জ্বলদর্চি

ছো শিল্পীদের স্টান্সগুলোতে সিনেমাও তুচ্ছ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৬০

ছো শিল্পীদের স্টান্সগুলোতে সিনেমাও তুচ্ছ

সূর্যকান্ত মাহাতো


"পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডী, ঝালদা, আড়সা এবং বান্দোয়ানের যে পৃথক পৃথক ধারা ছো নৃত্যে একসময় ছিল, এখন আর সেটা নেই। এখনকার ছো নাচে বরং এই চারটি ধারায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রতিটি দল এই চারটি ধারাকেই অনুসরণ করে চলেছে।"

"'ছো' নাচের যে 'স্টেপ' বা 'স্টান্স'গুলো নেওয়া হয় তাদের কি নির্দিষ্ট কোন নাম আছে?"

"অবশ্যই আছে। না হলে কাউকে শেখানোর সময় সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হয়! যে মূল ছ'টি(৬) স্টান্সের উপর 'ছো' নাচ গড়ে ওঠে বা নির্ভরশীল, সেই নামগুলোকে পশুপতি প্রসাদ মাহাতো বেশ একটি ছড়ার আকারে বর্ণনাও করেছেন---
"ডেগ, চালি, ডিগবাজী
উড়া, ঘুর‍্যা, রংবাজী""(জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডের লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা ১১৮)

"তবে এগুলোতেই 'ছো' নাচ এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। আরো নতুন নতুন 'স্টান্স' নিয়ে 'ছো' শিল্পিরা চর্চা করে চলেছেন। এই যেমন 'ডেগ' মানে হল, তালে তালে পা ফেলা। (পৃষ্ঠা ২৫৪, অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া, ১ম পর্ব) এই পদ সঞ্চালনেও আবার নানান ধরণের নতুনত্ব আনা হচ্ছে। বিভিন্ন রকমের শারীরিক অঙ্গভঙ্গীও নতুন নতুন করে তৈরি হচ্ছে। যেমন 'ভুঁই সুটনর', 'গা-হিলা', 'বাঁহিমলকা', 'উড়া মালট', 'উলফা' এসব তো আছেই, সেই সঙ্গে 'টপকা', 'ঘাড় ঘুরানো', 'হাঁটু গাড়া', 'এড়ি ধামসা' প্রভৃতিতেও নতুনত্ব আনা হচ্ছে।
'উড়া মালট' হল, দুহাত বুকের সমান বা উপরে তুলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা।
'উলফা' হল, হাঁটু গেড়ে বসা এবং হাঁটুর সাহায্যে সাপের মতো চলা।
এরপর বাজনার দ্রুততার সঙ্গে চলে শরীরকে কাঁপানো বা হিলানো। যেমন 'বাঁহি মলকা', 'ভুজা হিলা', 'বুক হিলা' বা 'ছাতি হিলা', 'মাটিদলকা' প্রভৃতি।
কোন ভারী জিনিস উপরে তোলার সময় আমাদের শরীর যেভাবে কেঁপে ওঠে সেই রকম ভাবেই শরীরকে কাঁপাতে হয়। শরীরের এই কম্পনকে 'ভাঁজ ওঠা' বলে।
এরপর আছে নানা রকমের ঝাঁপ। 'চরখি ঝাঁপ', 'পাইখ ঝাঁপ', 'চুড়পা' বা 'চটি চাইল' এর মতো নাচ।
বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে  পায়ের নানা রকম অসম্ভব সব কাজগুলো করে দেখাতে হয়। 'ঘুঁঘুর' নিয়ে পায়ের যে কাজ তাকে বলে 'ঘুঁঘুর ভাঁজা'। শিল্পীরা অতি দক্ষতায় পায়ে বাঁধা ঘুঁঘুরের কখনো একটিকে বাজাতে পারে আবার কখনো সবগুলোই বাজাতে পারে।
এই নাচে দেব-দেবীদের যে চাল, তারও পার্থক্য আছে। দেবী দুর্গার চাল হবে 'জলে ছলকার' মতো। অসুর ও দৈত্যদের চালও আলাদা হয়। বেশ ভারী ভারী পা ফেলতে হয়।
আজকের ছো নাচে যে 'উলফা', 'চুড়পা', 'হাঁটু পটকা'-র মতো স্টান্সগুলো দেখা যায় এগুলো ঝালদা থানার 'ছো' শিল্পীরা সৃষ্টি করেন (অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া/পৃষ্ঠা- ২৫৮)। 'জন আর্ডন' ছো নাচের এই স্টান্সগুলোকে একটু অন্যভাবে দেখেছেন।"

"তিনি কীভাবে এ নাচকে বর্ণনা করেছেন?"

'জন আর্ডন' 'ছো' নাচকে 'যুদ্ধ' ও  'পশু শিকারের' স্টান্স বলেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, "The steps of the dances are the steps of war dances or the movments of hunts men stalking their target for the movements of the animals they used to catch." (John Arden 1971, Page 70)


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



"নাচের সময় শিল্পীদের দেখি কখনো বাম পা ফেলে এগিয়ে আসে কখনো ডান পা ফেলে। এটাও কি কোন রীতি? নাকি যে কোন এক পা ফেলে এগিয়ে এলেই হয়?"

"না। যে কোন এক পা ফেলে এগিয়ে এলেই হবে না। পায়ের গতিবিধিরও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কাউকে আক্রমণ করার সময় বাম পা ফেলে এগোতে হয়। এবং প্রতিরোধ করার সময় ডান পা ফেলে এগোতে হয়।"

"আজকের 'ছো' নাচে অন্যান্য ধারারও সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন আঞ্চলিক নানা 'লোকনৃত্য' এবং 'লোকক্রীড়া'। এগুলো কেন ঘটছে?"

"আসলে 'ছো' নাচকে আরো বেশি করে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে এবং সর্বাঙ্গ সুন্দর করে গড়ে তুলতেই এগুলোকে গ্রহণ করা হচ্ছে। সমাজের অন্যান্য লোকনৃত্যগুলোর এভাবেই চাহিদা মতো অনুপ্রবেশ ঘটেছে এই নাচে। যেমন গাজন নাচ, কীর্তন নাচ, নাটুয়া নাচ, নাচনি নাচ, মাঝি নাচের  কিছু কিছু অংশ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে 'লোকনৃত্যের' মতো ঝাড়খণ্ডের কিছু 'লোকক্রীড়াকেও' গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন বুড়ি বসা, দাঁড়িয়া, লুকালুকি, চিয়ক-ফটক, হাডু-ডু-ডু, সীতাচুরি প্রভৃতি।" (জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডী লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা ১১৮)

"তবে আজকাল ছো নাচে 'খেমটা', 'নাটুয়া', 'দাঁড় ধরা', কাঁধে চেপে ডিগবাজির মতো 'সার্কাস', এসবের অনুপ্রবেশে 'ছো' নাচের মূলভাবটা যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটা তো এক রকম নিশ্চিত।"

"অবশ্যই। তাইতো প্রকৃত শিল্পীরা এ নিয়ে আক্ষেপও প্রকাশ করছে।"

"'ছো' নাচ বললে বারবার 'শিব গাজনের' একটা প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ দুটোর মধ্যে কি কোন গভীর সম্পর্ক আছে?"

"এতক্ষণ পর একটা ভালো প্রসঙ্গ উঠে এল। আগে দেখে নিই চলো এ সম্পর্কে বিদগ্ধজনেরা কে কী বলেছেন। তাহলে আলোচনা করতে সুবিধা হবে।
পশুপতি প্রসাদ মাহাতো বলেছেন,"শিব গাজনের আচার নৃত্য হচ্ছে ছো নাচ। এই নাচ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তির 'জাগরণ' উপলক্ষ্যে, শেষ হয় জৈষ্ঠ মাসের রোহিনীতে"(ঝাড়খন্ড সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন, পৃষ্ঠা- ৩০)
বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত বলেছেন,"চৈত্র সংক্রান্তির আগের রাতে অর্থাৎ ভগতা পরবের প্রাক্কালে যেখানে চড়ক বা ভগতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে সাজসজ্জা মুখোশ ইত্যাদি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জনতার সম্মুখে এ নৃত্য প্রদর্শন করা হয়" (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, পৃষ্ঠা- ১৭৬) ওই গ্রন্থেই তিনি আরো বলেছেন,"ছো নাচ বিশিষ্ট আচার অনুষ্ঠানের মতই চড়কের আগের রাত্রে অপরিহার্যরূপে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে"(পৃষ্ঠা ১৭৬)।
আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, "চৈত্র সংক্রান্তির পূর্ব দিন হইতে আরম্ভ করিয়া 'রোহন' বা বছরের প্রথম বীজ ধান বপনের (১৩ জ্যৈষ্ঠ) পূর্ব পর্যন্ত এই নাচের সময়(season)"।(বাংলার লোকসাহিত্য, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯০)

"তাহলে আমার মনে হয় চড়কের মতো উৎসব উপলক্ষ্যে এটাকে একটা জনমনোরঞ্জনের অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে।"

"না, না। সেটা সর্বাংশে সত্য নয়। এ যুক্তি বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতও খারিজ করে দিয়েছেন। তার মতে, আসলে ছো নাচ 'ঐন্দ্রজালিক' ভাবনা থেকেই গড়ে উঠেছে। (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, পৃষ্ঠা- ১৭৫) কারণ আদিম জনগোষ্ঠীর যৌথ নৃত্য ছিল মূলত ম্যাজিকের আচার অনুষ্ঠান এবং যৌথ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।" (ঝাড়খন্ড সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা- ৩১)

"'ঐন্দ্রজালিক' ভাবনা প্রসূত বলে কেন মনে হল!"

"ছো নাচের প্রকৃত সময়কালটা একবার ভালো করে লক্ষ্য করে দেখো। প্রতিবছরের চড়কের চৈত্র মাস থেকে রহিণ তথা জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। পন্ডিতেরাও এই তিন মাসকেই উল্লেখ করেছেন। এই সময়টা হল 'খরা'-র সময়। তাই এই সময় বিশেষ করে চড়কের সময় 'জল ঢালা'র যে অনুষ্ঠানগুলো পালিত হয়, তা কেবল "ভালো বর চাওয়া"-র মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং অনেক বেশি করে 'বৃষ্টি আনয়নের' ভাবনা থেকেই গড়ে উঠেছে। এ  নৃত্য তারই একটা মাধ্যম।" (পৃষ্ঠা ১৭৬, ঝাড়খণ্ডের লোক সাহিত্য)

"এমনটা মনে হওয়ার কারণ?"

"কারণ হল 'নাচের রূপ'। কালবৈশাখীর ভয়ংকর রূপটাই তো 'ছো' নাচে প্রতিফলিত। শারীরিক শক্তির প্রকাশ যেন অঙ্গভঙ্গীতে রুদ্র। সেই নাচে বীরত্বের ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠে।"

"একটু আগে বলছিলে 'ছো' নাচ স্থানীয় বিভিন্ন 'লোকনৃত্য' ও 'লোকক্রীড়া'কে গ্রহণ করে আরো বেশি সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আর কি কোন বৈশিষ্ট্য  সেরকমভাবে ফুটে উঠেছে, যেখানে ছৌ নৃত্য দেখলেই  স্পষ্ট হওয়া যাবে?"

"হ্যাঁ। অবশ্যই দেখা যায়। দেখো আমাদের জীবন ধারণের জন্য সবথেকে বড় প্রয়োজনীয় উপকরণ হল 'খাদ্য'। এবং সেটা সংগ্রহ করতে মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলতে হয়েছে। ছো নাচে সেই সংগ্রামী মনোভাব ফুটে উঠেছে বলেই তো 'জন আরডেন' সাহেবের মতো মানুষেরা একে 'যুদ্ধনৃত্য' ও 'শিকারনৃত্য' বলে উল্লেখ করেছেন। আদিবাসী জীবনের 'পশু শিকার' ও 'মৎস্য শিকার'ও 'ছো' নাচে প্রতিফলিত হয়েছে।"

"ছো নাচে, 'রামায়ণ-মহাভারত' বিরাট ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই নাচে অনুষ্ঠিত বেশিরভাগ পালাগুলোই এই দুই মহাকাব্য নির্ভর। এর কোন কারণ জানা আছে কি?"

"সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে উঁচু বর্ণের লোকেদের পরবর্তীকালে এই জঙ্গলমহলে অনুপ্রবেশকে তার মধ্যে একটা কারণ বলে মনে করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত। উঁচু বর্ণের অনুপ্রবেশের ফলেই এখানকার মানুষ নাকি হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেছিল। তারাও তখন সেই সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে এই দুই মহাকাব্যের গল্পকে গ্রহণ করেছে। এমনটাই তিনি ধারণা  করেন। তবে সেটা একমাত্র যুক্তি নয়। রামায়ণ মহাভারতের থেকে অনুস্মৃত ছোট ছোট কাহিনী ও পালাগুলোর সঙ্গে এখানকার মানুষ অনেক বেশি একাত্ম হতে পেরেছিলেন বলেই সেগুলো সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ রামায়ণকে তারা নিজেদের মতো করেই গড়ে তুলেছেন। কোথাও অতিরঞ্জিত কিছু নেই।"

"একে গ্রীষ্মের গরম তার উপর মুখ মুখোশে ঢাকা। এমন অবস্থায় ওইসব ভয়ঙ্কর স্টান্স করতে করতে নাচা তো রীতিমতো কঠিন এবং কষ্টদায়কও।"

"অবশ্যই। তবে কি জানো? শিল্পীদের কাছে এ নাচ কেবল অর্থ উপার্জন নয়। এই নাচ হল শিল্পীর কাছে একটা আবেগ। একটা ভালোলাগা। প্যাশন। একেবারে ভিতর থেকে ভালো লাগার স্ফুরণ না হলে সেটা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া এখন তো মুখোশ কাগজের তৈরি। অনেক হালকা। ভেবে দেখো আগে কি হত! তখন তো মুখোশ ছিল কঠের তৈরি।"

"কাঠের তৈরি মুখোশ! কাঠের তৈরি মুখোশ আগে ব্যবহৃত হত? এমনটা তো জানা ছিল না!"

"সরাইকেলার 'ছো' নৃত্যের কথাই যদি ধরো, সেখানেও আগে কাঠের মুখোশ ছিল। তারপর কিছুটা হালকা করার জন্য বাঁশের ফালির ওপর মাটি লেপে তার ওপরে লাউয়ের খোল বসিয়ে মুখোশ বানানো হত। এখন তো অনেক আধুনিক কাগজ, নেকড়া আর মাটি দিয়ে একেবারে হালকা মুখোশ তৈরি হচ্ছে।" (শারদীয়া দেশ। ১৩৬২, পৃষ্ঠা- ১৬৯)

"পুরুলিয়াতেও কি কাঠের মুখোশ ব্যবহৃত হত?"

"হত। এখানেও যে কাঠের মুখোশ ব্যবহৃত হত, সেকথা পশুপতি বাবুও বলেছেন, পুরুলিয়ায় এত সংঘবদ্ধ ও সুষ্ঠু ছো নাচেরও যে একটা যাত্রা পথ আছে সে কথাও তিনি বর্ণনা করেছেন।"

"কী রকম?"

"অনেক আগে তা ধরো প্রায় একশো বছরেরও আগের কথা। তখন গাজনের জাগরণের দিন কাঠের মুখোশ ব্যবহার করে 'ডাভা  তোড়াং' গ্রামের গ্রামবাসীরা 'আড়াইয়া' তালে এক রকমের 'ফুট' নাচ করতেন। এই 'ফুট' বলতে জলের মধ্যে মাছের বুড়বুড়ি দেওয়া বোঝায়। কোন একক নৃত্য শিল্পী মাছের মতোই নানান কসরত করে দেখাতেন ঝুমুর গান ও বাজনার তালে তালে। এই নাচকে বলা হতো 'একুড়া ছো'। এই 'একুড়া ছো'-কে সংঘবদ্ধ ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে কোরিওগ্রাফির দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন 'রাজকিশোর মাহাতো'।

"এই রাজকিশোর মাহাতো আবার কে?"

১৯১৯ সালে প্রথম পুরুলিয়ার মুলবাসী সন্তান হিসেবে মেট্রিক পাস করেছিলেন এই রাজকিশোর মাহাতো। সেই আনন্দে তাকে বিশেষভাবে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এই 'একুড়া ছো' নাচের মধ্য দিয়েই তাকে সংবর্ধিত করা হয়েছিল। সেই নাচ দেখে রাজকিশোর মাহাতো পরের বছর অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে তার নিজের কোরিওগ্রাফিতে অর্থাৎ ১৯২০ সালে তোড়াং এর শিব মন্দির মাঠে "বংশীচুরি" বলে একটি সঙ্ঘবদ্ধ পালা 'ছো' নাচের অনুষ্ঠান করেন। বাঘমুন্ডীর রাজাও সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলেন। রাজা তো 'বংশীচুরি'র পালায় এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, নিজের সোনার হার খুলে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন নাচিয়েদের দিকে।"(জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডী লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা - ১১৮)

"ছো নাচের বাজনার কি নির্দিষ্ট কোন তাল আছে?"

"অবশ্যই। প্রতিটি নৃত্যেরই একটি নির্দিষ্ট বাজনার তাল থাকে। 'ছো' নাচও তার ব্যতিক্রম নয়। এই যেমন সরাইকেলার ছো নাচের বাজনা বরাবর 'ছোট' তালের। অন্যদিকে পুরুলিয়ার 'ছো' নাচেও একাধিক বাজনার তাল রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, 'মাতোয়াল' তাল।"

"মাতোয়াল তাল!" সেটা আবার কী তাল!""

"এটা হল শিবের 'যোগিনী' নাচের তাল। শাক্ত মতে, এই 'যোগিনী' নাচ 'মাতোয়াল' তালে ষড়রিপুকে জাগানোর জন্যই ব্যবহৃত হয়। (ঝাড়খণ্ড সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা- ৩৯) এই তাল ছয় মাত্রার হয়। টেম্পো অনুসারে সেটাকে আবার বাড়নোও যায়। আর একটি তাল হল 'নাটা তাল'। 'নাটুয়া' নাচ থেকে এসেছে। মূলত 'উলফা' বা 'লম্ফ' দেওয়ার সময় এটা ব্যবহৃত হয়। আবার শরীর কাঁপানোর সময় 'ঝা-ঝা-ঝা' কিংবা 'তা-তা-তা' এই একতালকে দ্রুত বাজানো হয়। একে বলে 'ব্রহ্মতাল'। (ঝাড়খণ্ড সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন, পৃষ্ঠা - ৪০) এরকমই আরো নানারকমের সব তাল ব্যবহৃত হয়।"

"ছো নাচের গান কি বরাবরই ঝুমুর?"

হ্যাঁ। 'ভাদরিয়া' ও 'দরবারী' দু ধরণের ঝুমুর গানই 'ছো' নাচে ব্যবহৃত হয়। যেমন গনেশ বন্দনার একটি উল্লেখযোগ্য 'দরবারী' ঝুমুর গান হল---
"প্রথমে বন্দনা করি গনেশ চরণ
সিঁদুর বরণ অঙ্গ মুষিক বাহন
সকল দেবের সিদ্ধিদাতা হরগৌরীর নন্দন।"

মনে মনে তখন পশুপতিবাবুর কথাগুলোই ভাবছিলাম, ছো নাচ এক বহতা বা বহমান লোক ঐতিহ্য। আর সেই সুরের মূর্ছনা জঙ্গলমহলের মানুষের মনে এক অপূর্ব ভাবধারা সৃষ্টি করে চলেছে।

তথ্যসূত্র: ১) ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত
২) জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডী লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
৩) ঝাড়খণ্ড: সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাত ও সজল বসু
৪) অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া, ১ম পর্ব/ দেবীপ্রসাদ জানা
৫) বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম খণ্ড, ৩য় খণ্ড/আশুতোষ ভট্টাচার্য
৬) সেরাইকেলার ছোউ নৃত্য/ সুধীর বন্দোপাধ্যায়
৭) ছৌ নৃত্যের ঐতিহ্য/ সুধীর বন্দোপাধ্যায়

Post a Comment

0 Comments