জ্বলদর্চি

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু.... /সোমদত্তা

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু.... /সোমদত্তা 


আজ একটু  গল্প বলি।তখন কোম্পানির  শাসন চলছে সারা ভারত জুড়ে। তার মধ্যে ই গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটে,চলেছে নানা,অলৌকিক ঘটনা। কেউ বলবে গাঁজাখুরি , কেউ বলবে আজগুবি , কেউ বা,ভক্তমনে কপালে হাত ঠেকাবে।
যাই হোক, তখনো জম্ম হয়নি বিধান চন্দ্রের মানস কন্যা কল্যাণীর। তদানীন্তন  কাঞ্চন পল্লী বর্তমান কাঁচড়াপাড়া  থেকে  গঙ্গাবক্ষে আসতে হত ঘোষ পাড়া।সেখানে  ঘন জঙ্গল , বন্য প্রাণী র সাথে  মানুষের  বসবাস।
সেখানে বাস রামশরণ ও তাঁর পত্নী সরস্বতী দেবীর। একদিন এক গরু সন্তান প্রসব কালে তাদের বাড়ির সামনে মারা যায়।  ছোট্ট  বাছুর টিকে  দেখে,সরস্বতী দেবীর মায়া হয়। তিনি মা টিকে,বলেন, তুমি ছাড়া  তোমার সন্তানের কি হবে,,কে দেখবে তাকে, ওঠো তাকে দেখো। কিছুক্ষণের  মধ্যে  মা টি উঠে  দাঁড়ায় ও মালিকের বাড়ীর দিকে চলতে থাকে।

আরেক দিন এক মা,তার সন্তানকে নিয়ে  এসে হাজির সরস্বতী দেবীর কাছে। ততদিনে  তাঁর  অলৌকিক  ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পরেছে। মায়ের কোলে সন্তান টি একটা জীবন্ত মাংস পিন্ড, প্রাণ আছে, মনুষ্য অবয়ব নেই। মা তাকে রেখে দিয়ে যান সরস্বতী দেবীর কাছে। উনি তাকে ডালিম গাছতলার মাটি মাখান, এবং  বলেন, মানুষ  হয়ে জম্মেছিস যখন তখন মানুষ  হ।কিছুক্ষণের  মধ্যে  ছেলে টি তার মনুষ্য  অবয়ব  ফিরে পায়। তিনি হলেন, মায়ের বাঁকাচাঁদ।কিছু কালের মধ্যে ই তিনি গৃহত্যাগী হন, পরে ফিরে আসেন, তখন তাঁর  অলৌকিক  ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পরেছে।  জনশ্রুতি  তিনি শ্রীচৈতন্য  মহাপ্রভুর অবতার।

এরকম আরো কতগল্প,বেশ লৌকিক  আর অলৌকিক  এর দোলাচল থাকে।গাঁজাখুরি ও মনে,হয়।তার মধ্যে  দিয়েই আসল সত্যি র সন্ধানে  নামি।
যেকালের কথা,বলছি তখন লর্ড হেস্টিংস গভর্ণর জেনারেল।  
 গোবিন্দপুর  গ্রামের গোবিন্দ ঘোষের কন্যা সরস্বতী ।  তার বিয়ে হয় রামশরণ পালের সাথে।দুইজনের  সংসার।  এর মধ্যে  আআবির্ভাব  ঘটে আউল চাঁদ  ফকিরের।১৬৯৪ সালে নদীয়া জেলা উলা  বীরনগরের মহাদেব বারুই নামে এক বৈষ্ণব  পানচাষি তাকে কুড়িয়ে পান, পালন করেন,তাঁর  নাম ছিল পূর্ণ চন্দ্র। এরপর তিনি ফুলিয়া র বলরাম  দাসের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে  এবং এক মুসলমান ফকিরের কাছে শিষ্যত্ব  গ্রহণ  করেন, তাঁর নাম হয় আউলচাঁদ। তিনি আশ্রয় নেন রামশরণের কাছে।প্রথমে সমাজচ্যুত  হবার ভয়ে তারা তাঁকে লুকিয়ে  রাখেন। এর মধ্যে  জম্ম হয় রামশরণ  সরস্বতী দেবীর  পুত্র দুলালচাঁদের।সরস্বতী  দেবী অসুস্থ , মৃতপ্রায় হয়ে পরেন। রামশরণ  তাঁকে রেখে এলেন বাড়ির  কাছেই হিমসাগরের ধারে। কথিত, এই হিম সাগর  আর দুধসাগর গঙ্গার ই অংশ।  দিক পরিবর্তন করায় কালক্রমে  দুটি  বিচ্ছিন্ন  হয়ে  যায়।  দুটিই এখন পূণ্যস্নানের জায়গা।

যা বলছিলাম, গৃহ থেকে  বেড়িয়ে এলেন আউল চাঁদ , সুস্থ  করে তুললেন  সরস্বতী  দেবীকে।দুরদুরান্ত থেকে  ছুটে আসতে থাকে মানুষ। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


  শুরু হয় কর্তাভজা ধর্ম।প্রথম  ২২ জনাকে শিষ্য কে নিয়ে  শুরু  হওয়ায় একে ২২ ভজার ধর্ম ও,বলা হত।আউলচাঁদের প্রবর্তিত হলেও তিনি চলে যান, পরিবর্তে রামশরণ কর্তাবাবা, ও সরস্বতী দেবী কর্তামা,নামে পরিচিত হলেন। এই ধর্মে গুরুকে মহাশয়  ও শিষ্যকে বরাতি বলা হয়।এরপর রামশরন গত হলে সরস্বতী দেবী সতী মা,নামে পরিচিত  হলেন, এবং সম্প্রদায় কে এগিয়ে,নিয়ে  চললেন।এই ধর্মের  আরেক টি দিক হল নারী পুরুষ ভেদাভেদ হীনতা অবাধ মেলামেশা। আজ কোন ব্রাক্ষণ মহিলা পৌরহিত্য,করলে আমরা বাহবা,দিই। সেখানে  শতাধিক  কাল আগে দাঁড়িয়ে  কর্তাভজা ধর্মের গুরুমা,হতে পারতেন কোন মহিলা।তাঁকে কর্তামা,বলা,হত।
এখানে  উল্লেখ্য, সাহেবধনী সম্প্রদায়ের  প্রবর্তন করেন এক মুসলিম  মহিলা  উদাসীন , তিনি এই সহজিয়া,ধর্মের,প্রবর্ত,করেন,তার কাছে রাইকিশোরী  হলেন সাহেবধনী।

এই ধর্মে মুর্তিপুজার চল নেই।  একটা ডালিম গাছে পুজো হয়। তার বয়স,নিয়ে  বিস্তর মতভেদ, কেউ,বলে দেড়শো , তো কেউ বলে,তিনশো। তবে সারা বছর  ফুলে ফলে সাজানো থাকে, কেউকখনো  গাছটি কে শুকাতে দেখেনি।  মানুষ হিম সাগরের জলে স্নান করে  দন্ডী কাটে, এই গাছে ঘোড়া বাঁধে মনোষ্কামনা,পূরন,করতে।

এই ধর্মে নেউ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। মুসলিম  গুরুর,আছে হিন্দু  শিষ্য, আবার,হিন্দু  গুরুর মুসলিম  শিষ্যের দেখা মেলে।তৎকালীন  সময়ে নিম্নবর্ণীয় দের,উপর,উচ্চ সম্প্রদায়ের  বিশেষত  ব্রাক্ষণ্যতন্ত্রের অত্যাচার বা মুসলিম দের উপর কাজীর,অত্যাচার  থেকে  রক্ষা,করাই ছিল এ ধর্মের প্রধান,উদ্দেশ্য। একদিকে,বৈষ্ণব  ধর্মের সাথে  নাড়ীর বাঁধন, অন্যদিকে স্পষ্ট  প্রভাব সুফী ধর্মের। এক আদ্বিজচন্ডাল ধর্ম। এক আউল মানুষের  থেকে ই শোনা আউল ধর্ম মানে, আকুল হয়ে দেবতাকে খোঁজা।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের  এক প্রবীণ  বাউল শিল্পীর  মুখ থেকে  শোনা,এদের তিনটি  মুল সূত্র----
১.নরনারী  দুইজনে হবে চেতন বা শক্তি র মন্ত্রে শক্তির  পূজন।
২.সুধা ফেলে বিষপানে মত্ত অতিশয় 
বিষ,ত্যাগী  সুধা খাও ওহে মহাশয় 
৩.নারী,হিজড়ে,পুরুষ  খোঁজা  এই,তো সকল,
সাবধানে  করো সবে,সাধন ভজন।

প্রতিবছর  দোল পুর্নিমা কে উপলক্ষ  করে এখানে  অর্থাৎ  কল্যাণী সংলগ্ন ঘোষ পাড়ায় বিশাল  মেলা,বসে।দোলের দিন দুয়েক  আগে, থেকেই ভক্ত,সমাগম  ঘটে, চলে জায়গা,দখলের লড়াই।আসেন অঘোরপন্থী, নাথপন্থীরা, কালাচাঁদ সম্প্রদায়, শক্তিসাধক যোগতন্ত্রী মাধ্যার্চায্য, আসেন নামী,দামী বাউলরা। একম কি রাজশাহী, কুষ্টিয়া, থেকেও।একই সাথে নারী পুরুষ , সবাই থাকেন, রাত্রিবাস ও খোলা  আকাশের নীচে বা যৎসামান্য  তাবুর,নীচে। এক ই,সাথে  পংক্তিভোজন, নেই উচ্চনীচ ভাবনা। তারা সহজিয়া , সহজ  সাধনায়  পরমার্থকে বাইরে অনুসন্ধান  করা নয়, পরমার্থ আছে দেহভাণ্ডেই।তাঁরা  খোঁজেন Man of the heart.ভক্তি রসের প্লাবনে তিন দিন কাটিয়ে,তারা ফিরে যান আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নিজেদেরকেই।

মেলা চলে আরো বেশ কিছুদিন।গ্রামীণ মেলা, পসরা সাজিয়ে বসেন মানুষ গুলো। যদিও  আগের হ্যাজাক, বা,কুপির আলোকে ঢেকে  দিয়েছে  ইলেকট্রিক ঝকঝকে  আলো।পসরাতেও লেগেছে, আধুনিকতার ছাপ।গ্রাম তার কৌলিন্য  হারাচ্ছে শহরের  কাছে, মাটিএ সোঁদা গন্ধ আর পাই,না,।


তবুও বিশ্বাসে ভর,করে, সতীমাকে সাক্ষী রেখে,কল্যাণী বাসীর,মনে,কিছু টা,ধর্ম, কিছুটা  সংস্কার, বছরের পর বছর,ধরে চলা,কিছুটা,অলৌকিক, গল্প, এবং সবটা, মিলিয়ে এই ধর্ম মেলার আকর্ষণ  বোধহয়  থেকে  যাবে আরো বহুকাল।।

Post a Comment

0 Comments