জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প – সিরিয়া /বেড়ালমাসির বাহারী লেজ /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প – সিরিয়া
বেড়ালমাসির বাহারী লেজ
চিন্ময় দাশ
 
এক গ্রামে থাকতো এক বুড়ি। অভাবী মানুষ। সম্বল বলতে, একটা ধাড়ি ছাগল ছিল কেবল বুড়ির। দুধেল ছাগল। বুড়ির পেট চলত সেই ছাগলের দুধ বেচেই।
সকালে উঠে, বুড়ির প্রথম কাজ দুধ দুয়ে ফেলা। তার পর ঘর সংসারের টুকিটাকি কাজে সেরে নিল। এবার দুধের ভাঁড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই বাড়ি ওই বাড়ি দুধ ফেরি করে বেড়ায়।
একবার বুড়ির খেয়াল হোল, ভাঁড়ে দুধ যেন কম, মালুম হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? দুধ তো উবে যাওয়ার জিনিষ নয়!
পরদিন তক্কে তক্কে ছিল বুড়ি। ঠিক চোর ধরে ফেলেছে। দুধ রেখে, ঘরকন্নার কাজে যায় বুড়ি। সেসময়েই একটা বেড়াল এসে দুধ সাবাড় করে দিয়ে যায়।
বুড়ি যে সেদিন ঘাপটি মেরে বসে আছে, বেড়ালমাসি  জানবে কী করে? বেচারা সবে মুখ ডুবিয়েছে ভাঁড়ে। কপাক করে তার ঘাড় ধরে ফেলেছে বুড়ি। চেঁচিয়ে উঠেছে—তবে রে, হতচ্ছাড়ি! চুরি করে দুধ খাওয়া? আজ হাতে হাতে ফল পাইয়ে দিচ্ছি তোকে। 
বেড়াল তো ভয়াণক ঘাবড়ে গিয়েছে। প্রথমে মিয়াঁও, মিয়াঁও করে চেঁচাল কিছুক্ষণ। কিছুতেই কিছু হোল না। 
এবার কাকুতি মিনতি করতে লাগল—এবারের মত ছেড়ে দাও। আর কখনো এ বাড়ি মুখো হবো না।
--আরে ছি-ছি। সে কী কথা? আসবি না কেন? আসবি। অবশ্যই আসবি, নিত্যদিন আসবি। রাগে গরগর করছে বুড়ির গলা—আমি যত্নকরে দুধ সাজিয়ে রাখবো। আসবি আর চুকচুক করে দুধ খেয়ে, গোঁফ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে যাবি।
বুড়ি কথা বলছে, আর বাম হাতে বেড়ালটাকে ঝুলিয়ে ধরে, কিছু একটা যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। 
বেড়ালও চেঁচাচ্ছে—কথা দিচ্ছি, এ পাড়াতেই আসবো না আর কোন দিন। বিশ্বাস করো আমাকে। দোহাই, আজকের মতো ছেড়ে দাও।
বুড়ি বলল—না, না। আসবি না কেন? আমিই তো আসতে বলছি। তবে অন্য কেউ এলে চলবে না। তোকেই আসতে হবে। যদি চিনতে না পারি, তাই একটু ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
বলতে বলতে বুড়ি একটা বঁটি পেয়ে গেল হাতের মাথায়। সেকালে বেড়ালের লেজ ছিল এই ছোট্টটি। একেবারে খরগোশের লেজের মতোই, এই একটুখানি। বুড়ি করল কী, বেড়ালের ছোট্ট লেজটাকে কেটে নিল কুচ করে।


আর যায় কোথায়? যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠল বেড়াল। আর এক লাফে বুড়ির হাত ছাড়িয়ে নেমে, চোঁ-চোঁ দৌড়ে পগার পার।
বুড়ির তো আনন্দ ধরে না। আচ্ছা শিক্ষা দেওয়া গেছে বেড়ালটাকে। আর নিশ্চয় এ মুখো হবার সাহস পাবে না কিছু দিন। 
বুড়ির সব হিসাব ভুল! ভেবেছিল, বেড়াল আর এদিকের পথ মাড়াবে না। কিন্তু অবাক কাণ্ড! খানিক বাদেই বেড়াল এসে হাজির। কেঁদেকেটে একেবারে একশা। বুড়ির পায়ে মাথা কুটতে লাগল—দোহাই বুড়িমা। আমার লেজটা ফেরত দাও।     
   বুড়ি তো পড়ল আকাশ থেকে। বলল—ঐ তো ছোট্ট এক টুকরো একটা লেজ। তার জন্য অতো কান্নাকাটি কেন রে? 
--হোক না ছট এক্টুখানি। কিন্তু লেজ তো? লেজ নাই দেখে, পাড়ার সবার কি হাসাহাসি! টিটকিরি দিচ্ছে সবাই। হুলো তো বলেই দিয়েছে, লেজ না থাকলে, সে আবার বেড়াল না কি? যার লেজ নাই, পাড়ায় তার ঠাঁই নাই। এখন একলা আমি যাই কোথায়? তুমি দয়া করে আমার লেজটা ফেরত দাও।
শেয়ালের হয়রানি শুনে, বুড়ির তো ভারি মজা লেগেছে। বলল-- ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছিস, তাই না? চুরি করবার কেমন মজা, বুঝে দ্যাখ এবার। 
বেড়াল নাছোড়বান্দা—পাড়ায় মুখ দেখাতে পারছি না আমি। দয়া করে লেজটা ফেরত দাও। 
বুড়ি বলল-- লেজটা আমি ফেরত দিতে পারি। তবে, তার আগে আমার দুধ ফেরত দিতে হবে তোকে। তবেই লেজ ফিরে পাবি। তার আগে নয়।
ছুটতে ছুটতে বেড়াল এক ছাগলের কাছে গিয়ে হাজির। বলল—দুষ্টু বুড়িটা আমার লেজ কেটে নিয়েছে। দয়া করে, খানিকটা দুধ দাও আমাকে। বুড়িকে আমি দুধ দেব। বুড়ি আমার লেজ ফেরত দেবে।
ছাগল এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে বলল—ঐ যে সিরীষ গাছটা দেখছ, ওটা থেকে কতকগুলো ডাল-পাতা ভেঙে এনে দাও আমাকে। তাহলে দুধ দেব তোমাকে। 
বিড়াল শিরীষের কাছে গিয়ে বলল-- দুষ্টু বুড়িটা আমার লেজ কেটে নিয়েছে। দয়া করে, কয়েকটা ডালপাতা দাও আমাকে। সেগুলো পেলে, ছাগল দুধ দেবে আমাকে।    আমি বুড়িকে দুধ দেব। বুড়ি আমার লেজ ফেরত দেবে।
গাছটা বলল—বুঝতে পেরেছি, বিপদে পড়েছ। সাহায্য করব তোমাকে। কিন্তু বাছা, জানোই তো কী জলের অভাব এদেশে! আমাকে খানিকটা জল এনে দাও। ডালপাতা পেয়ে যাবে।
বেড়াল এক ভিস্তিওয়ালাকে খুঁজে বের করল। তাকে গিয়ে বলল-- দুষ্টু বুড়িটা আমার লেজ কেটে নিয়েছে। দয়া করে, খানিকটা জল দাও আমাকে। জলটা আমি শিরীষ গাছকে দেব। সে আমাকে ডালপাতা দেবে।  সেগুলো পেলে, ছাগল দুধ দেবে আমাকে। আমি বুড়িকে দুধ দেব। বুড়ি আমার লেজ ফেরত দেবে। 
ভিস্তিওয়ালা বলল—বুঝতে পেরেছি তোমার অবস্থা। কিন্তু তুমি দয়া করে আমার পা-দুটোর দিকে চেয়ে দ্যাখো একটি বার। গরম বালি ভাঙতে ভাঙতে, আমার জুতো জোড়ার একেবারে শতছিন্ন অবস্থা। আমাকে এক জোড়া জুতো এনে দাও। আমি তোমাকে জল এনে দিচ্ছি।
বেড়াল এবার এক মুচির কাছে গিয়ে হাজির—মুচিভাই, মুচিভাই! দুষ্টু বুড়িটা আমার লেজ কেটে নিয়েছে। দয়া করে, এক জোড়া জুতো দাও আমাকে। জুতো জোড়াটা  আমি ভিস্তিওয়ালাকে দেব। সে আমাকে খানিকটা জল দেবে। সে জল আমি শিরীষ গাছকে দেব। গাছ আমাকে ডালপাতা দেবে। সেগুলো পেলে, ছাগল দুধ দেবে আমাকে। আমি বুড়িকে দুধ দেব। বুড়ি আমার লেজ ফেরত দেবে। 
মুচি বলল—তোমার সমস্যা বুঝতে পারছি। কিন্তু বাছা, সেই সকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছি। দানাটিও পড়েনি পেটে। তুমি আমাকে একটা ডিম এনে দাও। আমি একজোড়া জুতো দিয়ে দেব। 
একটা মুরগিকে গিয়ে ধরে পড়ল বেড়াল-- দুষ্টু বুড়িটা আমার লেজ কেটে নিয়েছে। দয়া করে, একটা ডিম  দাও আমাকে। ডিমটা আমি মুচিকে দেব। মুচি এক জোড়া জুতো দেবে। জুতো জোড়াটা আমি ভিস্তিওয়ালাকে দেব। সে আমাকে খানিকটা জল দেবে। সে জল আমি শিরীষ গাছকে দেব। সে আমাকে ডালপাতা দেবে। সেগুলো পেলে, ছাগল দুধ দেবে আমাকে। আমি বুড়িকে দুধ দেব। বুড়ি আমার লেজ ফেরত দেবে।
মুরগি আড় চোখে চেয়ে দেখল খানিক বেড়ালকে। বলল—মওকা পেলেই তো, টুঁটি কামড়ে ধরবার তালে থাকো আমাদের। এখন বপদে পড়ে সাহায্য চাইতে এসেছ?
বেড়াল কাতর গলায় বলল—সেসব কথা এখন থাক, ভাই। পাড়ায় মুখ দেখাতে পারছি না আমি। একটু দয়া করো আমাকে।
মুরগি বলল—ঠিক আছে, দেব ডিম। আগে আমাকে এক মুঠো জোয়ার বা বাজরার দানা এনে দাও।
বেড়ালের ভারি আনন্দ হোল এ কথা শুনে। গাঁয়ের একেবারে মধ্যিখানে একটা গম মাড়াই কল। সেখানে গিয়ে হাজির হল বেড়াল। মাড়াই ঘরটাকেই বলল-- দুষ্টু বুড়িটা আমার লেজ কেটে নিয়েছে। দয়া করে, এক মুঠো জোয়ার বা বাজরার দানা দেবে আমাকে? দানা পেলে, মুরগি ডিম দেবে। সেই ডিম আমি মুচিকে দেব। সে আমাকে এক জোড়া জুতো দেবে। জুতো পেলে ভিস্তিওয়ালা আমাকে খানিকটা জল দেবে। সে জল আমি শিরীষ গাছকে দেব। গাছ আমাকে ডালপাতা দেবে। সেগুলো পেলে, ছাগল দুধ দেবে আমাকে। আমি বুড়িকে দুধ দেব। বুড়ি আমার লেজ ফেরত দেবে।
মাড়াই ঘর বলল—আমার মালিক লোকটা ভারি দয়ালু। কোন দিন ঝাঁটপাট দেয় না মাড়াই ঘরে। গম বলো, জোয়ার বলো, বাজরা বলো—সব দানাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সারা মেঝেয়।
বেড়ালের ভারি কৌতুকল হোল একথা শুনে। সে বলল—কেনগো, ঝাঁট দেয় না কেন?
--দেবে কেন? ইঁদুর বা ছুঁচো বলো, পাখ-পাখালি বলো, বা ধরো তোমার পিঁপড়ের দল। ছোট হোক বা বড়ো, সবারই তো পেট আছে একটা করে, তাই না? ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিয়ে লাভটা কী? তুমিই বিবেচনা করে দ্যাখো। 
বেড়ালের তখন শিরে সংক্রান্তি। কলমালিকের ভালোমানুষি বিচারের সময় তার হাতে নাই। সে মাড়াই ঘরটার মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখল। সত্যিই অনেক দানা ছড়িয়ে আছে মেঝেময়। পাঁচমিশেলি দানা সব। 
মাড়াইঘর বলল—নিয়ে নাও, যতোটা তোমার চাই। 
বেড়ালের তো আনন্দ ধরে না। চটপট দানাগুলো জড়ো করতে লেগে গেল সে। 
এদিকে ঘরের কাজকর্ম সেরে বুড়ি বসে আছে দাওয়ায়। হাতে সেই এক্টুখানি কাটা লেজটা। ছোট হলে কী হবে, দেখতে বেশটি। আর কী নরম তুলতুলে! 
মন খুঁতখঁত করতে লাগল বুড়ির। এইটুকু লেজ কখনো মানায় বেড়ালকে? খানিকটা বড় হলে, কেমন সুন্দর আর মানানসই হতো? 
শুকনো পাট ছিল বুড়ির ঘরে। হাতে কোন কাজ নাই এখন। পাটের নরম রোঁয়া দিয়ে বুনে বুনে, বেশ লম্বা একটা লেজ বানালো বুড়ি।  কাটা লেজটার সাথে সেলাই করে, জুড়ে দিল পাটের লেজটাকে। এবার ভারি সুন্দর লাগছে দেখতে।  
এদিক বেড়াল এক মুঠো দানা কুড়িয়ে, ছুটল মুরগির কাছে। দানা পেয়ে, একটা ডিম পেড়ে দিল মুরগি। ডিম নিয়ে মুচির ঘরে হাজির বেড়াল। সেখান থেকে এক জোড়া জুতো নিয়ে দিল ভিস্তিওয়ালাকে। সে লোকটা ভারি খুশি নতুন জুতো পেয়ে। এক কলসি জল দিয়ে দিল। জল পেয়ে, গাছও খুশি হয়ে ডালপাতা দিল বেড়ালের হাতে। ডালপাতা পেয়ে, ছাগলের আনন্দ ধরে না। সে এক ভাঁড় দুধ দিয়ে দিল বেড়ালকে।
দুধ নিয়ে বেড়াল যখন বুড়ির বাড়িতে হাজির হোল, বুড়ির তখন লেজ বোনা শেষ। বেড়ালের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে দাওয়াতেই।
বেড়াল দুধের ভাঁড় নামিয়ে বলল—যা খেয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি ফেরত দিলাম। এবার আমার লেজ ফেরত দাও।
সত্যি সত্যিই পুরো এক ভাঁড় দুধ এনেছে বেড়ালটা। বুড়ি ভারি খুসি হয়েছে দেখে। বুড়ি বলল—আমিও তোর ছোট্ট একটুখানি একটা লেজ কেটেছিলাম। তার বদলে, কত বড় একটা লেজ ফেরত দিলাম। চেয়ে দ্যাখ, হতভাগী!
লেজ দেখে ত বেড়ালের ভিরমি খাবার জোগাড়। কেমন বেখাপ্পা দেখাচ্ছে জিনিষটা। তাদের পাড়ায় এমন জিনিষ মেনে নেবে তো? 
বেড়ালকে দোনামনা করতে দেখে, বুড়ি বলল—ঘাবড়াচ্ছিস কেন? সোজা তোদের হুলোর ঘরে গিয়ে  হাজির হবি। নাচিয়ে নাচিয়ে দেখাবি লেজটা। লজ্জায় পড়ে যাবে তোদের মোড়ল। কেমন বাহারি লেজ একখানা! আছে না কি তোদের আর কারও?
কিন্তু সমস্যা হোল বড় মাপের নতুন লেজটা নিয়ে। কিছুতেই আর জোড়া লাগানো যাচ্ছে না সেটা। রজন, সিরিষের আঠা, শেষে আলকাতরা দিয়েও জোড়া হোল। কিন্তু কাজের কাজ হোল না কিছুই। যে আঠাই লাগানো হোক, লেজের ভারে খসে খসে পড়ে যেতে লাগল। 
তখন বুড়ি উঠে গিয়ে সূঁচ-সুতো নিয়ে এলো ঘর থেকে। সেলাই করে দিল লেজটাকে। বলল—এবার বাড়ি যা। বড় মাপের বদমাস তো তোরা। তাই লেজটাও বড় মাপেরই করে দিলাম। তোদের দেখলেই, সাবধান হয়ে যাবে লোকে। বলা তো যায় না, কখন কার কোন জিনিষটা নিয়ে সটকে পড়বি!
বুড়ির কথা কানেই তুলল না বেড়াল। বাহারি আর বড় মাপের লেজখানা পেয়ে, ভারি আহ্লাদ তার! হেলেদুলে পাড়ায় ফিরে চলল বেড়ালমাসি।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments