথাও একটু আঁচড় কেটেছিল। কর্ণের জীবনের অন্তিম সময়ে বাসুদেবের কাছে দ্রৌপদী সে কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সে প্রসঙ্গে আমরা যথাসময়ে আসবো।      
       
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
  
এরপর সেই সভাস্থলে ব্রাম্ভনবেশী অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে কৃষ্ণাকে লাভ করে রাজা দ্রুপদের মনের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। স্বয়ংবর সভা শেষে সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজারা ক্ষুব্দ হয়ে একযোগে ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন ও রাজা দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভীমার্জুনের বিক্রমে ধরাশায়ী হয়ে পলায়ন করেছিলেন। পঞ্চপান্ডব দ্রৌপদীকে নিয়ে কুটিরে ফিরে গিয়ে মায়ের আদেশে পাঁচজনে বিয়ে করেছিলেন। সে এক বিরাট ঘটনাবহুল কাহিনী। আমাদের লক্ষ্য মহাবীর কর্ণের জীবনালেখ্য আলোচনা করা। সেই প্রসঙ্গে আসার পূর্বে জানা দরকার দ্রৌপদী কেন কর্ণকে বললেন 'সুতপুত্র'? সত্যই কি কর্ণ সুতপুত্র ছিলেন না ক্ষত্রিয়পুত্র ছিলেন - সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে কর্ণের জন্ম রহস্য উদ্ঘাটন করার পরে।
মথুরা থেকে রাজা কুন্তীভোজের রাজ্য অনতিদূরে। কুন্তী শ্রীকৃষ্ণের বাবা বসুদেবের নিজের বোন। তাহলে মহাভারতকার কেন লিখলেন কুন্তীভোজের কন্যা? আসল কারণ হলো বাসুদেবের ঠাকুরদা বৃষ্ণি বংশের শূর ছিলেন কুন্তীভোজের সখা। কুন্তীভোজের নিজের কোন কন্যা না থাকায় পৃথার জন্মের পরে সখা শূরের কাছে কন্যাটিকে প্রার্থনা করেছিলেন কন্যাসমা পালন করার অধিকারের জন্য। রাজা শূরের অত্যন্ত আদরের হওয়া সত্ত্বেও তিনি কন্যাটিকে দত্তক দিয়েছিলেন বন্ধু কুন্তীভোজকে। যমুনার তীরে বৃষ্ণি বংশের রাজপ্রাসাদ থেকে পৃথা যেয়ে পড়লেন অশ্ব নদীর তীরে কুন্তীভোজের রাজপ্রাসাদে এবং কুন্তীভোজ তাঁকে কণ্যাসম আদরে লালন পালন করেছিলেন বলে সেখানে যেয়ে তাঁর নাম হলো কুন্তী। পরবর্তীকালে হস্তিনাপুরের ছোট রাজকুমার পান্ডুর বধূ হয়ে কুন্তী গেলেন যমুনার তীরে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে। প্রকৃতিতেও কি অদ্ভুত মিল। অশ্বনদী কিছুদূর প্রবাহিত হবার পরে চর্মন্বতীতে যেয়ে মিশে অবশেষে মিলিত ধারা যমুনাতে অবগাহন করেছে।                            
নারীজাতির সেইসময় কোন স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিসত্তা ছিল না, সবকিছু নির্বিকার চিত্তে গ্রহণ করতে হয়েছে। কুন্তীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তিনি নদীর স্রোতের মতো এক নদী থেকে অন্য নদীতে যেয়ে পড়েছেন, কিন্তু কুলভাঙ্গার সামর্থ্য তার ছিল না।   

কুন্তীভোজের রাজ্যে দুর্বাসা মুনি এলেন। রাজা কুন্তীভোজ তাঁর সেবার জন্য তাঁকে রাজপ্রাসাদে অবস্থান করতে অনুরোধ করলেন এবং কখনও যেন সেই কোপন স্বভাব মুনির সেবার কোনো ত্রুটি না হয় তার জন্য তাঁর কণ্যা কুন্তীকে নিয়োজিত করলেন। বেতনভুক দাসীরা যদি কোনো ত্রুটি করে মুণির বিরাগভাজন হয় তাহলে রাজাসহ রাজ্যের সমূহ বিপদ। দুর্বাসা মুনি কুন্তীর সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে যাবার সময় তাঁকে বললেন "কন্যা, তোমার সেবায় আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি আমার কাছে তোমার ইচ্ছামত বর চাও।" কুন্তী বললেন "হে মহামুণি, আপনি যে আমার সেবাতে সন্তুষ্ট হয়েছেন এতেই আমি খুশী"। দুর্বাসা মুনি বললেন "বর যখন নিতে চাইছো না তবে একটা মন্ত্র তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি, এটি শিখে নাও। এই মন্ত্র পাঠ করে যে দেবতাকে তুমি কাছে কামনা করে ডাকবে সেই দেবতা তোমার কাছে আসবেন এবং তোমার কামনা পূরণ করবেন"। এই কথা বলে দুর্বাসা মুণি কুন্তীকে আশীর্বাদ করে রাজা কুন্তীভোজের কাছে বিদায় নেবার সময় বললেন "রাজা তোমার প্রাসাদে আমি খুব আনন্দে ছিলাম এবং তোমার মেয়ে আমার যথেষ্ট সেবা যত্ন করেছে। তার সেবাযত্নে আমি খুব খুশী হয়েছি। কুন্তী মন্ত্রের অর্থ জ্ঞাত হয়ে জানতেন যে এই মন্ত্রের দ্বারা পুত্র উৎপাদন সম্ভব। 
দুর্বাসা মুনি চলে যাবার পরে কুন্তী একদিন কৌতূহলবশত বালিকাসুলভ চাপল্যে দুর্বাসা মুনি প্রদত্ত মন্ত্র পাঠ করে সম্মুখে উদিত অরুণ বর্ণ সূর্যদেবকে আহ্বান করলেন। মন্ত্রের শক্তিতে পূর্বাকাশ থেকে সূর্যদেব কুন্তীর নিকটে এসে বললেন "বরাননে, তুমি আমাকে আহ্বান করেছ সে জন্য তোমার কাছে এলাম"। এই কথা বলে তিনি কুমারী কুন্তীকে সম্ভোগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করতে কুন্তী সভয়ে দেব দিবাকরকে বললেন "প্রভু আমি মুণিপ্রদত্ত মন্ত্রের পরীক্ষার নিমিত্তে আপনাকে স্মরণ করেছিলাম। কৈশোরের চপলতায় আমি এ কাজ করেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে এ কাজ থেকে বিরত হন। তাছাড়া আমি এখন কুমারী, এমতাবস্তায় আমার গর্ভে সন্তান উৎপাদন হলে আমার নিজের এবং বংশের অপযশ হবে"। তাঁর কথা শুনে দেব দিবাকর বললেন "কন্যে তুমি বৃথাই ভয় পাচ্ছো। তোমার এই সন্তান গর্ভদ্বার দিয়ে না প্রসবিত হয়ে তোমার কর্ণের দ্বার দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখবে"। কুন্তী তখন বললেন "প্রভু এই সন্তানকে তো আমি পালন করতে পারব না, সেক্ষেত্রে সে কিভাবে বেঁচে থাকবে। অধিকন্তু ভবিষ্যতে আমি তাকে দেখে কিভাবে চিনতে পারব"? সূর্যদেব বললেন "তোমার আমার এই সন্তান যাতে জীবিত থাকে তার জন্য জন্মানোর সময় আমি তাকে শরীরে অভেদ বর্ম এবং ভবিষ্যতে তোমার যাতে চিনতে অসুবিধা না হয় তার জন্য তার কর্ণে কুণ্ডল এবং ডান হাতের বাহুতে কবচ বিদ্ধ করে দিয়ে পাঠাবো যা দেখে তুমি ভবিষ্যতে চিনতে পারবে"। অগত্যা কুন্তী সূর্য দেবতার কথামতো মিলনে লিপ্ত হলেন। 

কিছুদিন পরে তাঁর গর্ভের লক্ষণ দেখা গেল। তার এই গর্ভের কথা রাজবাড়ীর ধাত্রী একমাত্র জানত। যথানিয়মে সেই সন্তান কুন্তী প্রসব করলেন। সন্তানের মুখ দেখে কুন্তী খুশী হলেন। অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রীযুক্ত অভেদ্য সোনার বর্ম সারা শরীরে, কর্ণে সোনার কুণ্ডল এবং বাহুতে কবচ দেখে কুন্তীর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না এই সন্তানকে ত্যাগ করতে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে সেই ধাত্রীর সাহায্যে একটি পেটিকায় ভরে তার ভেতরের অংশের চারিদিকে মধু লাগিয়ে রাজপ্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে রাত্রির চতুর্থ প্রহরে দুজনে অতি সঙ্গোপনে অশ্বনদীতে ভাসিয়ে দিলেন। যতদূর দৃষ্টি যায় সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কুন্তী। অবশেষে দৃষ্টির অগোচরে যাবার পরে কুন্তী মাতৃহৃদয়ের মর্মবেদনা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশে উদিত সূর্যদেবকে প্রণাম করে বললেন "প্রভু তোমার আমার এই সন্তানকে তুমি চিরদিন রক্ষা করো"। অশ্বনদী কিছুদুর যাবার পরে চর্মন্বতীতে মিশে গেল। সেখান থেকে যমুনা হয়ে গঙ্গায় মিশে যেয়ে সেই পেটিকা ভাসতে-ভাসতে শেষে এসে ঠেকল গঙ্গাতীরস্থ অঙ্গরাজ্যের রাজধানী চম্পাপুরীতে এবং এই অঙ্গরাজ্য ছিল হস্তিনাপুরের করদরাজ্য।
     …….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

2 Comments