জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৫৯ / প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৯

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 সুবোধ মাস্টারমশাইয়ের ( শ্রীম ) কাছে গিয়ে সব কথাই বিস্তারিত বললেন। সব শুনে মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “তাই তো, সমুদ্রে যায় লোকে, কেউ জালা নিয়ে, কেউ কলসি নিয়ে, কেউ ঘটি নিয়ে। যার যার পাত্র ভরে জল নিয়ে আসে, আর সবাইকে সেই জলেরই একটু একটু দেয়। অন্য জল কোথায় পাবে? আমরা সামান্য মানুষ, তাঁর কাছে যা একটু-আধটু শুনেছি তা ছাড়া আর অন্য কোথায় পাব? এই যে এতটা পড়াশুনা করলুম, তাঁর কাছে গিয়ে সবই তো মিথ্যা হয়ে গেল। লেখাপড়া শিখে মনে হয়েছিল, দুনিয়ার সব তত্ত্বই জেনে ফেলেছি। ও মা, তাঁর সঙ্গে কথা কয়ে দেখলুম, সব বিদ্যা অবিদ্যা, যে বিদ্যায় ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়, অবিদ্যা অন্ধকার দূর হয়, সেই বিদ্যাই বিদ্যা। তাঁর একটি কথায় সব ভেসে গেল, মনে হলো কি আশ্চর্য এই বিদ্যা নিয়ে মানুষের এত অহঙ্কার হয়!”
 কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গলায় কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে অবস্থান করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। উদ্যানবাটী ভাড়া নেওয়া হয়েছে তাঁর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। ভক্তেরা সকলেই খুব চিন্তিত। বালকভক্ত সুবোধ একদিন ঠাকুরকে বললেন, “আপনি দক্ষিণেশ্বরে যে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকতেন, তাই আপনার গলা ব্যথা হয়েছে। আপনি চা খান। আমাদের গলা ব্যথা হলে, আমরা চা খাই, গলা ব্যথা সেরে যায়।” শ্রীশ্রীঠাকুর বালকস্বভাব ছিলেন, সহজেই এই কথায় স্বীকৃত হলেন। বললেন, “তবে চা-ই খাই। ও রাখাল, এ বলচে চা খেলে না কি গলা ব্যথা সেরে যাবে।” রাখাল উত্তর করলেন, “সে কি আপনার সহ্য হবে? সে যে গরম জিনিস।” শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “না বাবু, তাহলে -- আবার উল্টৈ গরম হয়ে যাবে। ( সুবোধের প্রতি ) ও রে, সইলোনি।” ( অর্থাৎ চা সহ্য হইল না ) 
( স্বামী সুবোধানন্দের স্মৃতিকথা-স্বামী চেতনানন্দ সঙ্কলিত, উদ্বোধন কার্যালয় )

 ১৮৮৬ সালের ১৬ অগাস্ট  কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীশ্রীঠাকুর মহাসমাধি লাভ করেন। এই সময় সুবোধের বয়স ছিল উনিশ বৎসর। ঠাকুরের দেহরক্ষার পরবর্তী সময়ের ঘটনা -- সুবোধ একদিন বাড়ি থেকে নিষ্ক্রান্ত হন। ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী মা'কে প্রণাম করে যখন যাত্রা করবেন, তখন দেখেন মা হাসছেন। হাস্যমুখী জগজ্জননী যেন তাঁর মস্তকে অভয়কর স্থাপনপূর্বক বলছেন, “ভয় কি, আমি তোর সঙ্গে আছি। তোর কোনও ভয় নেই।” মায়ের নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুবোধ। পায়ে হেঁটে এসে উপনীত হন কাশীধামে। সেই সময় লোকসঙ্গ বিষতুল্য জ্ঞান করতেন। কেউ পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, “ মা, বাপ, ভাই, বোন তিন কুলে আমার কেউ নেই।” কাশীতে এসে গঙ্গাস্নান ও বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণা দর্শন করে কিছু শান্তিলাভ করেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজন সংবাদ পেয়ে তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এদিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাসমাধির কিছুদিন পরেই কলকাতা ও দক্ষিণেশ্বরের মধ্যবর্তী বরানগর নামক স্থানে একটি পুরনো জীর্ণদশাপ্রাপ্ত ভাড়াটিয়া বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরের ত্যাগী সন্তানেরা তাঁর স্মৃতিচিহ্নগুলি একত্র করে ধ্যান, জপ, পূজা, পাঠ ও তপস্যায় রত হন। স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের সূচনা এখানেই। ক্রমে সুবোধও এসে মঠে যোগদান করেন এবং অন্যান্য ত্যাগী গুরুভ্রাতাদের ন্যায় বিরজা হোম সম্পন্ন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস নাম হয় স্বামী সুবোধানন্দ। ১৮৮৬ সাল থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ বরানগরে স্থাপিত ছিল। ১৮৯২ সালে স্থানান্তরিত হয় আলমবাজারে। ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত আলমবাজারে মঠ ছিল। তারপর ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখার্জির ভাড়াটিয়া বাগানবাড়িতে এবং অবশেষে ১৮৯৯ সালে বর্তমান বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রধান কেন্দ্র স্থাপিত হয়। মঠের সন্ন্যসীগণ কখনও মঠে অবস্থান করে তপস্যা করতেন, কখনওবা তীর্থ পর্যটনে এদিক ওদিক যেতেন। ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সুবোধানন্দজী স্বামী ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে প্রব্রজ্যায় বের হয়ে দ্বিতীয়বার কাশীধামে আসেন। কাশীতে তাঁরা প্রমদাদাস মিত্রের বাগানবাড়িতে থেকে কিছুকাল তপস্যায় অতিক্রান্ত করেন। ১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁরা ওঁকার, গির্নার, আবু, বম্বে ও দ্বারকা দেখে বৃন্দাবনে অবস্থান করছিলেন এবং ভক্তপ্রবর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখন সেখানে। এরপর সুবোধানন্দজী ৺কেদারনাথ ও ৺বদরীনারায়ণ দর্শনে বেরিয়ে পড়েন। কিছুদিন হিমালয়ে কাটিয়ে মঠে ফিরে আসেন এবং দাক্ষিণাত্যের তীর্থপর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। যাই হোক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে পরিব্রাজক জীবন সমাপনান্তে ১৮৯৭ সালের ২৩ মার্চ মাদ্রাজ হয়ে মঠে ফিরে আসেন।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
 এই সময় আলমবাজার মঠের একটি ঘটনা বিষয়ে শ্রীমৎ স্বামী গম্ভীরানন্দজী ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থে লিখছেন -- “ইতোমধ্যে স্বদেশ প্রত্যাগত স্বামীজী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে নবযুগে নবমন্ত্র-প্রচারের উপযুক্ত যন্ত্ররূপে গড়িয়া তুলিতেছিলেন। আলমবাজার মঠে বক্তৃতা-শিক্ষার জন্য তখন প্রতি সপ্তাহে অধিবেশন হইত এবং সন্ন্যাসীদিগকে পর্যায়ক্রমে বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইতে হইত। স্বামী সুবোধানন্দ তখন মঠে ছিলেন। একদিন তাঁহার পালা আসিলে তিনি অব্যাহতি পাইবার জন্য বহু চেষ্টা করিলেন, কিন্তু স্বামীজীর মত পরিবর্তিত না হওয়ায় নিরুপায় হইয়া কম্পিতহৃদয়ে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু এ কি! পদতলে ভূমি কম্পমান কেন? আর দূরে ঐ শঙ্খধ্বনিই বা উত্থিত হইল কেন? ক্রমে পুষ্করণীর জল পর্যন্ত তীর অতিক্রম করিয়া আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। ততক্ষণে কাহারও বুঝিতে বাকী ছিল না যে, ইহা প্রচণ্ড ভূমিকম্প ( ১২ই জুন, ১৮৯৭ )। সভা ভাঙ্গিয়া গেল এবং খোকা মহারাজ নিষ্কৃতি পাইলেন। কিন্তু ইহাতেও গুরুভ্রাতারা আনন্দোপভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন না। কম্পান্তে স্বামীজী সহাস্যে বলিলেন, ‘খোকার বক্তৃতায় পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল।’ সে মন্তব্যে খোকা মহারাজ পর্যন্ত হাসিয়া আকুল হইলেন।”
 বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার পর ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর যে এগারো জন গুরুভ্রাতাকে মঠের ট্রাস্টি নিযুক্ত করেন, স্বামী সুবোধানন্দ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। স্বামী শিবানন্দজী ( মহাপুরুষ মহারাজ ) সঙ্ঘাধ্যক্ষ থাকাকালীন খোকা মহারাজ ( স্বামী সুবোধানন্দ ) সম্পর্কে স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দজী স্মৃতিকথায় ( স্বামী সুবোধানন্দজীর স্মৃতিকথা, স্বামী চেতনানন্দ সঙ্কলিত, উদ্বোধন কার্যালয় ) জানাচ্ছেন --“তিনি বাস্তবিকই খোকার মতনই ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গেই পঙ্গতে বসিয়া খাইতেন এবং সকল বিষয়ে আমাদের মতনই ব্যবহার করিতেন। তখন তাঁহার কোনও সেবক ছিল না। আমাদের ডাকিয়া মাঝে মাঝে তাঁহার চিঠি লেখাইতেন। কিন্তু পাশের ঘরে মহাপুরুষ মহারাজের যাহাতে কোনরূপ অসুবিধা না হয় সেদিকে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখিতেন ও অনুচ্চ স্বরেই আমাদিগকে তাঁহার চিঠির মর্ম বলিয়া যাইতেন। এমন সময় যদি পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজ আমাদের ডাকিতেন তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহার চিঠি লেখা বন্ধ করিয়া তাঁহার নিকট যাইতে বলিতেন। তিনি তামাক খাইতেন কিন্তু কখনও তাঁহাকে পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজের সম্মুখে তামাক খাইতে দেখি নাই। পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজের সহিত আচরণেও তাঁহাকে খোকার মতন ব্যবহার করিতে দেখিয়াছি। একদিন ঢাকা হইতে কয়েকটি ভক্ত পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজকে সেখানে লইয়া যাইবার অনুরোধ করিতে আসায় তিনি তাঁহার শরীর অসুস্থ বলিয়া সেখানে যাইতে অস্বীকার করেন ও পূজনীয় খোকা মহারাজের ঘরে আসিয়া বলেন যে, ‘খোকা, এই সকল ভক্তরা ঢাকা হতে সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। তা আমার তো শরীর খারাপ তুই একবার সেখানে যা না।’ তাহাতে খোকা মহারাজ তাঁহার চোখ দুটি বড় বড় করিয়া বলিলেন, ‘ না, না, আমি সেখানে যেতে পারব না। সেদিকে যেতে যে বড় বড় নদী পড়ে তা দেখলে আমার ভয় করে।’ পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজও খোকা মহারাজের খোকাত্ব বুঝিয়া আর এই বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করিলেন না।”

Post a Comment

0 Comments