জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী

নির্মল বর্মন


প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাহিত্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । বস্তুতঃ কবি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ থেকে সরে আসতে পারেনি, ইংরেজি সাহিত্যের কৃতি অধ্যাপক জগন্নাথ চক্রবর্তী। আবার উত্তরাধিকার সূত্রে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ তাকে বিচলিত করেছে । সুতরাং , প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাহিত্য তাঁর মানসিকতায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিল।
অধ্যাপক জগন্নাথ চক্রবর্তী একাধারে ছিলেন সমালোচক , শব্দ গবেষক,  অনুবাদক ও কবি।  একসময় তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি অধ্যাপক এর দায়িত্ব যত্ন সহকারে পালন করেছিলেন।  কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী একসময় "এশিয়াটিক সোসাইটি"র গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকার , সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া "জাতীয় অভিধান নির্মাণে তার অবদান অনস্বীকার্য।  মূল রুশ থেকে "ইগর গাথা" বাংলায় অনুবাদ করে "সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু"  পুরস্কার পান জগন্নাথ চক্রবর্তী । বিভিন্ন সময়ে "ইন্ডিয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন" ; "সোসাইটি ফর রিসার্চ অফ ন্যাশনাল কালচার";  "ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার" প্রভৃতি নানান সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী  ১৯২৩ সালে পৃথিবীতে মায়ের কোল আলো করেছিলেন,
 ১৯৯২ সালে অন্ধকার জগতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পৌঁছে গেছেন। 
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল "নগর সন্ধ্যা 1946 ;  "কারার প্রার্থনা" 1950 ; "পার্কস্ট্রীটের স্ট্যাচু ও অন্যান্য কবিতা", 1969; "নিঃশর্তের নাম সুন্দরী" ; "মৌনী  হিমালয় স্তব্ধ আলপস " ; "কলকাতা ও অন্যান্য কবিতা"1973;   "জলস্রোতে বিম্বৌষ্ঠ 1980 ; "সিলুএট নামক স্বগত" ;  "গীতাঞ্জলি অস্তিত্ব বিরহ" ;  "মণিমঞ্জুষা"।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী প্রথম কাব্যগ্রন্থ "নগরসন্ধ্যা"। এই কাব্যগ্রন্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া ছবি অঙ্কিত হয়েছে। বর্তমান সময় ও সমাজে জগৎ ও জীবনে যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব'র  দূর্বিপাক রয়েছে তার কথা স্মরণ করে কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী "সরলরেখার জন্য" কবিতা লিখেছেন। উদাহরণ ---"সামান্য একটা সরলরেখার জন্য মাথা খুঁড়ছি ,
পাচ্ছি না ।
পৃথিবীতে কোথাও একটা সরলরেখা নেই"
বিশ্বের আকাশ , দিগন্ত , নদী, পাহাড়,হ্রদ, উপকূল হরিণের শিং, গোরুর খুর ইত্যাদি কোন কিছু সরল নয়। তাই কবির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত----
"কোন মানুষই সোজা নয়,
তাই বোঝা শক্ত।
মাথার উপর সূর্য- জবাকুসুম
তিনিও সোজা চলেন না,
উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়ন
মাতালের মতো টলছেন"।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী ফিরে এসেছেন নিজের কাছে। অর্থাৎ কবি ফিরে এসেছেন কবি নিজের কাছে।
"তোমার চোখের ইষৎ- ভাষাও
আমার বুকের মধ্যে এসে কেমন যেন বেঁকে যাচ্ছে,
আর সোজা ইচ্ছাটাও তোমার দ্বিধার মধ্যে
কেবলই কৌণিক।
সামান্য একটা সরলরেখার জন্য
আমরা বসে আছি"।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী "কলকাতা কলকাতা কলকাতা" নামক কবিতায় জীবনানন্দের 'কল্লোলিনী তিলোত্তমা'র ভিন্ন এক দিক উপস্থাপিত করেছেন । কবিতাটি মুন্সিয়ানার সঙ্গে শুরু করেছেন এভাবে---
"স্বর্গ যদি কোথাও থাকে --আকাশে, মাটিতে, মাটির নিচে
না ,   স্বর্গ  কোথাও নেই , কিন্তু এখানে এই কলকাতায় রয়েছে"।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী, মহানগরী কলকাতাতে কি আছে , কি কি পাওয়া যায় তার একটা সুদৈর্ঘ্য তালিকাও প্রকাশ করেছেন---+
"এখানে কি আছে আর কি নেই ?
বালকের জন্য প্লানেটরিয়াম , প্রাপ্তবয়স্কের জন্য সিনেমা,
এবং পালিত বৃদ্ধের জন্য ভাগবত,
বন্ধুর জন্য বন্ধুত্ব, তৃষ্ণার্তের জন্য পানীয় , আগন্তুকের --- জন্য রেশন কার্ড।
আপনি বিদেশী ? আপনি এখানে সুখে থাকবেন ;
আপনি বিদেশিনি  ?  আপনিও"।
কবি কল্লোলীনি মহানগরী কলকাতার আকর্ষণ কেমন তাও সরল ভাষায় পাঠকের দরবারে উপস্থিত করেছেন কবিতার মাধ্যমে------
"এই শহর দিনে রাতে সবাইকে টানে।
লাভ দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে, লুকানো ইচ্ছার গায়ে- হাত বুলিয়ে,
ব্যাংকের কাউন্টারে নোটের - বান্ডিল - শিকারি পিস্তল -- উঁচিয়ে
নিলামঘরে হাতুড়ি ঠুকে, পথে নিয়নাভ চোখের চুম্বক দিয়ে কেবলই টানে"।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী  মহানগর কলকাতাকে স্বর্গ মনুমেন্ট হিসেবে দেখেছেন , সে কথা জানাতে গিয়ে কবি পরিষ্কার ভাষায় লিখেছেন-----
"স্বর্গ কোথাও নেই, কিন্তু এখানে
ময়দানে কে কবে পুঁতেছিল এক স্বর্গের মুই- মনুমেন্ট,
যার পায়ে মিটিং , গায়ে ঘোরানো সিঁড়ি, মাথায় ছয় ঋতু।
এখানে সারাদেশের ধিক্কার , রাগ ,আহ্লাদ, সারা সংসারের উত্তেজনা মঞ্চে ওঠে;
এবং মানুষের সমুদ্রের মধ্যে এই মেঘ ছোঁয়া মই যখন লাইট হাউস তখন ইতিহাস তৈরি হয়"।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী'র সারা বাংলা তোলপাড় সৃষ্টি করা কবিতা, যার প্রতি লাইন হৃদয়ে নিংড়ানো অনুভূতি প্রকাশ করে ,সেই "পার্কস্ট্রীটের স্ট্যাচু" কবিতায় গান্ধীজীর প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন--+-
"এক বৃদ্ধ ; খালি পা , হাতে একটা লাঠি
ঠিক পার্কস্ট্রীটের মাথায় স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে"।
কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী পেশা একজন অধ্যাপক নেশায় কবি, সমালোচক , শব্দ গবেষক ও  অনুবাদক হওয়ার ফলে বাংলার স্বারস্বত সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Post a Comment

0 Comments