জ্বলদর্চি

গৌরদা, গৌরকিশোর ঘোষ // ঈশিতা ভাদুড়ী


স্মৃতি ডট কম ১৪

গৌরদা, গৌরকিশোর ঘোষ // ঈশিতা ভাদুড়ী 


কোথা থকে শুরু করি? সেই যে সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থা জারি করলেন সেইখান থেকে? নাকি, আনন্দবাজার নিউজরুমে প্রথম কিউবিকলে বসে বাংলা টাইপরাইটারে এক আঙুলে খটখট শব্দ তুলে টাইপ করছেন, ঠোঁটে চুরুট সেইখান থেকে? নাকি, স্বাধীনচেতা সাংবাদিক গৌরকিশোরকে ১৯৭৫ সালের 'মিসা' (MISA) অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জন-নিরাপত্তা আইনে যখন গ্রেপ্তার হন, সেইখান থেকে? নাকি, আনন্দবাজারে তাঁর সাপ্তাহিক কলাম ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’ পড়ে পাঠকের গুণমুগ্ধ অবস্থা থেকে?

হাফ পাঞ্জাবি বা ফতুয়ার মতো জামা, ধুতির কোঁচা মাটিতে ঠেকে না। ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে উজ্জ্বল দৃষ্টি, আর অবিন্যস্ত গোঁফের ফাঁকে একটু ফিচেল হাসির রেখা। এইরকম গৌরকিশোর ঘোষকে আমি দেখেছি আনন্দবাজারের ৪র্থ ফ্লোরে, আজকাল থেকে ঘুরে আসার পরে। গৌররদার সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয়, তাঁর আগেই তিনি রূপদর্শী বা গৌরানন্দ কবি এবং আরও অনেক নামে পরিচিত হয়েই গেছেন।

গৌরকিশোর ঘোষের দেশ মাটি মানুষ নিয়ে তিন খণ্ডে লেখা এপিক ট্রিলজি– ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘প্রেম নেই’ আর ‘প্রতিবেশী’ যদিও তিনটি স্বতন্ত্র উপন্যাস, কিন্তু মূলত একই উপন্যাসের পৃথক খণ্ড মাত্র। এই ত্রয়ী উপন্যাসের জন্যে ১৯২২ থেকে ১৯৪৬ এই পঁচিশ বছর সময়কালকে নির্বাচন করেছিলেন তিনি, এই সময় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের বিবর্তন, দেশবিভাগের ট্র্যাজেডি নিয়ে ভারত তথা বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লেখকের অভিপ্রায় ছিল এই তিনটি উপন্যাসের মাধ্যমে সেইসব ক্রমপরিবর্তন ও ট্রাজেডিকে তুলে ধরা। প্রথম খণ্ড ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’-র কাহিনীর সঙ্গে দ্বিতীয়  খণ্ড ‘প্রেম নেই’-এর কাহিনীর  কিছুটা ধারাবাহিকতা থাকলেও তৃতীয় খণ্ডের কাহিনী কিন্তু সম্পূর্ণই ভিন্ন। তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক পটে দাঁড়িয়ে সমাজকে বিভিন্নভাবে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ যখন শহর থেকে গ্রামে গিয়ে পড়েছিল এবং আন্দোলনের আঁচ লেগেছিল গ্রামের মানুষদের মধ্যে, সেই সময়কে এবং সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রেম, সংঘাত, রাজনৈতিক চেতনাকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করেছেন গৌরকিশোর তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া-জাগানো এই ত্রয়ী উপন্যাস কালের সীমা অতিক্রম করে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও মূল্যবান।


আনন্দবাজারে তাঁর সাপ্তাহিক কলাম ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’ পড়ে পাঠকের গুণমুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না –“এই যে একুশ শতক মহাশয়, নমস্কার, আপনার একটু সময় নষ্ট করতে পারি কী”, অথবা “মিসেস থ্যাচার ইন্দিরার পদবীটা লিজ নিতে পারেন” অথবা “আমার ভালো নাম ফ্রাঁসোয়া অগুস্‌ত্‌ রেনে রদ্যাঁ, একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন নান্‌”…

অন্তর্ভেদী দৃষ্টির জন্যে গৌরকিশোর ঘোষের লেখনী একটি অন্য মাত্রা পেয়েছে। তাঁর একের পর এক রচনা বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। শুধুমাত্র বাস্তবতার তীক্ষ্ণ হুল নয়, মজার কথা আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখতেও তাঁর জুরি কেউ ছিল না। রসবোধ থেকে লেখা ‘ব্রজদার গুল্পসমগ্র’ গৌরকিশোরের এক অনবদ্য সৃষ্টি, ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন। পরে সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আরও পরে সিনেমা তৈরি হয় ‘ব্রজবুলি’ নামে। তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সাগিনা মাহাতো, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য। গৌরকিশোর তাঁর ‘রূপদর্শী’ নামের ইতিহাস হিসেবে বলেছিলেন, সাগরময় ঘোষ ফরমায়েস দিলেন লেখার, পরামর্শ দিলেন বিষয়ের, জীবনের কিছু তাজা ছবি এনে দিতে বললেন, নাম দিলেন ‘রূপদর্শী’। প্রকাশ হতে থাকল কখনো নকশা, কখনো সংবাদভাষ্য। 

‘রূপদর্শীর নকশা’, ‘রূপদর্শীর সার্কাস’ নামে তাঁর বিভিন্ন ধরনের লেখা, তাঁর পরিশীলিত চিন্তার ক্রমাগত প্রকাশ। লেখকের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা এবং সেই দেখার প্রকাশই ছিল রূপদর্শীর মূল উদ্দেশ্য। তাঁর সমাজ-সচেতনতা, শাণিত কলম, এবং অন্তর্দৃষ্টিই রূপদর্শীকে জনপ্রিয় করেছিল। অন্যদিকে গৌরকিশোরের গল্প-উপন্যাসে যেভাবে মুসলমান-সমাজের নিখুঁত বর্ণনা উঠে এসেছে, তার প্রধান কারণ তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। শুধুমাত্র ধর্ম নয়, যে কোনো স্তরের মানুষের অধিকারের জন্যে সর্বদা সোচ্চার হয়েছেন। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিবাদ করতেও পিছপা হননি কখনো। ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম কোনও কিছু নিয়ে তাঁর কোনওরকম গোঁড়ামি ছিল না। প্রচলিত রীতি-নিয়মকে কিছুটা অবজ্ঞাই করেছেন নিজের জীবনেও।

যে কোনো প্রচলিত রীতি-নিয়মকে অস্বীকার করতে পিছপা হতেন না গৌরকিশোর ঘোষ। এমন কী তাঁর বিবাহ নিয়েও অনেক কথা শুনেছি। তাঁর বিবাহের অনুষ্ঠানে নাকি প্রবেশ মূল্য করেছিলেন পাঁচ টাকা! টিকিট না কেটে ঢোকা যাবে না। তাঁর বাবাকেও টিকিট কাটতে হয়েছিল। গৌরকিশোর ঘোষের কাছেই শুনেছি আমন্ত্রিত রাজশেখর বসু তাঁকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘‘তোমার বিয়ে নিয়ে আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ সেই মেয়েটিকে নিয়ে, যে তোমাকে পছন্দ করল।’’

শুনেছি নকশালদের কোপের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে ১৯৭০ সালে। নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আদর্শের দোহাই দিয়ে খুনের রাজনীতি গৌরকিশোর মানতে পারেননি, তাই তাঁর লেখায় তীক্ষ্ণ আক্রমণ ছিল বিরুদ্ধাচরণ করে। ‘গৌরকিশোর ঘোষের মুন্ডু চাই’ বলে নকশালরা ডাক দিয়েছিল। তার পরেও গৌরদা লেখা থামাননি। বরং রাতবিরেতে কাজকর্ম সেরে একাই হেঁটে ঢুকতেন পাড়ার রাস্তায়। এই মানুষটিই আবার নকশালদের বিরুদ্ধে পুলিশের নির্বিচার দমন নীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। ‘রূপদর্শী’র কলমে বারবার লিখেছিলেন, পুলিশ যেভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর উত্তেজনার আঁচ পৌঁছেছিল কলকাতার কিছু কিছু এলাকায়। গৌরদা বিভিন্ন সংবেদনশীল পাড়ায় ঘুরে বাসিন্দাদের অবস্থা দেখে তা লিখতেন। লোকদের বোঝাতেন সম্প্রীতি রক্ষার গুরুত্ব। গৌরদা মানুষটা এরকম ছিলেন।

শুনেছি গৌরদা বিভিন্ন রকম কাজ করেছেন তাঁর জীবনে। একসময় জাহাজে খালাসির কাজ করেছেন তিনি। তা ছাড়া কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও হোটেলের বেয়ারা, কখনও নাচের দলের ম্যানেজার, কখনও বা মাস্টারি— কত কী! শেষ পর্যন্ত সীমান্তে শুল্ক আদায় অফিসে কেরানির চাকরি থেকে সাংবাদিকতায়। পরবর্তীতে অফুরান অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার উপুড় করে উৎকৃষ্ট সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন তিনি একের পর এক। তবে লেখক গৌরকিশোরকে ছাপিয়ে সাংবাদিক গৌরকিশোর যে এগিয়ে ছিলেন তার প্রমাণ আমরা তাঁর বিভিন্ন রচনায় পেয়েছি আমরা। সাংবাদিকতায় নতুন মোড় এনেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ।

বয়স বা নামের গুরুভারে তিনি তরুণদেরকে দূরত্বে রাখতেন না কখনোই। কোনো পাঠকও তাঁর খুব নিকটজন হয়ে উঠতে পারতেন অনায়াসে। নিজেকে সাধারণভাবেই সহজ করে নিতে পারতেন গৌরকিশোর ঘোষ। নয়তো আমার মতন সামান্য তুচ্ছ মানুষের সঙ্গেও তাঁর এমন জমজমাট আড্ডা কী করে হতো! আমাকে ১৯৮৯ বইমেলাতে প্রকাশিত ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’ বইটি বইমেলা শেষ হওয়ার পর দিয়েছিলেন, লিখেছিলেন ‘ঈশিতাকে গৌড়ানন্দ কবি ১৭।২।৮৮’, বোঝাই যাচ্ছে ৮৯-র বদলে ৮৮ লিখেছিলেন। বইটি সম্বন্ধে আগেই লিখেছি। যাইহোক এককথায় অসামান্য প্রতিভাবান এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন গৌরদা। প্রথিতযশা সেই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


Post a Comment

0 Comments