জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল (দক্ষিণ আমেরিকা)/পায়রার গলায় বুলি নাই /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল (দক্ষিণ আমেরিকা)
পায়রার গলায় বুলি নাই

চিন্ময় দাশ

এক চাষির তিন ছেলে। দেখতে দেখতে একদিন বয়স হোল ছেলেদের। এবার নিজের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তাদের। উপার্জনের পথ দেখতে হবে। বিশাল এই দুনিয়া পড়ে আছে সামনে। বাইরে বেরুতে হবে।
একদিন ছেলেরা বেরুবে বলে তৈরি। প্রত্যেককে একটা করে তরমুজ ধরিয়ে দিল তাদের বাবা—পথে যেতে যেতে, দরকার পড়তে পারে এটার। তবে মনে রেখো, যে কোন একটা জলাশয়ের পাশেই এটা কাটবে। কাছাকাছি জল নেই, এমন কোথাও কাটলে, বিঘ্ন ঘটবেই। ভুলে যেও না যেন।
গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছে। তিন ভাই চলল তিন দিকে। বড় ছেলেটার মনে দারুণ কৌতুহল। কী আছে এই তরমুজের ভিতর? অন্য কিছু না দিয়ে, একটা তরমুজই বা বাবা ধরিয়ে দিল কেন আমাদের? 
চোখের সামনে থেকে যেই না গ্রামটা আড়াল হয়েছে, আর তর সইল না তার। কেটে ফেলল তরমুজটা। আর কী আশ্চর্য! সুন্দরী একটি মেয়ে বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। বলল—জল বা দুধ, যা-ই হোক কিছু একটু দাও আমাকে। দেরি কোর না। 
কিন্তু কোথায় জল? কাছাকাছি কোথাও জলের চিহ্নটুকুও নাই। দুধ তো অনেক দুরের কথা। মেয়েটা আছাড় খেয়ে পড়ল। আর মারাও গেল সাথে সাথে।
মেজো ছেলেটা ধরেছিল একটা পাহাড়ি রাস্তা। কিছু দূর হেঁটে, হাঁফ ধরতে লাগল তার। যখন প্রায় দূপুর। ভীষণ পিপাসা পেয়ে গেল। একটু জল না হলে যেন প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে। 
অথচ আশেপাশে জল নাই কোথাও। কী করে, অগত্যা তমুজটাই কেটে ফেলল সে। অমনি এটা থেকেও বেরিয়ে এল সুন্দরী একটি মেয়ে। বেরিয়েই বলল—তাড়াতাড়ি একটু জল দাও আমাকে। আথবা দুধ এক ঢোঁক। 
কিন্তু জল কোথায় পাওয়া যাবে সেই পাহাড়ি রাস্তায়। ছটফট করতে করতে মেয়েটা মারা গেল।
ছোট ছেলেটাও চলেছে একটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। বেশ খাড়া পাহাড়। খানিক দূর গিয়েই হাঁফ ধরে গেল। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ। কাছেপিঠে জলের দেখা নাই কোথাও। এদিকে সাথেও জল আনা হয়নি।   
একবার চোখ গেল ঝোলার তরমুজটার দিকে। মিষ্টি রসে ভরা ফল। এটার ভিতরেই তো পিপাসা মেটার সহজ ব্যবস্থা করা আছে। গলা শুকিয়ে বেঘোরে মারা পড়তে হবে না।
তরমুজে হাত দিয়েছে, সাথে সাথেই বাবার বারণ মনে পড়ে গেল। পই পই করে মানা করে দিয়েছে মানুষটা। কাছাকাছি জল না থাকলে, এটা কাটতে মানা। বিঘ্ন হতে পারে তাতে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
একবার কেবল হাত বুলিয়ে নিল তরমুজে। বের করবার চেষ্টাও করল না। এদিকে কপাল এমনই মন্দ যে একটা সরু ঝোরাও দেখা গেল না আশেপাশে। 
ধুঁকতে ধুঁকতে কতক্ষণ পরে একটা ছোট মত শহরে এসে হাজির হোল ছেলেটা। শহরটা একটা পাহাড়ের তলায়। শহরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ঝর্ণা। পা চালিয়ে সেখানে হাজির হোল সেখানে। 
আহা! কী ঠাণ্ডা আর মিষ্টি জল ঝর্ণাটাতে। পেট ভরে জল খেল প্রথমে। জল বুলিয়ে নিল হাতে-পায়ে মুখে-মাথায়। কী শান্তি, কী শান্তি! 
এবার মনে পড়ল খিদের কথা। সেই সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি। জলের একেবারে দোরগোড়ায় এসে বসে আছে। এখন আর বিঘ্ন ঘটবার কোন কারণ নাই। এবার তরমুজটা বের করা যেতেই পারে।
তরমুজটা কাটতে না কাটতে, সেই একই ব্যাপার। সামনে সুন্দরী একটি মেয়ে। বলে উঠল—তাড়াতাড়ি একটু জল দাও আমাকে।
ছেলেটা আঁজলা ভরে জল এনে দিল ঝর্ণা থেকে। সে জল খেয়ে, যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে এল সে মেয়ের। 
এবার ছেলেটা পড়ল মহা ভাবনায়। এই বিদেশ-বিভূঁয়ে এই মেয়েকে নিয়ে এখন কী করে সে? ঝর্ণার পাশে একটা ঝোপঝাড়। অনেক ভেবে, তার আড়ালে, একটা গাছের ডালে বসিয়ে দিল মেয়েটিকে—এইখানে বসে থাকো তুমি। আমি দেখি, কোথাও তোমার জন্য কিছু খাবার জোগাড় করতে পারি কি না। বাইরে বেরিও না যেন।
ছোট ছেলে চলে গেল খাবার জোগাড় করতে। খানিক বাদে একটি কালো মেয়ে এসেছে ঝর্ণায়। হাতে বড় একটা কলসি। জল ভরতে এসেছে। নিত্যদিন যেমন আসে।
গাছের ডালে বসা মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে দেখছে তাকে। কলসি ডোবানোর জন্য ঝুঁকেছে কালো মেয়েটি। অমনি জলে একটা সুন্দর মুখের ছায়া চোখে পড়ল তার। হায় হায়, আমি এতো সুন্দর! জানতাম না তো। কোনদিন বলেওনি তো কেউ। আর না জেনে, আমি কি না এতদিন চাকরানি হয়ে আছি অন্যের ঘরে! 
রইল পড়ে তার জল ভরা। হাতের কলসি আছড়ে ভেঙে ফেলল সেই মেয়ে। ঘরে ফিরে চলল আনন্দে ডগমগ হয়ে।
শূণ্য হাতে ঘরে ফিরেছে মেয়েটি। না এনেছে জল, না কলসি। বেধড়ক পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে, নতুন কলসি দিয়ে, আবার তাকে ফেরত পাঠাল মালকিন। 
এবার কালো মেয়েটি এসে জলে নেমেছে যেই, তাকে দেখে ফিক করে হেসে দিয়েছে গাছের সুন্দরী মেয়ে। 
কালো মেয়ে এবার গাছের ডালে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখল চোখ তুলে। বলল—আচ্ছা, তাহলে তুমিই সেই লোক। তোমার জন্যই এতগুলো মার খেতে হোল আমাকে। দেখাচ্ছি মজা।
তরতর করে উঠে গেল জল ছেড়ে। মাথার খোঁপা থেকে একটা কাঁটা খুলে নিয়ে, গেঁথে দিল সুন্দরী মেয়েটির গলায়। অমনি এক ভোজবাজি। কোথায় সেই মেয়ে! কোথার তার সুন্দর রূপ। একটা পায়রা বসে আছে মেয়েটির জায়গায়। 
 সেসময়েই ছোট ছেলেটা ফিরে এলো বাইরে থেকে। হাতে খাবারের ঠোঙা। তার পায়ের সাড়া পেয়ে, কালো মেয়েটি বেদম ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড় ঝোপের পিছনে লুকিয়ে ফেলল নিজেকে।
ছেলেটা তো সেখানেই রেখে গিয়েছিল সুন্দর মেয়েটিকে। এখন সেখানে পৌঁছে, একটা কালো মেয়েই চোখে পড়ল তার। ভয়াণক ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেল ছেলেটা। এমনটা ঘটল কী করে? জিজ্ঞেস করল—কতটুকুই বা সময় আমি ছিলাম না। এরই মধ্যে এই অবস্থা হোল কী করে তোমার? 
--আর বোল নাগো। যা রোদের তাত এখানে। চামড়া পুড়ে খাক হয়ে গেল আমার। যেতে দাও। ও কিছু না। এখান থেকে চলো, অন্য কোথাও চলে যাই। আবার আগের চেহারা ফিরে আসবে নিশ্চয়। চটপট কথাগুলো বলে গেল কালো মেয়েটি।  
সেই কালো আর চাকরানি মেয়েকেই বিয়ে করল ছেলেটা। চলেও গেল এলাকা ছেড়ে। মনে আশা, নিশ্চয় আগের রূপ ফিরে পাবে তার বউ। কিন্তু সত্যি সত্যিই তা কি আর হয়? কালোই রয়ে গেল সেই কালো মেয়ে।
বছরের পর বছর গেল। ব্যবসা বাণিজ্য করে বেশ অবস্থা ফিরেছে ছেলেটির। এখন সে বেশ বড়লোক। প্রাসাদের মত বিশাল বাড়ি। পাশেই সাজানো বাগান। নানা রঙের সুগন্ধী ফুলের গাছে সাজানো। নানা জাতের ফলের গাছ। টলটলে নীল জলের পুকুর বাগানের ভিতরে। রাজহাঁসেরা ভেসে বেড়ায় গলা উঁচিয়ে। 
দিন ফুরিয়ে এলে, বাগানে চলে আসে ছেলেটি। মনের কষ্ট মনে চেপে, ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। গাছে গাছে পাখিদের বাসা। তাদের মিষ্টি সুরের কলকাকলি। চেয়ে চেয়ে দেখে তাদের বাসার দিকে। 
 এখন টাকাকড়ি, ঘরবাড়ি, বাগান-পুকুর সব আছে তার। নাই কেবল মনের সুখ। সারা জীবন এমন এক কালো বউ নিয়ে কাটাতে হচ্ছে। অথচ একেবারে সেই প্রথম দিনটিতে কী অপরূপ সুন্দরই না ছিল সে। কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল! আর হোলই বা কেন?
এদিকে হয়েছে কী, বেশ কিছুদিন যাবত, তার চোখে পড়ছে, যখনই সে বাগানে আসে, একটি পায়রা এসে উদয় হয়। ঠিক তার মাথার উপর বরাবর উড়তে থাকে। সে যেদিকে যায়, পায়রাও যায় সেদিকেই। 
একদিন তার কালো বউয়ের অসুখ করল। অসুখ বলে অসুখ। বাঁচে কি বাঁচে না এমন অবস্থা। বদ্যি ডাকা হোল। সে এসে বিধান দিয়ে গেল—পায়রার মাংসের ঝোল খাওয়ালে, রোগ সেরে যেতে পারে।
সেই পায়রাটার কথা মনে এলো ছেলের। মাথার উপরে চক্কর কাটতে থাকে সারাটা সময়। বিরক্ত লাগে ভারি।
সেই পায়রাটাকেই কেটে ফেলা হোল। মাংসও পাওয়া গেল। বিদায় হোল আপদও।
রাঁধুনি পায়রার মাংস রেঁধে, সাজিয়ে দিয়েছে বউয়ের সামনে। খাবার সময় কালো বউর নজরে এলো, একটা কাঁটা বিঁধে আছে পায়রাটার বুকে। নোংরা কিছু হবে – এই ভেবে তুলে ফেলতে গেল মেয়েটি। অবাক ব্যাপার, পারল না। অনেক চেষ্টা করেও, কাঁটা তুলে ফেলা তার সাধ্যে কুলোল না।
কী আর করে। রাঁধুনিকে বলল—যাও, মালিককে গিয়ে ডেকে আনো।
ছেলেটি এসে পড়ল খবর পেয়ে। তার পর? তার পর আর কী? ছেলেটি যেই হাত দিয়েছে, টুক করে উঠে এলো কাঁটাটি। যেই না কাঁটাটা তুলে ফেলেছে, অমনি এক ভোজবাজি। সামনে সেই সুন্দরী মেয়েটি হাজির। একদিন ঝর্ণার পাশটিতে, তরমুজ থেকে আবির্ভাব হয়েছিল যার। আজও তেমনই সুন্দর, তেমনই মিষ্টি হাসি তার মুখে। এই মেয়েকেই তো গাছের ডালে বসিয়ে, খাবার আনতে গিয়েছিল সে!
ছেলেটি তো অবাক। নিশ্চয় কিছু একটা রহস্য আছে। যেটা তার জানা হয়নি। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল—ব্যাপারটা কী, খুলে বলো তো আমাকে। এত দিন ছিলে কোথায় তুমি? পায়রাই বা হয়েছিলে কী করে?  
মেয়েটি মুখে কোন কথা বলল না। বলবে কী করে? গলায় কাঁটা বিঁধিয়ে, তার কথাই তো বন্ধ করে দিয়েছে কালো মেয়েটি। সে পালঙ্কের দিকে চেয়ে রইল অপলক চোখে।
শুয়ে শুয়ে সব কিছুই দেখছে কালো মেয়ে। সুন্দরী মেয়েটি কিছু বলবার আগে, নিজের দোষ স্বীকার করে নিল সে স্বামীর কাছে। বলতে বলতে গলা বুজে এলো মেয়েটির। জল গড়িয়ে এলো দু’চোখ থেকে। তার পর বুজে গেল চোখ দুটো। আর খুলল না। মরেই গেল কালো মেয়েটি।
ধুমধাম করে সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে হোল ছেলেটির। ভারি সুখে দিন কাটতে লাগল দুজনের। 
কিন্তু মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে পড়ে মেয়েটি। নিজের পায়রা জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। সঙ্গীসাথী পায়রাদের সাথে দেখা হয় না এখন আর। বড্ড মন কেমন করে তাই নিয়ে।
কিন্তু পায়রারা তখন ছিল বনের পাখি। বনেই তারা বাসা বাঁধে। বনেই তাদের বসবাস। প্রাসাদের মত বাড়িতে সুন্দর করে সাজানো বাগানে তারা আসবে কেন? 
বউটি তখন করল কী, অনেকগুলো বাসা বানালো সুন্দর করে। বাসাগুলোকে সাজিয়ে দিল বাগানে। মুঠো মুঠো দানা ছড়িয়ে দিল চার দিকে। 
কাজ হোল তাতেই। এক দিন পায়রাদের সর্দার সেদিক দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দানাগুলো দেখতে পেয়ে গেল। চার দিক শুনশান। জনমনিষ্যির চিহ্নটিও নাই ধারে কাছে। পেট ভরে দানা খেলো খুঁটে খুঁটে। 
সেসময় বাসাগুলোও দেখতে পেয়ে গেল পায়রাটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, বেশ পছন্দও হয়ে গেল। বাহ, বেশ খাসা জিনিষ তো! ভালোবেসে যত্ন করে তৈরি করা জিনিষ, কার না পছন্দ হয়?  
পরদিনই বউ-বাচ্চাদের নিয়ে নতুন বাসায় উঠে এলো সর্দার পায়রা। তার দেখাদেখি, দু’একদিন বাদে বাদে আরও সকলে আসতে লাগল। এইভাবে সকলে এসে হাজির হয়ে গেল সাজানো বাসাগুলোতে।
সেদিন থেকেই বনে বাসা বানানো ছেড়ে দিয়েছে পায়রারা। মানুষের ঘরবাড়িই পছন্দ হয়ে গেছে তাদের। মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে পায়রারা। 
ছোট ছেলের সেই সুন্দরী বউ তার পায়রা জীবনের কথা শুনিয়েছিল তার ছেলেপুলেদের। একটি মেয়ে কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়েছিল তার গলায়। পায়রা বানিয়ে দিয়েছিল তাকে। সেদিন থেকে গলার স্বর হারিয়ে গিয়েছে তার।
সেই গল্প শুনেছিল ছেলেপুলেরা। তারা আবার শুনিয়েছিল তাদের নাতিপুতিদের। সেই থেকে আজও ব্রাজিলের ঘরে ঘরে শোনা যায় এই কাহিনী। সন্ধ্যে নামলে, ঠাকুমারা গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে নাতিনাতনিদের নিয়ে।

Post a Comment

0 Comments