জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৬১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬১

এবার এদেশে আসার পর প্রথমের দিকে কোনকিছুই মনকে ছুঁত না। সবকিছুই মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যেত। কোনকিছু জানতে বা শুনতে ইচ্ছে করত না।  ধিরে ধিরে স্বাভাবিক হয় ওঠার চেষ্টা করি। দেশের খবর জানতে ইন্টারনেটে

আনন্দবাজার, আজকাল পড়ি। টিভিতে খবর দেখি। এখানে আসার পর খবর পেয়েছি, মোদি দিল্লির সিংহাসন দখল করেছে। কাশ্মীরে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে।   কয়েকদিন পূর্বেই তো হুদ হুদ (আরবের এক জাতের পাখির নাম হুদ হুদ)ঝড়ে অন্ধ্রে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। ভারতের স্কুলগুলিতে শিশু ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। কখনো  স্কুলে, কখনো বাড়িতে, যত্র তত্র চলছে নারীমাংস ভক্ষণের প্রচেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গের খবর বলতে এতদিন ছিল সারদা আর মমতা, এখন যোগ হয়েছে জামাত। বহু  বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ খুলে পড়েছে। দেশের ভাল খবর বলতে  ভারত ও পাকিস্তান  যৌথভাবে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে। শান্তির জন্য এই পুরস্কার প্রাপ্তি। যদিও পুরস্কার  প্রাপক মালালা ইউসুফজাহান ও ভারতের কৈলাশ সত্যারথই। মালালা  বর্তমানে ইংল্যান্ডের বারমিংহামের বাসিন্দা। ওর সে কাহিনী আগেই বলেছি। নটিংহাম থেকে মাত্র ৪৫ মিনিট দূরত্বে বারমিংহাম। দেখা করার খুব ইচ্ছে, কিন্তু সেটা সম্ভব নয় জানি।
     অন্যান্য দেশের কিছু কিছু খবর মনকে কাঁদায়, রাগ হয়। গাজায় যুদ্ধ থেমেছে। ফুলের মত নিষ্পাপ মৃত শিশুগুলির মুখ আর তাদের বাবা মায়ের বুকফাটা হাহাকার মনে পড়লে অস্থির লাগে কান্না আসে। তবুও কোন না কোন দেশে যুদ্ধ চলছেই। যুদ্ধরত দেশগুলো জনমানবহীন হয়ে পড়ছে। 

    দীপের এক বন্ধু সিরিয়ার মেয়ে। দীপের কাছে শুনলাম, ওর পরিবারের ২০ জনের একটা দল প্রাণ বাঁচাতে নৌকোতে করে ইতালি পাড়ি দিয়েছেন। শেষপর্যন্ত ওরা বাঁচবেন কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। পরে জেনেছিলাম ওঁরা জর্ডনে পৌঁছে একটি রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। মেয়েটির বাবা-মা খুবই বৃদ্ধ, ওর চিন্তা বাবা-মা এই বয়সে এতবড় ধাক্কা সামলাতে পারবেন তো? ওঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জর্ডন থেকে হাঙ্গেরি বা সুইতজারল্যান্ড চলে যাবেন।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


   বারমিংহামের মত না হলেও নটিংহামেও ভাল সংখ্যায় মুসলিম বাস করেন।  এদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ এদের জীবনযাত্রার প্রতি কৌতূহল।  বোরখা ও হিজাব দেখে এদের চিনতে পারি। তবে এদেশে বসবাসকারী সব মুসলিম মহিলারাই বোরখা হিজাব পরেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই আছেন, যাঁদের পোশাক দেখে আলাদা করে চেনা যায় না। এঁরা ব্রিটিশ মহিলাদের মত এদেশীয় পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, অফিস যায়। এদের মধ্যে ১/২ জন ওড়নায় মাথা ঢাকে। পাকিস্তানি মহিলারা যে শালওয়ার কামিজ পরেন সেই কামিজের ঝুল পায়ের পাতা পর্যন্ত। টার্কি ইরান ইত্যাদি মুসলিম দেশের মহিলারা অনেকেই জিন্স টপ টিশার্ট পরেন। মেয়ের এক ইরানি বান্ধবি জানাল, এখানে যা খুশি পরি, কিন্তু দেশে গেলে হিজাবে মুখ ঢাকতেই হবে। টার্কিশদের মধ্যে এত গোঁড়ামি নেই। আবার আফ্রিকান মুসলিম মহিলারা খুবই পর্দানশিন। বোরখা পরেই বাইরে বের হন। এদের বাড়ির বাইরে বের হতে মানা নেই। এঁরা চাকরি করছেন, বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে  যাচ্ছেন। এ টি এম এ টাকা তুলে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করছেন। এখানে অনেক পাঞ্জাবি মহিলাদেরও দেখি, শুনেছি ওঁরা নাকি সালোয়ার কামিজ ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরা পছন্দ করেন না। বাবলিদের বাড়ির কাছে কয়েকটি গুজরাটি জৈন পরিবার আছে। এতভাল প্রতিবেশী বা বন্ধু সচরাচর মেলে না।

     এখানে একটা মেলা দেখতে গেছলাম, মেলার নাম ‘গুজ ফেয়ার’। এই নামের কারণ, বহুদিন পূর্বে এখানে পাখি বাজার ছিল, তার থেকেই এই নাম।  মেলাতে গিয়ে এদেশে প্রথম কান ফাটানো আওয়াজ শুনলাম। মেলা মানে ভয়ঙ্কর সব রাইডের সমারোহ। কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে এই রকম রাইডে চড়া সম্ভব বলে মনে হয় না। নিনাদি শুনে বললেন, ওরা ড্রিঙ্ক করে রাইডে চড়ে। ওদের চিৎকারে কান ঝালাপালা। বাচ্চাদের জন্য আলাদা রাইড রয়েছে, কফিসপ ও খেলনা জেতার খেলাও রয়েছে।

    কান্না-হাসি ও এই সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ছ’মাস কেটে গেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই গাছের পাতা ঝারা শুরু হয়েছে। ফুটপাতে এই ঝরা পাতার ওপর  দিয়ে পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে ছোটবেলায় পড়া রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন মনে পড়ে  ‘………………..পেয়েছে খবর পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু’। ঝরে পড়ার আগে পাতাগুলো সুন্দরভাবে রং বদলায়। সবুজ থেকে হলুদ হয়, হলুদ থেকে লাল হয়, তারপর ধিরে ধিরে মাটির বুকে ঝরে পড়ে।

      ওই পাতা ঝরে যাওয়া নেড়া গাছগুলোর সঙ্গে নিজের খুব মিল খুঁজে  পাই। তবে তুষারপাত বন্ধ হলে, বসন্ত এলে, আবার এই সমস্ত গাছের শুন্য শাখা পাতায়, ফুলে সেজে উঠবে। কিন্তু আমার এই শুন্য শাখায় আর কোনদিন ফুলও ফুটবে না, ফলও ধরবে না। তবুও অনেক কিছুই ঝুলি ভরে নিয়ে যাচ্ছি। এটাই  হয়ত বেঁছে থাকার ধর্ম। যত দিন ফুরিয়ে আসছে, ততই সবার সঙ্গে বেশি করে জড়িয়ে পড়ছি। নিনাদি আমাকে অনেকটাই সঙ্গ দিয়েছেন। নিনাদি আর সুপ্রীতিদি মনের  মধ্যে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছেন।
      এখানে মনটা ভরিয়ে রেখেছে আমাদের একমাত্র নাতনি ‘জারা’। এখানে কয়েকমাস থাকার ফলে জারা একটু হলেও বাংলা শিখেছে। আগে শুধু বুঝতে পারত, বলতে পারত না। এখন দুই একটা শব্দ বলতে  পারে। তবে ঠিক মত  শব্দ সাজিয়ে বলতে পারে না। যেমন- ওকে যদি জিজ্ঞেস করি, জারা কী করছ? ও উত্তরে বলে, আমি না করছি। এইভাবে বাংলা বলে। যেমনই বলুক, শুনতে খুব ভাল লাগে। এদেশের বাচ্চারা আনেকদিন পর্যন্ত বাচ্চাই থাকে। আমাদের দেশের বাচ্চাদের মত এঁচোড়ে পেকে যায় না বা পাকিয়ে দেওয়া হয় না। কিন্তু পড়াশোনা ও নিজের কাজকর্মের বিষয়ে আমাদের দেশের বাচ্চাদের তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচিওড়। খুব ছোট থেকেই নিজের কাজ নিজে করতে শেখে। একেবারে ছোটতেই জুতোমোজা খোলাপরা শিখতে হয়। বাড়ি থেকে পরে যাওয়া জুতোমোজা, সোয়েটার, টুপি খুলে নিজের নির্দিষ্ট ট্রেতে রাখতে হয়, স্কুল শেষে আবার স্কুলের জুতো খুলে রেখে নিজের জুতো, সোয়েটার পরতে হয়। প্রায়দিন জারা সোয়েটার, টুপি ফেলে আসে। পরদিন গিয়ে খোঁজ করলে অনেক সময় পাওয়া যায়। আমি তাই ওর স্কুলের প্রত্যেকটা সোয়েটার টুপিতে সুতো দিয়ে নাম লিখে দিয়েছিলাম। যাইহোক আমি ওকে তাড়াতাড়ি বাংলা শিখতে বলেছি। না হলে নানির বইগুলো পড়বে  কিভাবে?

      বিদেশে এসে অনেককিছু দেখলাম, অনেক কথা লিখলামও। অনেক কথা আড়ালে থেকে গেল। যা বলতে পারলাম না, তা বলার মত শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। সে আমার অন্য এক জীবনের কথা, যা একান্তভাবেই আমার।   ২৮/১০/১৪ র ফ্লাইটে দেশে ফেরার টিকিট। জানিনা ওখানে জীবনটা কেমন করে শুরু করব? গত মাসেই মুকুলের খবর নিয়ে জেনেছি, মুকুলের দুইটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, মেডিসিনে সুস্থ রাখার চেষ্টা করবেন, না হলে   ডায়ালিসিস  শুরু করতে হবে। বয়স কম, তাই ডোনার খোঁজা হচ্ছে। পাওয়া গেলে এবং দুজনের সবকিছু ম্যাচ করলে একটা আশা আছে। বাবার বয়স হয়েছে, মায়ের সঙ্গে ম্যাচ করছে না। তবুও নাকি মায়ের কিডনি নেওয়া যাবে। খান সাহেবের যার আণ্ডারে থেকে চিকিৎসা চলছে,  তাকে  এবিষয়ে জিগ্যেস করাতে বললেন, কলকাতায় হয় কিনা জানি না। তবে দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে হয়। সে তো  অনেক টাকার ব্যপার। কোথা থেকে আসবে এত  টাক? আমাদের জমি থেকে একবিঘা জমি বিক্রি করে দিতে বলেছি। ওখান থেকে লাখ ৪/৫ লাখ টাকা পাওয়া  যাবে। বার বার ওর সরল, মায়া জড়ানো মুখখানি মনে পড়ছে।

     বাড়ি ঘর সব নোংরা হয়ে আছে। কাজের মেয়েকে ফোন করলাম।সুইচ  অফ করে রেখেছে। ওকে না পাওয়া গেলে মুশকিলে পড়ে যাব। এই ভাঙ্গা মন আর শরীর নিয়ে কিভাবে কাজ করব জানিনা। যার তলায় বসে দুদণ্ড জিরিয়ে নেব ভেবেছিলাম, সে গাছটাই তো ভেঙ্গে গেছে।

                                    ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments