দুটি কবিতা
শেখর সিরাজ
দুঃখের ফেরিওয়ালা
এত দুঃখ আমি কোথায় রাখি, কার কাছে রাখি? কার কাছে জমাই দুঃখের খুচরো পয়সা? মানুষ ব্যাংকে টাকা জমায়, লকারে জমা করে ব্যক্তিগত সুখের হিসাব নিকেশ।
টাকা জমানোর মতো করে যদি আমার একটা
দুঃখের একাউন্ট থাকত, থাকত ব্যক্তিগত দুঃখের তহবিল, হিসাব নিকেশ।
টাকাওয়ালা মানুষের থাকে দম্ভ, আমার থাকত দুঃখ তাড়িত জগত বিখ্যাত শোক।
ধনী হওয়ার মতো করে আমিও হতাম নিশ্চুপ জগদ্দল পাথর, কবি কিংবা দার্শনিক।
শুনতে পেতাম মানুষের আত্মচিৎকারের সাথে ভোর রাতের কুকুরের আত্মচিৎকারের যোগসূত্র।
শুনতে পেতাম, ভবানীপুরের বাগদত্তা রমণীর বিয়োগান্ত দুঃখের সাতকাহন।
তজবিহ জপতে জপতে শুনতে পেতাম মানুষের ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান। আবেগের মহা- প্লাবনে কেন ডুবে যায় সাঁতার না জানা প্রেমিক যুগল।
কানে- মুখে ফিসফিসিয়ে ললিত কেন বলে যাবে? লজ্জা শরমের মাথা খাই- প্রেম প্রণয় ভারতবর্ষের দুঃখ উপনিবেশ,পরাধীনতা।
নামা পাড়ার হাবু"দা ভূগোলের মানচিত্রের মতো
মুখ ভেঙ্গচি করে কেন বলবে? শরীরের ইঞ্জিন বিকল হইলে এতো ট্যাহা পয়সা দিয়া মানুষ কী করে? টাকাও তখন ভাগাড়ের আবর্জনার মতো লাগে, যার যত বেশি ট্যাহা, তার ততো বেশি বড় দুঃখের ঝোলা! যত বড় বৃক্ষ, ততো বড় তার বাতাস।
আমার বন্ধু সতীর্থ, রাশভারি ব্যাংকের অফিসার। নয়টা- পাঁচটা অফিস।
বিয়ের প্রথম বছরে আমাকে বলেছিল,
তোর জায়গা হইবে না কোথাও, না ঘরে না ঘাটে, তোমার দুঃখের কড়ি দাদন নেওয়ার সময় নাই গো গোসাই- আমি এখন জোয়ান বউয়ের সাথে ইঁদুর বিড়ালের খুনসুটি করার ঝাঁঝ বেলার গরম রাজ- হাঁস।
চিরহরিৎ বনের অসুখী দম্পতির শিরোপা নিয়ে
সতীর্থ আমাকে শনিবারের চিঠিতে লিখেছে- বীর্য স্খলনের পর বউ তার কাছে পাংশে লাগে।
তার থেকে বেশি ভালো লাগে বীয়ারের ক্যান, স্কচ, স্কট- সার্ভিস। বুঝলাম, সতীর্থের মুখের রুচির বদল হয়েছে আর মনের রুচির পচন ধরেছে। সুবোধ বালক সতীর্থ এখন লম্পট কাপুরুষ।
কবিতা লিখি বলে, যে মেয়েটি কলেজ জীবনে পাত্তা দেয়নি, তাচ্ছিল্য চোখে করেছিল তীব্র চৈত্র খরার উপহাস- সে এখন মধ্য বয়সী তিন সন্তানের জননী- ফেসবুক, ম্যাসেন্জারে রাত জাগে। রাস্তার টুং টাং রিকশার শব্দে জিজ্ঞেস করে, তোর কবিতা উপলব্ধি না করার প্রায়শ্চিত্ত করছে আমার গলার মঙ্গলসূত্র। আমাকে তোর কাঁধের দুঃখের ঝোলা বানাবি?
আমার জীবনে কিছু হবে না বলা স্কুলের তুখোড় মেধাবী ছাত্র সুলায়মান পত্রিকার লিড নিউজের হেডলাইন এখন 'দীর্ঘ মেয়াদের জেল কয়েদি।' প্রিজনভ্যান উঠতে উঠতে প্রায় হেঁড়ে গলায় বলেছিল, কেন যে তোর মতো দুঃখের ফেরিওয়ালা হলাম না। সবজি বিক্রেতা হকারের মতো একজীবনে গলা হাকিয়ে যদি বলতে পারতাম, দুঃখ নিবেন? দুঃখ... ওওও
নীল দুঃখ, লাল দুঃখ.....হলুদ......দুঃখ,
দুঃখ নিবেন? দুঃখ... ওওও
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
আততায়ী পদচারী পরিব্রাজক
এই তল্লাটে আমি বসন্তের কোকিলের মতো-
উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনো নতুন ভাড়াটিয়া নই, নই কোনো আততায়ী পথচারী পরিব্রাজক, আগুন্তক।
আমার নামফলক চিনে পবিত্র দেয়াল লিখন, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর, তালপট্টি বাজারের মুচি ও মেথর।
আমি দলীয় দল দাস বধির ও রাতকানা রোগীদের মতো মিথ্যে ভাষণের পর ভাষণ দিয়ে
যক্ষা রোগীদের মতো রাতভর কাশতে পারি না।
আমি সতন্ত্র পার্থীর নিজস্ব শ্লোগানে কুখ্যাত রাজনৈতিক নেতার কুশপুত্তলিকা দাহ করি, অজুহাতের বদলে আমার ডানহাতে থাকে উদীয়মান কবি ও তার স্বরচিত কবিতা।
মিছিলের অগ্রভাগে থাকে অনুজ প্রতিম তরুণের নেতৃত্ব; আসন্নবর্তী বিপ্লবে মুখরিত হবে রাজপথের শিল্পকলা, রঙিন প্রজাপতির কারুকার্য।
আমার পরিচয় পাবে গলির মুখের চাঁদাবাজ, মোড়ের দোকানে আড্ডা প্রিয় রংবাজ। দুধভাতের নেতা থেকে জাতীয় সংসদ, লাল দালানের আরাম-আয়েশের মন্ত্রী পাড়া।
হে ডালভাতের মেহনতী মানুষ, আপনার সংবিধান নামক মহান কবিতার প্রতিটি পঙক্তি
খড়গ হস্তে পোস্টমর্টেম সুরতহাল রিপোর্ট দাখিল করবেন বর্ধিত জনসভায়।
আমার ঘোষণা পত্রে- স্বাক্ষরিত দস্তাবেজে
পবিত্র পুস্তক নিয়ে ঈশ্বর প্রার্থনায় আপনারা
ঋষি মনীষিণীর মতো হয়ে উঠবেন ধ্যান মগ্ন যোগী।
কবিতার পঙক্তি অনুধাবনে যদি মন্ডুপাত করতে পারেন নিজেদের জীবিত শবদেহের ব্যবচ্ছেদ। মেলায় হারিয়ে যাওয়া সহদোর ভাইয়ের মতো ফিরে পাবেন গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা।
ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন বলেই যিশু ঈশ্বরপু্ত্র, মাঘ পূর্নিমার ভরা জোছনায় বোধিবৃক্ষ প্রাপ্ত হলেন সিদ্ধার্থ গৌতম। রঙিন প্রজাপতির মহার্ঘ রক্তজবা ছাড়া না আসে অধিকার, না আসে স্বাধীনতা।
আপনি বুঝবেন না, আপনি বুঝবেন না-
শুভংকরের ফাঁকি, জনগণ আর মাছের মায়ের পুত্রশোক! চারদিকে কাকের পিঠে ময়ূরের লেজ লাগানো ভাষণ আর ভাষণ!
0 Comments