জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৬৮/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা   খান

পর্ব ৬৮

রাস্তার দুপাশে ফুলের কেয়ারি, সামনে প্রিমিয়াম সুপারমার্কেট। মার্কেটের বাম দিকে আমাদের কটেজ দেখতে পেলাম। আমাদের কটেজের সামনের দিকে একটি লেডিস টয়লেট রয়েছে। এগুলো মনে হয় যারা তাঁবুতে রাত্রি যাপন করেন, তাদের জন্য।  যাইহোক চাবি নিয়ে এসে দরোজা খুলতেই ভিতরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কটেজের ভিতরে সব রকম সুব্যবস্থা রয়েছে। বাইরে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য মজার মজার খেলার ব্যবস্থা। ইনডোর গেমসও রয়েছে।

     এখানে বেশ রোদ্দুর, বৃষ্টি নেই। আমরা ফ্রেস হয়ে, চা কফি খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সি বিচের খোঁজে। ভয় হচ্ছে, কালও যদি বৃষ্টি হয়? ওয়েদার রিপোর্ট অনুযায়ী আজও বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। প্রথমে  আমরা আটলান্টিকের উঁচুপাড়ে একটা পার্কে ঢুকলাম। বেঞ্চে বসে সমুদ্রের দিকে  তাকিয়ে থাকলাম, কিন্তু মন আমার অন্যখানে। জারা খেলছে, আমি আর খান  সাহেব সমুদ্রের কাছে যাওয়ার জন্য ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম। কিন্তু নিচে নেমেও   দেখলাম সমুদ্র অনেক দূরে, তাই আবার উঠে এলাম। খান সাহেবের খুব কষ্ট হল। রোদটা গায়ে খুব লাগছিল, একটা ছোট্ট গাছের তলায় বসলাম। পার্কের চারপাশে সবুজ ঝোপের বেড়া, হঠাৎ দেখি সেই ঝোপ থেকে একটা বাদামি রঙয়ের খরগোশ ছানা বেরিয়ে এসে ঘাস খাচ্ছে। এখানে বসেই অনেককিছু দেখলাম, প্রচুর সিগাল  উড়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ির ছাদে বসছে। সূর্যাস্ত দেখার জন্য একটি রেস্টুরেন্টের ছাদে গেলাম, ছাদটির তিনদিক কাচের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আছে। বসারও ব্যবস্থ্যা রয়েছে। আনেকে ওখানে বসে খাবার খাচ্ছেন। কিছু পরে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলে কটেজে ফেরাই সমীচীন মনে হল।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



     পরদিন বিছানায় শুয়েই টের পেলাম বৃষ্টি পড়ছে। চা খেয়ে মা আর মেয়ে  রান্নার তোড়জোড় শুরু করলাম। ফ্রিজে বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে আসা চিকেন ছিল। ভাতডাল আর ফুলকপি ভাজা করলাম। আজ আর গাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে না। এখান থেকে বাসে যাওয়া আসার ব্যবস্থা আছে, তাতেই যাওয়া হবে। এই ওয়েদারে খান সাহেব বের হতে রাজি হলেন না। আমরা ছাতা নিয়ে বের হলাম, বাস দাঁড়িয়েই ছিল, কিন্তু বন্ধ। দীপ আর জারা ওয়াটার প্রুফ জ্যাকেট পরে আছে, কিন্তু আমাদের মা মেয়ের ছাতাই ভরসা। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় ছাতা উড়ে যাবে মনে হচ্ছে। বাস আমাদের বিচের সামনে নামিয়ে দিলে আমরা  জলের কাছে পৌঁছাতেই তুমুল জোরে বৃষ্টি নামল, সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া তো ছিলই। আমি কোন রকমে শালটা ধরে রেখেছি। ভাগ্যিস আজ শাড়ি পরিনি। বিচে  লোকজন আছে ভালই, ৭/৮ মাসের বাচ্চাকে মা প্র্যেমএ(Prem) করে নিয়ে এসেছে। আসলে ওরা মাইনাস ১০ ডিগ্রিতে অভ্যস্থ। ওদের কিছু হবেনা। কত বয়স্ক মানুষ জলে ভাসছেন। আমরা শুধু জল ছুঁতে পারলাম। বিচের বামদিকে সারিদিয়ে নানারঙ্গের কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে, জানলাম, ওগুলিকে ‘বিচহাট’ বলে। যারা রোজ জলে ভাসেন, সাঁতার দেন, তারা ওই ওগুলি ভাড়া করে সাঁতারের সরঞ্জাম ইত্যাদি রাখেন। তাতে রোজ নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার ঝামেলা এড়ানো যায়।

     কটেজে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে সুপারমার্কেটের পাশেই একটি পটারিতে আমার আর জারার জন্য টিকিট করা ছিল সেখানে গেলাম। প্রচুর খেলনা সাজানো রয়েছে। সেখান থেকে যে কোনও খেলনা নিয়ে ১ ঘণ্টার মধ্যে রঙ করে দিলে ওরা সেটা পুড়িয়ে দেবে। তবে আগামিকাল ১০ টার আগে দিতে পারবে না। আমি একটা রাজকুমারী জারা একটা ঘোড়া নিল, রঙ তুলি, জল সবই টেবিলে সাজানো রয়েছে। হাতে নার্ভের সমস্যা থাকায় নিখুঁতভাবে রং করতে পারলাম না।

     বিকেলে গাড়িতে করে আবার বের হলাম। ঠিক হল আমরা কেউই গাড়ি থেকে নামব না। কিন্তু তবুও নামলাম। এখান থেকে সকালে দেখা উলাকামবে সিবিচ দেখা যাচ্ছে। কিছু মানুষও দেখতে পাচ্ছি। এইটুকু দেখেই ফিরে এলাম। জারা আবার সন্ধ্যাবেলা দীপের সঙ্গে ইনডোর গেম খলতে গেল। রাতে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, ডিমের অমলেট খাওয়া হল। সকালে  খেলনাদুটি পটারি থেকে নিয়ে একেবারে কটেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কারপার্কে গাড়ি রেখে গতকালের দেখা  ছোট্ট বিচে যাব ভেবে দাঁড়িয়েছিলাম, জারা নানুর হাত ধরে ঘাসে ঢাকা ঢালু জমি দিয়ে দিব্যি নেমে গেল। ওদের দেখে আমিও নামতে গিয়ে একেবারে ‘পা পিছোলে  আলুর দম’! সাদা ড্রেসে সবুজ দাগ হয়ে গেল। হাঁটুতে জোর ব্যথা লেগেছে।পায়ের বুড়ো আঙ্গুল মচকে গেছে। দীপ জারা সামনে এগিয়ে গিয়ে ফোনে ডাকলে সেদিকে পা বাড়িয়ে দেখি একেবারে কিনারায় প্রজাপতি আঁকা একটি শ্বেতপাথরের ফলক পোঁতা রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে, ১৯৯৯ সালে একটি বাচ্চা এখান থেকে পড়ে মারা গিয়ে ছিল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছোট্ট বিচটাতে  নামলাম। জলের স্পর্শে মচকানো আঙ্গুলটা আরাম পেল। ঢেউগুলো পাথরের খাঁজে ঢুকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের এই জায়গাটায় প্রচুর ছোট ছোট পাহাড় ও পাথরের চাটান রয়েছে। পাহাড় বা পাথরের চূড়াগুলো বুনো ক্যাকটাসের মত খাঁজকাটা। খান সাহেব ওপর থেকে চিৎকার করে  বলছেন, জারাকে দীপকে পাথরের ওপর থেকে নেমে আসতে বল। উনি ভয় পাচ্ছেন। কয়েকদিন আগে কর্নওয়ালে পাঁচবন্ধু পাথরের ওপর বসেছিল, ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। খাড়া স্লেট পাথরের গায়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে ছবি তুলছিল। কিছু সময় মা-মেয়ে-নাতনি জলে দাঁড়িয়ে  ছিলাম। তারপর অনেক কষ্টে ওপরে উঠে হাঁটতে শুরু করলাম উলাকামবে বিচের  দিকে। আজ রবিবার বলে বিচের রূপ একেবারে বদলে গেছে। প্রচুর ছোট ছোট তাঁবু, মাদুর দিয়ে আড়াল করে বারবিকিউ করছে অনেকে, ছেলেমেয়েরা বল নিয়ে ছোটাছুটি করছে। ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, বালির ক্যাসেল বানাচ্ছে। সাফরিন বোর্ডে করে ঢেউয়ের সঙ্গে ভাসছে।এদিকে পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা, তাই পাড়ে দাঁড়িয়েই চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি, নিচে নামার ক্ষমতা নেই। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি,তার সামনেই  একঝাড় কাশফুল ফুটে আছে। এর আগে কোনও সমুদ্রের পাড়ে কাশফুল দেখিনি। নটিংহামে একটি বাড়ির লনে কাশফুল দেখেছি।   

           আর কিছু দেখার ছিল না, এবার ফেরার পালা। জারা অসুস্থ বোধ করায় জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করাতে হল। ব্যথার ওষুধ খেয়েও ব্যথা কমছে না। দু’বার ব্রেক নিয়ে একসময় নটিংহামে পৌঁছালাম। কত কী তো দেখলাম, সব কিছুকে ছাপিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রজাপতি আঁকা শ্বেত পাথরের ফলকটি। মুখে নোনা স্বাদ অনুভব করতেই সম্বিৎ ফেরে, চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। মেয়ে আমাকে আজ আর রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি। পা নিয়ে কী করব জানিনা। ব্যথা কমছে না।
    আজ ৭ তারিখ, ১৭ সেপ্টেম্বরে রওনা হব। এই খোঁড়া পা নিয়ে এয়ারপোর্টে  কী করব ভাবছি। উনি তো হুইল চেয়ারে বসে থাকবেন। সুটকেশের ওজন নিয়েও  চিন্তায় আছি। দীপ অবশ্য বলছে, ওজন বেশি হলে টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। যাইহোক, আজও গোছগাছ করলাম, রান্নাও করলাম। আজ বাবলির ছুটি, দীপও হাসপাতাল যায়নি। দুজনে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। ফিরে এসে বাবলি বলল, ওরা ল’ইয়ারের কাছে গেছল উইল করার বিষয়ে কথা বলতে। তারপর ও একটি  ঘটনা শোনাল, দুটি ভিন্ন ধর্মের ছেলে মেয়ে ভারত থেকে এখানে মেডিকেল পড়তে এসে বিয়ে করেছিল। মুসলিম মেয়েটির পরিবার এ বিয়ে মেনে নেয়নি। একবার দেশে গিয়ে ছেলে বৌমা বাবা মায়ের কাছে বাচ্চাদের রেখে বেড়াতে গিয়ে দুজনেই কার এক্সিডেন্টে মারা যায়। উইল করা ছিল না বলে বাচ্চারা বাবা মায়ের কোন টাকা এ দেশ থেকে পাইনি। মেয়ের বাবা মা এর পরেও কোন খোঁজ নেননি। ছেলেটির বৃদ্ধ বাবা মা এতটাই অসুস্থ যে তাঁদের পক্ষে বাচ্চাদের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব ছিলনা। শেষে ছেলেটির আমেরিকাবাসী এক কাজিন বাচ্চাদুটিকে দত্তক  নিয়েছেন। এসব শুনলে সত্যিই খুব ভয় করে।

    দীপ আজ বারমিংহাম গেছল ইন্টারভিউ দিতে, ভাল হয়েছে বলছে। বাবলি ওর বসের জন্য সেমুই রান্না করতে বলে গেছল। অফিস থেকে ফিরে ছোলার ডাল আর পরোটা ভেজে নিয়ে দীপের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। এই সময় বোনের ফোন পেলাম, কলেজে রানীর ফোন চুরি হয়ে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারা কত কষ্টে টাকা যোগাড় করে ফোনটা কিনে ছিল।

                                        ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments