জ্বলদর্চি

বর্ণালী সামন্ত জানা (নার্সারি পরিচালক, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫০

বর্ণালী সামন্ত জানা (নার্সারি পরিচালক, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি


জীবনের নানা ওঠাপড়া তাঁর গায়ে লেগেছে। কিন্তু নিজেকে বোরোলিনের মতো অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বানিয়ে সেইসব 'ওঠাপড়া' গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছেন সুমুখপানে। আমফান, ইয়াস কিংবা বুলবুলের মতো দাপুটে ঝড়ঝঞ্ঝার চেয়েও ভয়ঙ্কর টাইফুন, হ্যারিকেন তাঁর জীবনের ওপর বয়ে গেলেও তিনি ভাঙেননি। মচকান নি। নুয়ে পড়েননি। নিজের মানসিক দৃঢ়তা এবং কর্মতৎপরতাকে পাথেয় করে এগিয়ে গিয়েছেন। পথ খুঁজে নিয়েছেন লড়বার। আলো দেখতে পেয়েছেন জুঝবার। 

তিনি বর্ণালী জানা। রামধনুর সাতরঙা বর্ণ তাঁর জীবনে নয়, কাজের নিরিখে, লড়াইয়ের নিরিখে উজ্জ্বল। তাঁর জীবন মোটেও বর্ণময় নয়। লড়াই সংগ্রাম করেই তাঁর বেঁচে থাকা। টিকে থাকা। কারও অনুকম্পাতেও নয়। মাথা তুলে, শিরদাঁড়া সোজাভাবে। জীবনের ক্যানভাস থেকে যাবতীয় রঙ শুকিয়ে যাওয়া পিপুলবেড়িয়ার বর্ণালী জানা কিন্তু আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। রামধনুর সাতরঙা বর্ণালী তাঁর চলার পথে আলোর ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন দৃঢ় মানসিকতা, অকুতোভয় ইচ্ছাশক্তি আর মাথা সোজা রেখে বেঁচে থাকবার প্রাণবায়ু গ্রহণ করে। আজ তিনি একাকী সৈনিক। জীবনযুদ্ধে বিদ্ধস্ত হয়েও তিনি নিজের কর্মগুণে অন্যান্য মহিলা দের চেয়ে আলাদা করতে পেরেছেন নিজেকে। হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন। 
আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০০৯ এর ২১ শে ডিসেম্বর মৃত্যু হয়েছিল স্বামী শুভাশিষ জানার। অসাধারণ নার্সারি পরিচালক ছিলেন তিনি। নানা জাতের গাছ ব্যবসায় তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। শুভাশিস বাবুর মৃত্যুতে  তিনি হয়ে গিয়েছিলেন 'একলা'। দুই মেয়ে ধী এবং ঐষীকে নিয়ে তাঁর ছিল তখন অসম লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। আর এই লড়াইতে তাঁর একমাত্র সঙ্গী পেয়েছিলেন স্বামীর রেখে যাওয়া 'গাছ' গুলোকে। নানা রকমের গাছ। বন্ধুর মতো উদ্ভিদের দলকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন তখন। সংসারের জোয়ালটা টেনে নিয়ে যাওয়ার শক্তি পেয়েছিলেন উদ্ভিদপ্রেমী স্বামীর দেখানো পথকে হাতিয়ার করেই। গাছেরাও আপন করে নিয়েছিল  তাঁকে সেদিন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত সেতারশিল্পী মৃত্যুঞ্জয় সামন্ত। একদিকে গাছ, অন্যদিকে গান -- এই দুয়ের ত্রহ্যস্পর্শে তিনি নিজেকে করেছেন অনুরণিত। 
তমলুক শহরের শঙ্করআড়ায় বাড়ি হলেও পিপুলবেড়িয়াতে স্থাপন করেছেন বিশাল নার্সারি। ১৯৯৮ তে তা শুরু করেছিলেন শুভাশিষবাবু। এখন যাবতীয় দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন 'এভারগ্রীণ নার্সারি'-র বর্তমান কর্ণধার বর্ণালী জানা। মেয়েদের পড়াশুনা, সংসার প্রতিপালন এসবের সাথেই বাগান দেখাশোনা করা, ব্যবসার হিসাব পত্তর রাখা। 'খুন্তি ঠেলা' মহিলারা যে এত ঝক্কি সামলাতে পারে তা বর্ণালী জানাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

আপাতত পিপুলবেড়িয়াতে ২টি, গৌরাঙ্গপুরে ২টি, কাকগেছিয়াতে ১টি এবং তমলুকের চড়াতে ২টি বাগান করা হয়েছে গাছের। মূল বাগানটি ১০ বিঘা জমিতে। মানুষজন একসময় 'গাছ দম্পতি' বলেই চিনতো শুভাশিষ বর্ণালীকে। কিন্তু হঠাৎ শুভাশিষবাবুর মৃত্যু সংসারে নিয়ে এলো অনভিপ্রেত সুনামির নিরবতা। কিন্তু সেই তাণ্ডবে ভেসে যাননি। শক্তভাবে আটকে থেকেছেন পাড়ের সাথে। লড়াই করেছেন রবাহূত অতিথিদের সাথে। একটা গাছ যেভাবে হাজার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার মহিমা দেখায়, ঠিক তেমনি সেই গাছের সাথে সখ্যতা করে গাছেরই জীবনবোধ নিজের চলার পথে ব্যবহার করতে পেরেছেন বর্ণালী জানা।
আজ তাঁর বাগানে দু'ধরনের গাছ মিলবে। একটি ওরনামেন্টাল গাছ এবং অন্যটি ফলকর গাছ। সাইকাস রিভল্যুটা, জিমিয়া ফুরফুরিয়া, জিমিয়া ফ্লোরিডানা, পাম বা সিফোর্থিয়া এলিগেন্স, র‍্যাপিস পাম, র‍্যাভেসিয়া পাম, ফক্সটেলা পাম, ডিপসিস লেপ্টোচুলিসদের অজস্র সম্ভার। কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক নাম তাঁর মুখস্থ। সাধারণ আম, লেবু, পেয়ারার পাশাপাশি দেদার তৈরি করেন এইসব ওরনামেন্টাল প্ল্যান্টস। ইউফোরিয়া মিলি, ডিওন, নোলিনা, ভিক্টোরিয়া, সং অব ইণ্ডিয়া, গোল্ডেন বটল ব্রাস, গোল্ডেন ব্যাম্বু, বুদ্ধজ ভ্যালি, ব্ল্যাক ব্যাম্বু, অ্যাডেনিয়াম ওডেসাস, ভেরিগেটেড বুদ্ধজ ভ্যালিদের নিয়ে তাঁর নিত্যদিনের ওঠাপড়া। আজ আর গায়ে আঁচ ফেলতে পারেনা ১৪ বছর আগের যন্ত্রনা। এখন তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সফল ব্যবসায়ী মহিলা। তাঁকে দেখে শেখা যায়। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়। তাঁকে দেখলে লড়াইয়ের ময়দান ছোট হতে বাধ্য। তিনি এখন অনায়াসে এই বঙ্গের বহু মহিলার রোল মডেল। 
   মানুষ ঠকাতে জানে, কিন্তু গাছ কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তাই সকলের আগ্রহ গাছের প্রতি। সেই বিশ্বাসী 'বন্ধু'কে পাশে পেয়েছেন সংসারের গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। শুধু নিজের সংসার নয়, এরই সাথে স্থানীয় বহু মানুষ পেয়েছেন কাজ। রুজিরুটির আবাসস্থল। তাঁদেরও ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন এই গাছেদের হাতিয়ার করেই।
  বাজারে গাছ লাগানোর চাহিদা বেড়েছে। মানুষ চাইছে এই 'বন্ধু'দের। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও গাছের দাম কমে যাচ্ছে। কেন না প্রচুর নার্সারি গড়ে উঠছে এখন। তাই এই ব্যবসা ক্রমশ: কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। হাতে কলমে ব্যবসার অন্দরমহলে কাজ করার সুবাদে ব্যবসার খুঁটিনাটি জেনে ফেলেছেন তিনি। লড়াইয়ের ময়দানে যখন নেমেছেন তখন লড়াই থেকে কি পিছিয়ে আসা যায়? হার জিৎ আছেই। তাই বলে 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী'।
   এখান থেকেই অর্ডার অনুযায়ী নানা ধরনের গাছ পাঠান দুই ২৪ পরগণা, মুচিশা, আমতলা, বেঙ্গালুরু, ওড়িশা, হুগলি, হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হয়। খোঁজ রাখতে হয়। নজর রাখতে হয়। এসব তিনি শিখে ফেলেছেন প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে অংশীদারি করানোর মাধ্যমেই। যাবতীয় ঝক্কি সামলানোর মানসিক এবং দৈহিক শক্তি অর্জন করতে পেরেছেন সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে নেমেই। ঠেকে এবং ঠকে শিখেছেন জীবনের অর্থকরী দিকগুলি। 
১৯৮৯ তে বাড়িতে গাছের বাগান শুরু করেছিলেন স্রেফ শখের জন্য। পরবর্তীতে তা ব্যবসায় পর্যবসিত। সেই ব্যবসার হাল আজ তাঁর হাতে। পাশে নেই জীবনসঙ্গী। এই বিশ্ব সংসারে তিনি আজ একাকী লড়াকু। কিন্তু পথভ্রষ্টা হয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। যে গাছের গোড়ায় তিনি নিয়মিত জল দিতেন, সেই গাছেদের দল আজ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সোহাগভরে। তাঁর দুঃখে দুখী। তাঁর সুখে সুখী। বর্ণালীর জীবনের বর্ণ আজ সবুজ। 'এভারগ্রীণ নার্সারি'র গাছেদের দল আজ তাঁর চলার পথের 'ক্লোরোফিল'। লড়াইয়ের শরিক। ভালোবাসার শরিক। কবি শ্রীজাতর 'গাছ' কবিতায় তিনি জড়িয়ে রেখেছেন নিজের চলমান জীবন ---
"মৃত্যু সেজে দাঁড়িয়ে আছে মুখনিচু এক গুরুত্বহীন গাছ
হাত রাখো তার বুকের কাছে, দেখতে পাবে আলো-গহীন গাছ।
ঘোড়ারা সব মৃত এখন, প্রান্তরে এক চাঁদ দাঁড়িয়ে চুপ…
আমার মতো একলা ঘরে কেউ বুঝি আর শোনে মহীন, গাছ?
রোদ চড়েছেন বাবা’র মতো, দেহাতি মা পাঁচিল সারাদিন
ভাই ধুলো, সে গ্রামকে বেড়ায়… চুপটি থাকে ছোটি বহিন গাছ
মৃত্যু সেজে দাঁড়িয়ে আছে মুখনিচু এক গুরুত্বহীন গাছ
হাত রাখো তার বুকের কাছে, দেখতে পাবে আলো-গহীন গাছ।"
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

Post a Comment

0 Comments