জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র/একাদশ পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                          একাদশ পর্ব     
 দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                                   


কর্ণ সূর্যদেবকে আরো বললেন "প্রভু আমার অস্ত্র শিক্ষার কৌশল হয়তো একদিন ব্যর্থ হয়ে যাবে। যার প্রশ্রয়ে আমি অঙ্গরাজ হয়েছি সেই দুর্য্যোধন শতভাই সমেত একদিন ঝড়ে পড়া গাছের মতো উৎপাটিত হয়ে যাবে, যে অর্জুন বধের লক্ষ্যে আমি এতদিন অগ্রসর হয়েছি সেই অর্জুনের মত দেব,গন্ধর্ব বিজয়ীর প্রাণ রক্ষার জন্য দেবরাজ আমার কাছে প্রার্থনা করবেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রার্থনা পূরণ করা তো মহাগৌরবের বিষয়। প্রভু আপনি আমাকে বাধা দেবেন না"।          
স্বপ্ন থেকে সূর্যদেব নিষ্ক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে কর্ণের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতে তিনি দেখলেন রাত্রির চতুর্থ প্রহর আগত। যথানিয়মে তিনি গঙ্গা স্নানের উদ্দেশ্যে নিষ্ক্রান্ত হলেন। নির্জনতা কর্ণের খুব প্রিয় কারণ কোলাহলমুখর স্থানে তাঁর সূর্য বন্দনায় ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা থাকায় তিনি সর্বদা নির্জন নদীতীরে গমন করেন। নদীতে তিনি নেমে স্নান করতে যাবেন এমন সময় সেই নিষাদ এসে তার পথরোধ করল। স্নান সমাপনান্তে তাঁর সূর্য বন্দনা করতে প্রায় দিবসের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় প্রহর সমাগত। সূর্যবন্দনা শেষ করে তিনি সূর্যদেবকে প্রণাম করে লক্ষ্য করলেন দেব দিবাকর আজ যেন ঈষৎ ম্লান। 
প্রণাম সমাপনান্তে তাঁর কর্ণগোচর হলো 'ভিক্ষাং দেহি'। নয়ন উন্মীলিত করে দেখলেন নদীতীরে এক ব্রাহ্মণ দণ্ডায়মান। কর্নের অনুধাবন করতে কোন অসুবিধা হলো না যে এই ব্রাহ্মণই তাঁর কার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করছেন। শুভ্রসিক্ত বসনে বালার্কদ্যুতিতে সমুজ্জ্বল কপালে রাজটিকা কর্ণের। তিনি ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন "বলুন ব্রাহ্মণ, আপনি কি ভিক্ষা প্রার্থনা করেন"? 
ব্রাহ্মণ ঈষৎ হাস্যে বললেন "আমি যা প্রার্থনা করব তুমি যদি তা দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হও তাহলেই আমার প্রার্থনা তোমার কাছে পেশ করবো"। এই কথা শুনে কর্ণের অন্তরে বিগত রাত্রির স্বপ্নের কথা ও নদীতীরে স্নানে নামার পূর্বে নিষাদের কথা মনে হলো। তিনি ভাবলেন স্বপ্নে সূর্যদেবের কথামতো ছদ্মবেশী দেবরাজ ইন্দ্র কি তাহলে তার কাছে এসেছেন? কিন্তু মনের আবিলতা দূর করে তিনি বললেন "ব্রাহ্মণ আপনি কি অবগত নন কর্ণের কাছে এইসময়ে যে যা যাচ্ঞা করে কর্ণ তার সেই অভীপ্সা পূরণ করেন। বলুন, আপনার কি প্রার্থনা? ধন-দৌলত, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, অশ্ব, হস্তী, সুন্দরী নারী অথবা রাজ্যপাট - আপনার অভীপ্সা পূরণে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ"। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



ব্রাহ্মণ বললেন "আমার এই সমস্ত কোন জিনিসের প্রয়োজন নেই"। 
কর্ণ বললেন "তাহলে বলুন, আপনার কি প্রার্থনা"? ব্রাহ্মণ সরাসরি বললেন "তোমার বাহুতে ও কর্ণে শোভিত সহজাত কবচকুণ্ডল আমি প্রার্থনা করছি"। 
কর্ণ বুঝতে পারলেন আসন্ন মহারণে ভীত হয়ে অর্জুনের জীবন রক্ষার্থে দেবরাজ ইন্দ্রের এই আকুতি। কর্ণ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে তার কটিদেশ হতে অসি নিষ্কাশন করে বাহু ও কর্ণের কবচকুণ্ডল ছেদন করে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশী দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে তুলে দিলেন। কবচ কুণ্ডল হস্তগত করে দেবেন্দ্র তার রূপ পরিবর্তন করে স্বরূপে দেখা দিয়ে বললেন "ধন্য তুমি কর্ণ! তুমি যে দানবীর বলে জগতে ঘোষিত আজ তা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলাম। তোমার মহত্ত্ব, সত্যবাদিতা যথার্থ। যতদিন চন্দ্র সূর্য এই ধরাধামে বিরাজ করবেন ততদিন তোমার এই দানের কথা মানুষের মনে জাগরিত থাকবে। আমি তোমাকে বর দিতে চাই। কি বর তুমি প্রার্থনা কর, শুধুমাত্র আমার বজ্রাস্ত্র ব্যতীত যা চাইবে তাই তোমাকে দেব"। 
কর্ণ বললেন "আপনি যদি একান্তই আমাকে বর দিতে আগ্রহী হন তাহলে আপনি আমাকে 'একাঘ্নী' অস্ত্র দান করুন। যাকে উদ্দেশ্য করে এই অস্ত্র প্রয়োগ করব তার মৃত্যু যেন অবধারিত হয়"। দেবরাজ বললেন "তথাস্তু, এই নাও অস্ত্র, তবে এই অস্ত্র একবারই মাত্র প্রয়োগ করা যাবে। একবার প্রয়োগ করার পরে এই অস্ত্র তোমার কাছে পুনরায় ফিরে আসবে না"। এই বলে দেবরাজ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে কর্ণ ভাবলেন দেব চরিত্র কি এক প্রহেলিকাময়!            
কর্ণ একাঘ্নী অস্ত্র পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে চিন্তা করলেন আসন্ন মহারণে তিনি এই অস্ত্র অর্জুনের উপরে প্রয়োগ করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখবেন। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরকম। সেই ঘটনা হ'ল বিপক্ষের যুদ্ধের তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে দুর্যোধনের অনুরোধে ভীমের রাক্ষস পুত্র ঘটোৎকচের উপরে তাঁকে প্রয়োগ করতে হয়েছিল।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে চারিদিকে সাজসাজ রব। কৌরব পাণ্ডব দুই শিবিরেই গুপ্তমন্ত্রনা শুরু হয়েছে যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। উভয়পক্ষের শ্রেষ্ঠ ধনর্ধরদের বিপক্ষে কে বা কারা প্রতিরোধ গঠন করবেন ইত্যাদি। দুর্যোধনকে শ্রীকৃষ্ণ সাত কোটি নারায়ণী সেনা দিয়েছেন দুর্যোধনের প্রস্তাব মত এবং অর্জুনের ইচ্ছা পূরণ করে বাসুদেব পান্ডব পক্ষে যোগ দিয়েছেন। অবশ্য তিনি নিজে  যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না। উপপ্লব্য নগরী যেখানে পাণ্ডবেরা শিবির স্থাপন করেছেন সেখানে মন্ত্রণা পর্ব শেষ করে বাসুদেব তাঁর নিজস্ব পৃথক তাবুতে প্রবেশ করার পূর্বে প্রতিহারী এসে বলল "মহাদেবী পট্টরানী আপনার সাক্ষাৎ অভিলাষী"। বাসুদেব প্রতিহারীকে অনুসরণ করে দ্রৌপদীর প্রকোষ্ঠে যেয়ে মধুর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন " সখী কি তোমার অভিপ্রায় যে আমাকে স্মরণ করেছ"? 
দ্রৌপদী আসন্ন যুদ্ধের কথা চিন্তা করে বললেন "হে কেশব, আসন্ন মহারন কি কোন ভাবেই বন্ধ করা যেত না? তুমিতো ইচ্ছা করলেই এই অযথা লোক ক্ষয়কারী যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে পারতে। এই যুদ্ধে আমার পঞ্চস্বামী, পুত্র, পৌত্র, পিতা, ভ্রাতা, আত্মীয়-স্বজন লিপ্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হবেন - এই চিন্তায় আমি যে স্থির থাকতে পারছি না। বিপক্ষে একা পিতামহ ভীষ্ম, তদুপরি আচার্য দ্রোণ ছাড়াও অন্যান্য বীরেরা আছেন"। 
শ্রীকৃষ্ণ দৃষ্টি কঠোর করে বললেন "ভাবিনী, তুমি তো কেবলমাত্র নিজের জনদের সম্বন্ধে চিন্তা করে দেখ কিন্তু চিন্তা করে ব্যাকুল হয়েছ। কিন্তু চিন্তা করে দেখো তো এই কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে সারা ভারতের অসংখ্য রাজা ও তাদের সৈন্যরা এসেছেন। তাঁরাও তো কারো পুত্র, ভ্রাতা অথবা স্বামী। কেবলমাত্র নীতির প্রশ্নে শৌর্য প্রদর্শনের, বীরের ধর্মাচরণের জন্যই তাঁরা সমাগত। আর তুমি কি ভুলে গেলে দ্যূতসভায় তোমার লাঞ্ছনা বা তোমার প্রতিজ্ঞার কথা? তোমার আশঙ্কার কথায় ফিরে যেয়ে বলি পিতামহ ভীষ্ম বা গুরু দ্রোণাচার্যের হাতে তোমার স্বামী বা পুত্রদের বিনাশের আশঙ্কা নেই। তাঁরা চিরকাল পান্ডবদের স্নেহের চোখে দেখেছেন তাদের চারিত্রিক মহত্ব, সৌজন্য, ন্যায়-নীতি, ধর্ম পথে থাকার জন্য। কেবলমাত্র হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদের অন্নে প্রতিপালিত বলে তাঁরা কৌরবদের পক্ষে অস্ত্রধারণ করছেন। কিন্তু যে মহাবীরের কথা তোমার কল্পনাতেও নেই আমি শুধু চিন্তিত তার জন্য"।  
                                                  ………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

0 Comments