একলা বসি বিজন ঘরে, হৃদয় যেন ভয়ে মরে
তাই আমেরিকা আসবার স্থির লক্ষ্যে অবিচলিত থেকে পড়াশুনা ও শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ জীবনের রোমাঞ্চময় ইতিহাস নিয়ে দিনাতিপাত করছি। কারণ তখনও তো বি.ই. কলেজ(শিবপুর) গন্ডী পেরুবার সময় হয় নি। বি.ই. ফাইন্যাল সেকশন 'বি' সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় নি। ফলাফলের প্রতীক্ষায় দিনগোনার উপসর্গটা তখন যেন বেশ বহুল পরিমাণে বৃ্দ্ধি পেল। চাকরী করবার ঝোঁকটাও মাথায় চেপেছে। দেশেই অর্থাৎ ভারতবর্ষে থেকে কাজ করতে হবে- এ রকম তখন মনের ভাব। আমেরিকা যাওয়া অসম্ভব। TOEFL এবং GRE পরীক্ষা দিয়ে কাঠখড় পুড়িয়ে আমেরিকায় স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে এসে- স্টুডেন্ট লাইফ শেষ হলেই দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই। কারণ, আর্থিক অবস্থার কথা ও নিজের সংগতির দিকটা ও তো আমাকেই ভাবতে হবে। আমার নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম ও ইমিগ্রান্ট ভিসার ব্যাপারে ঐশ্বরিক প্রার্থনা পাশাপাশি চলছে।
এমনি করেই ১১ই এপ্রিল থেকে ১১ই জুন ১৯৭৪ কেটে গেল। এই সুদীর্ঘ দুমাসে আমেরিকা আসার প্রস্তুতির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উন্নতি হয় নি। এই জুনমাসের ১১ তারিখ, ১৯৭৪ সাল আমার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন কারণ-আমার বি.ই. ফাইন্যাল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রথম শ্রেনীতে উত্তির্ণ হলাম। আমার আবাল্যস্বপ্ন ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সাধনা আজ বাস্তবায়িত। পিতৃদেবের ইচ্ছা আজ সফল যদিও তাঁর বিয়োগ আমার শৈশবেই। সত্যিই আমি গর্বিত ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছি বলে। এবার চাকরী খোঁজার পালা। ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসার সন্ধানেও রয়েছে আমার সজাগ দৃষ্টি।
ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর
নামকরা এক দেশীয় সাহিত্যিকের কলমের টানে জন্ম নিয়েছিল খুব সুন্দর কয়েকটি অক্ষর। আর এই অক্ষরের সমন্বয়েই তো বাক্যের প্রকাশ “ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর।” আমিও তখন ভিসার সন্ধানে সতীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে পরশ পাথর খুঁজছি ।
জানি না বন্ধুবর সঞ্চয় ঘোষের, “ইউ আর এ লাকি চ্যাপ হিরে -ডোন্ট বি নার্ভাস। সিওরলি য়্যু উইল কাম আউট উইথ ফ্লাইং কালারস।” এই উক্তিগুলো মনের মধ্যে গাঁথা রয়েছে। সেদিক দিয়ে তাই কিছুটা নিশ্চিন্তও রয়েছিলাম। ঈশ্বরের বরপুত্রের জন্য হাজার দুয়ারীর দ্বার খোলা ইঞ্জিনিয়ার হবার পর থেকেই।
এই হতভাগ্য “পরশপাথর” সন্ধানীর জন্মলাভের পর থেকেই জীবনের উপর দিয়ে যে কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে
গিয়েছে তা ভাষায় অবর্ণনীয়। এই ক্ষ্যাপা যখন অবোধ শিশু , তখন তার পিতৃকুল আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধাচারণে তার পরিবার যখন পথে বসতে শুরু করেছে তখন একমাত্র মাতুলপরিবার ছাড়া আর কেউ কোনই সাহায্য করে নি। দুফোঁটা চোখের জল ফেলে সহানুভূতি জানাবার প্রয়োজন ও বোধ করে নি। জীবনের প্রথম প্রত্যূষে যে ঝঞ্ঝা আমাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে সাহায্য করেছে , তরঙ্গবিক্ষুব্ধ নদীর মাঝদরিয়ায় ভগ্নহাল-ছিন্নপাল মাঝির কপালের ঘামটুকু মুছবার সময়টুকু যখন অশেষ মূল্যবান, তেমনি মাতুলপরিবারের সহায়তা আমার চারজনের পরিবারের সাক্ষাৎ জীয়নকাঠি। এটা ঈশ্বরের অমোঘ করুণা।
যোগ্যতার কষ্টি পাথরে আমাকে এ পর্য্যন্ত অনেকবার পরীক্ষা করেছেন করুণাময় ঈশ্বর। শৈশবে পিতৃবিয়োগ , সম্পত্তিলোলুপ কাকাদের দ্বারা পৈ্তৃকগৃহ থেকে চিরদিনের মত বিতাড়িত, পাড়া -প্রতিবেশীর সহানুভূতিহীন কথাবার্তা এবং পৈ্তৃক গৃহ বিতাড়নে কাকাদের সহায়তা করা-এ সমস্তই লিপিবদ্ধ হয়েছিল করুণাপরবশ ঈশ্বরের এই দুদিনের হাসি-কান্নার দোলায়িত পৃ্থিবীর জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ-নিবন্ধনের হিসাব নিকাশের খাতায়। “স্ট্র্যাগল ফর এগজিস্টেন্স” কথাগুলোর সত্যতা পৃ্থিবীর মাটি স্পর্শ করবার পর থেকেই যাচাই করতে পারছি। স্যাঁকরার দোকানে ছাইচাপা আগুনের নীচে পড়ে সোনার ঔজ্জ্বল্য যেমন ক্রমশঃই বৃ্দ্ধি পায়, আমি ও আজন্ম দুঃখের আগুনে পুড়ে সবই বুঝতে শিখেছি। এ সবই ভগবানের দান, করুণাও বলা যেতে পারে একটা কারণে।
জন্মগ্রহণের পর চোখের পাতা খুলতেই- “মা” “মা”- বলে সম্বোধন করার সেই ভাগ্য আমার হলেও পিতৃদেবের স্নেহ ভালবাসার কথা আমার নিজের একদমও মনে নেই। আমার ছোট ভাই তো তাঁকে চোখেও দেখে নি। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হতভাগ্য এই যে লোক পৃ্থিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করবার আগেই কালবৈশাখী ঝঞ্ঝার কবলে পড়েছিল, জীবনে বেঁচে থাকবার ক্ষীণ আশা ও যে পরিবার (চারজনের) ভাবতে পারে নি- আজ সেই পরিবারে আনন্দের জোয়ার একমাত্র ঈশ্বর কৃপায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই আনন্দজোয়ারে অবগাহনে এক ব্যক্তিই কেবল অনুপস্থিত। চিরতরের জন্যই তিনি এই অবগাহনে বঞ্চিত স্বর্গবাসী বলে।
তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ
ভাগ্যবান লোকের ব্যাপারই আলাদা। হতভাগ্য লোকের তো কথাই নেই, “অভাগা যে দিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।” আমার বক্তব্য ভাগ্যবান আর হতভাগ্য এই দুশ্রেণীকে নিয়েই। এ সম্পর্কে কারো মনঃক্ষুণ্ণ হবার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করি। কারণ জন্মলাভের সংগে সংগে হাসপাতাল নার্সিং হোমে যেমন “বার্থ রেজিস্ট্রেশন “ হয়ে যায়, তেমনি জন্মলাভের আগে আগেই পূর্বজন্মের কর্মফলের উপর ভিত্তি করেই ভগবান পাঠিয়ে দেন তার শিষ্যকে। তাঁর এই বিধিলিপি খন্ডাবার সাধ্য কারো নেই।
মানুষের কপালেই তাঁর ভাগ্য লেখা থাকে। যে এই কপাললিখন পাঠে অভ্যস্ত সে তাড়াতাড়ি নিজের কর্মক্ষমতা -কে সচল করতে শেখে। বাস্তবমুখী হয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাবার চেষ্টা করে। চলার রাস্তা কুসুমাস্তীর্ণ না হলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা এবং হোঁচট খেয়ে পথচলা অভ্যাস করতে হয়- ঠিক তেমনই অবস্থা হয় কপাললিখন পড়তে না পারলে। আমি সেদিক থেকে হয়তো সৌভাগ্যবান কারণ ঈশ্বরের অদৃশ্য ইংগিতে শৈশবেই বুঝে নিয়েছিলাম আমার কপাল লিখন আর তার প্রস্তুতি ও ক্রিয়াকলাপ বাস্তবায়িত করতেই জীবনের কিছু বছর কেটে গেল।
এখন জীবনটাকে গড়ার পালা। আকাশচুম্বী বাড়ির ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গিয়েছে ভারতবর্ষে থাকতেই -এখন প্রয়োজন সৌধ নির্মাণ। এই নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ কারিগর ও মালমশলার সন্ধানেই হন্যে হয়ে ছুটতে হবে আমাকে আমেরিকায়।
কথায় বলে হেঁটে-হেঁটে জুতোর শোল না খুঁয়োলে চাকরী পাওয়া অসম্ভব । সেদিক থেকে আমার ভাগ্যদেবী হয়তো আমার উপর কিছুটা সুপ্রসন্ন অন্ততঃ যতদিন পর্য্যন্ত ভারতবর্ষে ছিলাম। কারণ শিবপুর বি.ই. কলেজের ফাইন্যাল পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে নিয়ে যেদিন আর্গোসিতে ঢুকছি, তার দুদিন পরেই একটা চাকরিতে যোগদানের 'অফার' পেলাম। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে লাগতে পারে। কারণ মামা-কাকার খুঁটির জোর না থাকলে চাকরি পাওয়া অসম্ভব এই ধরণের একটা প্রবাদ বাক্য বহুদিন থেকেই চলে আসছে। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এ ধরণের সুযোগ পুরোমাত্রায়, শতকরা একশোভাগ বলা যেতে পারে। কারণ আমি নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তার উপর আমার চার মামার মধ্যে দুজন সিভিল এবং দুজন মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার – সবাই শিবপুরের ছাত্র এবং উচ্চপদে কর্মরত। ছোটমামাই কেবলমাত্র ব্যতিক্রম- ডাক্তার । কাজেই চাকরীর ক্ষেত্রে মামার খুঁটির জোর আমার ক্ষেত্রে বহাল তবিয়তেই। তবুও আমার এই চাকরী (যেটা ১লা জুলাই, ১৯৭৪ জয়েন করেছিলাম) পাবার ইতিহাস একটু সংক্ষেপে বলে রাখি। আমেরিকান ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসা জোগাড় করবার ব্যাপারে আমার অফিসের টেলিফোন-টারও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তাই টেলিফোনের সহায়তাকে অস্বীকার করলে আমি অকৃ্তজ্ঞ হয়ে পড়ব। সেজন্য চাকরী পাওয়ার ইতিহাসটা সংক্ষেপে বলে রাখছি। চাকরী না পেলে ঐ টেলিফোনের কোন সহায়তাই আমি পেতাম না ইমিগ্র্যান্ট ভিসার ব্যাপারে এ্যাপ্লাই করবার আগে। থ্যাঙ্কস টু দ্যাট টেলিফোন (নং ২২-৫৭০৬)।
চাকরী পাওয়ার ব্যাপারটা সত্যিই আশ্চর্য্যজনক। আমার জনৈক শিল্পী বন্ধু শ্রীমান সুকুমার চট্ট্যোপাধ্যায় (যিনি হাবড়া গার্লস হাইস্কুলের পিছনে বসবাস করেন, ডঃ দুর্গাদাস চট্ট্যোপাধ্যায় -এর তৃ্তীয় পুত্র) এই চাকরীর যোগসূত্র পরোক্ষভাবে। শ্রীমাণ দেবদাস চট্ট্যোপাধ্যায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (ডিপ্লোমা) এবং সুকুমার চট্ট্যোপাধ্যায় -এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই হলেন আমার চাকরীতে যোগদানের সু্যোগদাতা। ১৯৭৪ সালের ১লা জুলাই সোমবার(বাংলা ১৭ই আষাঢ় ১৩৮১ সাল)কলকাতা প্লাকন (PLACON) প্রাইভেট কোম্পানীতে জয়েন করি। ঐ কোম্পানীটা হল আর্কিটেকচারাল এ্যান্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম, বিশেষ করে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার একছত্র আর্কিটেক্ট। ওঁর মালিক মিঃ কে এস রায়চৌধুরী (কালী শংকর রায়চৌধুরী ) ১৩৮ বিপ্লবী রাসবিহারী বসু রোড(138 Canning Street) কলকাতা -১, ফোনঃ ২২-৫৭০৬। এটাই আমার চাকরী জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র বি.ই. কলেজ থেকে বেরুবার পরেই। প্লাকন কোম্পানীতে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার জুন ৩০, ১৯৭৪ পদত্যাগপত্র পেশ করায় তাঁর স্থান পূরণের সৌভাগ্য হল আমার। চাকরীটা ঐ সুকুমার চট্ট্যোপাধ্যায়ের দাদা দেবদাসবাবুর জন্যেই জুটেছিল। ফলে রেজাল্ট হাতে নিয়ে বিশ্রাম পাবার ফুরসুৎ-ই হয় নি। মনের আনন্দে চাকরীতে জয়েন করলাম ১লা জুলাই ১৯৭৪, সোমবার। অফিস কর্মী ছাড়াও আমার প্রিয় আপন জন হয়ে উঠল আমার টেবিলের উপরকার টেলিফোনটা। সমস্ত অফিসে যোগাযোগের ধারক ও বাহক হবার দায়িত্ব সহাস্যে কাঁধে নিল ঐ টেলিফোন। ভিসা জোগাড়ের ক্ষেত্রে তার অনবদ্য ভূমিকা।।
মরা গাঙে এলো জোয়ার
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ভিসা পাবার ব্যাপারে যখন নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছি, ইমিগ্রেশ্যান সম্পূর্ণ বন্ধ ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন মনমরা হয়ে দিন কাটাচ্ছি- আমেরিকা আসার উৎসাহে বেশ ভাঁটা পড়ে গিয়েছে। ঠিক তখনই মরা গাঙে জোয়ার এনে দিল আমার ছোটমামা শ্রী তুষার নিয়োগী পেশায় যিনি ডাক্তার । সম্ভবতঃ জুন ১১, ১৯৭৪ মংগলবার (বাংলা ২৮শে জৈষ্ঠ, ১৩৮১ সাল)। ওঁর পরামর্শমত একাই আমেরিকান কন্স্যুলেট অফিস ৩ এ সেক্সপীয়ার সরণী, কলকাতা -১৬ তে গিয়ে হাজির হলাম। রিসেপশানিস্ট-এর কাছ থেকে ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসা সেকশনে ঢুকতেই দেখলাম যে ইমিগ্রেশ্যান ওপেন্ড। তখন ঐ বিভাগে দুজন কর্মরত ছিলেন একজন মিঃ পি গ্যাণ্টি, গায়ের রং মাজামাজা, একটু কালোর দিকে, উচ্চতায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির মত; অপরজন মিঃ প্রদীপ সেন বাংলাভাষী হলেও কর্মসূত্রে ইংরাজী বলছেন-ফর্সা, খর্বকায়, উচ্চতা ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি; বড় জোর ৫ ফুট ০ ইঞ্চি।
মিঃ গ্যাণ্টির অফিসে ঢুকে বললাম<
-আই কেম টু নো ফ্রম মাই ফ্রেন্ড দ্যাট ইমিগ্রেশন ইজ ওপেন্ড, মিঃ গ্যান্টি?
-ইয়্যা (ইয়েস কথার সংক্ষিপ্ত রূপ 'ইয়্যা')
-দেন আই লাইক টু হ্যাভ দি ফর্মস কন্সারর্ণিং ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসা
-জাস্ট ফিল আপ দিস ফর্ম এ্যান্ড সেন্ড ইট বাই মেল, মিঃ রে
-ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ !!
আমি ঠিক করেই গিয়েছিলাম ফর্ম/কাগজপত্র কিছু দিলে সেগুলো পূরণ করে ওই অফিসের রিসেপ্সানিস্ট-এর হাতে জমা দেব ডাকে পাঠাবার অপেক্ষা না করেই। তা ছাড়া, ডাকে পাঠালে অহেতুক কয়েকটা দিনও নষ্ট হবে। সৌভাগ্যবশত; জনৈক অনুপম বোসের সাথে (বি.ই.কলেজ , মেকানিক্যাল, ১৯৭০ ব্যাচ) ওখানেই এই ভিসার সূত্রে যোগাযোগ হল !
বন্ধুত্বের পর্য্যায়ে অনুপম বোসকে ফেলতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না। বি.ই.কলেজের ছাত্র হিসাবে ঘনিষ্ঠতা আরও একটু বেশী হল। বেশ মনে আছে, কন্স্যুলেট অফিসে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে যে ফর্মটা পূরণ করলাম সেটা ছিল প্রথম ফর্ম FS 497 ( Preliminary Questionnaire to Determine the Immigran Status)। দেশে তখন ঘন ঘন লোড শেডিং হচ্ছিল, বিদ্যুৎ সরবরাহে বেশ বিঘ্ন ঘটছিল। তাই হ্যাজাক লাইটের আলোর নীচে বসে দুবার চোখ রগড়ে FS 497 ফর্মটা পড়ে পূরণ করলাম। তখনও অবশ্য অনুপম বোসের সংগে পরিচয় হয়নি। কারণ উক্ত ভদ্রলোকের দৈহিক আকৃ্তি (৬ ফুট উচ্চতা) এবং গায়ের রং (বেশ কালো) দেখে অনুমান করতে আমার বেশ সময় লেগেছিল বাঙ্গালী কিনা জানতে। ফর্ম পূরণ করে আমি একটা খামে ভরে (তখন সবসময় সংগে থাকত খাম, সাদা কাগজ, সেলোটেপ; লাল ও নীল কালির পেন, red pen for marking “Urgent!”, আলপিন, জেমস ক্লীপ) রিসেপ্সানিস্ট-এর হাতে জমা দিতে যাচ্ছি তখন মিঃ বোসের সাথে আমার সাক্ষাৎকারঃ
-এক্সকিউজ মি, ইউ আর এ্যাপ্লাইং ফর ইমিগ্রেশন ?
-ইয়্যা।
-আর ইউ এ্যান এনিজিনিয়ার অর ডক্টর?
-এঞ্জিনিয়ার, মেকানিক্যাল ফ্রম বি.ই. কলেজ, ১৯৭০।
-মি টুঃ, সিভিল, ১৯৭৩। ডু ইউ নো বাংলা?
-ইয়্যা, এ্যন্ড ইউ?
-ইয়্যা
এরপরের কথোপকথন মিঃ বোসের সঙ্গে খাস বাংলাভাষায়। কথাপ্রসংগে অনুপম বোসের একটা সাদা খামের প্রয়োজন বুঝলাম। বিন্দুমাত্র ইতঃস্ততঃ না করে ওকে একটা খাম দিতেই ধন্যবাদের ঝুড়ি আমার মাথার উপর পড়লো। ঐ ফর্মটাতে FS 497 এর 23 no. Item এ Why do you intend to go to U.S.A? এর উত্তরে আমি লিখেছিলাম “Like to go for M.S. and Ph.D in Environmental Engineering & then job Seeking। আর অনুপম বোস লিখেছিলেন “লাইক টু বি গেনফুলি এমপ্লয়েড ইন স্টেটস ।” ওই Item 23 এর ক্ষেত্রে দুজনে দুরকম লেখায় একটু চিন্তার মধ্যে ছিলাম কারণ আমাকে যদি স্টুডেন্ট ভিসার পর্য্যায়ে ফেলে তাহলেই তো মুস্কিল! আবার তাহলে GRE এ্যান্ড TOEFL পরীক্ষায় বসতে হবে; যার রেজাল্ট আর কাঠখড় পোড়াতেই প্রায় ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি হয়ে যাবে। কনস্যুলেট অফিসের রিসেপ্স্যানিস্টের হাতে দুজনেই ফর্ম FS 497 জমা দিয়ে বেরুলাম ১৮ই জুন, ১৯৭৪ বেলা বারোটা নাগাদ ।
ক্রমশঃ
0 Comments