জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৭৩/প্রীতম সেনগুপ্ত


পর্ব ৭৩
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী বিবেকানন্দ

 এযাবৎ শ্রীরামকৃষ্ণের ষোলোজন সন্ন্যাসী সন্তানের মধ্যে পনেরো জন সন্ন্যাসী সন্তানের জীবন নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ বাকি রয়েছেন একজন। তিনি ছিলেন তাঁর নয়নের মণি, পরম প্রিয়। ঠাকুরের নরেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত, উত্তরকালে বিশ্বখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ। এহেন বিবেকানন্দের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফরাসি মনীষী রোমাঁ রোঁল্যা লিখছেন --“...His athletic form was the opposite of the fragile and tender, yet wiry body of Ramakrishna. He was tall ( five feet, eight and half inches ), square shouldered, broad-chested, stout, rather heavily built; his arms were muscular and trained to all kinds of sports. He had a olive complexion, a full face, vast forehead, strong jaw, a pair of magnificent eyes, large, dark and rather prominent, with heavy lids, whose shape recalled the classic comparison to a lotus petal. Nothing escaped the magic of his glance, capable equally of embracing in its irresistable charm, or of sparkling with wit, irony, or kindness, of losing itself in ecstacy, or of plunging imperiously to the very depth of consciosness and withering with its fury. But his pre-eminent charecteristic was kingliness. He was a born king and nobody ever came near him either in India or America without paying homage to his majesty.” ( The life of Vivekananda and the Universal Gospel By Romain Rolland )
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
শ্রীরামকৃষ্ণের নরেন্দ্রনাথ বিষয়ে অসাধারণ দিব্যদর্শন হয়েছিল। গম্ভীরানন্দ লিখিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থে এর বর্ণনা এইরকম --“শ্রীরামকৃষ্ণ একদা বলিয়াছিলেন ‘একদিন দেখছি মন সমাধিপথে জ্যোতির্ময় বর্ত্মে উচ্চে উঠে যাচ্ছে। চন্দ্রসূর্যতারকামণ্ডিত স্থূল জগৎ সহজে অতিক্রম করে উহা ক্রমে সূক্ষ্ম ভাবজগতে প্রবিষ্ট হল।... নানা দেবদেবীর ভাবঘন বিচিত্র মূর্তিসকল পথের দুই পার্শ্বে অবস্থিত দেখতে পেলাম।..মন ক্রমে অখণ্ডের রাজ্যে প্রবেশ করল। সাত জন প্রবীণ ঋষি সেখানে সমাধিস্থ হয়ে বসে আছেন। জ্ঞাণ ও পুণ্যে, ত্যাগ ও প্রেমে ইঁহারা মানব তো দূরের কথা, দেবদেবীকে পর্যন্ত অতিক্রম করেছেন। বিস্মিত হয়ে দেখি, সম্মুখে অবস্থিত অখণ্ডের ঘরের ভেদমাত্রবিরহিত, সমরস জ্যোতির্মণ্ডলের একাংশে ঘনীভূত হয়ে দিব্যশিশুর আকারে পরিণত হল। অদ্ভুত দেবশিশু অসীম আনন্দপ্রকাশে অন্যতম ঋষিকে বলতে লাগল --‘আমি যাচ্ছি, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’... নরেন্দ্রকে দেখবামাত্র বুঝলাম, এ সেই ব্যক্তি।’ বলা বাহুল্য, শ্রীরামকৃষ্ণই ধরাধামে অবতরণের পূর্বে অখণ্ডের গৃহে  সচ্চিদানন্দের ঘনীভূত জ্যোতির্ময় বিগ্রহ দেবশিশুরূপে শরীরধারণ করিয়াছিলেন এবং সাগ্রহে ধ্যাননিষ্ঠ অন্যতম যে ঋষির গলে স্বীয় কোমল বাহুদ্বয় বেষ্টনপূর্বক তাঁর ধ্যানভঙ্গ করিয়া ধরাধামে লীলাসহচররূপে আগমনের জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন, তিনি বিশ্ববিশ্রুত স্বামী বিবেকানন্দ। এই যুগ্ম আত্মাই যুগে যুগে নারায়ণ ও নর-ঋষির অবতার-রূপে জগতে অবতীর্ণ হইয়া ধর্মসংস্থাপন করেন।”
 স্বামী বিবেকানন্দের এই ধরাধামে অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটটি, বিশেষত তাঁর পারিবারিক প্রেক্ষাপটের বিষয়ে পাঠককে অবহিত করা প্রয়োজন। কলকাতা মহানগরীর সিমলা পল্লীর শ্রীযুক্ত দুর্গাচরণ দত্ত মহাশয় সংস্কৃত ও পার্সি ভাষায় বিশেষ পাণ্ডিত্যসম্পন্ন ছিলেন। তাঁর পিতা রামমোহন দত্ত আইনজীবী ছিলেন ও বিপুল আয় করতেন। তাঁর আয়ের উপর নির্ভর করেই দত্ত বংশ বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করে। এহেন অতি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও দুর্গাচরণ ভোগবাদী জীবনে বিমুখ হয়ে পঁচিশ বছর বয়সে স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্র বিশ্বনাথকে ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যান। বড় হওয়ার সঙ্গে বিশ্বনাথের মধ্যেও পিতার গুণাবলি প্রকাশ পেতে থাকল। তিনি বহু ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেন। ইতিহাসেও ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। তবে পিতার মতো সংসারত্যাগী না হয়ে সংসারজীবনই যাপন করেন। পেশায় ছিলেন অ্যাটর্নি। আয় ছিল প্রচুর। রন্ধনে তিনি বিশেষ নিপুণ ছিলেন। নিত্যনতুন রান্না করে অন্যকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। দেশভ্রমণের অনুরাগী ছিলেন। এই ভ্রমণে গিয়েই ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমান সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন এবং এই বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েন। পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, বাইবেল ও হাফিজের বয়েৎগুলি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। বিশ্বনাথ-পত্নী ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন মিতভাষিণী, সুশিক্ষিতা ও সুরুচিসম্পন্না এক মহিলা। অসম্ভব আভিজাত্য ছিল তাঁর প্রকৃতিতে। ধর্মানুরাগিণী ছিলেন। তিনি ছিলেন চার কন্যার জননী, যার মধ্যে দুটি অল্পবয়সে মারা যায়। পুত্রমুখ দর্শনে বঞ্চিত ভুবনেশ্বরীর মনে এই কারণে শান্তি ছিল না। এই বিষয়ে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ প্রণেতা গম্ভীরানন্দজী লিখছেন --“...তিনি সকাল-সন্ধ্যায় হৃদয়ের এই বেদনা দেবতার চরণে নিবেদন করিতেন। অতঃপর অনেক ভাবিয়া কাশীধামে তাঁহাদের এক বৃদ্ধা আত্মীয়াকে পত্র লিখিলেন, তিনি যেন বংশরক্ষার জন্য ৺বীরেশ্বর শিবের মন্দিরে যাইয়া প্রত্যহ পূজা দেন ও অভীপ্সিত বর প্রার্থনা করেন। পূজা চলিতে লাগিল -- এদিকে ভুবনেশ্বরীও নিত্য শিবপূজা ও শিবধ্যানে মগ্না রহিলেন। অবশেষে সুদীর্ঘ তপস্যার পরে একদিন ভুবনেশ্বরী ৺যোগিরাজ মহাদেবের ধ্যানে সমস্ত দিবস দেবালয়ে যাপনান্তে রাত্রিতে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া নিদ্রাযোগে স্বপ্ন দেখিলেন, দেবাদিদেব রজতগিরিনিভ বরবপু শঙ্কর পুত্ররূপে তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত। তদবধি তাঁহার শ্রীবদনের অপূর্ব শোভা ও অপার্থিব জ্যোতিঃদর্শনে চমৎকৃত হইয়া প্রতিবাসীরাও বলিতে লাগিলেন যে, এইবারে শিব তাঁহার প্রার্থনা পূর্ণ করিবেন।
 যথাকালে ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারী ( বঙ্গাব্দ ১২৬৯, ২৯ শে পৌষ, পৌষ-সংক্রান্তি, কৃষ্ণা সপ্তমী তিথি ) সোমবার সূর্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পরে ( ৬টা ৪৯ মিনিটে ) ভুবনেশ্বরীর ক্রোড় আলোকিত করিয়া ভুবনবিজয়ী নবসূর্য উদিত হইলেন। স্বপ্ন-বৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া জননী পুত্রের নাম রাখিলেন বীরেশ্বর। শুভ অন্নপ্রাশনের সময় তাঁহার নাম হইল নরেন্দ্রনাথ। নরেন্দ্রই ভবিষ্যতের প্রথিতযশা স্বামী বিবেকানন্দ। স্বগৃহে কিন্তু ক্ষুদ্রকায় বীরেশ্বর ‘বিলে’ নামেই পরিচিত হইলেন।”বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলে ক্রমেই অসম্ভব দুরন্ত হয়ে উঠল। রোমাঁ রোল্যাঁ লিখছেন --“...Narendra grew up to be a sweet, sunny-tempered, but very restless boy. Two nurses were necessary to keep his exuberant energy under control, and he was a great tease to his sisters. In order to quiet him, the mother often put his head under the cold-water tap, repeating Siva's name, which always produced the desired effect.”

Post a Comment

0 Comments