জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলে জৈন ধর্ম ও সরাক সম্প্রদায়/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৬২

জঙ্গলমহলে জৈন ধর্ম ও সরাক সম্প্রদায়

সূর্যকান্ত মাহাতো


মনের মধ্যে নানা রকমের প্রশ্ন তোলপাড় করে চলেছে। বারবার কেবলই মনে হচ্ছে জঙ্গলমহলের 'কৌম' মানুষেরা কিংবা নিষাদ জনেরা সত্যিই কি মহাবীরের মতো জৈন তীর্থঙ্করকে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাড়া করেছিল? একটা বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে আমি কেবল ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছি। এত বড় একজন মহাপুরুষের পিছনে হঠাৎ কেন কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? এই ঘটনা যদি ঘটেই ছিল তাহলে তার পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য ছিল? এখানকার মানুষ কি এতটাই অসহিষ্ণু ছিল? নাকি অন্য কোন প্রেক্ষাপট ছিল! মহাবীর এদের উপর কোন অনৈতিক কিছু কি করেছিলেন? সবশেষে একটা অবিশ্বাস এ কারণেই যে, কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনাটা ঠিক কীভাবে প্রমাণিত হয়েছিল! যে কারণে 'বিনয় ঘোষের' মতো মানুষও এ কথাটা ব্যবহার করেছেন তার "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি" (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে?

মনের এই অস্থিরতা কীভাবে নিরসন হবে ভাবতে ভাবতেই এক শিক্ষক বন্ধুর সন্ধান পেলাম। বাড়ি পুরুলিয়া জেলায়। এ বিষয়ে বেশ কিছু পড়াশোনা তিনি করেছেন। তাকে মহাবীরের প্রতি 'কুকুর লেলিয়ে' দেওয়ার ঘটনাটা আদৌ ঘটেছিল কিনা সেটাই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম।

বন্ধু উত্তরে বললেন, "বিনয় বাবু ভুল কিছু বলেননি। উনি ঠিক কী বলেছেন চলো সেটা আগে দেখি, 'ঝারিখন্ড ঝাড়খন্ড ঝাড়গ্রাম জঙ্গলমহল সেই আদি নিষাদ জনের বাসস্থান যারা সুদূর অতীতে একদা জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরকে কুকুর লেলিয়ে তাড়া করেছিল।' (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫, দীপ প্রকাশন) এ কথা তো আর তিনি এমনি এমনি বলেননি! বড় কিছু প্রমাণ পেয়েছেন বলেই একথা তিনি বলেছেন।"

"কিন্তু অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার তো উল্টো কথাই বলছেন। তিনি তো এই ঘটনাকে অপপ্রচার বলেই মনে করেন। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে এপ্রিল, ২০২১)। তার যুক্তি হল, 'রাধা' অঞ্চলের মানুষ জৈন ধর্মের দ্বারা সুসভ্য হয়েছিল, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার থেকেই কুকুর কাহিনীর উদ্ভব।" (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫-৪-২০২১)

"তীর্থঙ্কর মহাবীরকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার কাহিনী পরবর্তীকালের লেখক ও গবেষকরা কীভাবে জানলেন সেটা আগে জানা দরকার। তারা নিশ্চয়ই সেই সময়কার মানুষ ছিলেন না, কিংবা লোকমুখের শোনা কথাকেও সহজে বিশ্বাস করে লিখবেন এমনটাও নয়। তাহলে তারা জানলেন কীভাবে?"


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



"কারণ এই ঘটনার কথা জৈনদেরই এক প্রাচীন 'ধর্মগ্রন্থে'ই উল্লেখ করা আছে।"

"সে কি! তার মানে এই ঘটনার কথা যত জন লেখক উল্লেখ করেছেন তা ওই ধর্মগ্রন্থ থেকেই?"

"হ্যাঁ। ঐ গ্রন্থই এর একমাত্র প্রমাণ। ঐ গ্রন্থের নাম হল "আচারাঙ্গ সূত্ত"। এবার তুমিই ঠিক করো কোন মতকে গ্রহণ করবে।"

"'মহাবীর' যে এই জঙ্গলমহলে এসেছিলেন, এমন কথা কি 'আচারাঙ্গ সূত্তে' উল্লেখ আছে?"

"সেখানে বলা আছে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর পর্বত ও অরণ্য পূর্ণ রাঢদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। (পুরাতত্ত্ব ও মন্দির পুরাকীর্তির আলোয় পুরুলিয়া/ ডক্টর শান্তি সিংহ, পৃষ্ঠা- ১১৬) শুভাশিস চক্রবর্তী, আবার একে 'রাধা' অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছেন। (আনন্দবাজার পত্রিকা ২৫/৪/২০২১) 'আচারাঙ্গ সূত্তে' এই রাঢ় দেশের দুটি ভাগের কথা আছে। বজ্র বা বজ্জভূমি এবং সূম্ভভূমি। এদিকে পুরুলিয়া  'বজ্রভূমি'-র অন্তর্গত। সুতরাং মহাবীর যে এই জঙ্গলমহলে এসেছিলেন সেটা দারুন রকমের সত্য। এতে কোন সংশয় নেই।"

"আবার 'যুধিষ্ঠির মাঝি' বলেছেন, মহাবীর যখন এসেছিলেন তখনই অঞ্চল দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল। 'বীরভূমি' ও 'বজ্জভূমি'। বজ্জভূমি ছিল আদিবাসী প্রভাবিত। আর 'বীরভূমি' ছিল 'সরাক' দের।" (সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি /যুধিষ্ঠির মাঝি, পৃষ্ঠা- ৫)

"এই 'সরাক' আবার কারা?"

"'সরাক' হল প্রাচীন জৈন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়। পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা মনে করেন, 'সরাক' শব্দটি জৈন শব্দ 'শ্রাবক' থেকে এসেছে। 'শ্রাবক' শব্দের অর্থ হল 'শ্রোতা'। অর্থাৎ যিনি গুরুর কাছে উপদেশ শোনেন। এই সরাকদেরকেই ধর্মীয় আলোয় আলোকিত করতে মহাবীর এখানে ধর্ম প্রচারে এসেছিলেন।"

"তার মানে 'সরাক' বা জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা মহাবীরের আগে থেকেই জঙ্গলমহলে ছিল?"

"অবশ্যই! তারা যে ভূমিজেরও আগে থেকে এখানে ছিলেন সে কথা তো নানা গ্রন্থে উল্লেখিত আছে। 'সরাক'-রা এখানে এলে এখানকার আদিবাসী মানুষেরা তাদেরকে সহজে জায়গা ছেড়ে দেয়নি। সরাকদেরকে সংগ্রাম করে সে জায়গাটা দখল করে নিতে হয়েছিল। তাই আদিবাসীরাও  সরাকদেরকে তেমন একটা পছন্দ করত না। পরবর্তীকালে মহাবীর যখন সরাকদের মধ্যে ধর্ম প্রচারে এসেছিলেন তখন এখানকার আদিবাসীরা সেই ক্রোধ থেকেই এমন অভদ্র আচরণ করেছিল।"

"তাহলে এটাই দাঁড়াল যে, 'সরাক' জৈনধর্মের মানুষেরা এখানে মহাবীরের আগমনের পূর্বকাল থেকেই বসবাস করছে।
আমার প্রশ্ন হল, মহাবীর হঠাৎ এই দুর্গম জঙ্গলমহলে জৈন ধর্মের প্রচারে ব্রতী হতে গেলেন কেন?"

"দেখো, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তোমাকে এর প্রেক্ষাপটটা একটু বুঝতে হবে। মূলত 'বৌদ্ধ' ও 'জৈন'ধর্ম প্রচারে জোর দেওয়া হয়েছিল অনার্যকৃত রাজ্য ও দেশগুলোতেই। যেখানে আর্য প্রভাব থাকবে না। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে রচিত "বৌধায়ন ধর্মসূত্র" থেকে জানা যায় মগধ ও অঙ্গদেশ আর্যকৃত হলেও পুন্ড্র, বঙ্গ ও কলিঙ্গ তখনো আর্য প্রভাবের বাইরে ছিল। এদিকে গৌতম বুদ্ধ উত্তর ভারতের কৌশল, বিহারের মতো অংশেই কেবল ধর্ম প্রচারে অধিক জোর দিয়েছিলেন। তাই মহাবীর ও তার অনুগামীরা রাঢ় ভূমি সহ বাংলাকেই প্রচারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।"

"কিন্তু নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতেই তাদের বাসস্থান গড়ে উঠলো কেন?"

"কারণ বড় বড় নদীর তীরবর্তী পথ ধরে জৈন শ্রমনরা যাতায়াত করত বলেই তো কাঁসাই, দামোদর, সুবর্ণরেখা, শিলাবতী, কুমারী নদীর তীরে জৈন মন্দিরগুলো গড়ে উঠেছিল। এ আর নতুন কী!"

"তাহলে এটা দাঁড়ালো যে সরাক বা জৈন ধর্মের মানুষেরা পুরুলিয়া সহ জঙ্গলমহলে মহাবীরের আগমনের পূর্বকাল থেকে বসবাস করছে।"

"হ্যাঁ। পুরুলিয়া জেলাকে উত্তর ও দক্ষিণে যদি ভাগ করা যায় তাহলে উত্তরভাগ তথা কাশিপুর, রঘুনাথপুর, পাড়া, হুড়া, নেতুরিয়া প্রভৃতি জায়গায় এই প্রাচীন জৈন জাতি 'সরাক'দের প্রাধান্য। আর দক্ষিণভাগে কেবল মাহাতোদের প্রাধান্য। আসলে পুরুলিয়াতে সব থেকে প্রাচীন জনজাতি হল আদিবাসীরা। এরা বজ্রের মতো কঠিন ও বিপজ্জনক বলেই তাদেরকে বলা হতো বজ্রভূমিজ (সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি /যুধিষ্ঠির মাঝি, পৃষ্ঠা - ৪)। তাই থেকেই এলাকা 'বজ্জভূমি' বা 'বজ্রভূমি' নামে পরিচিত। পরে সরাকরা এখানে এসে তাদের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেদের জায়গা অধিকার করে বসবাস শুরু করেছিল। 'Statistical Account of the District of Manbhum' গ্রন্থে ডব্লিউ হান্টার কী লিখেছেন দেখুন, 'The early Jain devotees, like the primitive Risis on the vedic period went out and established hermitage in the Jungles which became the centre of a colony of Jain worshippers.'"
"তার মানে জঙ্গলমহলে সরাকদের বসবাস খুব একটা সহজ ছিল না।"

"একদমই তাই। তাদের গতিপথ খুব একটা সহজ ছিল না। কারণ জঙ্গলমহলে পদার্পণের শুরু থেকেই তাদের লড়াই করতে হয়েছে। প্রথমে লড়াইটা করতে হয়েছিল এই আদিবাসীদের সঙ্গেই। কারণ তাদের অধিকৃত অঞ্চলে ভাগ বসানো, তার ওপর তাদের সমাজ ও সংস্কৃতিও ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তারপর তো সপ্তম শতাব্দী থেকে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক ও বাহকদের সঙ্গে লড়াইটা ছিল আরো কঠিন ও জটিল। কারণ আদিবাসীরা তো এই এলাকা থেকে তাদেরকে একরকম নির্মূল করে তোলার চেষ্টায় একেবারে বিতাড়ণের কাজ করতে শুরু করেছিল।"

চলবে...

Post a Comment

1 Comments

  1. অত্যন্ত মূল্যবান লেখা। খুব খুব ভালো লাগলো। পরুলিয়া বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ঘোরার সময় অনেক জৈন মন্দিরই শিব ভৈরবের উপাস্থনাস্থল হিসেবে দেখেছি। কোথাও আবার জৈনমুর্তিকে বিষ্ণুর রূপ দিয়ে পূজো করছে মানুষ। একটি ধর্মের দৌর্বল্যের কারণে অন্য ধর্মের মানুষের হাতে মন্দির স্থাপত্যেরও যে বিবর্তন ঘটে তা অনস্বীকার্য । এ বিষয়ে আরো লেখা পড়তে উৎসুক। লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন । অভিনন্দন অবশ্যা জ্বলদর্চির গুণী সম্পাদককেও।

    ReplyDelete