জ্বলদর্চি

এ্যাডাল্ট ডায়াপার /গৌতম বাড়ই

এ্যাডাল্ট ডায়াপার

গৌতম বাড়ই

সকাল থেকেই দেখছি আজ বেশ জমে গিয়েছে। গিন্নী বেশ হাসিখুশি খোশ-মেজাজ। মিহিসুরে গান গাইছে। অবশ্যই রবিঠাকুরের গান। গান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম গানের কথাগুলো কী। হুম! মালুম হলো এ রবিঠাকুরের ফিউসন। একটা গানে কয়েকটা মিশিয়ে দেওয়া। খুব চলছে এই হাল আমলে। আসলে শাসন করবার কেউ তো নেই, সেই শান্তিদেব ঘোষ বা শান্তিনিকেতনের রাশভারি কর্তারা! আর রবিঠাকুর এখন আর কারোর সম্পত্তি নয় , এখন জনগণের। গিন্নী সকাল থেকেই হেঁসেলে। আমায় তড়িঘড়ি এককাপ চা দিয়েই বাজারের ফর্দ পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে চোখের সামনে রেখে গিয়েছে। আমি রাতে ঘুমোতে যাবার আগেই মিউমিউ করা বেড়াল থেকে বাঘ হয়ে হালুম করেছিলাম --" যেই আসুক, বাপ-কাকা-দাদা, যে কারুর , আমি ছুটির দিন নটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠছি না। " আর ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক নয়টায় আমার বেডে চায়ের কাপ পৌঁছে গিয়েছে। উঠেই শুনতে পেলাম সেই মিহিসুরে গান। অন্যসময় সময়ের ঠিক-ঠিকানা নেই, আজ যেন সময় ভর করেছে ওনার ওপর।

আর যখনই এই মিহিসুরে গান শুনি তখন কিন্তু আমার বক্ষে তোলপাড় তুলে দেয়। না, এই বয়সে আর প্রেমের তুফানে নয়। ঐ মিহিসুরের পেছনে জানি একটা মতলব ভাজা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের সাংসারিক অভিজ্ঞতায় একজন দক্ষ খেলোয়াড় সব বুঝতেই পারে। কোথায় ড্রিবলিং, কোথায় থ্রু পাস, আর কোথায় স্ট্রেইট ডিফেন্সিভ খেলে যেতে হবে। কারণ রাতে তো একটু মাস্তানি করেই ঘুমিয়েছি। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇

তো খবরের কাগজ আগে দেখব, নাকি বাজারের ফর্দ? এই নিয়ে মনে মনে প্রশ্ন আওড়ে ফর্দেই চোখ বুলিয়ে নিলাম। চোখ আটকে গেল ফর্দের এ্যাডাল্ট ডায়াপারে। জোরসে রুম থেকে চেঁচিয়ে বললাম-" জবা এই এ্যাডাল্ট ডায়াপার কেন?" বলেই দিচ্ছি জবা আমার গিন্নীর নাম। অবশ্য বোঝাই যাচ্ছে পাঠকমনে।

"দরকার আছে। প্রয়োজন"- রান্নাঘর থেকে উত্তর ভেসে এলো। আমি এই উত্তরে সন্তুষ্ট থাকতে না পেরে 
আবার জিগ্গেস করলাম-" তোমার কি কিছু লিক হয়ে যাচ্ছে আজকাল? তাই লোকজন আসবে বলে---?"

-"মানে?"

- " ঐ মল বা মূত্রের ----?"

- " তাহলে কতটা উদাসীন তুমি আমার প্রতি ভাবো। পাশে শুয়ে বসে থেকেও চব্বিশ ঘন্টাই ধরে কিচ্ছুটি টের পাচ্ছো না! আর যতটা বয়স বাড়ে ততটাই যেন তোমার শুভবুদ্ধিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সব পুরুষ মানুষের একই ধারা। তুমি ভিন্ন হবে কী করে?কথার কি ছিরি! লোকজন মানে কী ? তারা আমার পরম আত্মীয় । বাবা, ন'কাকা, বুল্টি আর ওর ছেলে-মেয়ে। কতদিন পরে আসছে বলতো? কেউ তো তোমার বাড়িতে আসেই না। "

আমি প্রত্যুত্তর দিতে গিয়েও চুপ থাকা শ্রেয় মনে করলাম। এখন বাজারটাই জরুরী। সুধন তার ছেলে-মেয়ে বৌ নিয়ে গত সপ্তাহেই পাক্কা পাঁচটি দিন গান্ডে-পিন্ডে গিলে কাটিয়ে গেল এই বাড়িতে। সুধন জবার মেজোমামার ছেলে। জানি এই বাড়িটাই কখনও প্রবল ভাবেই আবার তেনার হয়ে ওঠে। জবা এখন ঠিক আমার নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে, উত্তর চাইছিল। আমি বহুযুদ্ধের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হাসিমুখে ডিফেন্স করে গেলাম। যেন ছুটির দিনটি মার যেন না যায়। তারপর তো জানি ঘরভর্তি লোকজন হা হা হি  হি করে তিনটি দিন কাটাবেন , খাসি মুরগি মাছের কাঁটা চিবোবেন।রসগোল্লা পানতুয়া গিলবেন।হাসি-হাসি মুখ নিয়ে সহ্য  করে যেতে হবে। শেষে আমায় দীননাথ করে দিয়ে চলে যাবেন। আর এই পহেলা বৈশাখের ছুটিটি মাঠে মারা যাবে আমার। তারা বৌয়ের জন্য , মেয়ের জন্য কিছু না কিছু আনবেন। আর কাঙাল দীননাথ কে মনেই পড়বে না। ব্রান্ডেড কিপটে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন গুলো। আমার গিন্নী তো সারা পৃথিবীর সমস্ত লোকজনের ছিদ্র বা দোষ ধরে বেড়ান, একমাত্র বাপগোষ্ঠীর লোকজন ছাড়া। এইরে গোষ্ঠীদ্বন্দ এসে যাচ্ছে। 

আমি বলেই ফেললাম -"তবে কাহার লাগি এই তাপ্পীমারার  আয়োজন?" 

--" আমার বাবার জন্য। মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ।"

- " বাড়ি থেকে ব্যাবস্থা করে আনতে পারছেন না?উনি তো এখনও সকার। ইন্ডিয়ান রেলওয়েজের পেনশনার।খারাপ কিছু পান না। তারপরেও সেটা আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে?"

-- " দেখ একজন বয়স্ক লোক। আজ আছে কাল নেই। মেয়েদেরও তো কিছু করবার অধিকার থাকে। এভাবে বলো না। দুদিন পরেই তো চলে যাবে। বাবার আজকাল প্রস্টেটের অপারেশনের পর ইউরিন নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছে। যখন তখন হয়ে যাচ্ছে এখানে- ওখানে। সেইজন্য আমি ব্যাবস্থা করে রাখছি। জানি আমি তো এই সংসারে কাজের লোক। এই সংসারে টাকা পয়সার ওপর আমার কোনও অধিকার নেই! "

মেয়েরা মোক্ষম ভাবে সেন্টু দিয়ে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে যায়। মনে-মনে ভাবলাম আর আমি তো এই সংসারে টাকার যোগাড়ে, শ্রমিক। সবার চাহিদাগুলো যুগিয়ে যাও শুধু আর ডেবিট-ক্রেডিট চালিয়ে যাও নিরন্তর। রণে ভঙ্গ দিলাম আপাতত। তবে এই এ্যাডাল্ট ডায়াপার মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না। বুল্টি তো এসব ব্যাবস্থা করে আনতেই পারত। আর এখন দু-দিন ধরে ওর বড়-বড় বাতেলা স্রেফ হজম করে যেতে হবে। আর আমার এনে দেওয়া ঐ ডায়াপার পরে আমার ফাদার-ইন- ল সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াবে। চোনা ছিটোবে না তো? আমি তবুও মুখ মিষ্টি করে বললাম-" যাকগে তবুও ভাল। আমি তো লিকড্ কেসটা তোমার ভেবেছিলাম । বয়স বাড়ছে আমাদের। অবশ্য কখন কার কী হয় কে জানে? বেঁচে যাওয়া মালগুলো আবার ওদের হাতে ধরিয়ে দিও না। বুল্টি ওখানে গিয়ে ব্যাবস্থা করে দেবে। আমি তো শুনেছি এ্যাডাল্ট ডায়াপারের বেশ দাম। বাজারে গিয়েই টেরটি পাব। "

বাজারের থলে আর ফর্দের এ্যাডাল্ট ডায়াপারে শুরু হয়ে গেল আমার পহেলারর তোড়জোড়। ভেতর থেকে গুনগুন করে  গান ধরলাম আমিও, তবে বড় দুঃখের এই শ্যামাসঙ্গীত। দুঃখ পেলেই গাই এ গান, তবে একদম নিরিবিলিতে একা-একা মনে মনে। কেউ শুনতে পেলেই তাল কেটে যাবে সেদিনের---" আমি মায়ের পায়ের জবা হয়েই রইবো চিরকাল।" এরসাথে হয়ত ঘটনার কিছুই মিল নেই, তবুও জানিনা কেন যেন মনে চলে আসে এ গান। আপনারা কী কিছু বুঝলেন পাঠক? 

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments