জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ /পর্ব – ২৮ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ
পর্ব – ২৮

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


এই মায়াজগতের ভেতর থেকে কবি শ্যামলকান্তি দাশ খুঁজে ফেরেন তার জলমাটি, নদীমাতৃক দেশ।চকলালপুরের রাঙা রাস্তা ছুঁয়ে জলপথ পেরিয়ে রূপকথার রাস্তা ধরে তিনি প্রতিদিন হাঁটতে থাকেন।সেই পাখিটিকে দেখতে পান অমল শৈশবের গায়ে যার পালকের বন্ধুতা লেগে আছে -

‘পাখি বলছে তুমি নেই, তুমি নেই

 কৃষ্ণ হয়ে কোথায় পালিয়ে গেছ।

 হেমন্তের পাকাধানে গড়াগড়ি খাচ্ছে

 তোমার শিখীপাখা

সুদূর ফলসা গাছের ডালে ডালে

দিনভর তোমার ছায়া দুলছে,

গেঁহুখেতের ঘন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে

সোনার আড়বাঁশি।( অদৃশ্য)

সোনার আড়বাঁশিতে বেজে উঠে গানের আকুলতা। তাই গভীর সন্তরণের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির সার্বিক আয়তনকে তুলে আনবার চেষ্টা করেছেন কবি শ্যামলকান্তি দাশ।তিনি প্রকাশ করেছেন সামগ্রিক জীবন,  নিরবচ্ছিন্ন জীবন, যা শুধুমাত্র বর্তমানের ভাসমান সত্তার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে না।স্মৃতির বিচিত্র কর্ষণ,প্রবাহিত চিন্তাধারার যথার্থ উত্থাপন এবং শব্দের সজীবতায় তা হয়ে ওঠে চিরকালীন।  ব্যক্তিগত হয়েও ব্যক্তিনিরপেক্ষ।সত্তার স্বরবর্ণ পেরিয়ে তা অপরতার ব্যঞ্জনবর্ণে রূপান্তরিত হয়। দৃশ্য এবং অদৃশ্য পরিসরের মিথস্ক্রিয়া থেকেই জেগে ওঠে  তাঁর মর্মস্পর্শী উচ্চারণ

মাকে যেদিন শেষ দেখলাম

মা সেদিন খুব কাঁদছে।

চোখের জলে ভারী হয়ে উঠছে কলতলা।

বললাম, মা তোমার কান্না খুব দামি,

যেখানে সেখানে ফেলতে নেই।

গৃহস্থের অকল্যাণ, কান্নারও অপচয়।

ফুলো ফুলো চোখে মা একবার

আকাশভরা চোখে আমার দিকে তাকাল,

তারপর কাঁদতে কাঁদতে এমন একখানা লম্বা হাসি দিল,

মুহূর্তে শূন্য হয়ে গেল পুরো একটা ফুলের বাগান।(হাসিকান্না)

খুব সহজ উচ্চারণে প্রাণের অন্তর্দেশ থেকে অনুভূতির মণিমুক্তা তুলে আনেন কবি শ্যামলকান্তি দাশ। ‘চোখের জলে ভারী হয়ে উঠছে কলতলা’ কী অপূর্ব শাব্দিক মুন্সিয়ানা।এক চিরকালীন মা এবং কলতলার শাশ্বত ছবি উঠে এসেছে শব্দের অনুষঙ্গে । দুই যেন সমার্থক হয়ে গেছে একবিন্দুতে এসে । জল এখানে জীবন ও বেদনার দ্বিঘাত সমীকরণ,  তৃষ্ণা নিবারক এবং সর্বংসহা। অবিকল মায়ের মতো যে তৃষ্ণায় উগরে দেয় বুকের তরল।কবিতা লেখার জন্য জল লাগে। অনুভব নিংড়ে বেরিয়ে আসে  লবনাক্ত জল।শূন্যের ভেতর থেকেই হাসিকান্না এবং সৌন্দর্যবোধকে কীভাবে নির্মাণ করতে হয় জলরঙে শ্যামলকান্তির নির্মাণভঙ্গিতে তারই বিনম্র প্রকাশ


সাজিয়ে দিয়েছি নরম গলা ভাত,

ভাতের মণ্ড ( মা তুমি খাও)


মরে যাওয়ার পর আমাকে একটা

ঠাণ্ডা দিও, আর দিও ঠাণ্ডা ভুলে

যাওয়ার জন্য একটা সহস্রচক্ষু আগুন…( স্বপ্নসম্ভব)


বাড়ির প্রাকার ঘেঁষে খালবিল

শত শত সওদাগর আসে।

কী বলব তোমাকে মাগো, ছেলের কীর্তির কথা,

স্থলে জলে সব লেখা আছে ( কীর্তি)


স্বপ্নের শেষ রাখতে নেই (স্বপ্নদোষ)


মানুষ জানতে চায় আমাদের জেগে ওঠা,পড়ে যাওয়া, জ্ঞানের খবর ( আমাদের কত বই)


 ৬

কী এমন অপরাধ একরাত্রে

হাসতে পারিনি আমি, কাঁদতে পারিনি আমি কী এমন দোষ ?

দৌড়েছি প্রাণের ভয়ে ঊর্ধ্বমুখ পলাতক,

ছোট, ছোট  দিগন্ত ওপার

অপরাধ এরকমই, থামতে দেয় না!

দু’পাশে শত্রুর ছায়া, মাঠভর্তি তৈরি লোক,

লাঠিসোঁটা আর জনরোষ ! ( অপরাধ)


কাঠ হয়ে পড়ে আছে কবি

চোখে- মুখে বাংলার আলো

কাঁটাবনে মুক্তির হাওয়া

কাগজের বাঘ চমকালো!


যদি সারা জীবনের আনন্দ হয়ে ওঠে

একটি দুটি তারা!

ভাবতে ভাবতে সরু রাস্তায় নিবিড় হতে থাকে

রাজহাঁসের ছায়া ( রাজহাঁসের ছায়া)


দু একটা সংঘর্ষ না হলে

জীবনকে ঠিক জীবন মনে হয় না।

১০

এত রাস্তা এত সুড়ঙ্গ এত বাঁক- কেন আমরা

বৃত্ত  আর বলয়ের মধ্যে আটকে রইলাম।

মৃত্যুর বিরুদ্ধে তুমি আরও মৃত্যু

মানুষ অমর।

১১

জলের অধিক জলে দেখলাম দু- চারটি  মোহন ফাটল।

১২

মিলন হল না বলে দিনশেষে দুঃখ হল খুব

চোখে মুখে সাংঘাতিক কালো নেমে এল

মাথা ভিজে জবজবে, গায়ে কোন জামাগেঞ্জি নেই

দাঁড়াতে পারছি না আর, এসে গেল ঘোর বর্ষাদিন

ভিজে উঠবার আগে টুক করে বাড়ি যেতে হবে ( দুঃখ)

১৩

রাক্ষস জমিয়ে আমি একদিন সাংঘাতিক বড়োলোক হব

মেঘে রোদ্রে ঘুরে ঘুরে সারাদিন রাক্ষস জমাই! ( সংগ্রহ) 

         মুদ্রারাক্ষসের এই পৃথিবীতে  আমাদের অর্থসর্বস্বতা  আমাদের আত্মচিন্তা  এতটাই প্রকট হয়ে উঠছে যে আমরা ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। এই পৃথিবীর ভোগদখলের স্বত্ব নিয়ে অবলুপ্ত করে চলেছি প্রাণী বৈচিত্রের পিরামিড। ইতিহাসের পাতাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে এই মরপৃথিবীতে আমরাই ধ্বংস করে যাচ্ছি আমাদের গৌরবময় অতীত।ছিঁড়ে ফেলছি যাবতীয় ঐতিহ্য।শেকড়বিচ্যুত সেই সব মানুষের মূলোচ্ছেদের ধারাবাহিক স্পৃহা কীভাবে আমাদের চেতনাকেই ক্ষতবিক্ষত করছে ‘ডাইনোসরের অমর কাহিনি’ তারই কাব্যিক মানচিত্র। কবি যথার্থই বলেছেন-

  ‘এই আনন্দ দেখব বলেই মরপৃথিবীতে

  আমরা কত বছর জ্যান্ত হয়ে আছি( মানুষ)

 আত্মকেন্দ্রিক জীবনের উল্লাস দেখার জন্যই মানুষের সভ্যতা বেঁচে আছে।প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ এবং ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই সমার্থক হয়ে পড়ছে।মানুষ যেন সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে চায়  তারই প্রতাপের বিজয়কাহিনি। বহুতল আবাসন মাটি থেকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করছে আমাদের দৈনিক সংস্পর্শ। অন্য কারোর নয় শুধু সভ্যতাগর্বী মানুষের ভোগবাদী লালসা গ্রাস করে নিচ্ছে আদিগন্ত পৃথিবীর অধিকার। এর ফল স্বরূপ ডাইনোসরের মতন বিলুপ্ত হতে চলেছে দুনিয়ার প্রাণিসম্পদ  

মাটি যেখানে শেষ আমি একটা আবাসন বানালাম।

আবাসনের নাক খানিকটা উঁচু,

মাথা খানিকটা দোলায়মান,

চোখগুলো ঘোলাটে হলে কী হবে,আঁখির মতো আয়ত।

গাছের শেষে আমি আরও একটা গাছ লাগালাম। ( দিনপঞ্জি)

নিজের লিপ্সাকে চরিতার্থ করার জন্য আকাশের নীচে আমরাই বিস্তার করে রেখেছি লালসার জাল।  কবি শ্যামলকান্তি দাশ জীবনের নিবিড়তা এবং অস্তিত্বের জিজ্ঞাসাকে যেভাবে প্রণালীবদ্ধ করেছেন তাঁর কাব্যিক বীক্ষণে তা আমাদের সচকিত করে, সতর্ক করে


আমরা তার অসহনীয় মিলন শুনব বলে

অনেকক্ষণ ধরে আকাশের নীচে জাল ছড়িয়ে রেখেছি ( সে কাঁদছে, সে হাসছে )


এতদিন পর মানুষের এত রহস্য, এত ঘোঁট পাকানো

তার একটুও সহ্য হয় না।

ডাইনোসর আবার জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।( একা একা )


ওগো নগ্নতা, ওগো সত্যিকারের নগ্নতা

তীরধনু নিয়ে মহাসড়কের দিকে

                           ধেয়ে যাচ্ছি ( অতিক্রম )

আমরা তাকে দরজা দিতে পারিনি, জানলা দিতে পারিনি

কিন্তু ভবিষ্যৎ রচনার জন্য

অনেকখানি চাঁদের আলো দিয়েছিলাম। (একা একা )


তোমার কপালে চাঁদের লেখা,

একলক্ষ বছর পরে দাক্ষিণাত্যের গ্রামে

তুমি অকস্মাৎ বেড়াতে এসেছ ডাইনোসর ( বেড়াতে এসেছে ডাইনোসর)


জনমানবশূন্য ঘরে

ছড়িয়ে আছে পাকুড়পাতা

কোথায় তোমার হারমোনিয়াম

কোথায় তোমার গানের খাতা

 

উচ্ছে গাছে কাঁপছে ফিঙে

ধানের মাঠে বৃষ্টি পড়ে

ভূতের মতো চাঁদ উঠেছে

জনমানবশূন্য ঘরে।


বোন তোর ক্ষীরে ক্ষারে আছে

মাকে তোর কাগাবগা  খায়

মিছিলের আগে আগে বাবা

স্বপ্নের পতাকা ওড়ায় ( বাবা)


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

সভ্যতার এই সংকটই শেষ কথা হতে পারে না বরং তা থেকে পরিত্রাণের পথই হচ্ছে চিরন্তন সত্য। এই জগত আমরাই তৈরি করেছি আমাদের প্রয়োজনের সমবায়িক ভাবনা থেকে। কোন অস্থির ভবিষ্যতের ক্ষমতা নেই আমাদের হাহাকারের মধ্যে নিক্ষেপ করার, সে রাস্তা যত লম্বাই হোক এক লক্ষ বছরের দীর্ঘ রাস্তা হলেও কপালের চাঁদের লেখা নিয়ে অতীতের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে । ডাইনোসর মানে আমাদের ঐতিহ্যচেতনা যা অমর, যার বিনাশ নেই। প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে লৌহনগরীর মাঝে আত্মঘাতী রাক্ষস দাঁড়িয়ে থাকলেও তার দৃষ্টিতে কোন ক্রুরতা নেই বরং তার চোখ ভর্তি আকাশ, সুন্দরের আবির উড়ছে। তার চোখ ফেরানো রয়েছে শেকড়ের দিকে, বাসভুমির দিকে। এই নাগরিক সভ্যতার ভেতর তিনি শব্দে শব্দে গড়ে তুলছেন গ্রামীণ মানচিত্র। ধোঁয়া ও বারুদ থেকে ভালোবাসা প্রাণ খুলে’ দেখার এক আর্তি তাঁর কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে।      

 হাহাকারের পথ টানা আর লম্বা,

খেজুরতলার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে

সরু আর দীর্ঘ-

মাঝে মাঝে গোধূলি, সুন্দরের আবির উড়ছে।

লৌহনগরীর এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে রাক্ষস,

তার চোখভর্তি আকাশ,

মাথাভর্তি সূর্যাস্ত,

সে অনেকখানি আনন্দ দিয়ে তোমাকে

          আগের মতো দেখছে। (রাস্তা)

Post a Comment

0 Comments