জ্বলদর্চি

লাগে দোল পাতায় পাতায় ( তৃতীয় পর্ব )/ জীবন যেমন /মিলি ঘোষ

লাগে দোল পাতায় পাতায় ( তৃতীয় পর্ব ) 
জীবন যেমন  
মিলি ঘোষ 

কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করে অনুরাগ এখন পুণেতে। আইটি'তে আছে। মধুবন্তীও তাই। তবে, ওর অফিস কলকাতায়। 
স্বামীকে ছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দিব্য দিন কাটাচ্ছে মধু। আর আছেই বা কে ওর। এক বছরের ব্যবধানে বাবা, মা দু'জনেই চলে গেলেন। বাবার বাড়ির এক তলাটা ভাড়া দিয়ে রেখেছে মধুবন্তী। ওপরটা খালি। মাঝেমাঝে মধু যায়, কাজের মেয়ে বুলাকে নিয়ে। ঘরদোর পরিষ্কার করিয়ে চলে আসে। বাড়িটা যেন গিলতে আসে ওকে। প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরে বাবা, মায়ের স্মৃতি। 
   তালা খুললেই মনে হয়, এখনই মা বলবে, "মধু এলি ? তুই আসবি বলে, আজ মোচা চিংড়ি করেছি।"
    বাবাও যেন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে অনুযোগের সুরে বলবে, "ভুলে গেলি না কি মধু, আমাদের ? কতদিন পরে এলি বল তো।" 
    "দুসপ্তাহ মোটে আসিনি বাবা। অফিস করে আর সময় করতে পারি না। ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের কাজ জমে থাকে।"
    "ও বৌদি, একা একা কার সঙ্গে কথা বলছ ?"
বুলা যে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই নেই মধুবন্তীর। চোখ মুছতে মুছতে বাবা'র ছবির সামনে থেকে সরে আসে মধু।
বুলা জানে, ওকে কী কী করতে হবে। বলতে হয় না।  

মধু এখনও দু'সপ্তাহ বাদে বাদেই আসে। কিন্তু বাবা আর কোনও অভিযোগ করে না। 
রান্না ঘরটায় গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে মধুবন্তীর। সব কিছু আগের মতোই গোছানো। শুধু মানুষটাই নেই। 
   মধুকে গ্যাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘর ঝাঁট দিতে দিতেই বলল বুলা, "চা খাবে বৌদি ? করে দেব ?"
   "নাহ্। তুই খেলে খা।" 
   
অনুরাগের বাবা, মা, মধুবন্তীকে যথেষ্টই স্নেহ করেন।  তবু কেউ কারোর বিকল্প হতে পারে না। মা, বাবার অভাবটা থেকেই যায়। এক সময় এই বাড়িতে আসার জন্য মধুবন্তী ছটফট করত। এখন আসতে হয়, তাই আসা। 
মধুবন্তী বুক কেসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষন সব পরপর সাজানো। সুনীল, শীর্ষেন্দু, মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসু কেউ বাদ নেই। 
     বুক কেসের কাচে হাত দিতেই বাবা বললেন, "মাঝেমাঝে সুকুমার রায়ের লেখা পড়বি। মন ভালো থাকবে।"
    মধুবন্তীর চোখ গেল একদম নিচের তাকে। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ সব রয়েছে সেখানে। 
    তার ওপরের তাকে চোখ যেতেই বাবা বললেন, "ভালোবাসলে, মাধবীলতার মতো ভালোবাসিস।"
    মধুবন্তী নিজের মনেই বলল, "বিপ্লবের আর এক নাম, মাধবীলতা।" 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



