জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-- ৬২/ প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬২

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত অনুযায়ী শ্রীশ্রীরথযাত্রার দিন ( মঙ্গলবার, ৩১শে আষাঢ়, ১২৯২, শুক্লা দ্বিতীয়া, ১৪ ই জুলাই ১৮৮৫ ) ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর বাসভবনে ( ভক্তদের কাছে অধুনা যা বলরাম মন্দির নামে পরিচিত ) শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছেন। সেখানে সারদাপ্রসন্ন এসে উপস্থিত। 
 শ্রীরামকৃষ্ণ ( সারদার প্রতি )-- দক্ষিণেশ্বরে যাস না কেন? কলিকাতায় যখন আসি, তখন আসিস না কেন?
 সারদা -- আমি খবর পাই না।
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- এইবার তোকে খবর দিব। ( মাস্টারকে সহাস্যে ) একখানা ফর্দ কর তো -- ছোকরাদের। ( মাস্টার ও ভক্তদের হাস্য )
 সারদা -- বাড়িতে বিয়ে দিতে চায়। ইনি ( মাস্টার ) বিয়ের কথায় আমাদের কতবার বকেছেন। 
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- এখন বিয়ে কেন? ( মাস্টারের প্রতি ) সারদার বেশ অবস্থা হয়েছে। আগে সঙ্কোচ ভাব ছিল। যেন ছিপের ফাতনা টেনে নিত। এখন মুখে আনন্দ এসেছে।

 ১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণেশ্বর থেকে কলকাতার শ্যামপুকুরে চিকিৎসার সুবিধার্থে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে আসা হয়। তিনি তখন মারণ ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত। ডিসেম্বর মাসে আবার স্থানান্তরিত করে শ্যামপুকুর থেকে কাশীপুরে আনা হয় শ্রী‌শ্রীঠাকুরকে। এই সময় সারদা নিয়মিত শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতেন, ঠাকুরের জীবনের শেষ দিনগুলিতে তাঁর সেবায় নিযুক্ত থাকতেন। কোনও কোনও দিন কাশীপুরে রাত্রিবাসও করেন, পিতার সমস্ত তিরস্কার উপেক্ষা করে। ১৮৮৬ সালের ৩ জানুয়ারি সারদা জননী জানান পিতা তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেছেন। মায়ের মুখে একথা শুনে হতবাক হয়ে যান সারদা। দ্রুত নিজের ঘরে চলে আসেন এবং নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্থিরভাবে চিন্তা করে সংক্ষেপে পিতামাতার উদ্দেশ্যে এইরকম লিখলেন --“ পরম পূজনীয় বাবা ও মা, আমি বিবাহ করব না। মায়ার ফাঁদে আটকে পড়ার কোনও বাসনা আমার নেই। যেদিকে দু'চোখ যায় আমি সেদিকে চলে যাচ্ছি।” একটি ডেস্কের উপর লেখা কাগজটি রেখে সকাল সাড়ে এগারোটায় গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। প্রথমে গেলেন কাশীপুর। সেখানে ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণ করে পদব্রজে পুরী অভিমুখে ( ৩০০ মাইল দূরে ) রওনা দিলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছেন এমন কথা অবশ্য ঠাকুরকে জানান নি।
 ইতিমধ্যে সারদার পিতামাতা সারদাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ঠাকুরের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে খোঁজ পেলেন সারদার। জানলেন পুত্র পুরী অভিমুখে যাত্রা করেছেন। কয়েকদিন বাদে সারদা জনকজননীর উদ্দেশ্যে মেদেনীপুর জেলার পাঁশকুড়া থেকে লিখলেন -- “পূজনীয় বাবা-মা, আমি তোমাদের অকৃতজ্ঞ সন্তান এবং অনেক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি। দয়া করে ক্ষমা কর। দেশের বহু মানুষ অশেষ কষ্টে দিনযাপন করছে, এমতাবস্থায় গৃহে বসে অলসভাবে সময় অতিবাহিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ো না, আমি ভালোই আছি। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে চলে এস না, কারণ পত্রটি পোস্ট করেই অন্যত্র চলে যাব।” বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণান্তে অবশেষে ওড়িশার ভদ্রক হয়ে পুরী পৌঁছলেন সারদা। তাঁর পিতামাতাও পুরীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ১৮৮৬ সালের ২৭ জুন বুধবার তাঁরা পুরী পৌঁছে সারদাকে খুঁজে পেলেন। পরম আনন্দে ভেসে গেলেন স্বভাবতই। সারদা তাঁর এই পদব্রজে পরিভ্রমণের সবিস্তার বর্ণনা দিলেন পিতামাতাকে। বর্ণনাটি এইরকম --“তোমাদের লিখে জানিয়ে দেওয়ার পর আমি গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, টানা দু'দিন কোনওপ্রকার আহার হয় নি। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হয়ে আশা করলাম সন্ধ্যার পূর্বে কোনও একটি গ্রাম পেয়ে যাব। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এক গভীর জঙ্গলে এসে পৌঁছলাম। জঙ্গলের ভিতর একটি আঁকাবাঁকা পথে কিছুদূর এগোবার পর অন্ধকারে পথ হারালাম। এমতাবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণের নাম নিতে শুরু করলাম ও ঈশ্বরের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করতে থাকলাম। কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ একটি বৃহৎ বৃক্ষের উপর আরোহণ করে সেই বৃক্ষশাখায় নিদ্রামগ্ন হলাম। আকস্মিকভাবে এক ব্যক্তির কন্ঠস্বর কানে এল। তিনি বলছেন, ‘হে পবিত্র ব্যক্তি তুমি নীচে নেমে এস, এখানে কিছু মিষ্টান্ন রয়েছে। দয়া করে এস এবং ক্ষুধা নিবারণ কর।’ কিছুক্ষণ পর তিনি জলপূর্ণ পাত্র এনে দিলেন। এরপর অন্ধকারে অদৃশ্য হলেন। তাঁর করুণায় মুগ্ধ হলাম এবং জল ও খাদ্য ঈশ্বরের অসীম কৃপা হিসেবে গ্রহণ করলাম। দিনের বেলায় সেই ব্যক্তিটিকে আর কোথাও খুঁজে পেলাম না!”
 কাশীপুর পরিত্যাগের সময় শ্রীরামকৃষ্ণের অপর এক অন্তরঙ্গ যুবা পার্ষদ তারক পাঁচ টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন সারদাকে। যদি পথে কোনও প্রয়োজন পড়ে। তারক জানতে পেরেছিলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায় সারদা পরিভ্রমণরত হতে চলেছেন। কিন্তু পথে নানা বাধাবিঘ্ন কষ্টের মুখোমুখি হয়েও তারক প্রদত্ত অর্থ ব্যয় করেন নি সারদা। ত্যাগের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ সারদা উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন সেই দিব্য অঙ্গীকার  --‘পুত্র আমি সর্বদা তোমার সঙ্গে রয়েছি।’
 পুরীতে পিতামাতার সঙ্গে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন সারদা ও সমস্ত প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলি পরিদর্শন করেন। কলকাতায় ফেরেন -- ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক এক মাস আগে। সারদা এই পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুক জেনে পিতা শিবকৃষ্ণ মেট্রোপলিটন কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। সারা বছর পাঠ্যপুস্তক স্পর্শ না করা সত্ত্বেও মাত্র একমাসের প্রস্তুতিতে সারদা কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
 বিষয়ী মানুষদের কাছে আধ্যাত্মিক জীবন নিতান্তই নীরস ও অর্থহীন, অন্যদিকে অধ্যাত্মপথানুসারীদের কাছে পার্থিব, সাংসারিক উপভোগ নিতান্তই বিরক্তিকর। সংসারী বা বৈষয়িকদের অধ্যাত্মপথে কিংবা অধ্যাত্মবাদীদের সাংসারিক পথে জোর করে উৎসাহিত করা অসম্ভব। কাশীপুরে সারদার শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে যাওয়া আসা কোনওভাবেই বন্ধ করতে পারেননি শিবকৃষ্ণ। কিন্তু ১৮৮৬ সালের ১৬ অগাস্ট শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধিতে লীন হলে সারদার পিতা শিবকৃষ্ণ সহাস্য মন্তব্য করেন, “কালীঘাটে গিয়ে আমি নিয়মিত প্রার্থনা করেছিলাম, তাই ফল পেলাম।” অর্থাৎ ঠাকুরের মৃত্যু কামনা করেছিলেন! পুত্রের  মায়ায় কী ভয়ানকভাবে আবদ্ধ, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়! তাঁর বিশ্বাস ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ ইহজগত পরিত্যাগ করায় নিজ পুত্রকে পুনরায় তাঁর মতো করে ফিরে পাবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটেছিল অন্য। স্বয়ং ঈশ্বরাবতারের কৃপা যাঁর উপর বর্ষিত হয়েছে তাঁকে ঈশ্বরের পথ থেকে সরানো কার সাধ্য!

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments