জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ব্রাজিল (দক্ষিণ আমেরিকা)/বাঘ আর হরিণের ঘরবাড়ি /চিন্ময় দাশ


দূর দেশের লোকগল্প—  ব্রাজিল (দক্ষিণ আমেরিকা)
বাঘ আর হরিণের ঘরবাড়ি

চিন্ময় দাশ

ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় পাহাড় হোল নেবলিনা। পাহাড়টার একেবারে গোড়ার দিকে থাকে বড়সড় এক হরিণ (ব্রাজিলের বিখ্যাত রেড ডিয়ার)। যেমন তার বিশাল চেহারা, তেমনই তার শিং জোড়া। সে কী বাহার তার শিংয়ের! অজস্র শাখা-প্রশাখা। সেগুলোর প্রত্যেকটা ডগা যেমন সূচালো, তেমনি শক্ত। পুরোপুরি এক বোঝা শিং মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় হরিণটা।
একদিন হরিণটার মনে হোল, আচ্ছা, নিজের একটা ঘর নাই কেন আমার? মোটেই ভালো লাগে না। ঘর নাই, তাই তো এখানে ওখানে রাত কাটাতে হয় আমাকে। যেভাবেই  হোক, এবার একটা ঘর বানাতেই হবে আমার। 
ঘর বানাবো বললেই তো আর হোল না। উপযুক্ত একটা জায়গা বেছে বের করতে হবে সবার আগে। প্রত্যেকটা পাহাড়ে ঢুঁ মেরে বেড়ালো হরিণ। প্রত্যেকটা চাটান ঘুরে বেড়ালো। কাছে পিঠে যে ক’টা নদী আর ঝোরা আছে, সবগুলোর কাছে গেল। বড়সড় গাছের তলাও। বাকি রইল না কিছু। জুতসই জায়গা না হলে কি আর বাড়ি বানানো যায়? 
অনেক ঘুরে অনেক খুঁজে, শেষমেষ একটা জায়গা  মনে ধরল হরিণের। জায়গাটা খুব উঁচুতে নয়, খুব নীচুতেও নয়। কোন নদী-ঝোরার একেবারে গা ঘেঁষে নয়, আবার তেমন দূরেও নয়। ঘন গাছপালার ভিতরে নয়, আবার উদোম খোলা প্রান্তরে গণগণে সূর্যের নীচেও নয়। ভারি মনে ধরে গেল জায়গাটা। 
বাহ, এখানেই বাড়ি বানাব আমি। বেশ জায়গাটা। এই ভেবে কাজে লাগে পড়ল। সাফসুতরো করার কাজ শুরু করে দিল। এক নাগাড়ে সারাদিন কাজ চলল। সূর্য ডুবে অন্ধকার না নামা পর্যন্ত থামল না। 
হয়েছে কী, ঐ নেবলিনা পাহাড়ের জঙ্গলে একটা বাঘও থাকে। যেমন দশাসই তার চেহারা, তেমনি রাজসিক চাল-চলন। ধারালো দাঁত, আর হিংস্র চাউনির একজোড়া উজ্বল চোখ। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
একদিন বাঘটারও মনে হোল, দূর এভাবে কত দিন চালানো যায়? নিজের একটা ঘর নাই আমার। ছোটাছুটি করে শিকার ধরে, ফিরে এসে বিশ্রাম করব, তেমন জুতসই কোন জায়গাই নাই আমার। এবার একটা ঘর বানাতেই হবে। 
বানাবো বললেই তো আর ঘর বানানো যাবে না। তার জন্য উপযুক্ত জায়গা দরকার। প্রথমে তেমন একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। 
প্রত্যেকটা পাহাড়ে ঢুঁ মেরে বেড়ালো হরিণ। প্রত্যেকটা চাটান ঘুরে বেড়ালো। কাছে পিঠে যে ক’টা নদী আর ঝোরা আছে, সবগুলোর কাছে গেল। বড়সড় গাছের তলাও। বাকি রইল না কিছু। জুতসই জায়গা না হলে কি আর বাড়ি বানানো যায়?
অনেক খোঁজাখুঁজির পর, শেষমেষ পাহাড়তলির সেই জায়গাটাই মনে ধরল বাঘের। জায়গাটা খুব উঁচুতে নয়, খুব নীচুতেও নয়। কোন নদী-ঝোরার একেবারে গা ঘেঁষে নয়, আবার তেমন দূরেও নয়। ঘন গাছপালার ভিতরে নয়, আবার উদোম খোলা প্রান্তরে গণগণে সূর্যের নীচেও নয়। ভারি মনে ধরে গেল জায়গাটা।
বাঘ বেশ খুশি। নিজেকেই নিজে বলল—এখানেই ঘর বানাব আমি। মোটামুটি পরিষ্কারও আছে দেখছি জায়গাটা। 
রাজার বাড়ি বলে কথা। আরও যতটা পারা যায়, পরিষ্কার করতে লেগে পড়ল বাঘ। একেবারে সূর্য ওঠা পর্যন্ত কাজ করে, বেরিয়ে গেল বাঘটা। 
সকাল হয়েছে। এবার হরিণ এসে হাজির হোল সেখানে। জায়গাটা দেখে ভারি খুশি। কী আনন্দ, কেউ একজন দেখছি সাহায্য করছে আমাকে। জায়গাটা একেবারে নিকিয়ে রেখে গেছে যেন। এবার নিশ্চিন্তে ভিতের কাজটা শুরু করে দেওয়া যেতে পারে। 
সারা দিন ধরে বাড়ির ভিত তৈরি করল হরিণ। সন্ধ্যা নাগাদ ভিত তৈরির কাজ শেষ। হরিণ চলে গেল সেদিনের মত।
রাত নামলে, বাঘ এসে হাজির কাজের জায়গায়। জায়গাটা দেখে বাঘ ভারি খুশি। বাহ, কেউ একজন দেখছি সাহায্য করছে আমাকে। পুরো ভিতটা গড়ে দিয়ে গেছে। তাহলে আর কী, দেওয়াল তুলে ফেলা যাক।
কাজে লেগে পড়ল বাঘ। সারা রাত কাজ চলল বাঘের। ভোর বেলা যখন থামল, চারদিকের দেওয়াল গড়া হয়ে গেছে। সামনে একটা দরজা, আর পিছন দিকে ছোট্ট একটা জানালাও আছে। 
একবার ঘরটার চারদিকে চক্কর কেটে দেখে নিল, কাজটা ঠিমমত হচ্ছে কি না। তারপর চলে গেল হেলেদুলে।
সকাল হতে, হরিণ এসে হাজির। তার তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। স্বপ্ন-টপ্ন দেখছি না তো? এই ভেবে চোখ দুটোকে দু’চারবার বুজিয়ে খুলে, ভালো করে দেখে নিতে লাগল। তাতেও যেন মনের ধন্দ কাটে না! 
নিশ্চয় কেউ আমার উপকার করে যাচ্ছে। কিন্তু কে সে? দেওয়াল তুলে দিয়েছে। মাপসই একটা দরজাও। হা-হা, তার সাথে পুঁচকে একটা জানালাও দেখছি আবার! ঘরে খিল তুলে বসেও, বাইরেটা দেখা যাবে। দারুণ মজা!
সারাদিন ধরে ঘরের মাথায় ছাউনি চাপানো চলল হরিণের। সন্ধ্যার মুখে থামল যখন, শুকনো ঘাসের পরিপাটি চাল গড়ে উঠেছে ঘরটার মাথায়। 
হরিণ বলল—বাহ, দারুণ হয়েছে তো! এবার থেকে নিশিন্তে ঘুমানো যাবে ঘরটাতে। তাহলে আর দেরি কেন? আজ থেকেই শুরু করে দেওয়া যাক। বলেই, ঘরের একটা কোনের দিকে নিজের বিছানা পেতে, শুয়ে পড়ল হরিণ। 
সারা দিন খাটুনি গেছে। শোয়া মাত্র গভীর ঘুমের কোলে চলে গেল। 
রাত্রে বাঘ এসে হাজির। নিজের চোখকে তারও বিশ্বাস হচ্ছে না। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে দেখল বাড়িটাকে। কে এমন সাহায্য করছে আমাকে? কেমন সুন্দর করে চাল গড়ে দিয়েছে বাড়িটার মাথায়! 
যাকগে যাক। যেই গড়ুক, হয়ে তো গেছে। এবার ভালো করে তো ঘুম লাগাই একটা। এই বলে ভিতরে ঢুকে পড়ল বাঘ। ঢুকেই একটু থমকে গেল। কোণের দিকে তাগড়াই একটা হরিণ ঘুমিয়ে আছে না? 
গরগরে রাগী গলায় বাঘ বলল—কেরে তুই? এখানে আমার ঘরে ঢুকেছিস কেন?
এমন পাকা ঘুমটা ভেঙে গেলে, কারই বা ভালো লাগে? হরিণের মেজাজ গেল খিঁচড়ে। সে চেঁচিয়ে উঠল—তুই কে? আমার ঘরে ঢুকেছিস কেন? 
--এটা তোর ঘর নয়। আমার ঘর। আমি নিজে বানিয়েছি এটা। 
--এটা আমার ঘর। হরিণ বলল—আমি এটা বানিয়েছি। 
--বললেই হোল? জমিসাফ করা। দেওয়াল তোলা আমিই তো করেছি। এই যে দরজা, ওদিকে তোর মাথার কাছে যে জানালাটা, কে করেছে? আমিই তো করেছি। 
--জমি সাফ করার কাজ তো আমি শুরু করেছিলাম। ভিত গড়েছি আমি। আজ সারাদিন ধরে, শুকনো ঘাস বয়ে বয়ে এনে ঘর ছাওয়া, সে তো আমিই করলাম!
সারা রাত ধরে তর্ক চলল দুজনের। কেউ দাবি ছাড়তে রাজি নয়। হার মেনে নিয়ে, চলে যেতে রাজি নয় কেউ। তর্কাতর্কিতে সকালই হয়ে গেল। কী করা যায়? অগত্যা একটা ফয়সালায় পৌঁছালো দুজনেই। কেউ ছেড়ে যাবে না। কেউ একা দখল করবে না। একটা ঘর। দুজনে মিলেই থাকবে ঘরটাতে। 
সেদিন রাতেই শুরু হোল দুজনের একসাথে থাকা। রাত গেল। পরের দিনটাও কেটে গেল নির্বিবাদেই। রাত শুরু হলে, বাঘ বলল—আমি শিকারে যাচ্ছি। ফিরব যখন একেবারেই কাহিল হয়ে যাব। ঝরণা থেকে জল তুলে আনবি। আর শুকনো কাঠ জোগাড় করে আনবি এক বোঝা। আগুন জ্বালাতে হবে। 
জল আর কাঠ এনে জড়ো করে রেখেছে হরিণ। বাঘ ফিরল মাঝ রাতে। হৃষ্টপুষ্ট একটা হরিণ এনেছে টানতে টানতে। 
দেখে একটু চমকে গেল হরিণ। একেবারে তারই জাতের একটা হরিণ শিকার করে এনেছে বাঘ। সে রাতে খিদের কথা ভুলেই গেল সে। সারা রাত জেগেই কাটাল বেচারা। দু’চোখের পাতা এক হোল না কিছুতেই। 
পরদিন হরিণ বলল—আজ আমি শিকারে যাচ্ছি। জল আর শুকনো কাঠ এনে রাখবি।
বাঘ সেই মতো জল আর কাঠ জোগাড় করে এনে রেখেছে। সন্ধ্যা নাগাদ হরিণ ফিরে এলো। মস্তবড় এক বাঘ মেরে এনেছে সে। 
চোখে পড়া মাত্রই বাঘের তো আক্কেল গুড়ুম। হরিণ বলল—তাহলে ভোজ শুরু করা যাক এবার। দেরি করে কাজ কী? 
কিন্তু সে রাতে খিদে উবে গেল বাঘের। মাংসে একটা কামড়ও বসালো না বেচারা।
শুধু কি খিদে? সে রাতে ঘুমও উড়ে গেল বাঘের চোখ থেকে। মনে একটাই ভয়, ঘুমিয়ে পড়লে, আমাকেও মেরে ফেলবে শয়তানটা। ঘাপটি মেরে পড়ে রইল বাঘ। 
সত্যি বলতে কী, ঘুম নাই হরিণের চোখেও। তারও ভয়, না খেয়ে শুয়েছে শয়তানটা। আজ আমাকেই খাবে নিশ্চয়। 
ঘুমানো তো বহু দূরের কথা। দু’চোখের পাতা একও করল না হরিণ। ভয়ে শরীর কাঠ। পাথরের মত শক্ত হয়ে পড়ে রইল। 
তখন বোধকরি মাঝরাত হবে। একভাবে শুয়ে থেকে, হরিণের সারা শরীরে ব্যথা। সে একবার পাশ ফিরতে গেল। হোল কী, হরিণের তো বিশাল লম্বা শিং! পাশ ফিরবার সময় তার শিংয়ের খোঁচা লেগে গেল ঘরের ছাউনিতে।


