জ্বলদর্চি

হে, কবি হে... /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

হে, কবি হে...

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 


যাঁরা উঠতে বসতে ভুল বানানের কবিতা লেখেন, যাঁরা একই ঢঙে সারাজীবন একই ভাবে লিখে যান -- নিজের লেখায় নতুন কিছু খোঁজেন না, যাঁরা সূচিপত্রের দাবিতে বছরে ৩৫০ টি কবিতা লেখেন ও প্রকাশ করেন, যাঁরা কবিতার স্বর্গে বাস করবেন বলে প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, পরিবারকে ত্যাগ করেন, যাঁরা কবিতা উৎসবে ডাক পাবেন বলে চার মাস অন্তর বই প্রকাশ করেন, যাঁরা কবিতা উৎসবে ডাক না পেলে হতাশায়  কর্মকর্তাদের খিস্তি দেন, যাঁরা বহুল প্রচারিত পত্রিকায় লেখা বেরুলে কাছের বন্ধুদের চিনতে পারেন না, যাঁরা ভাবেন পুরস্কারপ্রাপ্ত বই মানে 'নিশ্চিত ভালো', যাঁরা পুরস্কার পাওয়ার জন্য লেখক জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন, যাঁরা কবিতায় সাম্যবাদ, নিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা তুলে ধরে চমকে দেন অথচ বাস্তবে চরম সাম্প্রদায়িক, যাঁরা সাহিত্যসভায় গম্ভীর ভাবে তত্ত্ব ছুঁড়ে মারেন ও শ্রোতার আসনে এসে অন্যের তত্ত্বকে নিছক তথ্য ভেবে অন্যমনস্ক হোন, যাঁরা পড়ে সময় নষ্ট না করে গুচ্ছ গুচ্ছ লেখেন ও সব লেখা মুদ্রণযোগ্য ভাবেন-- তাঁরা নিশ্চয়ই নিজেদের কাজের পক্ষে সদর্থক যুক্তি পান বলেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করেন!
 সেই মিথ্যা আত্মবিশ্বাসের জোরে অন্যের সমালোচনা করেন। দিন রাত। রাত দিন। এঁরা নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ ভাবেন। এঁরা নির্ণয় করে দেন আধুনিক সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, খোদাই করেন কালজয়ী কবিদের তালিকা, দেন লিটল ম্যাগাজিনের চিরন্তন সংজ্ঞা। এঁরা নির্ণয় করেন কারা প্রকৃত লেখক কারা বাণিজ্যিক তথা মিথ্যা লেখক। এঁরা সরকারকে ট্যাক্স দেবেন, সরকারি চাকরি করবেন কিন্তু সরকারি উদ্যোগে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে উঠুক চাইবেন না। এঁরা জীবনবিমা করবেন কোটি টাকার, লক্ষ লক্ষ টাকার বই ছাপবেন কিন্তু তাঁর অবর্তমানে সে বই কোথাও পাওয়া যাবে না। কারণ বই সংরক্ষণ তথা লেখকজীবনের বিমা নিয়ে ভাববেন না এঁরা। এই 'এঁরা'-ই স্বপ্ন দেখবেন ও স্বপ্নের কথা প্রিয়জনকে বলে যাবেন যে তাঁদের লেখা সমকাল বুঝলো না, মহাকাল বুঝবে। এঁরা ভাবগম্ভীর। চিন্তামগ্ন। লিখে আনন্দ পান না। সারাক্ষণ নিজের লেখা প্রকাশে সচেষ্ট ও পুরস্কার কমিটির কাছে আবেদন নিবেদন নিয়ে চরম ব্যস্ত।
আচ্ছা, হে কবি, লেখা কমিয়ে, সময় বার করে বন্ধুর পাশে কখনও বসেন! অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান! প্রিয়জনের জন্য  হাসপাতালে রাত জাগেন! এসব কাজে হে কবি, কবিতা লেখার মতোই আনন্দ পান আপনি! প্রশ্ন থাকলো। উত্তর জানেন কেবল আপনিই।

কবিতা কবিতাই। ভালো, খারাপ, জনপ্রিয়তা, হারিয়ে যাওয়া সব আপাত। সব সময়ের হাতে, সময় শেষ কথা বলে- এমন সহজ ব্যাখ্যাতে আস্থা নেই। কারণ, সময়ও পরিবর্তনশীল। একসময় যা অসম্ভব জনপ্রিয়, এক সময় তা-ই আবার অনুজ্জ্বল। সুতরাং, সময় ব্যাখ্যাতীত। জীবন অন্তহীন। ব্যক্তি জীবন সীমিত। সময় অখণ্ড। তাই মুহূর্তও মূল্যবান। কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি নিছক সময়কে গুরুত্ব দেয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী চলে না।
কবিতা লেখা বা পড়া-- কোনওটাই জরুরি নয়, যদি না হয় তা মেজাজ অনুযায়ী। আমাকে আশ্রয় দিচ্ছে কি না! এমন কবিতা লিখলাম যা কেউ ছাপতেই চাইলো না! তা না ছাপুক। পাঠক তো শূন্য নয়! আমি কি কম পাঠক! সবচেয়ে বড় পাঠক। এই মেজাজে অজস্র কবিতা থেকে যায় অপ্রকাশিত। তা থাকুক। না-লেখা কবিতাই তো আসল কবিতা। এই মেজাজেই বহু জনপ্রিয় কবিতাকে মনে হয় 'ধোঁয়া'। এই আছে, পরমুহূর্তেই কোথায় মিলিয়ে যায়! ধোঁয়া নয়, আমি খুঁজি ধোঁয়ার উৎস, আগুন। চাই প্রতিটি আগুনের উৎস-মুখ যেন হয় নতুন। অজস্র কবিতার মাঝে নতুন খুঁজি। নইলে আনন্দ নেই। একই ধরনের কবিতা না লিখে না পড়ে আসুন ভালো সিনেমা দেখি। মেজাজহীন কবিতা লিখে, পড়ে আয়ু নষ্ট করবো কেন! আসুন বারান্দায় বসে থাকি অকারণ। গান শুনি। আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে, শুনে ও ভেবে কাটানো যায়। সৌন্দর্যের দিকে তাকালে সুন্দর কি রাগ করবে! আসুন, রূপ ও সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নির্মাণ করি স্বাধীন নিরপেক্ষ ভাবে। সাজসজ্জাকে গৌণ করে আসুন মেধাযুক্ত মানুষকেই বলি: সুন্দর।
আসুন, সুন্দরের দিকে অপলক হই। তাকিয়ে থাকি সামনের দিকে। অকারণ। 'অকারণ' শব্দেও তো 'কারণ' আছে। আসুন গাছ লাগাই, গাছ দেখি। আসুন পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে বেড়াই, পুরোনো স্মৃতিকে উদ্ধার করি। সম্পর্ককে মেরামত করি। যা কিছু অপছন্দ, অথচ সমাজের চাপে "না" বলতে পারিনি, এবার থেকে চোখে চোখ রেখে "না" বলি। জীবন একটাই। নিজের জন্য পরিবারের জন্য, পরিচিত অপরিচিত জনের জন্য জীবনের কাছে সুন্দরের প্রার্থনা জানাই। আসুন মাধুর্যকে দিই চিঠি। না-লেখা চিঠি পৌঁছে দেবে আমাদের মেঘদূত। আসুন, পেনসিলে লেখা ধর্ম-অধর্ম, দেশভাগ-কাঁটাতার, জাতপাত, হিংসা-প্রতিহিংসা, রাজা-প্রজা মুছে জীবনের জন্য মানত করি। তবেই তো আমরা আবার ফিরে দাঁড়িয়ে, পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাবো। তবেই তো কবিতা হয়ে উঠবে প্রকৃত কবিতা! চেয়েছি বলেই এত দেশ, এত দ্বেষ,  নইলে একটাই পৃথিবী হত। আসুন, সেই দেশের নাগরিক হতে চাই, যে দেশের সংবিধানে উল্লেখ থাকবে : প্রেম অবশ্যম্ভাবী ও জরুরি। 
আপনি কি এমনই বস্তুবাদী, যে কারণ ছাড়া জীবনকে পান না! তাও সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে ঢুকে পড়লেন! তবে কি আত্মঘাতী স্বভাবের আপনি নিজেকেও ভালোবাসেন না! হে, কবি হে!


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇





Post a Comment

10 Comments

  1. সত্যি। গুছিয়ে লিখেছেন। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. একদম সঠিক সময়ে একদম সঠিক দীপ্ত উচ্চারণ। আপনার এই বাক্যবন্ধটি ভীষণ ভালো লাগে-" চেয়েছি বলে দেশ, দ্বেষ।" শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো। 🌹

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ

    ReplyDelete
  4. ভাল লেখা।সত্যি কথা-

    ReplyDelete
  5. শানিত কলম.. দারুন স্যার 🙏

    ReplyDelete
  6. ঈশিতা ভাদুড়ীJanuary 21, 2023 at 10:13 PM

    বাঃ!

    ReplyDelete
  7. তরবারির ধারকেও হার মানাবে। শুভ কামনা রইল ।

    ReplyDelete
  8. কী বলবো! গভীর মননে পড়লাম। প্রতিটি শব্দবন্ধই যেন আমারই মনের কথা। মুগ্ধতা রেখে গেলাম।

    ReplyDelete
  9. আপনার ভাবনা সত্যিই ছুঁয়ে গেল।আমরা ক্ষমতালোভী/খ্যাতির লোভ আমাদের সবার অল্পবিস্তর আছে।উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে লিখে সত্যিই কোন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়না আমাদের সৃষ্ট সাহিত্যে।শিখলাম অনেক কিছু।অশেষ ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete