জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬০/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬০

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 পরিণত বয়সেও খোকা মহারাজ দীক্ষাদান করতেন না। দীক্ষার্থীকে বলতেন, “আমি কি জানি? আমি যে খোকা। তোমরা রাখাল মহারাজ কিংবা মায়ের কাছে নিও -- তাঁদের আধ্যাত্মিকভাব খুব উঁচু।” শ্রীশ্রীমা বলেছিলেন, “খোকা কেন মন্ত্র দেয় না? যে কদিন তাঁর ( ঠাকুরের ) ছেলেরা আছে, যে পায় লুটে নিক।” ( শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় ) এতদসত্ত্বেও খোকা মহারাজ দীক্ষাদানে প্রয়াসী হন নি। তবে দু'একটি ক্ষেত্রে অন্তরের তাগিদে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে পূর্ববঙ্গে যান। তৎকালীন সঙ্ঘগুরু স্বামী শিবানন্দজীর নির্দেশে সেখানে দীক্ষাপ্রার্থীদের কৃপা করেছিলেন। এখানে একটি অদ্ভুত দীক্ষাদানের ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে জনৈক ভক্তের বয়ানে -- “শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম শিষ্য শ্রদ্ধেয় খোকা মহারাজকে আমি প্রথম দেখি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলায় বালিয়াটি গ্রামে। কয়েক বৎসর হইল এই গ্রামে একটি রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম স্থাপিত হইয়াছে। আশ্রমের উদ্যোক্তাগণ রামকৃষ্ণ মঠ হইতে সাধু-মহারাজদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইতেন। এ পর্যন্ত তাঁহারা যথেষ্ট যত্ন ও চেষ্টা সত্ত্বেও শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্তরঙ্গ শিষ্যদের মধ্যে কাহাকেও আনিতে সক্ষম হন নাই। এই জন্য যখন শুনিলাম যে, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এক শিষ্য আসিতেছেন, তখন আমাদের উৎসাহ ও উদ্বেগের অন্ত ছিল না। খোকা মহারাজ সম্বন্ধে বহু কথা তাঁহার আসিবার পূর্বেই লোকমুখে প্রচারিত হইল। শুনিলাম শ্রীশ্রীমা নাকি পা ছড়াইয়া বসিয়া মুড়ি খাইতেন, আর যেই একটা মুড়ি ডালা হইতে পড়িত, তাহাই ইনি কুড়াইয়া কুড়াইয়া মুখে দিতেন। এইরূপে অনেক বিষয় যাহা শুনিলাম, তাহাতে তিনি নামেও যেমন খোকা, কাজেও তেমনই খোকা, ইহাই মনে বদ্ধমূল হইল। আমরা এই খ্যাতনামা বৃদ্ধ খোকা মহারাজকে দেখিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া রহিলাম।
 তখন আমি স্থানীয় স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ি -- প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হইতেছি। আশ্রমে যথাশক্তি সেবাকার্যাদি করিতাম। একদিন বিকালবেলায় যথানিয়মে আশ্রমে যাইয়া দেখি, খুব সমারোহ, সেবকগণ ছুটাছুটি করিতেছেন, দর্শনার্থী লোকের বিশেষ ভিড়, ঘরে ঢুকিতে পারিলাম না। উঁকি মারিয়া দেখিলাম, একঘর লোক বসিয়া আছেন, একধারে একটি তক্তপোশের উপর বেশ ভাল বিছানা পাতা, তাহার উপর একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বসিয়া আছেন, দুইজন সেবক দুই দিক হইতে দুইটি বড় বড় পাখা ধীরে ধীরে চালাইতেছেন। ... নিকটে বসিয়া কথাবার্তার সুযোগ হইল না, এজন্য একটু মনক্ষুণ্ণ হইয়া ফিরিয়া আসিলাম। পরদিন সকালবেলা কিছু পয়সা লইয়া চলিয়াছিলাম বাজারের দিকে -- মিষ্টি কিনিবার জন্য। ভাইবোনও সঙ্গে ছিল। আশ্রমের ধার দিয়া যাইতেছিলাম। ইচ্ছা ছিল, আশ্রমে উঠিয়া সন্ন্যাসীকে দেখিয়া ও প্রণাম করিয়া যাইব। আশ্রমে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সেই পূর্বের ঘরে একাকী বসিয়া আছেন। আমরা উঁকি মারিয়া দেখিতেই তিনি ডাকিলেন, ‘আয় আয়, তোরা এদিকে আয়।’ আমি সাহস করিয়া তাঁহাকে যাইয়া প্রণাম করিলাম। নিজে প্রণাম করিয়া ছোট ছোট ভাইবোনেদের ডাকিয়া আনিয়া প্রণাম করাইলাম। তাহারা প্রণাম করিয়া ঘরের বাহিরে গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তিনি আমাকে দুই-এক কথা কি যে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহা এখন আমার মনে পড়িতেছে না। সম্ভবত পরিচয় ও কি পড়ি, তাহাই জিজ্ঞাসা করিয়া থাকিবেন। হঠাৎ তিনি তক্তপোশের উপর হইতে নামিয়া আসিয়া সস্নেহে আমার কাঁধে হাত দিয়া কানের নিকট মুখ রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দীক্ষা নিবি?’ আমি তখন একেবারে ছোট নেই। ধর্মপুস্তক কিছু পড়িয়াছি। বয়স ১৫ হইতে ১৬ -র ভিতর। সুতরাং এই প্রশ্নের অর্থ বুঝিতে পারিলেও, ইহা অপ্রত্যাশিত বলিয়া একটু চমৎকৃত হইয়াছিলাম। আমি সামনের দিকে মাথা বাঁকাইয়া উত্তর করিলাম, ‘আচ্ছা।’ আমাদের উভয়েরই খালি গা এবং উভয়েই দাঁড়াইয়া। তিনি আমার নিকট ঘেঁসিয়া আসিয়া কানে মৃদুস্বরে একটি মন্ত্র বলিলেন ও আমার বুঝিবার জন্য দুই তিনবার উচ্চারণ করিলেন। যখন দেখিলেন বুঝিতে পারিয়াছি, তখন বলিলেন, ‘আজ পূর্ণিমা, বেশ ভাল তিথি -- ভালোই হলো।’ এই বলিয়া জলপাত্র হইতে গঙ্গাজল লইয়া নিজে একটু পান করিলেন, আমার মুখেও কিছু ঢালিয়া দিলেন এবং পরে বলিলেন, ‘দীক্ষা নিলি, দক্ষিণা দিবিনে।’ আমি একটু অপ্রস্তুত হইলাম। পরক্ষণেই স্মরণ হইল, আমার নিকট একটা সিকি আছে, তাহাই দিতে চাহিলাম। তিনি একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘থাক থাক তোর দিতে হবে না, তুই রেখে দে।’ আমি পুনরায় তাঁহাকে প্রণাম করিলাম, তিনি মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন ও বলিলেন, ‘আবার আসিস’।” ( স্বামী সুবোধানন্দের স্মৃতিকথা, স্বামী চেতনানন্দ সঙ্কলিত, উদ্বোধন কার্যালয় )

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

 শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি সুবোধানন্দজীর অপরিসীম ভক্তি ছিল। ১৮৯১ সালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও স্বামী নিরঞ্জনানন্দজীর সঙ্গে জয়রামবাটী গিয়েছিলেন। ১৯১১ সালে দক্ষিণ ভারতে তীর্থ দর্শনান্তে শ্রীশ্রীমা বেলুড় মঠে আসেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দজী মায়ের অভ্যর্থনার জন্য সুবন্দোবস্ত করেন। মন্দির ( বেলুড় মঠে ঠাকুরের পুরনো মন্দির ) সুসজ্জিত করা হয়। সাধু-ভক্তরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, শ্রীশ্রীমা মঠ  প্রাঙ্গন দিয়ে ধীরপদে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ব্রহ্মানন্দজী ঘোষণা করেছিলেন কেউ যেন মায়ের পদধূলি  গ্রহণের নিমিত্ত সারি ভঙ্গ না করে। হঠাৎই যেমন করেই হোক সারির পশ্চাদভাগ থেকে ছুটে এসে কে যেন মায়ের পদধূলি নিমেষে গ্রহণ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্রহ্মানন্দজী বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন, “কে ও? ধর ওকে।” সকলে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল সুবোধানন্দজীর বালক স্বভাব দেখে। কারণ সেই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, স্বয়ং খোকা মহারাজ।
  ইতিমধ্যে বিভিন্ন ব্যাধিতে জর্জরিত হতে থাকেন সুবোধানন্দজী। মধুমেহ, রক্ত আমাশয় ইত্যাদি। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাব প্রসারের উদ্দেশ্যে দীক্ষাগুরু হিসেবে বাংলা, বিহার এবং উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন। একটি পত্রে লিখছেন তাঁর ব্যাধির কারণ অতিরিক্ত শ্রম। একটুখানি হাঁটবার সময়ও পান না। সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত একটানা মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, অধ্যাত্ম পথে কীভাবে এগোতে হবে বলেছেন। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিহারের জামতারা কেন্দ্রে গিয়ে অবস্থান করেন। একদিন শারীরিকভাবে তাঁর পরিস্থিতি বেশ সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে, তাঁর সেবক সেই সময় পাখায় হাওয়া করছিলেন। হঠাৎই তিনি সেবককে বলে ওঠেন, “আমাকে বিছানা থেকে তোল। ঠাকুর, মা, ব্রহ্মানন্দজী এসেছেন, দেখতে পাচ্ছ না?” পরে সেবককে বলেন, ঠাকুর তাঁকে বলেছেন যে শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন।

 ১৯৩১ সালের শুরুর দিকে তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। সমস্তরকম চিকিৎসা সত্ত্বেও তাঁর শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকে। দেহত্যাগের ( ১৯৩২ সাল, শুক্রবার, দুপুর ৩ টে ৫ মিনিটে, বেলুড় মঠ ) পূর্ব রাত্রিতে সুবোধানন্দজী বলেন, “আমার শেষ প্রার্থনা, সঙ্ঘের উপর ঠাকুরের আশীর্বাদ সতত যেন বর্ষিত হয়।” বস্তুতপক্ষে তিনি ছিলেন শ্রীমকৃষ্ণদেবের শিশুস্বভাবসম্পন্ন এক দিব্য তনয়।

Post a Comment

0 Comments