খোঁচা লাগতেই, একটা মড়মড় আওয়াজ। সেই সাথে বোঝাখানেক ঘাস ঝরে পড়ল নীচে। ভয়ে বাঘের তো প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়! সে ভাবল, নিশ্চয় হরিণ তার উপর ঝাঁপাতে আসছে। আর যায় কোথায়? 
বিশাল এক লাফে ঘরের বাইরে গিয়ে পড়ল বাঘটা। তার পর সে এক লম্বা দৌড়। দোড়তে দৌড়তে কিছু দূর গিয়ে একটা সরু নদী। এক লাফে নদীটাকেও পার হয়ে গেল বাঘ। 
এদিকে, হরিণ যেই বুঝতে পারল বাঘ লাফ দিয়েছে, তারও মারা পড়বার অবস্থা। নিশ্চয় আমাকে মারতে আসছে। ঘরের ভিতরে অন্ধকার। ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেও লাফিয়ে উঠেছে মাটি ছেড়ে। তার পর দৌড়।
হরিণের লাফে বাঘও হার মানে অনেক সময়। তেমনি লাফ দিতে দিতে, সেও পালাতে লাগল বাঘের হাত থেকে। 
দুজনের মনেই একটাই ভয়। ঘাসের ছাউনি দেওয়া সেই বাড়িটা। যত নষ্টের গোড়া ঐ বাড়িটাই। বাড়িটা না বানালে, কোন বিপদই ছিল না। আর একটু হলে, বেঘোরে প্রাণটাই যেতে বসেছিল আজ। দুজনেই ঘরটা ছেড়ে, যত দূরে পারা যায় সরে পড়তে লাগল। 
দুই বেচারার দৌড় কোথায় গিয়ে থেমেছিল, কতটা দূরে-- কারও জানা নাই। তবে, একটা জিনিষ ভালো মতন জানা গিয়েছে—সেদিন থেকে বাঘ বা হরিণ নিজের হাতে ঘর বানাবার চেষ্টা কোন দিন করেনি আর।

Post a Comment

0 Comments