জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো /পর্ব -২০/সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো
পর্ব -২০
সুকন্যা সাহা 

হাল খাতার হাল হকিকৎ ... 
              
"বহুবছরের কঠিন পরিশ্রমের পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, 'নতুন-বছর' 'নতুন-বছর' বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই। যখনই কোনো নতুন বছর এসেছে, এক বছরের বেশী টেকেনি....!!"….  শিবরাম চক্রবর্তী 
নববর্ষঃ নতুন বছর , বেশ  হই হই করে বাঙ্গালীয়ানা দেখানোর এক বিশেষ  সুযোগ । সারা   বছর বাংলা  ক্যালেণ্ডার , তিথি নক্ষত্রের হিসাব রাখি বা না রাখি সম্ববচ্ছরের এই  একটা দিন ধাক্কা পাড় ধুতি পাঞ্জাবী আর ধনেখালি, জামদানিতে   আমরা ফিটফাট বাবু-বিবি ।রেঁস্তোরায়  বাঙ্গালী মেনু থেকে শুরু করে চুলে যুঁই ফুলের  মালা , যত্র তত্র বর্ষবরণের উৎসব থেকে শুরু করে হালখাতার  মিষ্টির প্যাকেট, দোকানে দোকানে  সিঁদুর মাখানো আম্র পল্লব আর মংগল ঘট  থেকে  শুরু করে  এসো হে বৈশাখ কে  বলবে বছরের বাকি এগারোটা মাস  এই বাঙ্গালীই ফিটফাট কেতা দুরস্ত সাহেব ? আমাদের  ছোটোবেলায় যখনও এই দ্বিচারিতা এত প্রকট হয় নি বা হলেও সমাজের সর্বস্তরে এভাবে ছড়িয়ে পড়ে  নি তখন আমাদের কাছে পয়লা   বোশেখ মানেই ছিল  হাল খাতা ।
 আমার দাদুর ছিল লোহার কারখানা ... ব্যবসায়ী পরিবার হওয়ার সুবাদে পয়লা   বোশেখে  লক্ষী গণেশের  পুজো অবধারিত । নতুন   মাদুর , কাঁচা হলুদ , কাঁচা টাকা ,সিঁদুর , সাদা বাতাসা   এ সব   ছিল  পুজোর   অনুষঙ্গ। হলুদ রঙ্গের  সুতোয় বাঁধা লাল  হিসেবের  খেরোর খাতা  ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে  শুরু  হত ব্যবসার নতুন হিসেব পত্র   লেখা ... ঠাকুরের মূর্তির গলায় ঝুলত মোটা  বেল ফুলের  মালা  আর দরজায় আম্র পল্লব আর কাগজের   কদম  ফুল... আর ছিল তালপাতার  পাখা  আর  বেজোড়  সংখ্যার   বট পাতায় ফল আর  সন্দেশের  নৈবেদ্য ...আমরা  ছোটরা   স্নান  সেরে  সূতির   নতুন হাতকাটা ফ্রক  পড়ে সার  দিয়ে  বসতাম  পুজোর কাছে ...এই পুজোয়   অবশ্যি  পুরুত  মশাইয়ের   চল  ছিল না ... কোড়া নতুন ধুতি  পড়ে দাদু  নিজেই  বসতেন পুজোয় আর  লাল পাড়   গরদের   শাড়ি  পরে  ঠাকুমা  ব্যস্ত  থাকতেন  হেঁশেল সামলানোর  কাজে ... পয়লা  বোশেখের   দিন অতিথি অভ্যাগতের   অন্ত  ছিল না ... তারা কেউ দাদুর ব্যবসায়ী বন্ধু কেউ বা বাবার বন্ধু বান্ধব ... দুপুর বেলায় অতিথি এলে   গন্ধরাজ লেবু দিয়ে  ঘরে পাতা দইয়ের  ঘোলের  শরবত আর বেল পানা  ছিল মাস্ট । রকমারি বাঙ্গালী রান্নায় মম  করত  রান্নাঘর ... ওপার বাংলার  লোক বলেই হয়ত কোনো পুজো পাব্বনে  মাংস ঢুকত না একেবারেই... থাকত মাছের নানা রকম পদ, সর্ষে বাটা  দিয়ে  পাবদার  ঝাল  থেকে , কালোজিরে,  আলু ,বেগুন ডাঁটা  দিয়ে মৌরালা মাছের   চচ্চড়ি, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল থেকে , কালো জিরে গোল মরিচ দিয়ে  আড় মাছের  মাখা মাখা ঝোল ... শেষ পাতে  আমের  টক বা আমের চাটনি আর  ঠাকুমার হাতের অমৃত পরমান্ন । মাছের   সব আইটেমেই ঝাল   থাকত   খুব  বেশী ... আর আমরা  ছোটোরা  হুস হাস   শব্দ   করে  চোখের  জলে নাকের জলে   একাকার  হতুম ; বিকেলে ফি বছর বাবা মায়ের   হাত   ধরে দোকানে দোকানে   হালখাতা   করতে  যেতুম ...বেশীর ভাগই ছিল সোনার দোকান ... সারা বছরের বিকি কিনির অ্যাকাউণ্ট (খাতা )মেন্টেন   হত ... সেই খাতা সেদিন বন্ধ হত আবার খোলা হত নতুন  খাতা ...পুরোনো খাতার   জমা   খরচ  ক্যারি ফরোয়ার্ড হত তাতে ... সোনার  দোকানদারের  সারা  বছরের বাঁধা কাস্টমারদের বেশ খাতির  যত্ন  করত... একটা  করে কোল্ডড্রিংক্স , মিষ্টির  প্যাকেট আর  বাংলা ক্যালেন্ডার ছিল বাঁধা । নতুন  বছরের প্রথম   দিনে কাজের লোকেদের একটা করে ছাপা শাড়ি দেওয়া  হত ; এছাড়াও  দুপুরে ছেলে  মেয়ে  নিয়ে   পাত পেড়ে খাওয়ারও নেমন্তন্ন থাকত ... কালের  নিয়মে   একান্নবর্তী পরিবার   উঠে  গেছে   বটে   তবে  সেই দেওয়া  থোওয়ার  রেওয়াজ  রয়ে গেছে আজও...

(ক্রমশঃ)


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments