জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৫৮
'চড়ক': পুনর্জন্ম লাভের কামনাতেই অনুষ্ঠিত
সূর্যকান্ত মাহাতো
"জঙ্গলমহলে দেব দেবীদের উৎস ও প্রভাব মূলত 'ভয়-বিস্ময়-বিশ্বাস' থেকেই। শৈব পূজাও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নয়। শিবের আরাধনাও কি এভাবেই গড়ে উঠেছে?"
"আসলে 'লিঙ্গ' পূজা, 'যোনী' পূজা, 'শ্মশান', 'শিব' ও 'ভৈরব' পূজা এগুলো সবই আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম ও কর্মানুষ্ঠান, এবং পূজা অনুষ্ঠান। সেখান থেকেই পরবর্তীকালে অ-আদিবাসীরা এই 'লিঙ্গ' ও 'শিব' পূজাকে গ্রহণ করেছে।(বাঙ্গালীর ইতিহাস/নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা ৬১১)
"বলেন কি! 'মহাদেব' আদিবাসীদের নিজস্ব দেবতা ছিলেন!"
"শুধু ছিলেনই না, 'শিব' নিজে অনার্য হয়েও নিজস্ব প্রতিভা গুণে ব্রাহ্মণদের আরাধ্য হয়ে উঠেছেন। আর তুমি ঠিক কথাই বলেছো, ধর্ম কর্মের এইসব আচার অনুষ্ঠানগুলো মূলত গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের প্রধান ও আদিতম 'ভয়-বিস্ময় ও বিশ্বাস' থেকেই গড়ে উঠেছিল। জঙ্গলমহলের কুড়মি, ওঁরাও প্রভৃতি জনজাতির প্রাচীন 'কথা' ও 'কাহিনীতেও' 'মহাদেবের' কথা পাওয়া যায়। আরো একটা জিনিস জেনে অবাক হবে, শুধু পূজা পার্বণই নয়, আদিবাসীদের থেকে আরো অনেক কিছু রীতি রেওয়াজই পরবর্তীকালে গৃহীত হয়েছে। যেমন বিবাহের যে রীতি রেওয়াজ সেটাও তো অবৈদিক, অস্মার্ত ও অব্রাহ্মণ্য। কেবল 'সম্প্রদান', 'যজ্ঞ', এবং 'সপ্তপদী'র মতো মন্ত্র অংশটুকু কেবল যা বাদ। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৬১১)
"সত্যি নাকি! 'মন্ত্রটুকু' অংশ ছাড়া আর সবই 'অবৈদিক' ও 'অব্রাহ্মণ্য'! এ তো দারুন একটা ব্যাপার!"
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
"বাংলায় শৈব ধর্মের এই প্রভাবটাও হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। এর একটা ধারাবাহিক পর্যায়ক্রমও ছিল।
বাংলার 'শৈব' ধর্মের ইতিহাসটা যদি একবার সংক্ষেপে দেখো, তাহলে বুঝতে পারবে সেটা হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। মূলত 'গুপ্ত' ও 'গুপ্তোত্তর'(৩৫০-৭৫০ খ্রি:) যুগেই বাংলায় 'শৈবধর্ম' প্রসারের হাঁটি হাঁটি পা-পা। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েক জায়গায় সেটা চোখে পড়ে মাত্র। তাও আবার সেটা পৌরাণিক শৈবধর্ম। ষষ্ঠ শতাব্দীতে মহারাজ 'বৈন্যগুপ্তের' সহযোগিতায় শৈবধর্ম পূর্ব বাংলায় কিছুটা বিস্তৃত ছিল।এরপর সপ্তম শতাব্দীতে শশাঙ্কের মুদ্রায় মহাদেব ও নন্দীবৃষের প্রতিকৃতি ছিল। সমাচার দেবের মুদ্রাতেও দেখা যায় 'শৈব লাঞ্ছন'। যাইহোক এ সময় শৈবধর্মের প্রসার যতটুকু ঘটেছিল তা কেবল রাজা ও রাজবংশের পোষকতাতেই। বরং বাংলার বুকে শৈবধর্মের জোয়ার নেমেছিল পাল ও চন্দ্র-পর্ব যুগে। এ সময় শৈবধর্মের বিভিন্ন লিপি, মূর্তি সহ একাধিক মন্দিরের প্রচুর প্রমান রয়েছে। এই পর্বের শৈবধর্ম ছিল 'পাশুপত' ধর্ম। এসময় শিবের নানান প্রতিকৃতিরও পরিচয় পাই। যেমন 'লিঙ্গরুপী', 'নটরাজ' রুপী, 'সদাশিব', উমা মহেশ্বর যুগল মূর্তি, শিবের বৈবাহিক বা যুগল মূর্তি, 'রুদ্ররূপ' প্রভৃতি। কেবল বৈদ্যনাথ নয়, শিব যে সংগীতাচার্যও ছিলেন তার প্রমাণ একদিকে যেমন রয়েছে ঋকে ১/৪৩/৪, তেমনি নটরাজ শিবের যে মূর্তিগুলো বাংলায় পাওয়া গেছে তাদের হাতেও বীণা ও করতাল নৃত্য লক্ষ্য করা গেছে। এরপর 'সেন-বর্মন-দেব'পর্বে বাংলায় শৈব ধর্ম আরো বেশি করে প্রসার ও বিস্তার লাভ করে। সেন বংশের পারিবারিক দেবতা ছিলেন 'সদাশিব'। তুমি কি জানো 'গীতগোবিন্দ'-র রচয়িতা, জয়দেব কেবল রাধা-কৃষ্ণের স্তুতিই করেননি, তিনি শিবেরও স্তুতি করেছিলেন?"
"তাই নাকি! এমন শ্লোক কোথায় আছে? গীতগোবিন্দেই?"
"ধুর! গীতগোবিন্দে থাকতে যাবে কেন! 'সদুক্তিকর্ণামৃতে' (১/৪/৪) আছে।
শুধু তাই নয় ভাবলে অবাক হয়ে যাবে, 'শাক্তধর্ম'ও এই সময়েই গড়ে উঠেছিল। 'তন্ত্র' সাহিত্যের জন্ম তো এই বাংলাদেশেই।"
"তন্ত্র সাহিত্যের জন্ম বাংলায়!"
"আমার কথা বিশ্বাস না হলে নীহারঞ্জন রায়ের 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' গ্রন্থের ৬৫৭ পৃষ্ঠা খুলে দেখতে পারো। সেখানে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, তন্ত্র ধর্মের পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত বিকাশ এদেশেই।"
"এতটা জোর দিয়ে বলার কারণ!"
"কারণ দ্বাদশ শতাব্দীর আগে সেরকম আর কোন তন্ত্রসাহিত্য রচিত হয়েছিল বলে জানা যায়নি।জঙ্গলমহলে যে দুটো শিবের উৎসব সবথেকে জনপ্রিয় তাদের মধ্যে অন্যতম একটি হল 'চড়ক'। চৈত্র সংক্রান্তির এই উৎসব কি কেবলই শৈব আরাধনা?
এখানকার 'ধর্ম' ও 'চড়ক' পূজা দুটোই কেন প্রচলিত হয়েছিল জানো?"
"কেন?"
"কোম সমাজের 'ভূতবাদ' ও 'পুনর্জন্মবাদের' চিন্তাভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কোমের মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্ম লাভের কামনাতেই বছর বছর 'চড়ক' উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।"
"কেবলমাত্র পুনর্জন্ম লাভের কামনাতেই 'ধর্ম' ও 'চড়কের' মতো অনুষ্ঠানগুলো একদিন প্রচলিত হয়েছিল! এতো অবাক করা বিষয়।"
"চড়কের সময় দেখবে একটি শোল মাছকে পোড়ানো বা পুজো করা হয়। কেন করা হয়? আসলে তার পুনর্জন্মের প্রত্যাশাতেই। এর সঙ্গে আবার মহাভারতের শ্রীবৎসরাজার উপাখ্যানকেও তুলনা করা হয়।"(বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৬২০)
"বাহ! তাহলে চড়কে 'কুমির পূজা', 'জলন্ত অঙ্গার এর উপর দিয়ে ভক্ত সন্ন্যাসীদের হাঁটা', 'কাঁটা ও ছুরির উপর ঝাঁপ দেওয়া', শরীরের একাধিক জায়গায় 'বান ফোঁড়া', 'অগ্নি নৃত্য', 'চড়ক গাছে' তোলার মতো দৈহিক যন্ত্রণা গ্রহণ ও রক্তপাতের যে ঘটনাগুলো দেখা যেত এবং এখনো কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায়। সেগুলো গড়ে ওঠার পিছনেও কি তাহলে ওই একই উদ্দেশ্য ছিল?"
"সেটা জানলে আরও বেশি চমকে উঠবে। এসবের সঙ্গে প্রাচীন কোম সমাজের 'নরবলি' প্রথার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।"
আমি প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বললাম,"কি বলছেন! এইসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে 'নরবলি'র ইতিহাস জড়াতে যাবে কেন? এমন প্রমাণ নিশ্চয়ই কোন ফালতু পুরাণে পেয়েছেন?"
"না। ইতিহাসেই পেয়েছি।" একটু সিরিয়াস হয়ে বললেন, নীহাররঞ্জন রায়ের "বাঙ্গালীর ইতিহাস" গ্রন্থের ৬২০ পাতাটা খুলে দেখো। সেখানেই উনি সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তবে এগুলো যে ভয়ঙ্কর, সে কথা সমান সত্য। এবং এগুলো অযৌক্তিকও ছিল। তাই ১৮৬৩ সালে আইন করে এগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।"
"'শিব' পূজায় ভক্তদের 'গঞ্জিকা' সেবনের ব্যাপারটা কীভাবে যুক্ত হল? দৈহিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করতেই কি?"
"সেটা একরকম বলা যেতে পারে। তবে শৈব পূজা মানেই তো কেবল চড়ক নয়। অন্যান্য শৈব ভক্তদেরকেও মাঝে মাঝে যেমন গাঁজা খেতে দেখা যায়, তেমনি অভক্তদেরও খেতে দেখা যায়।"
"সে তো নেশা করার জন্য। ওটা তো নেশাদ্রব্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সেটা শিবের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেল?"
"হাসালে দেখছি। কে বলল, গাঁজা নেশাদ্রব্য!"
"'গাঁজা' 'নেশাদ্রব্য' নয়! তাহলে কী? ঔষধ?"
"হ্যাঁ। ঔষধ। 'ভেষজ' ঔষধ।
"পাগল হয়েছেন!"
"না। বরং 'গাঁজা' যে ভেষজ গুনে গুণান্বিত সেটা প্রথম ভারতবাসীকে শিব বা মহাদেবই শুনিয়েছিলেন, এবং জানিয়েওছিলেন।( পৃষ্ঠা ২৭- তন্ত্রের শিকড় সন্ধানে/ড: জয়দেব মুখোপাধ্যায়)"
"তা কী এমন গুণ রয়েছে?"
"পাশ্চাত্য ভৈষজতত্ত্বে গাঁজার গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি বেদনা নিবারক, স্নিগ্ধকারক, ধনুষ্টংকার নাশক, মাদক, মূত্রকারক ও প্রসবের সহকারী। শুধু তাই নয়, কম্প, প্রলাপ, তড়কা, কলেরা, রক্তস্রাব, বাত, হাঁপানি প্রভৃতিতেও গাঁজার ব্যবহার হয়ে থাকে। (পৃষ্ঠা-৩০/ তন্ত্রের শিকড় সন্ধানে)
"কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কি আর এসব কথা বিশ্বাস করবে! এগুলোকে গাঁজাখুরি বলে তো উড়িয়ে দেবে!"
"সে দিতেই পারে। তবে John Warings এর "Pharmacopaeia of India"-র ৪৬৪ পাতার লেখাটি পড়লে তোমারও ধারণা পাল্টে যাবে। ডাক্তার অসফনেসি গাঁজাকে ঔষধি রূপে বিদেশে ব্যবহারও করেছিলেন। তবে মাত্রাতিরিক্ত হলে সেটা তো ক্ষতিকর হয়ে উঠবেই। সেটা যে কোন ড্রাগের পক্ষেই সমান সত্য। বেশ কিছু বছর আগেও পাড়ার ঠাকুর ভাসানে ছেলে ছোকরারা যে 'সিদ্ধি' খেত, সেই 'সিদ্ধি' আসলে কী! সে তো 'গাঁজা' গাছের পাতাই। আর 'গাঁজা' বলে যেটাকে জানি সেটা তো আসলে গাছের 'ফুল'। হিমালয়ের কনকনে ঠান্ডায় দিগম্বর সাধুদের শরীরকে বাঁচিয়ে রেখেছে ওই গাঁজার টানই। একবার ভেবে দেখো, কয়েক হাজার বছর আগে এই গাঁজাকেই ভেষজরূপে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের পরম আরাধ্য দেবতা 'শিব'।"
"জঙ্গলমহলের সবথেকে বড় 'গাজন' উৎসব পালিত হয় গোপীবল্লভপুরের 'চোরচিতা' গ্রামে। এখানে শিবের নাম 'চোরেশ্বর'। শিবের সহস্র নামের মধ্যে 'চোরেশ্বর' বলে কি কিছু পেয়েছেন?"
"শোনা যায় এক সময় এখানে চোরের খুব উপদ্রব ছিল। তাই চোরেদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্যই হয়তো কেউ এই 'চোরেশ্বর শিব' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ১২৫) আসলে এই শিবের নামের অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যেকোনো শব্দের শেষে '-(ঈ)শ্বর' যোগে শিবের নাম প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই যেমন কলকাতা হাইকোর্টের কাছে একটি শিব আছেন তার নাম নাকি 'হাইকোর্টেরশ্বর'।"
"ধুর! হতেই পারে না! এরকম শিবের নাম কখনো তো শুনিনি। 'হাইকোর্টেশ্বর' বলে কোন শিব হতে পারে নাকি! নিশ্চয়ই বানিয়ে বলছেন?"
"বানিয়ে বলতে যাব কেন! বিনয় ঘোষ তার "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি" গ্রন্থের ১২৫ পৃষ্ঠায় তো সে কথা জানিয়েছেন। কয়েকজন ব্যবসায়ী ঐ 'শিব' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যারা হাইকোর্টে মামলা মোকদ্দমা করতে যান তারা প্রণামী দেন ও মানত করেন। এতে প্রতিষ্ঠাতাদের যে ভালো রকম আয় হয় সে কথা তো আর তিনি এমনি এমনি বানিয়ে বলেননি। তবে এখনো আছে কিনা বলতে পারব না। এরকম নামকরণ কেবল আধুনিককালের নয়। প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এই যেমন বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার 'সিয়ান' গ্রামে একটি 'শিলালেখ' পাওয়া গেছে। সেই 'শিলালেখ'-তে শিবের কয়েকটি এরকমই নামের পরিচয় আছে। যেমন 'হেতুকেশ' শিব, 'বরাক্ষেশ্বর' শিব, 'ক্ষেমেশ্বর' শিব, 'বটেশ্বর' শিব, 'মতঙ্গেশ্বর' শিব ইত্যাদি। এগুলো সবই সম্ভবত স্থান নাম থেকেই হয়েছে। (পৃষ্ঠা ৭১২, বাঙ্গালীর ইতিহাস/নীহাররঞ্জন রায়) সুতরাং নামে কিছু এসে যায় না। কথায় আছে না, মানলে 'শিব' নয় তো 'পাথর'।"
তথ্যসূত্র: ১) বাঙ্গালীর ইতিহাস/ নীহাররঞ্জন রায়
২) ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে(১ম খণ্ড)/ ড: জয়দেব মুখোপাধ্যায়
৩) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি(দ্বিতীয় খণ্ড)/ বিনয় ঘোষ
৪) বিশ্বকোষ(বিংশ খণ্ড)/ নগেন্দ্রনাথ বসু
0 Comments