পুজোর সময় অনুরাগ বাড়ি এল। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, সবাই খুশি। ছেলেকে কী খাওয়াবে, কী রান্না হবে! হবে নাই বা কেন, ছুটি ফুরিয়ে গেলেই তো আবার কর্মস্থলে ফিরতে হবে। তাই ওই ক'দিন বাড়িতে একটু সাজো সাজো রব। 
     রাতের খাবার খেতে বসে একদিন অনুরাগের মা বললেন, "আর কতদিন তোরা তুইতোকারি করবি বল তো ? ছেলেমেয়েরা শুনলে কী ভাববে ?"
অনুরাগ বেশ জমিয়ে খাচ্ছিল। 
     মুখ তুলে বলল, "কার ছেলেমেয়ে ?"
     অনুরাগের কথায় কান না দিয়ে নিজের স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে বলবে না বলো তো, আমার মা বাবা তুই তুই করে কথা বলে ?"
     মধুবন্তী মুখ টিপে হাসছে দেখে ওকেই ধরলেন এবার। 
     বললেন, "তুমিও কি ওর মতো ? বোঝাতে পারো না ? এগুলো শুনতে মোটেও ভালো লাগে না।"
     অনুরাগ খাওয়া থামিয়ে বলল, "বলতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে। তুমিও বাবাকে, আপনি করে বলবে, আজ থেকেই।"
     পরিমলবাবু হা হা করে হাসলেন ছেলের কথা শুনে। 
     তারপর স্ত্রীকে বললেন, "সুপ্রিয়া, বাস্তবটা বোঝো। ওদের বন্ধুত্ব আজ প্রায় নয় বছর। জীবনের এক তৃতীয়াংশ ওরা এভাবেই কথা বলেছে। এতদিনের একটা অভ্যেস কী করে চেঞ্জ করবে ? সত্যি তো, তুমি পারবে আমাকে হঠাৎ করে আপনি বলতে ?"
     "তুমিও দেখছি ওদের মতো অদ্ভুত। আমাদের বিয়ে হয়েছে, উনত্রিশ বছর হয়ে গেল। এখন কী করে বলব ?"
     "আচ্ছা, ন'বছর ছেড়ে দাও। বিয়ের দু'বছর পরে তুমি পারতে, 'তুমি'কে 'আপনি'তে ডাইভার্ট করতে ?"
     "কী জানি বাবা, আমি সেকেলে মানুষ। অতশত বুঝি না।"
     বাবার সমর্থন পেয়ে অনুরাগ, মধুবন্তীকে বলল, "বাবাকে আর এক পিস মাছ দে।" 

অনুরাগ পুণেতে ফিরে যাবার পর, সুপ্রিয়াদেবী কিছুদিন মনমরা হয়ে থাকেন। কান্নাকাটিও করেন। 
   পরিমলবাবুও দুপুরে কাটা পোনার ঝোল দিয়ে ভাত মেখে বললেন, "আজ বাজারে ভালো পাবদা দেখলাম।"
   কথাটা বলে, একটা চাপা শ্বাস ফেললেন। 
মধুবন্তী জানে, বাবা নিজেও পাবদা মাছ   ভালোবাসেন। কিন্তু অনুরাগ ফিরে গেছে বলে, আনতে পারলেন না। ছেলে যে ক'দিন থাকে, খুঁজে খুঁজে ওর পছন্দের খাবার নিয়ে আসেন বাবা।
 
কষ্ট চাপা হোক, না হোক, প্রকাশ সবাই করে। পারে না শুধু মধুবন্তী। কোন্ অলিখিত নিয়ম সমাজ সংসার বেঁধে রেখেছে, যেখানে স্ত্রী, স্বামীর জন্য সর্বসমক্ষে চোখের জল ফেলতে পারে না। কেউ জানতে পারে না, মধুর মনের কথা। মাঝেমাঝে 
স্নানের জলে, চোখের জল ধুয়ে যায় মধুবন্তীর। 

সেই কলেজ জীবন থেকে অনুরাগ আর মধুবন্তীর অভ্যেস, রাতে শুয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলা। অনুরাগ কলকাতায় থাকলে, এই অভ্যেসে ছেদ  পরে। পুণেতে গেলে, আবার যেই কে সেই।
     অনুরাগ মেসেজ দিল, "বাড়ি যেতে তো ভালো লাগে, কিন্তু ফিরে এসে মাইন্ড সেট করতেই হাল খারাপ। যাক গে, একটা ভালো দেখে গান শোনা, যাতে মন ভালো হয়ে যায়।"
     "কী যে বলিস, মা পাশের ঘরে।"
     "বাবা ঘুমোয়নি ?"
     "নাসিকা গর্জন।"
     "ওহ্, তাহলে তুই নিশ্চিন্তে গাইতে পারিস।"
     "মা, কী করে ঘুমোয় বল তো, কানের কাছে ওই ভয়ঙ্কর আওয়াজ নিয়ে ?"
     "মা'র বহু বছরের অভ্যেস। মা যদি জেগেও থাকে, ওই ব্যাঘ্র গর্জন ভেদ করে তোর গান মা'র কানে পৌঁছবে না।"
     "দাঁড়া, ভাবি কী গাইব।"
     মধুবন্তী তাও গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে গাইতে শুরু করল, 
     "আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান--
         তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,
       তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমাণ।" 
     
পড়াশুনা দু'জনেরই এক সঙ্গে, চাকরিও প্রায় একই সময়ে। অনুরাগ জয়েন করার মাস তিনেক পরে মধুবন্তী চাকরি পায়। তাও তো দু'বছর হয়ে গেল। যতদিন মধু চাকরি না পেয়েছে, অনুরাগের মন বিষণ্ণ থাকত। খালি ভাবত, মধু কবে একটা চাকরি পাবে। মধুবন্তীর টাকার দিকে তাকিয়ে অনুরাগের সে চিন্তা ছিল না। আন্তরিক ভাবেই কামনা করত, মধুবন্তীর সাফল্য। অনুরাগ মনে করে, প্রতিটি মানুষের সাবলম্বী হওয়া দরকার।  
   এমনকী ওর মাকেও বলেছে, "তোমার হাতের রান্না, আচ্ছা আচ্ছা হোটেলকে হার মানিয়ে দেবে। তুমি হোম ডেলিভারী শুরু করো।"
     "না বাবা, এই বয়সে আর নতুন করে কিছু পারব না। শরীর দেবে না। ঘরের ক'জনের রান্না, তাই এক এক সময় পেরে উঠি না।" বলেছেন মা।
     বাড়ির জন্য যা করো, তাই আর একটু বেশি করে করো। আমি লোক রেখে দেব। তারা তোমাকে হেল্প করবে। প্রথমে অল্প করে শুরু করো। দাঁড়িয়ে গেলে অন্য লোক দিয়ে, তুমি করাবে।"
কিন্তু সুপ্রিয়াদেবী রাজি হন না।
      অনুরাগ রাগ দেখায়, "অদ্ভুত তোমরা মেয়েরা। সারাজীবন বাবার কাছে হাত পাততে ভালো লাগে তোমার ?"
সুপ্রিয়াদেবী হাসেন। সেই হাসির যে কী অর্থ, অনুরাগ বোঝে না। 

চাকরি পাবার আড়াই বছর পরে মধুবন্তীর প্রোমোশন হলো। মধুর প্রথমেই মা'র মুখটা মনে পড়ল। চাকরি পেয়ে প্রথম খবর মা'কেই দিয়েছিল মধু। মা তো আনন্দে যাকে পেরেছে বলেছে। সবাই যে এসব খবরে খুশি হয় না, মা'কে বুঝিয়ে লাভ নেই। বাবাও বিস্তর খুশি। তবে সবার আগে খবর না পেয়ে অভিমান হয়েছিল অনুরাগের। 
     বলেছিল, "তুই এত দেরিতে খবরটা দিলি ?"
     "দেরি কোথায় ? মা, বাবাকে বলেই তোকে ফোন করলাম।"
আজ তাই আর দেরি করতে চাইল না মধুবন্তী। মা, বাবা নেই। থাকলেও অনুরাগকেই সবার আগে সুখবরটা দিত। 
অফিস থেকেই ফোনটা করল মধু।
     "গুড নিউজ আছে।"
     "স্যালারি বেড়েছে ? ট্রিট দে।"
     "প্রোমোশন পেয়েছি। আজকেই মেল করেছেন এইচ আর। তোকেই কিন্তু সবার আগে খবরটা দিলাম।"
ফোনের ও'ধারে সাড়া নেই।
     "হেলো, হেলো! শুনতে পাচ্ছিস, অনু ? হেলো!"
ওদিক থেকে ঠান্ডা গলার উত্তর, "একটু বিজি আছি রে। কনগ্র্যাটস্!"
লাইন কেটে দিল অনুরাগ। 

ফোন হাতে কতক্ষণ যে মধুবন্তী বসে রইল, নিজেরই খেয়াল নেই।
    "বিজি আছে ? তাহলে তো প্রথমেই বলতো। এখন তো ওর কলও নেই। কালকেই তো বলল, বিকেল চারটের সময় কল আছে। তাহলে ? হঠাৎ কাজ এসে গেছে হয়তো। চাপ কমলে, ও নিজেই ফোন করবে, নয় তো মেসেজ দেবে।" এ'সব ভাবনাকে মন থেকে  সরিয়ে ল্যাপটপে চোখ রাখল মধুবন্তী। 
    
কিন্তু সারাদিনে একটি ফোন বা মেসেজ এল না অনুরাগের থেকে। এমনকী রাতেও না।

Post a Comment

0 Comments